গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে – পর্ব ৪৩

0
494

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪৩

শেষ অ’শ্লীল গা’লিটা শুনে এবার আপনাআপনি না চাইতেও চোখ ভরে পানি চলে এলো রূপাঞ্জনার। হৃদয়ে পেল যেন তীব্র আ’ঘাত। অসহনীয় য’ন্ত্রণা সৃষ্টি হলো দেহে। বার বার এটা মনে করিয়ে মনে দহন বাড়ানোর কি সত্যিই কোনো প্রয়োজন আছে? এতকিছু ভাবনার মাঝে এবার কানে আসে ডার্ক ম্যাক্সের কড়া কণ্ঠ।
“জবাব দে রূপা! নয়ত আমি জানি না তোর কী করব। আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিস না।”

“আ…আমি মা’রার সুযোগ পাইনি। পুলিশের লোক আমাদের ট্র্যাক করে ফেলেছিল।”

“মিথ্যে বলা শিখে গিয়েছিস। ডার্কের কাছে মিথ্যে বলতে এসেছিস? বুকের পাটা অনেক বড় হয়েছে তোর। একটা কথা ভুলিস না। সারা দুনিয়াকে তুই ধোঁকা দিতে পারিস। কিন্তু ডার্ক ম্যাক্সের চোখ ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয়। সময় আছে। আমি রাগে পা’গল হয়ে যাওয়ার আগে বলে দে। তোকে মা’রতে আমার ইচ্ছে করে না। আমাকে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিয়ে যাস না।”

এই প্রথম ডার্ককে মিথ্যে বলেও পার পেল না রূপাঞ্জনা। তার দুটো গাল শক্ত করে চেপে ধরার সাথে সাথে মনে হলো ভেতরের দাঁত সহ সব ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে। হাসফাস করতে লাগল ছাড়া পেতে। অবশেষে তাকে ছেড়ে দূরে এসে উল্টে পড়ে থাকা চেয়ার ঠিক করে বসল ডার্ক ম্যাক্স। শান্ত কণ্ঠে জানতে চাইল,
“আমি জাস্ট কারণটা জানতে চাই। কী এমন কারণ? যে তুই সুযোগ পাওয়ার পরেও সেটা হাতছাড়া করলি? এটা ভুলিস না তোকে আমি যতটা চিনি ততটা তুই নিজেও নিজেকে চিনিস না।”

রূপা বড় বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ডার্কের প্রশ্নের কাঙ্ক্ষিত উত্তরটা তার কাছে উপস্থিত থাকলেও মুখ ফুটে বলার সাহসটা হয়ে উঠল না যেন। ডার্কের চোয়াল শক্ত হলো। রেগেমেগে আগুন জ্বলে গেল ভেতরটা। তবুও থমথমে গলায় বলল,
“লাস্ট টাইম জিজ্ঞেস করছি। বল আমাকে।”

“ছোট থেকে আমাকে শেখানো হয়েছে মানুষকে কষ্ট দিয়ে কীভাবে আনন্দ লুফে নিতে হয়। যখন থেকে আমার বুদ্ধি হয়েছে তখন থেকে আমাকে বোঝানো হয়েছে কোনো জীবকে মৃ’ত্যু দেওয়ার মাঝে যে খুশি সেটা আর কোথাও পাওয়া যায় না। আপনিও হয়ত সেটাই শিখেছেন বা জেনেছেন। কিন্তু আমি কখনো এটা বুঝিনি যে কাউকে বাঁচাতেও আনন্দ হয়। কারণ এটা কখনো জানতামই না আমি। যেই বয়সে আমার মা-বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়ার কথা ছিল। যখন আমার সহপাঠীদের সাথে অনেক অনেক খেলার কথা ছিল সেই বয়সে আমার হাতে রিভ’লবার তুলে দেওয়া হয়েছে। আমাকে খুব যত্ন করে হিংস্র এক প্রাণীর মতো তৈরি করা হয়েছে। যার কাছে মৃ’ত্যু দেওয়া একটা খেলা। আর সেই খেলাতে আমি বারবার জয়ী হতে যা ইচ্ছে তাই করতে পারি।”

“হঠাৎ এইসব কথা বলে তুই কি বোঝাতে চাচ্ছিস?”

“কিছু না। ইচ্ছে করল কিছু অতীতের কথা বলতে তাই বলে ফেললাম।”

“আজকে তুই অভিরূপকে বাঁচিয়েছিস?”

ডার্ক ম্যাক্সের শান্ত গলা এবং এমন প্রশ্নে কাঁপুনি ধরে গেল রূপাঞ্জনার। কী বলবে সে? তার নীরবতা দেখে ডার্ক কিছু একটা আন্দাজ করে বলল,
“ভয় পাচ্ছিস কেন এত? সাধারণ একটা প্রশ্ন করেছি। এতদিন ভিলেনের রোল প্লে করে হুট করেই সতী সাবিত্রী সাজতে চাইছিস? কারণ তো আছেই। কী সেই কারণ? ওই গায়ক তোকে একদিন বাঁচিয়েছিল বলে?”

রূপা আবারও চুপ রইল। মুখে এলো না কোনো কথা। ডার্ক ম্যাক্স এবার কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া না করে টেবিলের শেষদিকে পড়ে থাকা কাঁচের বোতল থেকে পানি ঢেলে নিল সে। তারপর গ্লাসটা ধরল রূপার দিকে। বলল,
“হাঁপিয়ে উঠেছিস বোধহয় আমার দেওয়া যন্ত্র’ণা সহ্য করতে করতে। নে পানি খেয়ে শান্ত হয়ে নে।”

রূপাঞ্জনার তৃষ্ণাই পেয়েছিল। তবে পানির কথা মুখ ফুটে বলে উঠতে পারছিল না। তাই না চাইতেই পানি পেতেই বিলম্ব করল না সে। তড়িঘড়ি করে ডার্কের হাত থেকে গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে সব পানি পান করল। সঙ্গে সঙ্গেই ঘর কাঁপিয়ে হাসল ডার্ক ম্যাক্স। তার হাসির কারণ ঠিক বোধগম্য হলো না রূপার। শূন্য চোখে চেয়ে রইল তার দিকে। দুহাত দিয়ে ডার্ক নিজের চুলগুলো এলোমেলো করতে করতে বলল,
“আমাকে কতটা ভরসা করিস তুই! আমি মুগ্ধ।”

রূপা এবারও কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। কপালে পড়ল কিঞ্চিৎ ভাঁজ। তৎক্ষনাৎ ডার্ক বলল,
“পানিতে কী ছিল জানিস? সেই কেমিক্যাল যেটা দিয়ে আমি বাজিমাত করি সেটা মিশিয়ে দেওয়া ছিল। রাই’সিন! যেটার প্রভাবে ধীরে ধীরে তুই ম’রে যাবি।”

আকাশ ভেঙে পড়ল রূপার মাথার ওপর। থরথর করে কেঁপে উঠল আপাদমস্তক। সে বারংবার বলেছে মৃ’ত্যুকে সে ভয় পায় না। তবে আজ একথা শুনে সত্যিই মনে হচ্ছে মৃ’ত্যু আসলেই তাকে ভয় আঁকড়ে ধরল। না চাইতেও জোরে জোরে কেশে উঠল সে। ম’রণ যেন তার সামনেই। ডার্ক ম্যাক্সের কাছে ভারি মজা লাগল দৃশ্যটা। সে নির্বিঘ্নে হাসতে থাকল। রূপা গলা চেপে ধরেছে। চেষ্টা করছে কেশে কেশে পান করা পানি বের করার। কিন্তু তা কী হয়? এসব দেখে আয়েশি ভঙ্গিতে চেয়ারের দিকে হেলে চোখ বুজল ডার্ক। হাতের আঙ্গুল বের করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলল,
“এটা শুধু ট্রেলার ছিল। পানিতে কিছু মেশানো নেই। তোর চোখেমুখে আতঙ্ক দারুণ লাগে।”

এতক্ষণ ধরে ছটফট করতে থাকা রূপাঞ্জনা স্থির হলো। অপলক চোখে তাকাল ডার্ক ম্যাক্সের দিকে। এই লোকটাকে মানুষ বলে গণ্য করা মুশকিল! তারপরেই রূপা ভাবে সে নিজেও কি আদেও মানুষ হতে পেরেছে? ঠোঁট চেপে বসে রইল মাথা নত করে। ডার্ক এবার জবান খুলল,
“তুই যদি ভাবিস ওই অভিরূপ তোর প্রতি ফিদা হয়ে তোকে রক্ষা করেছে তার প্রতিদান তুই দিবি তাহলে তোর ভাবনা দিন দিন অধঃপতনে যাচ্ছে রূপা। তুই তো নিজের চেহারা নিয়ে ঘুরিস না। চেহারা অন্যকারো। যদি ফিদা হয় তোর চেহারা দেখেই ও পটে গিয়েছে। নিজেকে স্পেশাল ভেবে আমার কাজে বাগড়া দেওয়া বন্ধ কর। ঢাকায় কেন এসেছি ভুলে গিয়েছিস? এখানে আসার পর পরিবর্তন লক্ষ্য করছি তোর মাঝে। তোকে লাস্ট চান্স দিলাম। দিতাম না! কারণ আমার ডাকা’তি করার সমস্ত টাকা তোর পেছনে ঢালতে হয়েছে। বিফলে যেতে দেব না কিছু। আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ।”

রূপাঞ্জনা তাড়াহুড়ো করে ওঠার চেষ্টা করল। একটু সময় লাগায় কটমট করে তাকাল ডার্ক। নিজের হাতের কাছে থাকা সেই কাঁচের বোতল ছুঁ’ড়ে মা’রল রূপার দিকে। বেখেয়ালে এমন করায় রূপার গায়ে লাগল না সেটা। পাশেই বিকট শব্দে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। রূপাঞ্জনা দ্রুত দাঁড়িয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ডার্কের চোখের আড়াল হতেই সেই রহস্যে ঘেরা মুখটা থমথমে হলো। বুক চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। মাথা চেয়ারের সাথে লাগিয়ে বিড়বিড়িয়ে আওড়াল,
“নারীর মন! যতই হক জটিল। অল্পতেই গলে যায়। হাজার হাজার বছর ধরে জমে থাকা বরফের মতো হিং’স্রতা সহজেই গলে যায় যদি সেখানে কোনো পুরুষের আদুরে ছোঁয়া লাগে।”

থামলো ডার্ক ম্যাক্স। কথার মাঝে বিরতি নিয়ে আবারও বলল,
“ওকে দিয়ে আর কোনো কাজ হবে কিনা নিশ্চয়তা নেই। আমাকে যা করার করতে হবে এবার। একটা সুযোগ করেই দিয়েছে ওই জানো’য়ার মেয়েটা। সেই সুযোগটাকে কাজে লাগালে মন্দ হয় না।”

চোখটা মেলতে কষ্ট হলো রাগিনীর। তবুও জোর খাটিয়ে চোখ মেলে তাকিয়ে আবছা দেখল আশপাশ। হাত নাড়াতেও যেন হাতে কিছুটা ব্যথা অনুভব করল সে। অন্যপাশ ফিরতেই নিজের নয়নে পড়ল হালকা রশ্মি। গতকালকের কথা স্মরণে এলো। তাকে কে যেন পেছন থেকে মুখ চেপে ধরেছিল। তারপর? মনে ঝেঁকে বসল ভয়। না চাইতেও হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল সে। পাগলের মতো আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল সে কোথায়। চারিদিকে ঘোলা দেখে মাথা চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে বলল,
“ওরা আবার ফিরে এসেছে। পিছু ছাড়ছে না আমার।”

এমতাবস্থায় রাগিনীর কানে এলো চেনা কণ্ঠস্বর।
“রাগিনী! কেমন লাগছে এখন?”

রাগিনী শান্ত হলো। কান্না পালিয়ে গেল ঢক গিলে নিজের চোখ কচলে পাশ ফিরে তাকাল। পৃথিবীর সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মানুষ তার পাশে। তার বাবা রাশেদ সাহেব। কেমন ঝিমানো দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছেন। চোখের চশমা খুলে রেখেছেন। রাগিনী আবার চারিপাশটা দেখল। এটা তারই ঘর। ঘড়ির দিকে চোখ গেল। এখনো ছয়টাও বাজেনি পুরোপুরি। এত ভোরে তার বাবা কী করছে? আর সে এখানে কী করে? তার মাথায় রাশেদ সাহেব স্পর্শ করতেই রাগিনী অস্থির নয়নে তাকাল। তার বাবা বললেন,
“কী বলছিলে তুমি এখনি? কারা ফিরে এসেছে?”

চোখমুখ চুপসে গেল রাগিনীর। কাঁপা সুরে উত্তর দিল,
“দু…দুঃস্বপ্ন বাবা।”

“সত্যিই কি তাই?”

রাগিনী মাথা নাড়াতেই এবার কণ্ঠস্বর বদলে গেল রাশেদ সাহেবের। কাঠকাঠ গলায় বললেন,
“মিথ্যে বলছ তুমি। তোমার চোখ বলছে তুমি মিথ্যে বলছো। আমার থেকে লুকিয়ে কী লাভ হচ্ছে তোমার? আমাকে বলো মা। আমরা সমাধানের রাস্তা খুঁজতে পারি। ঠিক কী কারণে তোমার সঙ্গেই অদ্ভুত আর বিশ্রী কান্ড ঘটছে? সব খুলে বলো আমায়।”

রাগিনী উশখুশ করতে থাকে। গলা খাঁকারি দিয়ে একবার তার বাবার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। অস্বস্তিতে ভরে ওঠে চোখজোড়া। রাশেদ সাহেব নিজেকে শান্ত করে তাকে আশ্বস্ত করে বলেন,
“এমন কি কোনো ঘটনা রয়েছে যা আমার হেলথ্ ভালো রাখার জন্য তুমি বলো নি? লুকিয়ে গিয়েছো কোনো কথা? আমার সাথে শেয়ার করো ভালো লাগবে।”

রাগিনী শুকনো ঢক গিলল। মুখ নিচু করে বসে থাকল। রাশেদ সাহেব পাশ থেকে গ্লাসে পানি দিলেন তাকে। রাগিনী পানি পান করল। মিনমিন করে বলল,
“আমার কথাগুলো শুনে তুমি কোনো প্রেশার নেবে না প্রমিস করো!”

“আই প্রমিস ইউ, মাই প্রিন্সেস। এখন বলো আমাকে।”

“বাবা মনে আছে তোমার? আমি যখন চট্টগ্রামে ভার্সিটি থেকে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে সকলে মিলে ক্যাম্পিংয়ে গিয়েছিলাম তখন আমার আইডি কার্ডটা হারিয়ে ফেলেছিলাম। তার ফলে অনেক ফর্মালিটিজ পূরণ করতে হয়েছিল?”

রাশেদ সাহেব খানিকটা ভেবে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালেন। রাগিনী আবারও একনাগাড়ে বলতে শুরু করল,
“ওটা আমার খামখেয়ালিপনার জন্য হারায়নি বাবা। এর পেছনে অনেক বড় একটা কাহিনী ছিল যেটা আমি তোমার কাছ থেকে লুকিয়ে যাই। কারণ তখন তোমার সবে সবে হার্টের প্রবলেম ধরা পড়েছিল। তাই আমি চাই নি তুমি আমায় নিয়ে দিনরাত চিন্তা করো।”

“ঘটনাটা কী রাগিনী?”

সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাগিনীর দিকে চেয়ে নিজের উত্তরের অপেক্ষা করলেন রাশেদ সাহেব। রাগিনী একটু দম নিলো। জানালার পানে চেয়ে দেখল নতুন সকালের আকাশ।

তখন বছরের মাঝখানের সময়। চট্টগ্রামের মতো মনোরম শহরে পড়েছিল আত’ঙ্কবা’দীদের কালো ছায়া। রাগিনীর বয়স তখন একটু কম হওয়ায় একটু বেশিই চটপটে ছিল। সবখানে তার আগ্রহ আর নাক গলানো থাকতেই হবে। তারা সেই সময় হইহই করে ক্যাম্পিংয়ে গিয়েছিল পতেঙ্গা সী বিচে। বেশি দিন নয় মাত্র তিন দিনের জন্য। দ্বিতীয় দিন ভোর বেলা যখন হয়। অর্থাৎ সূর্যদ্বয় হওয়ার আগে টেন্টের মধ্যে এত জনের মাঝে ঘুমে দম বন্ধ হয়ে এসেছিল রাগিনীর। ঘুম থেকে উঠে বাহিরে যখন আধো আলো দেখেছিল তখনই মনে এক বাসনা জেগেছিল। সমুদ্রসৈকতে গিয়ে সূর্যদ্বয় দেখার আকাঙ্ক্ষা জেঁকে বসেছিল। ফলস্বরূপ পাশে থাকা তার বান্ধবী হুমায়রাকে ডাকল সে।

“হুমু! এই হুমু! শোন না। ভোর হয়ে গিয়েছে। আর আমার ঘুমও আসছে না।”

হুমায়রা ঘুমের মাঝে বিরক্ত হলো। তারপর গায়ের চাদর টেনে মুখের কাছে ধরে বিড়বিড়িয়ে উত্তরে বলল,
“তোর আসছে না তো তুই বসে থাক। অন্যের মাথা খাস না।”

রাগিনী নাক ফুলিয়ে তুলল। তবে আশা ছাড়ল না। নাছোড়বান্দা হয়ে হুমায়রাকে ডেকে তুলল। মনে মনে শত গা’লি দিতে দিতে হুমায়রা তৈরি হলো। রাগিনী ব্যাগে পানির বোতল নিয়ে চুপি চুপি বেরিয়ে পড়েছিল সেই আশা পূরণের উদ্দেশ্যে। সেটাই সে কাল হয়ে দাঁড়াবে বুঝেছিল কি কেউ? টেন্টের জিপ খুলে বাহিরে বেরিয়েই বেশ কিছু মুখোশধারী ভয়ানক মানুষের সামনা-সামনি হয়েছিল তারা। সকলের হাতে ছিল বড় বড় মাপের ব’ন্দুক। তা দেখে দুজনেই চিৎকার দিয়ে উঠেছিল। তাদেরকে ধরে বন্দু’ক তাক করা হয়। আকাশে গু’লি ছোঁড়ার শব্দে রাগিনীকে প্যানিক অ্যা’টাক করেছিল। হুমাইরা ও সে মিলে বাঁচতে চেয়েছিল। প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেদিন টেরো’রিস্ট টিমের উদ্দেশ্যই ছিল ক্যাম্পিং এ আসা সমস্ত স্টুডেন্টদের শে’ষ করে দেওয়া।
“চুপচাপ শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাক নয়ত…”

এক উদ্ভট এবং হিংস্র মেয়ের এমন কথায় থেমে গিয়েছিল রাগিনীর ছটফটানি। তবে অন্তরাত্মা কাঁপছিল তার। নিজেকে শান্ত রাখতে পারছিল না কিছুতেই। উপায় খুঁজছিল নিজেকে বাঁচানোর। সকলে নিজের প্রা’ণ যেন হাতে করে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। যেখান থেকে বাঁচা অসম্ভব ছিল। সবকিছু সামলে যখন রূপাঞ্জনা ডার্কের আদেশ পাওয়ার জন্য ডার্ককে কল করেছিল সে। কলটা দ্রুতই রিসিভ করেছিল ডার্ক ম্যাক্স।
“ডার্ক ম্যাক্স, সব রেডি। আপনি বললে আমরা আমাদের কাজ শুরু করে দেব।”

ডার্ক ওপরপাশ থেকে খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়ে জবাবে বলেছিল,
“তোদের আশেপাশেই আছি আমি। সব দেখেছি। কিন্তু একটা কারণে প্ল্যানিং ক্যান্সেল করতে হবে আমাদের।”

রূপা আকাশ থেকে পড়েছিল। এ কেমন কথা? সবকিছু রেডি হবার পর এমন কথা মানায়? রূপাঞ্জনা খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বলেছিল,
“বাট অল ইজ সেট ডার্ক ম্যাক্স। আর এমন সময় এটা বললে…”

“আই সেইড ক্যান্সেল দিস প্ল্যানিং। সরে আয় তোরা।”

রূপাঞ্জনা সেদিন নিজের প্ল্যান ক্যান্সেল করেছিল। তারা কোনোরকমে পালিয়ে এসেছিল। নিজের চোখের সামনে বেশ কয়েকজন মানুষকে আহত হতে দেখে তার থেকে রাগিনীর আরো বেশি ভয় লাগা শুরু হয়। রাগিনীর ফোবিয়া আরো তাকে জেঁকে বসেছিল সেখান থেকেই। সেদিন রাশেদ সাহেব টিভিতে নিউজ পেলে রাগিনীকে জিজ্ঞেস করলে রাগিনী সেদিন মিথ্যে বলেছিল যে তার কিছুই হয়নি। অর্থাৎ সে টেরো’রিস্টদের কবলে পড়েনি। পরে নিজের ভার্সিটি আইডি কার্ড খুঁজলে সেটা রাগিনী আর পায়নি। হয়ত বোতল রাখা ব্যাগেই ছিল। সেই ব্যাগটাও সে তন্নতন্ন করে খুঁজে হতাশ হয়েছিল সে। কোনোক্রমে আর ব্যাগটা মিলেনি।

রাশেদ সাহেব সবটা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। চিন্তা করবেন না বলে কথা দিয়ে চিন্তারা প্রগাঢ় হয়ে ধরা দিল। কপালে পড়ল গাঢ় তিনটে ভাঁজ। মেয়েকে কী বলে শান্তনা দেবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। তবে কৌতূহল বশত প্রশ্ন করলেন,
“তুমি কীভাবে নিশ্চিত হলে যে ওরাই তারা?”

“আমার মন বলছে বাবা। তাছাড়া এই খবর তো পাওয়া গিয়েছে যে ওরা চট্টগ্রাম থেকে এসেছে আর…”

কোহিনূরের কথা মুখ ফুটে বলা হলো না রাগিনীর। মানুষটির মুখ মনে পড়তেই হৃদয়ে সৃষ্টি হলো মিশ্র অনুভূতি। লোকটা এতটাই তীব্র অনুভূতির সূচনা করে দিয়েছে যা ক্ষণে ক্ষণে রাগিনীকে মনে করিয়ে দেয়। মানবটি মনটাকে চুরি করেছে। লোকটা ভয়ানক হওয়ার সাথে সাথে চোরও বলা যায়। তবে সেই মনটাকে ফেরত পাওয়ার উপায় কী? রাশেদ সাহেবের কথায় ধ্যান ভাঙল রাগিনীর।
“আর কী রাগিনী?”

“কিছু না বাবা। আমার আর ভালো লাগছে না। আমি ভালো থাকতে চাই।”

রাশেদ সাহেব বেশ বুঝতে পারেন মেয়ের মনের অবস্থা। উনি শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ভাবলেশহীন হয়ে গাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন। মেয়েটা কত ভাবে তাকে নিয়ে। আর এই ভাবনা কতগুলো কথা লুকিয়ে গুপ্তধনের মতো নিজের মনের অভ্যন্তরে রেখে দিয়েছিল সে। মেয়ের ফ্যাকাশে মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন,
“যা হয়েছে সব দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাও। আমি চাই না আমার ঘর উজ্জ্বল করে রাখা মেয়েটার চেহারা এমন বিবর্ণ হক। আর আমি তো আছি। আমার মেয়ের কোনো ক্ষতি হতে দেব না।”

রাগিনী কোনো প্রতিত্তোর করে না। নীরবতা পালন করে। রাশেদ সাহেব আবারও বলেন,
“আমার দুটো কথা রাখবে?”

উৎসুক নয়নে তাকায় রাগিনী। তার বাবা শান্ত গলায় বলেন,
“জানো তো আমি চাই না আমার বন্ধু আমায় অবিশ্বাস করুক। অভিরূপের বাবার কথা বলছিলাম আমি। অভিরূপকে কিছু জানিয়ো না। আমার মান সম্মান মিশে যাবে তার কাছে। তার সঙ্গে কথা বলাও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। আরো একটা কথা!”

রাগিনী শুনেই গেল। আগের মতোই বাকি কথা শোনার জন্য আগ্রহ নিয়ে চেয়ে রইল।
“তোমার মনে কোথাও যদি কোহিনূরকে নিয়ে সুন্দর কোনো শব্দ হলেও ভেবে থাকো তবে ভুলে যাও। মনে রাখবে, তোমার বাবা সবসময় তোমার ভালো থাকাটাই চেয়েছে।”

ব্যস…আর বিলম্ব করলেন না তিনি। উঠে দাঁড়ালেন রাশেদ সাহেব। হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন। রাগিনী তখন নিস্তব্ধ, বাকরুদ্ধ। সবটা যেন এক মূহুর্তে থমকে গিয়েছে। তার বাবাও কি কোহিনূর সম্মন্ধে সবটা জেনে গেল? থমকে গিয়েছে ভালোবাসার ফুলে ভরা সুসজ্জিত পৃথিবী। যেই ভালোবাসার ফুলগুলো সমস্ত কোহিনূরের নামে যত্ন করে রাখা হয়েছিল। সেও তো চায় সব ভুলতে। কিন্তু ভুলতে গিয়ে যে সে ভেতরে ভেতরে গুমরে গুমরে ম’রছে প্রতিটা সময়।

টেবিলের ড্রয়ার খুলে ঘড়ির বক্সটা আনলক করে সুন্দর হাতঘড়িতে হাত বুলাতে থাকে নির্জন। ঘড়িটা রাগিনীর দেওয়া। মেয়েটা যেদিন জোর করে এলোমেলো পাগল পুরুষ থেকে সাহেব পুরুষ বানাতে উঠেপড়ে লেগেছিল সেদিনকার কেনা এই ঘড়ি। ঘড়ির গ্লাসে যেন রাগিনীর প্রতিচ্ছবি দেখতে পায় নির্জন। ওইতো মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে। আবার নাক ফুলিয়ে রেগে রেগে যাচ্ছে। কতটা মিষ্টি সে! এই মিষ্টি পেলে বোধহয় জীবনে সবরকম মিষ্টিই তুচ্ছ মনে হবে। ঘড়িতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মেহরাজের কণ্ঠে তড়িঘড়ি করে ড্রয়ার বন্ধ করল সে।
“স্যার, কোনো কারণে কি আপনার মনমেজাজ খারাপ?”

নির্জন ভ্রু কুঁচকে তাকায়। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে,
“কেন?”

“রাগিনী ম্যাডামের বাবা গতকাল যা যা বললেন তাতে তো আমারই…”

“আই রেসপেক্ট হিম অ্যান্ড হি’জ ডিসিশন।”

“তাহলে কি আপনি রাগিনী ম্যাডামের কথা ভুলে যেতে চাইছেন?”

অন্তর কেঁপে উঠল নির্জনের। দুরুদুরু করল মন। চেয়ারের হ্যান্ডেল শক্ত করে চেপে ধরল। রাগিনী নামক নামটা গেঁথে গিয়েছে যে। এটা কীভাবে ভুলবে? যেই হাসিতে সে মাতাল হয়েছে বার বার সেই হাসি মুখটাকে মন থেকে কী করে মুছবে? সবকিছু কী এতই সহজ? সে এখনো মন থেকে ক্ষণে ক্ষণে চায় রাগিনী তাজরীন নামক সবচেয়ে অমূল্য কাঠগোলাপের গন্ধে মেখে থাকতে।

চলবে…

[বি.দ্র. অনেকে গত পর্বে জিজ্ঞেস করেছিলেন অভিরূপ এবং নোমান এতকিছুর মাঝে কোথায়? আমি কোথাও উল্লেখ করেছিলাম তারা কনসার্টে গিয়েছে। অভিরূপের কনসার্ট ছিল। আর এটাও জানতে চেয়েছিলাম অভিরূপ আর রূপার সম্পর্ক ঠিক কেমন হওয়া উচিত। একেক জন একেক মন্তব্য করেছেন। তাতে আমি বেশ খুশিও। তবে যারা রূপাকে পছন্দ করে উঠতে পারেনি তারা বলেছে অভিরূপের জন্য নতুন কাউকে আনতে আর যারা রূপাকে কিছুটা পছন্দ করেছে তারা চেয়ে অনুভূতি বাড়তে দিতে। সব মিলিয়েই তাদের গল্প তৈরি হবে। আর রূপাঞ্জনার শা’স্তির কথাও উল্লেখ করেছেন অনেকে। তাদের বলি, আমি রূপার কর্মকান্ডের কথা ভুলিনি। আমাকে সময় দিন এবং শেষ অবধি দেখুন। সবাই সবার প্রাপ্তি পাবে। ভালো হক বা মন্দ। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। গল্প গতকালকেই পোস্ট করতাম। তবে ভায়োলেন্সের কারণে তা হয়ে ওঠেনি।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here