#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৬
হাত মুঠো করে ফেলে কোহিনূর। সারা শরীরে যেন তরঙ্গ বয়ে যায়। এ যেন ভয়ের তরঙ্গ। চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে ফেলে। মুখের ফ্যাকাশে বর্ণ ফুটে ওঠে। অন্যদিকে রাগিনী বিষয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সে একবার কোহিনূরের পানে চাইছে আর একবার সেই মেয়েটির পানে চাইছে। লিফটে বিরাজ করছে নিস্তব্ধতা। এবার রাগিনী বিস্ময়ের সাথে কোহিনূরের দিকে ইশারা করে বলে ওঠে,
“এক্সকিউজ মি! আপনি কি উনাকে বিগ ব্রাদার বলে ডাকলেন?”
আগ্রহের সঙ্গে তাকিয়ে থাকা নয়নতাঁরা এবার ভ্যাবাচেকা খেয়ে রাগিনির দিকে পলক ফেলে তাকালো। রাগিনীর আপাতমস্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। কি সুন্দর মেয়েটা! ডাগরডাগর হরিণীর চোখ তার। সেই টানা টানা চোখে অনেক বিস্ময়। কথা বলার সময় যখন ঠোঁটজোড়া নড়তে থাকে তখন তার হালকা ফোলা গাল দুটোও নড়তে থাকে। নয়ন বিমোহিত হলো। কিছু বলতে গিয়েও লক্ষ্য করল কোহিনূরের কঠিন দুটো চোখ। নয়নতাঁরা ঢক গিললো। বুঝতে সময় লাগলো না তার খবর খারাপ আছে। রাগিনী নয়নতাঁরার কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে আবার জিজ্ঞাসা করল,
“কি হলো বলুন আপনি কি উনাকে চেনেন?”
নয়নতাঁরা কিছু বলার আগেই কোহিনূর হুড়মুড়িয়ে বলে উঠলো,
“প্রশ্নই আসে না। হেই গার্ল, হু আর ইউ? ডু ইউ নো মি?”
বলেই নয়নতাঁরার দিকে হালকা ঝুঁকে পড়লো কোহিনুর। তার কঠোর দৃষ্টি নয়নতাঁরাকে অন্য কিছুর ইঙ্গিত দিল। সেই মুহূর্তেই লিফটের দরজা খুলে গেল। ব্যাস… নয়নতাঁরাকে আর পায় কে! সে হম্বিতম্বি করে বেরিয়ে যেতেই পিছু ডেকে উঠলো রাগিনী। রাগিনী মেয়েটা নাছোড়বান্দা। রাগিনী ওর লিফটের বাইরে বেরিয়ে আসে সেই সঙ্গে কোহিনূরও। কোহিনূর আবারো তড়িঘড়ি করে কাঠকাঠ গলায় বলে উঠল,
“তোমার বিগ ব্রাদারের নাম কি?”
“উমম…পেন্সিল!”
এবার রাগিনী ও কোহিনূর উভয়েই বিস্ময়ের সাথে একই সঙ্গে বলে উঠল,
“হোয়াট?”
নয়নতাঁরা সঙ্গে সঙ্গে চমকে বলে উঠল,
“না! সরি। জায়ান্ট। মানে দৈত্য।”
বাকহীন হয়ে অসহায় চোখে তাকিয়ে কোহিনূর। তার দৃষ্টি যেন নয়নকে বলছে, ‘অন্তত নামটা তো ঠিক বল! দফারফা আর করিস না।’
রাগিনী বা কোহিনূরের কিছু বলার আগে নয়নতাঁরা আবারও যেচে বলে উঠল,
“আরে না! ডেভিল। নাউ ইট ইজ পারফেক্ট!”
রাগিনী বেশ ভাবলেশহীন হয়ে রইল। আদেও বুঝলো না আসলে মেয়েটা কী বলছে? তার মাথায় আবার সমস্যা নেই তো? তাহলে তো মহা বিপদ! কিছু বলার মতো পাচ্ছেই না সে। আসলে কী বলা উচিত? তৎক্ষনাৎ কোহিনূর দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে,
“আমি আপনার বিগ ব্রাদার আসল নাম জানতে চেয়েছি মিস.!”
“নির্জন… নির্জন আহমেদ…”
কোহিনুর তার কথার মাঝখানেই বলে ওঠে,
“ইটস ক্লিয়ার। আমি কোহিনূর। নাউ ইউ ক্যান গো।”
বললেই আর তীব্র করা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কহিনুর নয়ন তারার দিকে। নয়ন তারার মাথায় যেন বাজ পড়েছে। তবে কহিনুরের ইঙ্গিত বুঝতে পারল সে। মুখটা কোনরকমে চোরের মত ঢেকে ছুট লাগালো। রাগিনী হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলো সেই মেয়েটার দিকে। আশ্চর্যিত হয়ে বলল,
“মেয়েটা এমন করল কেন?”
“আমার মনে হয় মেয়েটা বুঝে গিয়েছে তুমি বিপদজনক একটা মেয়ে। মানুষের খাইতে শহীদ করে ফেলতে পারো। তাই রিস্ক নিতে চায়নি।”
বেশ উদ্বেলিত হয়ে রাগিনীর প্রশ্নের উত্তর দেয় কোহিনূর। চোখ রাঙিয়ে তাকায় রাগিনী। তবে সে কথার প্রতিত্তোর না করে রাগে গজগজ করে বলল,
“লিফট থেকে তো বেরিয়েই এসেছি। বাকিটা সিঁড়ি দিয়ে যাই। আর একটা ফ্লোর উপরে যেতে হবে।”
“এজ ইউর উইশ!”
রাগিনী রাগে কটমট করে দ্রুত হাঁটতে শুরু করে সিঁড়ির দিকে। কোহিনূরের পাশ কাটিয়ে সিঁড়ির নিকট যায়। কোহিনূরের হৃদয়ে যেন প্রাণ আসে। একবার ফিরে করিডোরের কিনারায় তাকায়। বিরবির করে কিছু একটা বলে। অতঃপর দ্রুত হেঁটে নিজেও সিঁড়ির দিকে যায়।
কেবিনে প্রবেশ করা মাত্রই সেখানকার বেডে বসে থাকা বাচ্চা ছেলেটি মাথা উঠিয়ে তাকায় উৎকন্ঠা হয়ে। যেন সেও রাগিনীর অপেক্ষাতেই ছিল। রাগিনী তাকে বসে থাকা অবস্থার দেখেই কিছুটা আগ্রহের সাথে বলে উঠল,
“এখন কেমন আছো? শরীর ভালো?”
“আমি তো এখন ভালাই আছি। এখানের ভালা ভালা খাবার, কত যত্ন নিতাছে। ঠান্ডা ঘর। আমি এমনিতেই ভালা হইয়া গেছি ম্যাডাম।”
বলেই সুন্দর করে হাসে ছেলেটি। তারপর রাগিনীর সঙ্গে থাকা কোহিনূরকে দেখেই ফট করে বলে ওঠে,
“কাল তো অন্য স্যাররে দেখছিলাম। এইডা আপনার সোয়ামি বুঝি?”
সঙ্গে সঙ্গেই কোহিনূর রাগিনীর দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে কেশে উঠল। রাগিনীর নিঃশ্বাস ঘন হয়ে উঠল। কেমন যেন লজ্জা লাগলো। অস্বস্তি লাগলো। ‘সোয়ামি’ শব্দটাই তার গায়ের লোম শিউরে ওঠার কারণ হয়ে দাঁড়াল। কান গরম হয়ে উঠল। নিজেকে সংযত রেখে কিছু একটা বলার জন্য উদ্যত হতেই কোহিনূর তার আগেই আগ বাড়িয়ে বলে ফেলল,
“নো লিটল বয়। আমিও তোমার মতোই এক অসহায় মানব। পার্থক্য একটাই। এই ম্যাডাম তোমার সেবা করে আর আমাকে সেবা করার নামে অত্যা’চার চালায়।”
“চুপ করুন তো আপনি। একবার মুখ খুললে যা-তা বলে বসেন।”
রাগ ঝেড়ে বলল রাগিনী। তারপর গিয়ে ছেলেটির পাশে বসল। ছেলেটিও দুজনের চাপা ঝগড়া দেখে নিজের হাসি প্রসারিত করেছে। রাগিনী ছেলেটির উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল,
“তোমার মা কোথায়? কাল উনার সাথে ভালো করে কথা বলা হয়নি।”
“এখনি এখানেই আছিল। বাইরে গেছে মনে হয়। আপনে একটু বসেন আম্মা আইসা পড়বে।”
কোহিনূর দরজার কাছেই বুকে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকে একভাবে। তার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে না। দূর থেকে দেখতে ইচ্ছে করছে সামনে থাকা সেই মুগ্ধময়ীকে। সেই কোমলিনীকে দূর থেকে অনুভব করতে মনটা টানছে। দূর থেকে তার কোমলতা অনুভব করতে ইচ্ছে করছে। মেয়েটা কীভাবে যেন সকলের প্রিয় হয়ে ওঠে! তবে কোহিনূর কি মারাত্মক ভুল করে বসল? এখন এই ভুলের সমাধানের উপায় কী?
“পারো কী করে কারোর জন্য এতো কিছু করতে?”
আনমনেই প্রশ্নটা করে ফেলল কোহিনূর। রাগিনী ছেলেটির সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত ছিল তখনি তার ব্যস্ততা ভেঙে দিল সেই প্রশ্নটি। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। ছোট্ট করে জবাব দিল,
“বিশ্বাস! বিশ্বাস থাকলে সবকিছুই করা যায়।”
“আমাকে বিশ্বাস করো?”
বেশ উৎসুক হয়ে রইল এবার কোহিনূর জবাব শুনতে। রাগিনী ফিচেল হেঁসে বলল,
“কী মনে হয়?”
কোহিনূর কোনো কথা বলা ছাড়া শুধু মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ, সে মনে করে রাগিনী তাকে বিশ্বাস করে না। তা দেখে রাগিনী স্পষ্ট জবাব দিলো,
“মি. কোহিনূর! বিশ্বাস একটা স্বচ্ছ, সূক্ষ্ম কাঁচের মতো। যেটা অতি দৃঢ় হলেও একটু অবিশ্বাসের ছোঁয়া লাগলেই তা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আর আপনি আমার কাছে একটা স্বচ্ছতায় পরিপূর্ণ মানুষ। আপনাকে বিশ্বাস করি বলেই আপনার সঙ্গে থাকলে নিজেকে নিরাপদ লাগে আমার। আপনার সংলগ্নে এলে কোনো অস্বস্তি লাগে না। আপনার ছোঁয়ায় কখনো আমি খারাপ উদ্দেশ্য অনুভব করিনি। তবুও বলবেন আপনাকে আমি বিশ্বাস করি না?”
বাকরুদ্ধ কোহিনূর। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সামনে থাকা রাগিনী নামক মেয়েটির দিকে। চোখের পলক ফেলতেও আর ইচ্ছে না কোহিনূরের। রাগিনী ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে। কোহিনূরের সংলগ্নে এসেছে। শান্ত গলায় বলল,
“পৃথিবীতে দুটো পুরুষের কাছে নিজেকে সবথেকে নিরাপদ মনে করি আমি। প্রথমজন আমার বাবা। দ্বিতীয়জন কোহিনূর সাহেব।”
কথার মাঝে নিঃশ্বাস নিয়ে থামে সে। থেমে থেমে আবারও বলে,
“আমি চাই না এই বিশ্বাসে কখনো অবিশ্বাসের ছোঁয়া লাগুক। দয়া করে কখনো এটা হতে দেবেন না।”
কোহিনূর কোনো জবাব খুঁজে পাচ্ছে না। কেন যেন নিজেকে দিশেহারা লাগছে এবার। হারিয়ে যেতে মন চাইছে। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসছে। তখন রাগিনী অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করে,
“আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন?”
শুঁকনো ঠোঁট জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিল কোহিনূর। এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া থেকে বাঁচতে চতুর্পাশ তাকালো। তারপর বেডে মাথা ব্যান্ডেজ লাগানো নিয়ে বসে থাকা ছেলেটির দিকে চোখ পড়তেই ফট করে বলল,
“বাচ্চা ছেলেটাকে এখনি পাকিয়ে দিও না। আমাদের দিকেই চেয়ে আছে।”
প্রসঙ্গ পাল্টাতেই ইতস্তত বোধ করে পিছু ফিরে তাকায় রাগিনী। কোহিনূর এমন কেন? তার সঙ্গে কথা বলতে গেলে অন্য কোনো দিক থেকে তার খেয়াল হারায় কেন এভাবে? এটা একদমই ঠিক না। নিরবতার মাঝে এবার ভেসে এলো অন্য মহিলার গলা। মহিলাটি দরজার কাছ থেকে বলে উঠলেন,
“ম্যাডাম, আপনে আসছেন!”
উচ্ছ্বাস নিয়ে বলা কথাগুলো শুনে দরজার দিকে চোখ পড়ল রাগিনীর। মহিলাটিকে দেখে সে এক গাল হেঁসে জবাব দিল,
“না এসে পারি? আপনার ছেলে তো মায়ায় বেঁধে রাখতে জানে।”
“কী যে বলেন! আমাগো গরীবের প্রতি আবার মায়া!”
“কেন আপনারা মানুষ নন বুঝি?”
“সবাই তো মনে করে না। করলে তো আমার পোলাডার উপরে একটু মায়া করতো।”
শেষ কথা গুলো হতাশা নিয়ে বললেন মহিলাটি। তবে রাগিনী শক্ত কন্ঠে বলল,
“সবার কথা বাদ দিন। আগে নিজে মনে করবেন আপনি মানুষ। শ্রেষ্ঠ জীব! যারা আপনাদের মানুষ মনে করে না তারা নিজেরাই কোনো মানুষের কাতারে পড়ে না।”
রাগিনীর কথায় মহিলাটি আশ্বস্ত হয়ে একটু হাসেন। নিজের ছেলের দিকে তাকিয়ে আবার চিন্তিত হয়ে বলেন,
“কিন্তু ম্যাডাম, আমার পোলাডারে এতো ভালা হসপিটালে ভর্তি করছেন। এখানে তো অনেক বিল উঠবো। এতো টাকা…”
কথার মাঝখানে থামায় রাগিনী। মাথা নাড়িয়ে বলে,
“টাকাপয়সা নিয়ে চিন্তা করে মাথা খারাপ করবেন না। আমি ম্যাডাম নই। আপনার ছোট বোনের মতো। তাই ছোট বোন হয়ে না হয় এতটুকু করলাম। আর ছেলেকে না খাটিয়ে ভালো স্কুলে লেখাপড়া শেখান। অনেক বড় হবে সে।”
“তাইলে আমাগো পেটের ভাত কেমনে ঘরে আসবে?”
“এতটুকুও আমাকে ভাবতে দিন।”
এবার মহিলাটি কঠোর হয়ে বলল,
“না ম্যাডাম। এগুলা অনেক খরচের ব্যাপার। আমি আপনের থেকে এতো খরচ কেমনে নিমু? পারমু না।”
রাগিনী আর কোহিনূর অবাক হলো কিছুটা। গরীব, নিম্নবিত্ত হলেও তারা কি সুন্দর নিজেদের আত্মসম্মান বজায় রেখেছে। এখন কোহিনূর ভাবছে যে রাগিনী কী জবাব দেবে। সে বেশ আগ্রহের সঙ্গে কথাগুলো শুনছে। তৎক্ষনাৎ রাগিনী কিছুটা ভেবে বলল,
“মোটেও না। আপনাকে এমনি এমনি খরচ তো দেবোই না। আপনাকেও কিছু করতে হবে এর বদলে। শুনুন, আমার বাড়ির পেছনে একটা কাঠগোলাপের গাছ আছে। গাছটার যত্ন নেওয়ার জন্য বাড়িতে তেমন কেউ নেই। আপনার দায়িত্ব আপনি কাল থেকেই আমার বাড়িতে গিয়ে সেই গাছটার যত্ন নেওয়া।”
এবার ভ্যাবাচেকা খেলেন মহিলাটি। কোহিনূর মিটমিটিয়ে হাসছে। মেয়েটার বুদ্ধি আছে বলতে হবে। কীভাবে কৌশলে কথা ঘুরিয়ে দিচ্ছে। মহিলাটি বিস্ময়ের সুরে বললেন,
“এতটুকু কাম?”
“এতটুকু মানে? এটা অনেক বড় কাজ। আমার সবথেকে প্রিয় গাছটা। কত নজরে রাখতে হবে বুঝতে পারছেন? আমার নম্বর লিখে নিন তো। কাল ঠিক সময়ে এসে পড়বেন।”
মহিলাটি না চাইতেও নম্বর দেওয়া নেওয়া করল। আরো কথাবার্তা হলো। একটু গল্প হলো। সবশেষে রাগিনী ও কোহিনূর বিদায় জানিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়ল। দুজন পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। হাঁটার মাঝে হঠাৎ কোহিনূর বলে ওঠে,
“তোমাকে যতটা ভেবেছিলাম ততটাও বোকা নও তুমি!”
হাঁটার মাঝে দাঁড়িয়ে যায় রাগিনী। ভ্রু কুঁচকে বলে,
“মানে?”
“মানে একটু আধটু চালাক আছো। কীভাবে উনাকে তাক লাগিয়ে দিলে।”
“এটা প্রশংসা করছেন নাকি ইনসাল্ট করছেন?”
“অবশ্যই প্রশংসা। তোমার মতো মেয়ের প্রশংসা না করে ইনসাল্ট করা যায়?”
রাগিনী এবার কোহিনূরের কথায় পাত্তা না দিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করল। দুজনই লিফটের কাছে এসে দাঁড়াল। কোহিনূর মুচকি হেঁসে রাগিনীর বাঁধা চুল টান দিয়ে আবারও চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। রাগিনী কটমট করে তাকিয়ে লিফট খোলার বাটনে চাপ দিল। কোহিনূর বিরবিরিয়ে বলল,
“চলো! উনি কাঠগোলাপের গাছ সামলাতে থাকুক আর আমি আমার জীবন্ত কাঠগোলাপকে সামলাই!”
বড়সড় সাদা রঙ করা বাড়ি। বাড়ির আশেপাশের পাঁচিলও সাদা রঙের। বাড়ির সদর দরজার পাশে সুন্দর করে নেম প্লেট লাগানো। বাড়ির নাম ‘আহমেদ মেনশন’। কেমন যেন উঁচু উঁচু লাগছে পাঁচিলগুলো নয়নতাঁরার কাছে। মাঝে মাঝে লাফ দিয়ে পাঁচিল দিয়ে ওপাশ দেখার চেষ্টা করছে সে। উদ্দেশ্য পাঁচিল টপকে বাড়িতে ঢোকা। যেই ভাবা সেই কাজ। কোনোরকমে পাঁচিলে হাত রেখে পা দিয়ে নিজেকে ঠেলে উপরে ওঠার চেষ্টা করল সে। ধড়ফড় করে পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। বড় একটা দম ফেলে পাঁচিলের গায়ে একটা লা’ত্থি মে’রে বলল,
“কী কপাল আমার! নিজের বাড়িতে চোরের মতো ঢুকতে হচ্ছে।”
নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে এবার নয়নতাঁরার। আবার পাঁচিলের দিকে তাকিয়ে ওঠার চেষ্টা করল সে। এবার সফল হলো। পাঁচিল টপকে পেছনের দিকে লাফ নামতেই একটা শব্দ হলো। এবার পায়ের শব্দ কানে এলো। চোখ বড় বড় করে সামনের দিকে চাইলো নয়নতাঁরা। দুটো লোক ফট করেই এগিয়ে এসে তার দিকে রি’ভলবার তাক করতেই হকচকিয়ে উঠল নয়নতাঁরা। হাত দিয়ে নিজেকে দ্রুত আড়াল করে বলল,
“আরে আরে কী হচ্ছে! আমি এ বাড়ির মেয়ে। কোনো চোর নই।”
রি’ভলবার তাক করে থাকা দুজন লোক দুজনের দিকে তাকাতাকি করল। তারপর কঠোর সুরে বলল,
“মেয়েই যদি হন তাহলে চোরের মতো আসলেন কেন বাড়িতে? কে আপনি সত্যি করে বলুন। নয়তো…”
নয়নতাঁরা চুপসানো মুখে হাত দুটো উঁচু করে। জোর দিয়ে বলে,
“আমি নয়ন। নয়নতাঁরা আহমেদ। নির্জন আহমেদের একমাত্র আদরের, ভোলাভালা, সাধাসিধা, সরল, প্যাঁচবিহীন ছোট বোন।”
এক নিঃশ্বাসে বলা নয়নতাঁরার কথাগুলো যেন বিশ্বাসযোগ্য লাগলো না দুজনের কাছে। তারা নয়নের নিকটে গিয়ে জোর করে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে দিল। চেঁচামেচি করে উঠল নয়ন। কিন্তু তাদের কানে কথা গেলে তো!
অন্ধকার ঘরে দিনের আলো এসে ঘরটা খানিকটা আলোকিত করেছে। ছিমছাম একটা ঘর। অতিরিক্ত আসবাবপত্র নেই। বড় একটা বেড। বেডের দুপাশে সুন্দর ল্যাম্পশিট। জানালার পর্দা সরিয়ে রাখা। জানালার কাছে চেয়ার টেনে বসেছে নির্জন। হাতে কফির কাপ। মাঝে মাঝে শব্দবিহীন হালকা করে চুমুক লাগাচ্ছে কফির কাপে আর মুখে বিরাজ করছে অদ্ভুত গাম্ভীর্য। দরজায় টোকা পড়ে তখন। নির্জন গম্ভীর সুরে জবাব দেয়,
“কাম ইন।”
দরজা খুলতেই চেঁচামেচি কানে আসে নির্জনের। মেয়েলি কন্ঠ চিনতে বিন্দুমাত্র ভুল হয় না তার। কফির কাপটা রেখে চেয়ার নিয়ে ঘুরে বসে নির্জন। তাকে দেখে ছটফটাতে থাকা নয়নতাঁরা শান্ত হয়। দাঁত কেলিয়ে হাঁসে আর বলে,
“বিগ ব্রাদার!”
“কেন আমাকে এখানে এক্সপেক্ট করো নি?”
“না। মানে হ্যাঁ। তোমার বাড়ি। তুমিই তো থাকবে।”
পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে ঘাড় কাঁত করে নির্জন জবাব দিল,
“তুমি আমাকে বাহিরে দেখেছো সেকারণেই তো এখানে এসেছো।”
ঠোঁট উল্টিয়ে অসহায় পানে চায় নয়নতাঁরা। তার ভাইটা এতো বুদ্ধিমান কেন? তার মতো একটু বোকাসোকা হলে কি পারতো না? নির্জন ইশারা করে নয়নকে ছেড়ে দিতে বলে। হ্যান্ডকাপ খুলে দিতেই নয়ন ফোঁসফোঁস করে বলে,
“বলেছিলাম না? আমাকে না ধরতে। মিলল তো আমার কথা। যার বাড়ি তাকেই চোর বানিয়ে দিচ্ছে।”
“ওদের উপর চেঁচিয়ে লাভ নেই নয়ন! আমি ওদেরকে বলেছিলাম তোমার ছবি দিয়ে যাতে তোমাকে দেখামাত্র আমার কাছে ধরে বেঁধে নিয়ে আসে।”
নয়ন এবার কান্না করার ভান ধরে। নির্জনের দিকে এগিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে,
“তুমি এমনটা করতে পারলে?”
“না করার কী আছে? কম নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছো আমাকে? কোন সাহসে লন্ডন থেকে পালিয়ে এসেছো?”
নয়নের বুঝতে বাকি থাকে না তার ভাইয়ের মেজাজ এবার চড়ে যাচ্ছে। তাকে যে করে হোক ঠান্ডা করতে হবে। ফট করেই নির্জনের কোলে বসে নিষ্পাপ চাহনি নিয়ে তাকায় সে। আর আদুরে ভঙ্গিতে বলে,
“বিকজ আই মিসড ইউ।”
“হুমম। কত মিস করো সেটা আমার জানা আছে। সেকারণেই তো আগে আমার সাথে দেখা করা বাদ দিয়ে ইন্সপেক্টর রায়ানের সঙ্গে দেখা করতে হসপিটালে ছুটছিলে।”
নয়নতাঁরা এবার শয়তানি হাসে। হাতের কনুই দিয়ে নির্জনের বুকে গুঁতো দিয়ে বলে,
“তুমি কী করছিলে শুনি? আজকে যা দেখলাম দেশে এসে। না আসলে তো মিস করে যেতাম।”
“শাট আপ! যা বোঝো না তা নিয়ে কথা বলবে না।”
নয়নতাঁরা মিটমিটিয়ে হাসে। নির্জনের এক গাল টেনে ধরে বলে,
“কোনটা বুঝি না? একটা মেয়ের কত সুন্দর করে ধরে ছিলে সেটার মানে বুঝি না? নাকি লাজুক চেহারা বুঝি না? ইউ নো হোয়াট বিগ ব্রাদার? এই প্রথম তোমাকে লজ্জা পেতে দেখছি। যাক ওই কিউট মেয়েটা আই মিন হবু ভাবির দৌলতে জীবনে নির্জন আহমেদের ব্লাশিং ফেসও দেখা গেল।”
নির্জন যেন থতমত খেলো নয়নতাঁরার কথায়। আসলেই কি তার লজ্জা লাগছে? ফেস ব্লাশ করছে? তবুও সে না দমে নয়নতাঁরাকে একটু ধাক্কা দিয়ে বলল,
“আই এম নট জোকিং নয়ন! এটা কেস সংক্রান্ত ব্যাপার।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমিও বা কোথায় জোক করলাম? কেস সংক্রান্ত ব্যাপার আমিও বুঝলাম। কিন্তু যেমন তেমন কেস নয় এবার লাভ কেসে ফেঁ’সে গিয়েছো।”
“উফফ…আসলে কী বলো তো! তোমাকে বোঝানোর জন্য মুখ নাড়ানোর থেকে একটা গাছের সঙ্গে মুখ নাড়ানো অনেক ভালো। দেখি সরো। অনেক ভারি হয়ে গিয়েছো। পায়ের হাড় ভাঙবে এবার আমার।”
নয়নতাঁরা নাছোড়বান্দা। সে আরো নির্জনের কোলে ভালো করে বসে বলল,
“না উঠব না। তুমি যদি সত্যি না বলো আমি উঠছি না আজকে।”
“তুমি যা ভাবছো তা নয়। ব্যাপারটা অন্যরকম। গল্পটা অন্য। গোধূলি বেলার গল্প। রাগিনী জানেও না আমার পুরো নাম নির্জন আহমেদ কোহিনূর। তার ধারণাও নেই আমার পরিচয় সম্পর্কে। সে যেটা জানে সেটা আমি নই। আর যেটা জানে না সেটাই নির্জন আহমেদ কোহিনূর!”
চলবে…
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]