#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৮
উপস্থিত সকলের চোখে তাক লেগে যায় এবং নিস্তব্ধতা বিরাজ করে নির্জনের বলা কথা শুনে। নির্জন থামে না। বরং দম নিয়ে বলতে শুরু করে,
“ইয়েস আমি ঠিকই বলেছি। হাতে সময় কম ছিল আমার। আমি ধরতে পেরেছিলাম এখানে মা*ইন ফিট করা ছিল। জানতে দেরি হয়েছে। তবুও যতটুকু করা সম্ভব হয়েছে ততটুকু করেছি। আই এম সরি স্যার! হয়ত আমার অসাবধানতার জন্যই আজকে আমাদের টিমের আরেকজন মেম্বার কমে গেল। শাহিদকে আমি পাঠিয়েছিলাম আমার সন্দেহ করা রাগিনী তাজরীনকে ফলো করতে। পরে ওর সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে বুঝতে সময় লাগেনি যে হয়ত কিছু একটা ঘটে গেছে। তাই আমি শাহিদের লাস্ট লোকেশন ট্র্যাক করে এই পর্যন্ত আসি। আশপাশ খুঁজে ফ্যাক্টরির পেছনে খুঁজে পাই শাহিদের মৃ’তদেহ। বুঝতে পারি এখানেই কোনো গোলমাল আছে। আমি এই জায়গা সিল করে দিয়েছি আর এখানকার সবাইকে বলে দিই কাজ বন্ধের জন্য। দ্রুত লোকজন দিয়ে এখানকার মেটেরিয়ালস্ সরিয়ে ফেলি। অনেক খুঁজেও পাইনি কিছু। তাই হাল ছেড়ে দিই। আমার অনুমান অনুযায়ী এখানে ব্লা*স্টও হয়ে যায়। আর যতটুকু ক্ষতি হয়েছে তার জন্য আই এম সরি!”
সকলে স্তব্ধ হয়ে রইল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। নির্জনও এবার ক্ষ্যান্ত হলো। নির্জন জানে এবার কারোর মুখ থেকে কথা বের হবার নয়। সে সবাইকে পাশ কাটিয়ে মেহরাজের নিকটে গিয়ে ব্যস্ত থাকার ভান ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। ইন্সপেক্টর রায়ানের নজর তবুও তার থেকে সরছে না। অফিসার নির্জন নামক ব্যক্তিটি ভীষণই অদ্ভুত। ঠিক সময়ে ঠিকভাবে কি করে পরিস্থিতি খুব ঠান্ডা মাথায় সামলাতে হয় সেটা সে খুব ভালো করে জানে। রায়ান কিছুটা মুগ্ধ হলেও তা প্রকাশ করে না। চুপ থাকে। এসপি অফিসারের কন্ঠে নির্জনের থেকে মনোযোগ সরায় রায়ান।
“আমার এখন মনে হচ্ছে কেসটা আমি সঠিক জনের হাতে তুলে দিয়েছি। এই কেসটা একমাত্র অফিসার নির্জন সমাধান করতে পারবে। হি ইজ সাচ অ্যা ব্রিলিয়ান্ট পারসন! তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিই একমাত্র এতোদিনের এই পুরোনো কেসকে সলভ করতে পারবে।”
বলে থামলেন এসপি অফিসার। আবারও বলে উঠলেন,
“ওয়েট! অফিসার নির্জন কার যেন নাম বলল। রা…রাগিনী নাম! এই রাগিনীটা কে?”
রায়ানের নিরবতা ভাঙ্গে এবার। বলে ওঠে,
“রাগিনী তাজরীন! সাইকোলজিস্ট শাহ্ রাশেদের একমাত্র মেয়ে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে সাইকোলজি নিয়ে। আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায় রাগিনী যখন পরীক্ষা দিয়ে ঢাকায় ব্যাক করে সেই টেরো*রিস্ট টিমও সেই সময় চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকায় আসে। তাও আবার চট্টগ্রামে বিগ এনাউন্সমেন্ট করে এসেছে সেই টিম। বলেছে তারা ধ্বংস করে তবেই বিদায় হবে। আরেকটা কথা, ট্রেনে যেদিন চেক আউট করা হচ্ছিল তখন ব্যাগে যেই বো*ম বানানোর যন্ত্রপাতি সব পাওয়া গিয়েছিল সেটা রেখে সেই ব্যাগের মালিক পালিয়েছিল। আর একজনের বর্ণনা অনুযায়ী সে রাগিনী তাজরীন ছিল। তার থেকে স্কেচ এঁকে নেওয়া হয়েছে। স্কেচটা রাগিনীর সাথে মিলে যায়। এর বেশি আমার জানা নেই স্যার।”
এসপি অফিসার সবটা মনোযোগ দিয়ে শুনে বেশ কিছুক্ষণ কিছু একটা ভাবলেন। তারপর বললেন,
“জানা নেই এর সত্যতা কতটুকু। যদি সত্যিই তা হয় তাহলে নির্জনকে সঠিক প্রমাণ খুঁজে বের করতে হবে। কারণ এতো বড় অপরাধের দায়ে আমরা সঠিক এবং উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া কাউকে অভি’যুক্ত করতে পারব না।”
রায়ান মাথা নুইয়ে বলে,
“ইয়েস স্যার!”
আজ ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছে রাগিনীর। প্রায় দশটা বেজে গিয়েছে। ঘুমাবে কি করে? সারারাত তো আজগুবি চিন্তাভাবনা মাথায় ঘুরঘুর করছিল। কল্পনার মি. সাহেব কোহিনূর তাকে ঘুমোতে দেয় নি একদম। চোখ বুঁজলেই দেখা দিয়ে আর তার মারাত্মক হাসি দিয়ে বিরক্ত করেছে। চোখ খোলা রাখলেও বিরক্ত করেছে। সব মিলিয়ে রাত পার হয়ে গিয়েছিল ঘুমানোর চেষ্টা করতে করতে। তাই তো আজ এতো দেরি। অবশ্য ফ্রেশ হয়েই নিজেকে তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছে সে। একটা হলুদ রঙের লং জামা এবং তার উপরে সাদা ওড়না পেঁচিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো সাইড করে বেনী করে ছেড়ে দিল সে। তারপর খেয়াল করল ড্রেসিং টেবিলের পাশে সদ্য ফোঁটা কাঠগোলাপগুলো পড়ে আছে। তাদের বাড়ির পেছনে বড় কাঠগোলাপের গাছ থেকে মাটিতে পড়ে ছিল ফুলগুলো। রাগিনী ফুল পছন্দ করে বলে সৈয়দ মাঝে মাঝেই কুড়িয়ে এনে রেখে দেয় রাগিনীর ঘরে। তা দেখে রাগিনী একটা একটা করে ফুল হাতে গিয়ে চুলের বেনীর প্রতিটা ভাঁজে লাগিয়ে নেয়। চুল ঠিকঠাক করে নিজেকে দৃঢ় নয়নে পর্যবেক্ষণ করে দেখে খুব একটা খারাপ লাগছে না তাকে। ভালোই লাগছে। কিন্তু কান ফাঁকা ফাঁকা লাগছে!
ড্রয়ার থেকে বের করে ছোট্ট দুটো ঝুমকো দুই কানে পড়ে রাগিনী। হাতে একটা একটা করে সযত্নে পড়ে নিল হলুদ ও সাদা রেশমি চুড়ি! তারপর হাত ঝাঁকাতেই ঝনঝন করে উঠল তার হাত। শব্দটা কানে আসতেই হালকা শব্দ করে হাসে রাগিনী। তারপর উঠে যায় আয়নার সামনে থেকে।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে একটু কষ্ট হচ্ছে রাগিনীর। পায়ের ব্যথা রয়ে গেছে এখনো একটু। হাতটা এখনো আগের মতোই ব্যান্ডেজ করা। সেদিকে খেয়াল নেই ততটা। দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলেছে সে। তার নামার ধরণ দেখে সৈয়দ খেয়াল করে বলে উঠল,
“রাগিনী মা, এতো তাড়াহুড়ো করে নামছো কেন? তোমার পায়ে তো লাগা আছে। হাতের অবস্থাও তো ভালো নয়। এই অবস্থায় তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাচ্ছো?”
কথা শোনার নয় রাগিনী। ছুটে গিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে রাগিনী। আর বলে,
“সৈয়দ কাকা! তোমাকে যে বলেছিলাম টিফিনবক্সে খাবার রেডি করতে সেটা করেছো?”
“হুমম করছি। কিন্তু এতো সকালে কই যাচ্ছো? স্যার জানে তুমি যাচ্ছো বাহিরে?”
“আমি কথা বলে নেব। এখন তাড়াতাড়ি আমাকে একটু খাবার দাও তো। হাতে একদম সময় নেই জানো তো! জলদি করো।”
সৈয়দ এগিয়ে এসে রাগিনীকে খাবার বেড়ে দেয়। খাবার মুখে দিয়ে বিড়বিড় করে বলে ওঠে,
“ইশশ… কোহিনূর সাহেব বোধহয় না খেয়ে বসে আছেন এখনো!”
সৈয়দের বুঝতে বাকি থাকে না রাগিনী কোথায় যাচ্ছে! তিনি গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে কিছুটা শান্ত ভঙ্গিতে বললেন,
“রাগিনী মা! তোমার কি মনে হয় না তুমি ওই পাগলটাকে নিয়ে একটু বেশিই চিন্তাভাবনা করছো?”
রাগিনীর খাওয়া বন্ধ হলো। সৈয়দের কথা বোঝার চেষ্টা করে বলে উঠল,
“আমি শুধু উনাকে তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। এখানে অতিরিক্ত তো কিছুই করিনি। আর কাকা! উনার একটা নাম আছে। সেই নাম ধরে সম্মোধন করলে ভালো লাগে।”
বলেই ভার মুখে খাবার খাওয়া আরম্ভ করে রাগিনী। সৈয়দ আর কিছু বলেন না। কিই বা বলবে? যদি রাগিনী রেগে যায়?
অল্প খেয়ে উঠে গেল রাগিনী। নিজ গন্তব্যের জন্য বেরিয়ে গেল দ্রুত!
সকাল সকাল ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে বসে আছে কোহিনূর। মুখে নেই কোনো হাসি শুধু রয়েছে তিক্ততা। গোমড়া মুখ করে চেয়ে আছে দরজার দিকে। দরজা অনবরত বাহির থেকে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে আজিম। আজ সে এসেছে সকালের খাবার নিয়ে। কিন্তু খাবার নিয়ে আসা দেখেই কোহিনূরের দরজা লক করে দেওয়া শেষ। সে এখন ঘরে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। এতো দরজা ধাক্কানোর শব্দে ক্ষুদ্ধ সে। হঠাৎই তার ক্ষুব্ধ মনে সুভাসের সঞ্চার হয়ে এলো রাগিনীর কন্ঠস্বর। দরজায় হালকা থাবা দিয়ে নমনীয় কন্ঠে ডাকছে রাগিনী। কোহিনূরের ঠোঁটের প্রান্তে মূহুর্তেই চলে আসে এক রাজ্য জয়ের অদ্ভুত হাসিটা। দেরি না করে তড়িঘড়ি করে গিয়েই খুলে দেয় দরজা।
আচমকা দরজা খোলাতে চমকে উঠে তাকায় রাগিনী। তার বাম হাতে টান পড়ে। চাপ পড়ে ঠিক কাটা জায়গায়। চিৎকার করবার আগেই তাকে ঘরের ভেতরে টেনে আনা হয়। আর বসিয়ে দেওয়া হয় অগোছালো বিছানায়। ততক্ষণে রাগিনী চোখ খিঁচে ফেলেছে ব্যথায়। হাত যেন ছিঁড়ে গেছে। বড়বড় শ্বাস ফেলতে থাকে সে। বাম হাতটা কাঁপতে থাকে অনবরত। আকস্মিকভাবে রাগিনীর এমন রূপে হতবিহ্বল নয়নে দৃষ্টিপাত করছে কোহিনূর। মুখে কোনো শব্দ আসছে না। শরীরে নেই কোনো গতি। তার সামনে এক অপরূপ নারী। বেনী করে বেঁধে রাখা চুলগুলোতে আঁটকে রাখা কাঠগোলাপেই চোখ আটকায় তার। খুঁটিয়ে দেখা শুরু হয় কোহিনূরের। রাগিনীর ঠোঁটে হালকা করে লিপ গ্লোস লাগানো। সেই ঠোঁটে গিয়ে আঁটকে গেছে কিছু ছোট চুল। না চাইতেও কোহিনূরের হাত চলে যায় সেখানে। আলতো করে ছুঁইয়ে সরিয়ে দেয় সেই ছোট চুল। কানে সুন্দর করে গুঁজে দিতেই তার খেয়াল হয় সে কি করছে? তড়তড় করে হাত সরিয়ে নেয়। পুরো শরীর কেঁপে ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে তার। খেয়াল করে তার কন্ঠস্বর শুঁকিয়ে এসেছে। নারীর রূপের ঝলক বুঝি এতোই তীব্র হয় যে একজন পুরুষের গলা শুঁকিয়ে আসে? হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়? কোহিনূর না চাইতেও অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,
“এতোগুলো কাঠগোলাপের ভেতরে থাকা এক বড় কাঠগোলাপ এই মানবী। যেই কাঠগোলাপের সৌন্দর্য সব থেকে বেশি চোখে পড়ছে আমার! চোখটা যেন ঝলসে যাচ্ছে।”
এতোক্ষণ অবধি চোখটা বন্ধ রেখেছিল রাগিনী। হাতটা ব্যথা যে নাড়ানো যাচ্ছে না একেবারেই। কিন্তু কোহিনূরের স্নিগ্ধ সেই কন্ঠে অদ্ভুত সব বাক্য শুনে যেন চোখটা আপনাআপনি খুলে গেল। একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকালো কোহিনূরের দিকে। লোকটা তাকে বুঝি মনোযোগ দিয়ে দেখেছে? এই সাজ বুঝি তার পছন্দ হয়েছে? রাগিনীর মনটা না চাইতেও খুশিতে নেচে ওঠে। এ কেমন মনের এক অনাকাঙ্ক্ষিত অনুভূতি? না চাইতেও এই অনুভূতির প্রবেশ কেন?
চলবে…
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সন্ধ্যা থেকে একটু ব্যস্ত ছিলাম বলে গল্প ছোট হয়েছে আর আজ বেশিই দেরিও করে ফেলেছি। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। জানি, অনেকের মাঝে উত্তেজনা রয়েছে আর কনফিউশান রয়েছে যে আসলে গল্পের যেই রাগিনী চরিত্র আসলে কেমন? ভালো না খারাপ! এটা নিয়ে অনেকেই দ্বিধায় ভুগছেন। এটা আমি আস্তে আস্তে ক্লিয়ার করব।]