#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৫০ [অন্তিম পর্বের প্রথমাংশ]
রাগিনী বড়ো শপিংমলের এত এত মানুষের মাঝে যেন সম্পূর্ণ একা। এত কোলাহলে একটা যান্ত্রিক রোবট লাগছে নিজেকে। যে যেভাবে পারছে পরিচালনা করে চলে যাচ্ছে। মিথ্যে অভিনয় সাজিয়ে তাকে উপহার দিয়ে চলেছে। আর সে আপনমনে সেসব গ্রহণ করে যাচ্ছে। তবুও কোনো অদ্ভুত জোরের কারণে মনে আকাঙ্ক্ষা জাগল মানুষটার সঙ্গে মেয়েটির ঠিক কেমন সম্পর্ক সেটা জানতে এবং হাতেনাতে তাকে ধরে সাবধান করে দিয়ে আসতে। অনেক হয়েছে আর সহ্য করা যাচ্ছে না। এবার থেকে যদি মানুষটি তার কাছে আসে তবে খুব খা’রাপ হয়ে যাবে! সেটাই রাগিনী আর বুঝিয়ে দেবে কোহিনূরকে। এসব ভেবে নিজের উপর জোর খাটিয়ে এগোতে থাকে রাগিনী। কিন্তু সে মানুষটিকে হারিয়ে ফেলেছে। এত লোকজনের মাঝে খুঁজে পেল না চেনা ব্যক্তিত্বকে। কোথায় গেল সে? হাঁটতে হাঁটতে সামনে থাকা রেলিং ধরে দাঁড়াল রাগিনী। নিচটা দেখতে থাকল বেশ মনোযোগ দিয়ে। হঠাৎই চোখে পড়ল কোহিনূরকে। ওইতো নিচে নেমে পার্কিং এর দিকে হেঁটে যাচ্ছে মেয়েটার সাথে। রাগিনী ঝটপট করে লিফটের কাছে গেল। তবে এতটা ভীরের মধ্যে লিফটে যেতে টাইম লাগবে বলে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামল সে। পার্কিং এর দিকে যেতেই রাগিনী খেয়াল করল কোহিনূর আইসক্রিমের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। তার পাশে থাকা মেয়েটি কোহিনূরের হাত জড়িয়ে ধরে আইসক্রিম কেনার পাগলামি জুড়ে বসেছে। রাগিনী ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। মেয়েটা নিশ্চয় কোহিনূরের বেশ কাছের কেউ। কৌতূহল বাড়ল মনে। সরগমের মাঝে মানুষজনের মধ্যে সূক্ষ্ম দৃষ্টি দ্বারা তাদের প্রতিটা পদক্ষেপকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে।
“মাই ডিয়ার ব্রাদার! তুমি ভাবির পছন্দের খেয়াল রাখতে রাখতে আমার পছন্দ ভুলতে বসেছ! আমি স্ট্রবেরি ফ্লেবার পছন্দ করি।”
ভ্রু কুঁচকে ক্ষীণ গলায় নির্জনের উদ্দেশ্যে কথাটা বলল নয়নতাঁরা। ফোনে ব্যস্ত থাকা নির্জন খুব একটা পাত্তা না দিয়ে দোকানদারের উদ্দেশ্যে বলল,
“তাকে একটা স্ট্রবেরি ফ্লেবারের আইসক্রিম দেন।”
মেহরাজের সঙ্গে কিছু ডিটেইলস নিয়ে কথা বলছিল নির্জন হোয়াটসঅ্যাপে। চোখমুখ হালকা কুঁচকানো। মেহরাজ একটা ছবি পাঠিয়েছে তাকে। ছবিতে একটা ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বয়সের একটা লোক। ডান ভ্রু এর মাঝে কাটা। শ্যামলা দেখতে। নকল রাগিনীকে রাগিনীর মতো বানাতে এই লোকটাই সমস্ত ডিটেইলস আর টাকাপয়সা দিয়েছিল। নির্জনের কাছে চেনা চেনা লাগল এই মুুখটা। তবে মনে এলো না। যেই ডক্টরের কাছে নকল রাগিনীকে নেওয়া হয়েছিল তার ভাষ্যমতে তখন নকল রাগিনীর অবস্থা বেশ খারাপ ছিল। চোখমুখ প্রায় ঝ’লসে গিয়েছিল তার। নির্জন এটা এখনো বুঝতে পারেনি রাগিনীর চেহারা অবিকল তৈরির জন্যই কি তার চেহারা ঝ’লসে দেওয়া হয়েছিল নাকি এটা এক্সি’ডেন্ট ছিল? তবে ছবিতে থাকা এই লোকটা তখন হসপিটালের পেপারে নওশাদ খান লিখে সাইন করেছিল বলে জানা যায়। নির্জন এটা নিশ্চিত যে ওটা তার আসল নাম ছিলই না। এসব কিছুর মাঝে নির্জনের অন্যহাতে টান পড়ায় কিছুটা হকচকিয়ে নিচু হয়ে তাকায় সে। একটা ছোট্ট মেয়ে। কৃষ্ণবর্ণ তার গায়ের রং। বয়সটা দশ বছরের বেশি হবার কথা নয়। হাতে ফুলের গাজরা। নির্জন ঝুঁকে নিচু হতেই মেয়েটি জিজ্ঞেস করল,
“ফুলের মালা লইবেন? মাত্র ত্রিশ টাকা।”
“নাম কী তোমার?”
“দিয়া।”
“বেশ সুন্দর নাম। তা দিয়া! আমি ফুলের গাজরা নিয়ে কাকে পড়াব বলো তো? আমার তো কেউ নেই পড়ানোর মতো।”
দিয়া মাথা চুলকালো। মূহুর্তেই দিয়ার পেট থেকে উদ্ভট আওয়াজ আসতেই নির্জন বুঝল মেয়েটি না খাওয়া। তৎক্ষনাৎ সে প্রশ্ন করল,
“আইসক্রিম খাবে?”
দিয়া মাথা নাড়াল আর মিনমিন করে বলল,
“আমার ফুলের মালা কিনে টাকা দেন তাইলেই হইব। আবার এইডা বসরে জমা দিতে হইব। তারপর তার মধ্যে থেকে যা পামু ওইডা নিয়া আমি আর আমার কানা ভাই মিলে ভাগ করে খামু।”
নির্জন ভ্রু কুঁচকে ফেলে। বস মানে সে বোঝেনি। সে নরম গলায় জিজ্ঞেস করল,
“বস মানে? আর তোমার ভাই আছে?”
“এত শুইনা কী করবেন? মালা না কিনলে কন চইলা যাই।”
এবার মেয়েটির কণ্ঠস্বরে জড়তা খুঁজে পেল নির্জন। এটা অস্বাভাবিক কিছু না। শহরে ছোটো ছেলেমেয়েদের ভিক্ষা করতে বসিয়ে দেওয়া বা তাদের রোজগার করতে লাগিয়ে দেওয়ার অনেক চক্র কাজ করে। এর আগেও নির্জন এমন কয়েকটা কেস সলভ করেছে। এটাও হয়ত তেমনই কিছু। নির্জন শ্বাস নিয়ে আশ্বাস দিয়ে বলল,
“ভয় পাচ্ছো কেন? আমাকে বলতে পারো। ভয় পেও না।”
“আপনের লগে বেশি কথা কইলে বস আমারেও ভাইয়ের মতো কানা কইরা দিয়া চোখ বেইচা দিবে। আমি গেলুম।”
ছোটো মানুষ! পেটে কথা থাকে না। শেষ কথাতে নির্জন বুঝতে পারল সে যা ভেবেছিল তাই। মেয়েটি চলে গেলেও নির্জন তাকে চক্ষু আড়াল করল না। কিছুদূর না যেতেই বেশ লোকজনের মাঝে মলের বাহিরে দাঁড়াতেই সেই ছোট্ট মুখে ঠাস করে চ’ড় দিয়ে বসল একটা লোক। নির্জন বেশ ভালোভাবেই দেখে নিলো সেটা। বেশ ভালো করে খেয়াল করতেই তার চক্ষু চড়কগাছ হলো। এটা তো সেই লোকটা! যার ছবি মেহরাজ হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছে! একে যদি ধরতে পারা যায় তবে অনেক ইনফরমেশন বেরিয়ে আসবে। নির্জন যেন হাতের শপিংব্যাগগুলো নয়নের হাতে দেওয়ারও সময় পেল না। সেগুলো সেখানেই ফেলে দিয়ে ভীর ঠেলে যেতেই নয়নের বিরক্তি ভরা কণ্ঠ শুনল,
“মহা বিপদ তো! তোমার সঙ্গে শপিং এ এসেও শান্তি নেই। আমি গাড়ির কাছে ওয়েট করব। লোকটাকে উ’দুম কে’লানি দেওয়া শেষ চলে এসো। বেশি লেট করাবে না বলে দিলাম।”
নয়নের জোর দিয়ে বলা কথায় নির্জনের এক মূহুর্তের জন্য মনে হলো আসলেই সে একটা পা’গলকে বড়ো করছে। একের পর এক লোকজনের পাশ কাটাতে কাটাতে যখন সেই নওশাদ খানের মুখটা বেশি স্পষ্ট হলো তৎক্ষনাৎ চিনে উঠতে পারল নির্জন। এটা তো সেই ক্রি’মিনাল যার সঙ্গে ওই নকল রাগিনী মিলে মেন্টাল হসপিটালে তাকে মা’রতে এসেছিল! সেদিন অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিল সে এবং হসপিটালের সকল পেশেন্ট। সেদিনের ব্যর্থতার ক্ষো’ভ মাথায় চেপে বসল এবার তার। আজ তার পরিচয় জনসম্মুখে এলেও নির্জন ওই নওশাদকে ধরার প্রতিজ্ঞা নিলো। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া একের পর এক পড়তে থাকা ছোট্ট মেয়েটির গায়ে মা’র যেন নির্জনের শরীরেও লাগল। তার প্রলম্বিত নিঃশেষ নিঃশ্বাস আর অগ্নি প্রবাহের ন্যায় দৃষ্টির সম্মুখীন হলেও যেন কেঁপে উঠবে শত্রুপক্ষ।
দিয়ার ঠোঁট ফে’টে র’ক্ত বেরিয়েছে পাশ দিয়ে। ফুঁপিয়ে কাঁদতে গিয়েও থমকে থমকে যাচ্ছে মেয়েটা। লোচন ভর্তি আতঙ্কের ছড়াছড়ি সেই সঙ্গে টলটল করছে পানি। কবির জলন্ত সিগারেটটা বেশ ক্ষিপ্র হয়ে মুখে ধরে রেখেছে। এতক্ষণে একটা রোজগারও করতে পারেনি মেয়েটা। এদের বাঁচিয়ে কী লাভ? অবশ্য ডার্ক ম্যাক্স আদেশ দিয়ে দিয়েছে এই মেয়েটার কিডনি নিয়ে একটা কেমি’ক্যাল জাতীয় কিছু দিয়ে খতম করে দিতে। কাজটা আজকের মধ্যেই সারতে হবে। এসব ভাবনার মাঝে ব্যাঘাত ঘটিয়ে দিয়া আধো গলায় বলল,
“মাফ কইরা দেন। আমারে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় দেন। আমি যা পামু সব দিয়া দিমু। একটু খাইতে দিয়েন আমারে আর ভাইডারে। তাইলেই হইব।”
কবিরের বাসনা জাগল রেগে এবার দিয়ার ছোট্ট গলাটাই চে’পে ধরতে। হাতটা মুঠো করে ফেলল সে। ধ’মক দিতে উদ্যত হলো। সেই মূহুর্তে তার ঘাড়ে হাত রাখল কেউ। প্রশস্ত হাতের জোর এবং শক্ত করে চেপে ধরায় যেন কাঁধের হাড্ডি ভে’ঙে যেতে খুব একটা সময় লাগবে না। কিছু বলার আগেই শুনতে পেল এক পুরুষালী কণ্ঠ।
“কতকাল আর কাপুরুষের মতো বাচ্চাদের ইনকাম খাবি? এরচেয়ে জেলে গেলে কোনোরকম পরিশ্রম ছাড়া দুইবেলা রুটি আর একবেলা ভাত জুটে যাবে।”
এমন কথায় চরম রেগে গেল কবির। কার এত বড়ো সাহস? তাকে জেলের হু’মকি দেয়? কবির দ্রুত ক্ষিপ্ত হয়ে তার কাঁধ থেকে আগন্তুকের হাতটা সরিয়ে নিতেই মূহুর্তের মাঝেই কিছু বুঝের ওঠার আগেই ছিটকে পড়ে সে মাটিতে। কানের নিচের জায়গাটা টনটন করে ব্যথা করে ওঠে। হাতটা না চাইতেও চলে যায় সেই গালের জায়গাটিতে। আঙ্গুলে এসে ঠেকে তরল আর হালকা গরম এক পদার্থ। কাঁপা হাতে কবির গাল থেকে হাত সরিয়ে চোখের সামনে ধরতেই কনিষ্ঠা আঙ্গুলের মাথায় তাজা র’ক্ত দেখতে পেতেই চোখ তুলে তাকায় হাত চালানো সেই ব্যক্তির দিকে। নির্জনকে চিনতে খুব একটা ভুল হয় না কবিরের। কাঁপুনি বাড়ে তার। আজ সে কোনো দলবল নিয়ে আসেনি। সে ধরা পড়তে চায় না পুলিশের কাছে। কবির পিছিয়ে এলো। নির্জন এগিয়ে এসে তার পায়ের উপর পা তুলে দিতেই ব্যথায় কুঁকড়ে গেল সে। নিজের সমস্ত ক্রো’ধ অর্পন করতে ব্যস্ত নির্জন। আশেপাশে জমা হয়েছে ভীর। ভীরের মাঝে তাকে তার প্রিয় দুটো চোখও পর্যবেক্ষণ করছে সেটা নির্জনের অজানা। নির্জন হিসহিসিয়ে কবিরকে টেনে তোলে। কলার চেপে ধরে দাঁতে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
“জানো’য়ার একটা! লজ্জা লাগে না তাই না? বাচ্চাদের সাথে জঘ’ন্য কাজ করতে? লজ্জার বলিদান দিয়ে দিস নাকি তোরা?”
“ভালো হচ্ছে না অফিসার। পরিণাম ভালো হবে না। ছেড়ে দে আমায়! নয়ত আমার কাছে থাকা রি’ভলবার দিয়ে যে কারোর প্রা’ণ চলে যাবে।”
কবিরের বলা ঠুনকো হু’মকি বিন্দু মাত্র ভয় ধরাতে পারল না নির্জনের মনে। থমথমে সুরে জবাব দিল,
“রি’ভলবার চালাতে হাত লাগে। আর সেই হাত তুই কাজে পারবি না।”
নির্জন মুচড়ে ধরে কবিরের হাত। আর্তনাদে কেঁপে ওঠে আশপাশ। সকলে দূর থেকে হতবাক হয়ে চেয়ে দেখছে। কেউ কেউ কাছে এগিয়ে আসছে জানার জন্য। তবে তার আগেই কোনোমতে নির্জনকে ধা’ক্কা দিয়ে পালায় কবির। সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে শুরু করে নির্জন। মেইন রাস্তার জ্যামের মাঝে গাড়ির ফাঁক দিয়ে দুজনই দৌড়াচ্ছে। নির্জন ছোটার গতি বাড়াল। কবির প্রাণপণে চেষ্টা করছে কোনোরকমে বাঁচার। শেষ রক্ষা বুঝি হলো না। তার মাথাটুকু নির্জনের হাতের কবলে আসতেই সঙ্গে সঙ্গে সে ফে’লে দিতেই কবিরের মাথা গিয়ে লাগে বাসে। চারিপাশ অন্ধকার দেখতে পায় কবির। এরইমধ্যে বুকে অনুভব করে তীব্র ব্য’থা। বুকে হাত দিয়ে চিত হয়ে পড়ে যায় সে। নির্জন স্থির হয়ে দাঁড়ায়। বাসের থাকা সকলে, যানবাহনে থাকা যাত্রীরা বিস্ময়ে দেখে চলেছে দৃশ্য। নির্জন কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের ঘাড়ের একপাশ ধরে ঘাড় কাত করে দেখতে থাকল আ’হত কবিরকে। সময় নষ্ট করা যাবে না। কবিরকে দ্রুত ঘাড় ধরে তুলে অন্যহাতে দুটো হাত মু’চড়ে ধরল সে। এখন এর থেকেই হয়ত পাওয়া যাবে পরের কোনো অজানা তথ্য!
কবিরকে গাড়িতে তুলে হুড়মুড়িয়ে গাড়ির দরজাটা লক করল নির্জন। নয়নতাঁরা সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আশ্চর্য! এই আঁটকুড়ে লোকটাকে গাড়িতে তুললে কেন? ওর সঙ্গে গাড়ি শেয়ার করে কী করে যাব?”
“তোমায় এত কষ্ট করে এই ক্রি’মিনালের সঙ্গে গাড়ি শেয়ার করতে হবে না। তুমি রিকশা বা অটোতে করে বাড়ি এসো।”
বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় নয়নতাঁরা নির্জনের কথায়। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে জেদ ধরে বলল,
“মানছি না, মানব না। তুমি গাড়িতে এই ক্রিমি’নালটাকে এসি গাড়িতে নিয়ে যাচ্ছো আর আমি কিনা গরমে অটোতে যাব? নেভার এভার!”
নির্জন গাড়িটা স্টার্ট দিল। সামনে থাকা সানগ্লাস চোখে দিয়ে ফিচেল হেঁসে বলল,
“তাহলে অনশন শুরু করতে পারো নো প্রবলেম।”
ব্যস…আর কোনো উত্তরের অপেক্ষা করল না নির্জন। গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। পায়ের ধাপটা বিরক্তি নিয়ে জোরে ফেলে মুখটা জড়িয়ে ফেলল নয়ন। এখন কিনা অটোতে বাড়ি ফিরতে হবে?
পুলিশ স্টেশনের সামনে রাগিনীর গাড়িটা থামল। এখানেই তো থেমেছে কোহিনূরের গাড়ি। সে সচক্ষে দেখেছে। গাড়িটা তো বাহিরেই রয়েছে এখনো অবধি। রাগিনী তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নামল। নিজেকে এবার কেমন যেন পাগল পাগল লাগছে তার। কোহিনূরের সঙ্গে এই জায়গাটির সম্পর্ক কোনোমতে বুঝে উঠতে পারল না। অতিরিক্ত ভাবনায় বুকটা ধড়ফড় করছে। মনে মনে একটা কথা জেগে উঠল বারংবার! মানুষটিকে তবে শুধু শুধু ভুল বুঝে এলো নাকি সে? রাগিনী ভেতরে ঢোকার আগেই বাঁধা হয়ে দাঁড়াল দুটো কনস্টেবল। একজন শুধালো,
“কমপ্লেন বা জিডি করাতে এসেছেন নাকি?”
রাগিনী বুঝে উত্তর দিল,
“না। কোনো কমপ্লেন নেই।”
“তবে কেন এসেছেন? কোনো কমপ্লেন থাকলে ওই বিল্ডিং-এ যান। এইদিকে যাওয়া যাবে না। বড়ো স্যার ছোটোখাটো বিষয়ে দেখেন না। ব্যস্ত আছেন।”
রাগিনী শুধু হেলেদুলে ভেতরে দেখার চেষ্টা করল। তবে কোনোমতেই পেরে উঠলো না সে। আগ্রহ নিয়ে তাদের দুজনকে বলল,
“আচ্ছা, এখানে একজন লোক ঢুকলো। একজন আ’হত লোককে নিয়ে। ব্লু কোট পড়া ছিল। উনি কে?”
কনস্টেবল দুজন এবার বড়োই বিক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকাল। মেয়েটির এত কৌতূহল তাদের ভালো মনে ঠেকল না। শক্ত গলায় বলল,
“আপনার কি কোনো কাজ আছে এখানে? থাকলে বলেন। আমাদের বিষয়ে আপনাকে কেন কৈফিয়ত দেব? আপনি যান তো! আপনাকে তো সুবিধাজনক লাগছে না।”
রাগিনী কোনোমতেই বোঝাতে পারল না তাদেরকে। বরং যেন তারাই উল্টো চোখে তাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে। রাগিনীর অতিরিক্ত উত্তেজনার চোটে কান্নাও পেয়ে যাচ্ছে। সে হতাশ হয়ে পেছন ফিরে কয়েক ধাপ হেঁটে বাহিরে এলো। দৃঢ় নিঃশ্বাস ফেলে গাড়ির দিকে ধাবিত হলেও সবশেষে শোনা গেল এক কাঙ্ক্ষিত ব্যস্ততায় ভরা কণ্ঠ। রাগিনী ফিরে তাকাল তৎক্ষনাৎ। ফ্যাকাশে চোখেমুখে তখন অদম্য আগ্রহ। ফোনে কথা বলতে বলতে একমনে হেঁটে বাহিরে আসছে কোহিনূর। হাঁটাচলা, পোশাকে-আশাকে একটা চটপটে, দক্ষ, সাহেব রকমের হাবভাব। রাগিনী সবচেয়ে বেশি অবাক হলো তখন যখন দেখল দুটো কনস্টেবল তাকে স্যালুট করল। কোথাও একটা উত্তেজনা তড়তড় করে বাড়ল। নিঃশ্বাসের মাত্রা ঘন হয়ে এলো। কর্ণগোচর হলো মানুষটির উতলা কণ্ঠ।
“শোনো, ওখানে আমার মনে হয় অনেক বাচ্চা আছে যাদেরকে দিয়ে ভিক্ষা করানো হয়। যাদের শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গ বি’ক্রি করা হয়। আর কবির স্বীকার করেছে ইতিমধ্যে এক থেকে দেড় বছরের বাচ্চাদের কোলে নিয়ে কিছু মহিলা যে ভিক্ষা করে বেড়ায় তারাও একটা চক্র। সবটাই টেরো’রিস্টের মাস্টারমাইন্ডের খেল! ওদের রেসকিউ করার ব্যবস্থা করো। এজ স্যুন এজ পসিবল, আন্ডারস্ট্যান্ড মেহরাজ?”
অপরপাশে কী বলা হলো তা শুনতে পেল না রাগিনী। শুনতে চাইলও না। এলোমেলো পায়ে এসে কোহিনূরের সামনে পড়ল সে। ফোন কাটতেই সামনে এসে পড়া হৃদয় জুড়ে থাকা নিজের প্রিয়তমার এমন মুখটা দেখে থমকালো কোহিনূর। ফোনটা কোনোরকমে পকেটে রেখে নিজেকে শান্ত রেখে জিজ্ঞেস করল,
“রাগিনী! তুমি এখানে হঠাৎ?”
রাগিনীর কানে যেন পৌঁছালোই না কথাটা। তার মাথাটা ঘুরছে এবার। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে গমগমে আওয়াজে বলল,
“কে আপনি?”
কোহিনূর নিজেও থতমত খেয়ে গেল! কী বলছে মেয়েটা? এই সময় এসে কীসব প্রশ্ন করছে? সে কি মজা করছে? কোহিনূর কিছু না বুঝে অসাময়িক হেঁসে বলল,
“তোমার অপ্রিয়তম ব্যক্তি!”
“সেটা জানতে চাইনি। আপনার পরিচয় কী? আপনি কী করেন?”
“সেকী! শাহ্ রাশেদ স্যার কিছু বলেনি তোমায়? তোমায় যেদিন আমি তোমার বাড়ির পেছনের চিলেকোঠা থেকে রেসকিউ করি সেদিন তো উনাকে সব বলেছিলাম। আমি কে! কেন আমি তোমার বাবার হসপিটালে পেশেন্টের বেশে ছিলাম! কেনই বা আমাকে শত শত মিথ্যে বলতে হয়েছে। সব বলেছি। তোমায় উনি কিছু জানান নি?”
রাগিনী মনে করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। তার বাবা তাকে শুধু বলেছিল, এই মানুষটিকে ভুলে যেতে। দ্রুত রাগিনী মাথা নাড়ায়। বিড়বিড়িয়ে বলে,
“কেউ কিছু বলেনি আমায়। আপনার রুমে আমি রি’ভলবার পেয়েছিলাম। আপনার শতশত মিথ্যের মাঝে আপনাকে শুধু আমার জীবনের সবচেয়ে বাজে অপ্রিয় চরিত্র মনে হয়েছে। কিন্তু কেন করেছিলেন ছলনা? আপনি টেরো’রিস্ট নন?
কোহিনূর হতাশ ভঙ্গিতে তাকায়। সত্যিই মেয়েটা জানে না সে আসলে কে? কেন বলেছিল এত মিথ্যা? সে নির্লিপ্তে স্বীকার করে বসল,
” আমি কেন টেরো’রিস্ট হতে যাব? যাদেরকে ধরতে আমি মিশনে নেমেছি তাদের জন্যই আমার এত ছলনা।”
কোহিনূর থামল। ঢক গিলে বলল,
” রাগিনী, আমি নির্জন আহমেদ কোহিনূর। দ্যা লিডার ওফ সিক্রেট টিম পুলিশ ডিপার্টমেন্ট।”
চলবে…
[বি.দ্র. শ্বাস ফেলার সময় পাইনি বিগত ক’দিন ধরে। বিয়ে মানে অনেক ব্যস্ততা। তিনদিন ব্যাপী বিয়ে! দৌড়াদৌড়ির ওপর ছিলাম। তার উপর পরীক্ষা তো লেগেই আছে। আজও পরীক্ষা ছিল। কয়েকদিন পরীক্ষা বন্ধ তাই গল্প দিতে পেরেছি। অনেকের অভিযোগ আমি জানি। দেরিতে গল্প দিই বিগত কয়েকদিন ধরে তাই বেশ পাঠক হারিয়েছি। তবে মানুষ হিসেবে আমার সমস্যা, অনুষ্ঠান বলেকয়ে আসেনি। আমি প্রথমে নিয়মিত ছিলাম। হঠাৎ অনিয়মিত হবার কারণ একবারও কেউ ভেবে দেখেনি। ইচ্ছে করে এমন করিনি আমি। ১ম খণ্ডের অন্তিম পর্ব পুরোটা হয়ত ফেসবুক সাপোর্ট করবে না। তাই অর্ধেক করে দিলাম। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাকি অংশ কাল পেয়ে যাবেন।]