শুভ্রতায় নবনীতা – পর্ব ১২

0
348

#শুভ্রতায়_নবনীতা
#নবনীতা_নীরু
পর্বঃ ১২

চোখ খুলে যখন তাকাই তখন ঝাপসা চোখে নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করলাম।ছোটবেলা থেকে নিজের বা কারও জন্য তেমন হাসপাতালে আসতে হয় নি তাই বুঝতে পারছি না এটা হাসপাতালের শুধু সাধারণ রুম নাকি অন্যকিছু।চারপাশে তাকিয়ে দেখব তার কোন অবস্থা নেই,মানে মাথা নাড়াতে পারছি না।হাত পা ভারি হয়ে আছে।অনেকক্ষণ হয়ে গেল পিটপিট করে তাকাচ্ছি আর চোখ বন্ধ করছি।কিছুক্ষণ পর নার্স এসে আমার তাকানো দেখে ভূত দেখার মত আচরণ করে দৌড়ে বাহিরে চলে গেল।দুই তিন মিনিটের মধ্যে কিছু ডাক্তার নার্স আর নিহান স্যার ঢুকলেন।
ডাক্তার আমার চেকআপ করছেন, দূরে দাঁড়িয়ে আছেন নিহান স্যার আর বাবা।মা আর তুশি বাহিরে দাঁড়িয়ে কান্না করছে।আমি চুপ করে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছি আর মনে করার চেষ্টা করছি সেদিন কি হয়েছিল তারপর?নাহ কিছুতেই মনে পড়ছে না।
— আজকে মিস নবনীতার অবস্থা অনেকটা ভাল।উনার আশা তো প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম,বলতে পারেন উনাকে আল্লাহ দ্বিতীয় জীবন দিয়েছেন।(ডাক্তার)
— হ্যাঁ স্যার আমরা তো ভেবেছিলাম রোগীর হয়তো আর জ্ঞান ফিরবে না।(নার্স)
— আচ্ছা উনাকে এখন একটু রেস্ট নিতে দেন,উনার এখন রেস্টের প্রয়োজন অনেক।(ডাক্তার)
— থ্যাংক ইউ সো মাচ স্যার।(নিহান স্যার)
— আসছি থাকুন,রোগীর খেয়াল রাখবেন।দুই একজন করে রোগীর পাশে এসে দেখা করতে পারেন তবে বেশি কথা বলবেন না প্লিজ।

ডাক্তার চলে যেতেই মা বাবাকে ডেকে বাহিরে নিলেন কি যেন বলছেন।নিহান স্যার আমার দিকে এগিয়ে এসে পাশে রাখা চেয়ারটায় বসলেন।
— কেমন লাগছে এখন?
— আমি চোখের পাতা ফেলে মুখে হাল্কা হাসি দিয়ে বুঝালাম এখন একটু ভালো আছি।
— নীরু তোমার এই অবস্থা দেখে কেঁদেই যাচ্ছে, আমি ওকে কথা দিয়েছিলাম ওর মানিকে আমি ওর কাছে সুস্থ করে ফিরিয়ে দেব।
— আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে নীরুকে খুঁজতে থাকলাম কিন্তু পেলাম না।
— নীরু এখন একটু ঘুমাচ্ছে,বাবা ওকে বাসায় নিয়ে গেছে।

— আচ্ছা আমি বাহিরে গিয়ে দাঁড়াই,তুমি তোমার বাবা মা আর বোনের সাথে দেখা কর,উনারা এ কয়েকদিন খুব কান্নাকাটি করেছে।
আমি আস্তে আস্তে কথা বলার চেষ্টা করলাম।
— ক কত দ দিন?
— তুমি এখনি কথা বলার প্রেশার নিও না।তুমি এক্সিডেন্ট এর পর প্রায় এক সপ্তাহ সেন্সলেস আছো।
— এক সপ্তাহ!!
— হ্যাঁ। থাকো ডেকে দেই
— আবার কখন আসবেন?
— দেখি কখন আসা যায়।
বলেই উনি বাহিরে চলে গেলেন।মা বাবা আর বোন ভেতরে এলো। সবাই এসে আমার পাশে বসলো।মা আর তুশি তো আমাকে দেখে কেঁদে দিল।বাবার চোখ ছলছল করছে।
— কেঁদো না তোমরা।তুশি কাঁদিস না বোন।
— তুই জানিস আমাদের কি অবস্থা হয়েছিল তোকে ওরকম দেখে।মা তো অসুস্থ হয়ে গেছিলো।আর বাবা তার কথা তো বলাই যাবে না।আমি বাবাকে কখনও ওভাবে কাঁদতে দেখি নি।
কাঁদতে কাঁদতে তুশি কথাগুলো বলল।
— নবু বিশ্বাস কর মা তোর এই মা না তোকে খুব ভালোবাসে রে খুব ভালোবাসে। তুই প্রথম আমাকে মাতৃত্বের অনুভূতি জাগিয়েছিস।তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাবি ভেবেছিলি কিভাবে?আমি তোকে কোথাও যেতে দেব না।
সবার কথা শুনে আর কান্নাকাটি দেখে খারাপ লাগছিল আবার একটু ভালো ও লাগছিল সবাই আমাকে কত ভালোবাসে।বাবা মা আর তুশি অনেকক্ষণ ছিল বসে।
— তুশি তুই এখানে আপার কাছে থাক কেমন?আমি আর তোর বাবা বাড়ি থেকে একটু ঘুরে আসি।আর আবিরদের বাড়িতেও তো খবর দিতে হবে যে নবনীর জ্ঞান ফিরেছে।
— আচ্ছা মা।
মা বাবা বেড়িয়ে গেল।তুশি আমার কাছে বসে আছে।মেয়েটার চোখমুখের কি অবস্থা করেছে এ ক’দিনে।আমার কেমন যেন ঘুম ঘুম পেল,তুশিকে বলতেই তুশি বলল আপা তুই ঘুমা আমি আছি এখানে তোর ভয় নেই।

ঘুম ভাঙলে দেখি সামনে আজমল চাচা আর ও বাড়ির কয়েকজন। মা এসে আমাকে ধীরে ধীরে তুলে বসালেন।
সবাই অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলল।মিখি ও এসেছে সবার সাথে।
— কেমন লাগছে মা এখন?(আজমল চাচা)
— জ্বী আলহামদুলিল্লাহ।
— আমরা তোমার খবর পেয়ে সাথে সাথে ছুটে এসেছিলাম।আনন্দের মাঝে এত বড় একটা দূর্ঘটনা ঘটে যাবে বুঝতেই পারি নি।
সবাই অনেক কথাবার্তা বলল।নার্স এসে সবাইকে বাহিরে যেতে বললে একে একে সবাই বাহিরে চলে গেল।
প্রায় আধাঘন্টা পর তুশি এলো ভেতরে।
— আপা আজকে থেকে তোকে একটু করে খেতে হবে,এতগুলো দিন কিচ্ছু খেতে পারিস নি।
— কি খাব এখন?
— নিহান ভাইয়া তোর জন্য স্যুপ নিয়ে এসেছে।বারে বারে বয়েল করে খাইয়ে দিতে বলেছে।
— কোথায় উনি?আসবেন না?
— উনি তোকে দেখে অফিসে চলে গেছে আর খাবার দিয়ে গেছে।
— আচ্ছা।আবার কখন আসবেন?
— তা তো বলে যায় নি, হয়তো রাতে আসবে।উনি তো তোকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর থেকে বেশির ভাগ সময় উনিই এখানে ছিল।
— নীরু তো আসলো না এখনও আমাকে দেখতে?
— ভাইয়া বলল আঙ্কেল নীরুকে স্কুল ছুটির পর আবার নিয়ে আসবে,সকালে নিহান ভাইয়া,আঙ্কেল, নীরু সবাই এসে তোকে দেখে গিয়েছে।নে এবার খেয়ে নে।
তুশি আমাকে স্যুপ খাইয়ে দিল,মেয়েটা এখন মায়ের অনুপস্থিতিতে মায়ের ভূমিকা পালন করছে,
–কত বড় হয়ে গেছিস রে বোন!
— বড় বোন অসুস্থ থাকলে,ছোট বোনকে তো বড় হতেই হবে।আচ্ছা তুই এখন রেস্ট নে।
— আচ্ছা।
— ওহ আচ্ছা একটা কথা।
— হ্যাঁ বল।
— আবির ভাইয়া এসেছে দেশে।মিখি আপু বলল আবির ভাইয়াকে এখনও কিছু জানানো হয় নি। বিকেলে নিয়ে আসবে হাসপাতালে। ভাইয়া নাকি রাতেই এসেছে বাড়িতে।
— আচ্ছা ঠিক আছে।
— ডাক্তার বলেছে আর সপ্তাহখানেক এখানে থাকলেই তুই সুস্থ হয়ে যাবি।

তুশি আমাকে খাইয়ে রেস্ট নিতে বলে বাহিরে গেল।তুশি যাওয়ার সময় আমার ফোনটা দিয়ে গেছে।সেদিন ফোনটা আমার কাছে থাকলে আমার মতো ফোন ও অসুস্থ হয়ে যেত বা ইন্তেকাল করত।সেদিন বের হওয়ার সময় ফোন রান্নাঘরে রেখেই বেরিয়ে গিয়েছিলাম।
পিছনে হেলান দিয়ে বসে ফোন টিপছিলাম।এমন সময় নার্স এলো।
— কি ব্যাপার নবনীতা আপু?শরীরটা কি ভাল লাগছে এখন?
— হ্যা আজকে অনেকটা ভাল লাগছে।
— স্যার তোমার যেভাবে খেয়াল রাখছে!
— কোন স্যার?
— নিহান স্যার আবার কে!আমরা তো প্রথমে তোমাকে দেখে একদম অবাক,তুমি স্যারের ওয়াইফের মত দেখতে।উনি আমাদের হাসপাতালেই মারা গিয়েছিলেন বাচ্চা হতে গিয়ে।আর তোমার যত খরচ উনিই দিচ্ছেন এখন পর্যন্ত।
— কি বলেন!
— হ্যাঁ তাই তো।আচ্ছা তুমি এখন বিশ্রাম নাও আমি আসছি।
নার্স বেরিয়ে যেতেই ভাবতে লাগলাম এতকিছু করছে আমার জন্য?আর আমি কি না স্যারের অসুস্থতার সময়…….ছি!!
বিকেলে তুশি আবার এসে আমাকে খাইয়ে দিয়ে গেল।ওর এ সময় পরিক্ষা চলছে তবুও সে এখানে আসা ছাড়ছে না।আমি কতবার নিষেধ করলাম আসতে তবুও আসে।পরিক্ষার সময় একটু বসে বসে পড়বে তা না এখানে আসছে বারবার।

কিছুক্ষণ পর তুশি আবার ফিরে এলো,
— কি রে আবার আসলি যে?
— একটু পর তো আবির ভাইয়ার আসার কথা তাই ভাবলাম থেকেই যাই,তোদের প্রেমালাপ শুনবো বসে বসে।
— কিন্তু বই কেন?
— এখানে বসে বসে পড়ি যতক্ষণ না আসে।
— খুব পেকে গেছিস তাই না?
— বড় বোন কাচা হলে ছোটবোনদের একটু পাকতেই হয়।
— একটু না অনেকটাই পেকে গেছেন।
— তোর তো গর্ব হওয়ার কথা।
— হ্যাঁ অনেক গর্ব আমার আপনাকে নিয়ে।
দুবোন বসে বসে কথা বলছিলাম।এমন সময় বাহিরে থেকে কেউ বলল আসব বউমণি?
তাকিয়ে দেখি মিখি।

চলবে…….

নবনীর চিন্তায় কে কে ছিলেন??এখন ভালো লাগছে তো!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here