রোদেলা,পর্ব: ৬২

0
888

#রোদেলা,পর্ব: ৬২
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু

খুব সকালে ঘুম ভাঙে সুফিয়ানের। যদিও রোদেলার সাথে দেখা হবে সেই বিকেল ৩ টায়, তবুও দ্রুত ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে একটা কাজে বাইরে যায়।

এদিকে রোদেলাও সকাল সকাল উঠে তৈরী হয় ইউভার্সিটির উদ্দেশ্যে। আজ বহুদিন পর ও শাড়ি পরে। শাড়ি পরায় ঝামেলা হওয়ায় বরাবর এড়িয়ে যায় ও। তবুও কেন যানি ইচ্ছে হলো শাড়ি পরতে। শাড়িটা গত ইদে রুবিন আঙ্কেল পাঠিয়েছিলেন। হালকা কলাপাতা আর বেগুনী পাড়ের জামদানী । তিনি প্রতি ইদেই তার শ্বশুরবাড়ির সবার জন্য দেশীয় কাপড়চোপড় শপিং করে পাঠান। রোদেলা এখানে আসার পর থেকে নিয়ম করে ওর জন্য ও পাঠান। শাড়িটা যত্ন করে পরলো ও। সাজসজ্জা ও সবসময় এড়িয়ে চলে, এটাকে ওর মনে হয় সময়ের অপচয়। সাজলে ওকে পেত্নীর মতো লাগে। তাছাড়া এখানে যে জীবন যাপন করে ও প্রায় সময়ই দুপুরের খাবারের সময় থাকে না, সাজগোজ তো পরের কথা। এজন্য নানু প্রায়ই রাগারাগি করেন। কিন্তু কিছু পেতে হলে তো তার মূল্য পরিশোধ করতে হয়। আজ যে অবস্থানে ও এসেছে তা ওর এই পরিশ্রমেরই ফসল। এসব ভাবতে ভাবতে লম্বা ওভারকোটের গায়ে জড়িয়ে দ্রুত নেমে গাড়ি হাঁকিয়ে রওনা দেয় রোদেলা।

সুফিয়ান যথাসময়ে বাড়ি পৌঁছে তৈরী হয়ে চেষ্টারের উদ্দেশ্যে। ব্লু রঙের শার্টের উপর ধূসর রঙের ব্লেজার, আর জিন্স প্যান্ট। হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে চিরকুটটা এক ঝলক দেখে নেয়। গাড়িটা সকালে পরশ নিয়ে বের হয়েছে। ও তাই উবার ডাকে।

গাড়ি যখন চেষ্টার ঢুকে। ইউনিভার্সিটির একটু কাছেই নেমে পরে সুফিয়ান। মুক্ত বাতাসে চিন্তা গুলো গুছিয়ে নিতে চায় ও। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে দুপুর আড়াইটা বাজে। লাঞ্চ করা হয় নি, পরশের বউ বলেছিলো লাঞ্চ করে বের হতে৷ কিন্তু ও তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যায় ব্যাস্ততা দেখিয়ে।

তিনটা বাজতেই কল করে রোদেলাকে, কল বেজে কেটে যায়। আবারও কল না দিয়ে ছোট্ট একটা ম্যাসেজ করে…
অপেক্ষা করতে থাকে রোদেলা আসার।

ঘন্টা খানিক হতে চললো তবুও কল কিংবা ম্যাসেজ কোনটারই খবর নেই, তিনটা থেকে চারটা এই একঘন্টা সময় পেরুতে কি যে কষ্ট হয়তো গত পাঁচ বছরের অপেক্ষায় এমন কষ্ট ছিলো না। মনকে শাসন করে সুফিয়ান।
ধীর বৎস, ধীরে….

আরো কিছু সময় পর কল করে রোদেলাকে। রোদেলা রিসিভ করে বলে
: আমি খুবই সরি, দেরি করে ফেলায়, আমি হোয়াটসঅ্যাপে
একটা লোকেশন পাঠাচ্ছি, আপনি সেখনে বসুন আমি পনেরো মিনিটের মধ্যে আসছি….

সুফিয়ান কিছু বলার আগেই কলটা কেটে যায়। অগত্যা ফোনে দেয়া লোকেশন ট্রেস করতে করতে পৌঁছে যায় একটা রেস্টুরেন্টে। দ্যা ফ্লাওয়ার কাপ….
ভিতরে ঢুকতেই চোখ জুড়ালো যেন। খুবই সুন্দর ভাবে ডেকোরেশন করা। রেস্টুরেন্টটি মোটামুটি ফাঁকাই, এক কোণের একটি টেবিল দেখে বসে পরলো সুফিয়ান যাতে এখানে ঢুকলেই ওকে চোখ পরে রোদেলার।

পনেরো মিনিট মানে পনেরো মিনিটই…
রোদেলা ঠিক পনেরো মিনিটের মাথায়ই পৌঁছালো রেস্টুরেন্টের কাছে। গাড়িটা সাইডে পার্ক করতেই তা নজরে আসে সুফিয়ানের। ভেতরের স্পন্দন যেন বেড়ে যায়। রোদেলাকে এখনো দেখে নি সুফিয়ান, গাড়ি দেখেই এ অবস্থা। এমন হওয়ার তো কথা না…

অবশেষে রানীর বেশে গাড়ি থেকে নামলো রোদেলা। রেস্টুরেন্টের স্বচ্ছ দেওয়াল ভেদ করে সুফিয়ানের দৃষ্টি রোদেলাতে। কি মনে করে যেন গাড়ির দড়জা আবার খুলে গায়ের ওভার কোটটা রাখলো। আজ ভালোই রোদ উঠেছে। ঝকঝকে আকাশ….
কলাপাতা রঙের শাড়ীটায় বেশ লাগছে রোদেলাকে। ঠিক যেন ইংল্যান্ডের বুকে এক টুকরো বাঙালী আবেশ। রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই মুচকি হাসির বিনিময় হলো ওদের। উঠে দাঁড়ালো সুফিয়ান। আপাদমস্তক এক ঝলক ও দেখলো রোদেলাকে। শাড়ীর ভাজে আর চোখের কাজলে লেপ্টে আছে ক্লান্তি। তবুও ওর সৌন্দর্য যেন একটুও ম্লান হয় নি। মনে হচ্ছে এই যে ক্লান্তি চোখেমুখে আর শাড়ির ভাঁজে তা ওর সৌন্দর্যেরই একটা অংশ৷ মনে মনে আফসোস করে সুফিয়ান
-নিশ্চয়ই আজ খুব ধকল গেছে ওর…

রোদেলা চেয়ার টেনে বসে বলে- খুব সরি, অপেক্ষা করাবার জন্য, আসলে একটা পেপার নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় দেরী হয়ে গেলো। তারপর…. লাঞ্চ করা হয়েছে….?
অপ্রস্তুত সুফিয়ান কিছু না বুঝেই বললো
: হুম,
চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুসময়, তারপর বলে-
: মিথ্যে ও বলতে পারেন দেখছি…
মুচকি হাসে সুফিয়ান…
: চেহারা শুকিয়ে আছে…
ঠিক বোঝা যাচ্ছে দুপুরে খাওয়া হয় নি, আমিও খই নি কিছু…
আচ্ছা…. এখানে লাঞ্চের একটা সিগনেচার আইটেম রয়েছে সেটা অর্ডার করি…
: হুম, সিউর….
: খাওয়া শেষে এখানকার কফি…
: ওকে….
: এখানে ওরা কফিটা বেশ ভালো তৈরী করে।
খাবার অর্ডার করে টুকটাক কথা বলতে শুরু করে ওরা। সুফিয়ান ওর কাজের ধরন, পড়াশোনার প্রেশারসম্পর্কে জানতে চায়, রোদেলাও ওর কাজ আর পড়াশোনার ব্যাপারে বলে সুফিয়ানকে। হালকা কথাবার্তা….

সুফিয়ানের ভিতর গুটুর গুটুর করে….
কিছু কথা গালার কাছটায় আটকে আছে যেন বের হওয়ার অপেক্ষায়। অনেক কষ্টে সংযত করে নিজেকে। কিছু কথা জিজ্ঞেস করবার লোভ যেন তর সইছে না। তবুও হাবিজাবি কথাবার্তা চালাচালি হয় দুজনের….
রোদেলারও একই অবস্থা…
ও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সুফিয়ানের গল্পের বাকী অংশ জানার জন্য। কিন্তু হুট করেই তো আর এসব প্রশ্ন করা যায় না। ম্যাচুরিটি আসলেই একটা শাস্তি। কারন এই এক কারনে কথা বার্তা রয়ে সয়ে বলতে হয়।

খাবার আসলে তা খেতে খেতে হালকা কথাবার্তা হয় দুজনের। রোদেলা জিজ্ঞেস করে –
: তারপর… বাড়ির সবাই কেমন আছে….?
: এই তো বাড়ি বাড়ির জায়গায় আছে, মানুষগুলো একেক জায়গায়। মা মা*রা গেলেন, বোনটাকে বিয়ে দিলাম, ভাইটা চলে গলো স্কলারশিপ নিয়ে। আমি এখন নিজগৃহে পরবাসী।
: আন্টির মৃ*ত্যু আমার কাছে এখনো অবিশ্বাস্য। এখনো চোখ বন্ধ করলে আমি দেখতে পাই সেন্টমার্টিনের সেই রাতটিকে। কত কথা হয়েছিল সেরাতে। তার ভাইবোনের গল্প, তার বিয়ের গল্প। উনি খুব ভালো গল্প বলতে পারতেন। কি সুন্দর পরিপাটি একজন মানুষ… কত সুন্দর তার চিন্তা ভাবনা, কথা বার্তা। হঠাৎ চলে গেলেন। যার সব ছিলো তিনিই নেই, কিন্তু দেখেন এমন অনেকেই আছে যার কেউ নেই, কিচ্ছু নেই তবুও দিব্যি বেঁচে আছে অপমান, লাঞ্চনা নিয়ে। একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো- সবই আল্লাহর ইচ্ছা…. দোয়া করি আল্লাহ তাকে বেহেশতের সর্বোচ্চ স্থান নসীব করুন।
: আমীন….
: আমি খুবই সরি,
: সরির কিছু নেই। বাস্তব মেনে নিলে জীবণটা সহজ হয়।
মা নেই… তা মেনে নিতে অনেকটা সময় লেগেছে আমার। কিন্তু একটা সময় আমার মনে হলো মা কষ্ট পাচ্ছেন। মা যেন আমাকে বললেন- এভাবে না ভাবতে, বাস্তব মেনে নিতে।
: হুম, বাস্তব কি আমি খুব ছোট্ট বেলায় টের পেয়েছি জানেন… জীবণে কোন কিছুতে যখন এক পা বাড়িয়েছি, জীবণ আমাকে ধরে দশ পা পিছিয়ে দিয়েছে। তবুও আলহামদুলিল্লাহ ফর এভরিথিং। আমি কষ্ট পেয়ে বুঝেছি সুখের মূল্য কত…
: আমার জীবণে কোন স্ট্রাগল নেই, তাই বাস্তবতা আমার কাছে অস্পষ্ট। বাবা মা*রা যাবার পর একটা ধাক্কা খেয়েছি, মা চলে গিয়ে একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেলেন আমাকে। আমি এখন বলতে গেলে উদ্দেশ্যহীন জীবণ যাপন করছি…
: উদ্দেশ্যহীন কেন…
: কেন জানিনা…
: কফি দিতে বলি…?
: একটু পর বলো, মাত্র খাবার খেলাম…
: ওকে… তারপর…
: তারপর আর কি…
: আপনার গল্পের বাকী অংশটা…
: গল্প আর কি… গল্প তো আমার না….
তোমার….
তোমার পুরো গল্পের কিছুটা অংশ আমার কাছে…
কথাটা শুনে চমকে তাকায় রোদেলা সুফিয়ানের দিকে… শান্ত স্বরে বলে-
: তো বলুন শুনি সেটা…

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here