রোদেলা,পর্ব: ৬৪

0
802

#রোদেলা,পর্ব: ৬৪
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু

বাড়ি ফিরে নানা রকম চিন্তা করে সুফিয়ান। নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ পৃথিবীর সবচেয়ে প্রলয়কারী যুদ্ধের একটি, কারন এতে নিজের শত্রু নিজেই। একটা সময় কেমন ফাঁকা হয়ে যায় ওর মাথাটা… এত খাটিয়েছে এটাকে এখন যেন একটু রেস্ট চাচ্ছে ও ….
আজ বিকেলে রোদেলাকে ও বলেছিলো আমার জীবণে কোন স্ট্রাগলের গল্প নেই….!

অনেক চেয়েও ও এর পরের কথাটা বলতে পারে নি সুফিয়ান। যে আমার জীবণের একমাত্র স্ট্রাগল তুমি….! তোমাকে খুঁজতে আমি আমার মেধা, শ্রমের সর্বোচ্চ ব্যাবহার করেছি আমি । কিন্তু কি মূল্য এত এত স্ট্রাগলের….?

কি সুন্দর ও বলে দিলো ওকে খোঁজার কারন ও জানে না…..
এই একটা কথাই কেবল সুফিয়ান ভাবতে থাকে অনবরত- সত্যি ও জানে না কেন আমি পাগলপ্রায় হয়ে খুঁজে বেড়িয়েছি ওকে। নাকি ও এড়িয়ে গেলো আমাকে…? ওর বর্তমান স্ট্যাটাসের সাথে আমি যাই না তাই কি ওর এই এড়িয়ে যাওয়া…? কথাটা ভেবেই মাথার নিজের চুল টেনে উদ্ভ্রান্তের মতো হাসতে থাকে সুফিয়ান। এমন একটা দিন দেখবো বলেই অন্ধের মতো দৌড়েছি মরীচিকার পেছনে।

রোদেলা তো এখন আর আগের সেই রোদেলা নেই… যাকে আয়রন মিলের গুদাম ঘরে প্রথমবার দেখেছিলো সুফিয়ান, সহজ সরল সাদামাটা জীবণ যাপনকারী, যে কিনা নিজের মায়ের দ্বারা মানসিক নিপিড়ীত ছিলো, যার জীবণে কষ্টই ছিলো একমাত্র অলংকার।

সেই রোদেলা পাঁচ বছরের ব্যাবধানে কোথায় পৌঁছে গেছে। ভালো বেতনের চাকরী করছে স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে, পিএইচডির জন্য আবেদন করেছে বললো সেদিন। পিএইচডির পর চাকরীতে প্রোমোশন হবে তার । কৃষ্ণচূড়া বাড়িটা কিনবে বাবা-মায়ের জন্য। যার মূল্য এককোটি টাকার কম না বর্তমান বাজারে। নিজের ফ্ল্যাট কিনবার কথা রোদেলা নিজে না বললেও পরশ ঠিকই খবর নিয়ে জেনেছে সে কথা। এটা যে এখানে স্থায়ী বসবাসের জন্যই কিনেছে তা বুঝতে রকেট সাইন্স জানা লাগবে না। মিতব্যয়ী রোদেলা আয়ের সবটুকু সঞ্চয় করেছে এবং তা এখন খরচ করছেক্যালকুলেট ভাবে। ওর জীবণ ও নিজেই গুছিয়ে নিয়েছে….

মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় ওর পথে কাঁটা হবে না। ভালোবাসা মানে তো বেঁধে রাখা না, মুক্ত করে দেয়া। আমারর যা অনুভূতি সেটা একতরফা ভালোবাসা। ও যদি আমাকে এড়িয়ে ও যায় তবুও ওর কোন দোষ নেই তাতে। তাছাড়া ওকে এখন ভালোবাসতে বাধ্য করা মানে ওকে ভালোবাসে যা করেছি তার প্রতিদান চাওয়া…

সেদিন রাতে ঘুম হয় না ওর। চিন্তা ঘুরপাক খায় মাথাতে…

রিটার্ণ টিকিট ও আসার সময়ই কেটে এসেছে। সে ডেট অনেক দেরী, প্রায় দুই মাস পর। অভিমান থেকে রোদেলাকে ও পরশু চলে যাবার কথা বলেছিলো তখন। রোদেলার ঐ কথাটায় সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো ওর, বাসায় ফিরেই এজেন্সিতে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলো টিকিট এক্সচেঞ্জ করা যাবে কি না। করা গেলে ভালো, না গেলে নতুন টিকিট কিনেই রওনা দিবে দেশের উদ্দেশ্যে। এত কাছে থেকে এত দূরত্ব ওর সহ্য করা অসম্ভব। তারচে ভালো নিজেই দূরে থাকুক রোদেলার।

এজেন্সি সেদিন রাতের মধ্যেই সুফিয়ানের টিকিট ম্যানেজ করো দিলো। পুরো টাকা রিফান্ড না করলেও বেশ কিছু টাকা এডজাস্ট করে টিকিট ম্যানেজ করে দিলো তারা । কারন আর্লি ডেইটের টিকিটগুলোর দাম বেশী হয়। তবে সমস্যা হলো পরশু না, তারপরের দিনের টিকিট এভেইলেভল ছিলো। তারমানে আরো একটা দিন বেশী থাকা লাগবে দমবন্ধ, ভালোবাসাহীন এই নগরে।

রোদেলা সেদিন সুফিয়ানের এমন চলে যাওয়ায় কষ্ট পায়। ও শুধু সুফিয়ানের মুখ থেকে শুনতে চেয়েছিলো ওকে ভালোবাসর কথাটা, এটা কি অন্যায় চাওয়া। ও ঠিক জানে সুফিয়ানের ওকে খুঁজে বের করার কারন। সত্যি বলতে এখন না, সেই যে প্রথম দিন – কৃষ্ণচূড়ায় এসেছিলো পান খাওয়া, ফুলহাতা শার্ট পরা, অশুদ্ধ কথা বলা অগোছালো সুফিয়ানের পরিবর্তিত রূপ, যে রোদেলাকে দেখে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, ফিরবার সময় রোদেলার মায়ের সাথে পরিবারের অন্যদের সাথে আন্তরিকতার সাথে পরিচিত হয়েছিল ওদের পরিবারের একজন হতে, রোদেলা তখনি টের পেয়েছিলো সুফিয়ানের দৃষ্টিতে ওর প্রতি ভালোবাসার। তা আরো জোড়ালো ভাবে বুঝেছে যখন ওর মা,ভাইবোনকে নিয়ে হঠাৎ করে সেন্টমার্টিন এলো তখন, এবং সেটা পুরো স্পষ্ট করেছে সুফিয়ানের মা সুফিয়া আন্টির রোদেলাকে জানা, বোঝা, আপন করে নেয়ায়।

রোদেলা তখন ঐ জাল থেকে নিজেকে বের করতে মরিয়া ছিলো। কিন্তু এখন….!

পরদিন গাড়ি নিয়ে একটা কাজে বের হয় রোদেলা, ইউনিভার্সিটিতে ফোন করে ও ছুটি নিয়েছে একসপ্তাহের। খুব জরুরি না হলে বের হতো না ও মনের এমন বেহাল অবস্থা নিয়ে। কাজ সেরে বাড়ি ফিরবার সময় গাড়িতে একটা ব্যাগ চোখে পরে রোদেলার। সেটা তুলে ভাবতে থাকে কার এটা…?

এই গাড়িটা নানু আর ওর ব্যবহারের জন্য, নানু নিজে ড্রাইভ করে না, রোদেলা নিজে ড্রাইভ করে নিয়ে যায় যেখানে যাওয়ার। তাহলে….!

এটা সুফিয়ানের নয় তো….!?
রুমে ঢুকে প্যাকেট খুলে দেখে রোদেলা। সুন্দর একটা অর্নামেন্ট বক্সে লাল কাপড়ে মোরা এক জোড়া চুরি…..!
ভিতরে ছোট্ট চিরকুট –
“চুড়িগুলো আমার মা তোমার জন্য রেখে গেছেন”

হঠাৎ চোখ ভিজে উঠলো রোদেলার। উত্তরাধিকার সূত্রে বড় ছেলের বৌ-ই শ্বাশুড়ির অলংকারগুলে প্রথমে পায়। সুফিয়ান মোটামুটি নিশ্চিত ছিলো কাল ওদের এই লুকোচুরি খেলা শেষ হবে। তাই হয়তো এটা এনেছিলো ওকে দিতে। অঘোষিত বাগদান……!

ওর প্রতি সুফিয়ানের ভালেবাসাটা ভাবতে থাকে রোদেলা। জীবণে ও সবসময় এমন কাওকেই খুঁজতো যে ওকে ওর সবটা জেনে আগলে রাখবে, একেবারে ওর ঘুমের ঘোরে দেখা স্বপ্নের সেই যুবকের মতো। সুফিয়ান তো সবই জানে রোদেলার, তাছাড়া ও যে কত কেয়ারিং একজন মানুষ তা পাঁচ বছরের প্রমাণিত করেছে বহু বহু বার। এই মামুষটাকে হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। কত পুরুষ চারদিকে, কিন্তু সুফিয়ান এই বিশাল পৃথিবীতে একটাই……!

পরদিন সুফিয়ানের ফ্ল্যাইট, লজ্জায় ফোন করতে পারে না ও। রাতের বেলা ভাবে এই যে লজ্জা, ইগো এটা কি জিতে যাবে আমাকে হারিয়ে…. অনেক ভেবে কল দেয় সুফিয়ানের ফোনে। ফেনটা সুইচঅফ…, কোন কিছু না ভেবে রওনা দেয় মেলিংটনের উদ্দেশ্য। সেখানে পৌঁছে জানতে পারে ও ওর নানাবাড়ি ওয়েলস্ এ গিয়েছে বিদায় নিতে। আর ওর ফ্লাইট আগামীকাল না আগামী পরশু সকাল সাড়ে দশটায়।

সেখনে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করে রোদেলা। সুফিয়ানের ফেরার খবর নেই। কোন উপায় না দেখে ফিরে যায় বাড়িতে। পরশের স্ত্রী প্রেমাকে বলে সুফিয়ানকে যেন বলে রোদেলাকে অবশ্যই কল করতে।

সুফিয়ান সে রাতে বাড়ি ফিরে না। প্রেমার কাছে তার নানু বাড়ির কোন নম্বরও নেই যে জানাবে কথাটা। কি একটা সমস্যা। এদিকে ওদের মেয়েটা অসুস্থ। খুব জ্বালাতন করছে সকাল থেকে। পরদিন রাতে ফিরে সুফিয়ান। এদিকে অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে হসপিটালে ওরা। সেই সব ঝামেলায় রোদেলার কথাটা বেমালুম ভুলে যায় প্রেমা।

পরদিন সকালে ব্যাগপত্র গুছিয়ে একাই রওনা হতে চায় কিন্তু পরশ ওকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে হসপিটালে যাবে বলে। সুফিয়ান ভোরে রওনা দেয় এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। সাড়ে দশটায় ফ্লাইট কিন্তু দু’ঘন্টা আগে যেতে হবে সেখানে। গাড়ি চালাচ্ছে পরশ, দু’জনে মনের অবস্থাই বিক্ষিপ্ত। কেও কোন কথা বলে না। এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে চলে যেতে বলে পরশকে। কিন্তু ও যায় না বসে থাকে, বিদায় না দিয়ে যাবে না জানায়। সুফিয়ান বলে আমি কি ছোট…?
ঠিক পারবো যেতে, তুই যা হসপিটালে ওদের তোকে বেশি দরকার। পরশ জানায় বাচ্চাটার অবস্থা এখন কিছুটা ভালো। ফোন করে জেনেছি এখন ও ঘুমাচ্ছে।

সাড়ে আটটায় সুফিয়ান ওর লাগেজটাকে চেক-ইন এ দিয়ে বিজনেস ক্লাস লাউন্জে বসে অপেক্ষা করে। সেখানে রেস্টুরেন্টের মতো বসার সুন্দর স্পেস, খাবারদাবার ও রয়েছে। এখানে ওরা ফ্রি ফুড প্রোভাইড করে বিজনেস ক্লাস টিকিট হোল্ডারদেরকে।

সুফিয়ান সকাল থেকে অভুক্ত। তবুও কিছুই খেতে মন চাইলো না ওর। এখানে আসার অনেক পরে একগ্লাস জুস আর স্যালমন স্যালাড নেয় ও । খাবার খেতে খেতে হঠাৎ মনে পরে পরশের কাছে ওর ক্রেডিট কার্ডটা রাখা। গতরাতে ওর কার্ড ব্লক হওয়ায় আর ওর কাছে ক্যাশ না থাকায় এটা দিয়ে ঔষধের বিল দিয়েছে পরশ। পরে কার্ডটা আর নেয়া হয় নি। সুইচ অফ করা ফোনটাকে খুলে সুফিয়ান, পরশকে একটা কল করবে। কাছাকাছি থাকলে যেন দিয়ে যায় কার্ডটা। ফোনটা খুলতেই অনেক গুলো ম্যাসেজ আসে, সেগুলো চেক করতে না করতেই কল আসে ফোনে। ফোনে তেমন চার্জ না থাকায় সাথে সাথে ফোনটা সুইচ অফ হয়ে যায়। এক মুহূর্তের জন্য একটা নাম ভেসে উঠেছিলো স্ক্রিনে। সুফিয়ানের মাথাটা কেমন চিড়িক দিয়ে উঠে। সেখানকার ওয়ার্কারদের সাহায্য নিয়ে ফোনটাকে চার্জ দেবার ব্যাবস্থা করে। ওর চার্জার লাগেজের মধ্যে যেটা অনেক আগেই চেক ইন এ দিয়ে এসেছে ও। ফোনে চার্জ হওয়া অবস্থায়ই ফোনটা চালু করে ও। মুহূর্তেই আবার ফোন আসে সেই একই নম্বর থেকে। ফোনটা রিসিভ করতেই একটা কান্নার কন্ঠস্বর ভেসে আসে ওপাশ থেকে। চুপ করে হতবাক সুফিয়ান ওপাশের কথাগুলো শোনে ও। কোনকিছু না ভেবেই দৌড়ে বের হয় ইমিরিয়েট এয়ারলাইন্সের বিজনেস ক্লাস লাউন্জ থেকে। এখান থেকে বের হওয়া নিষেধ তবুও দেড় ঘন্টার মতো সময় হাতে থাকায় সিকিউরিটি পুলিশ বের হতে দেয় ওকে।

সেখান থেকে দৌড়ে বের হয় সুফিয়ান। এয়ারপোর্ট কি এতটুকু জায়গা…? এত বড় এয়ারপোর্ট হাঁপিয়ে উঠছে ও তবুও প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে । এয়ারপোর্টের সবাই তাকিয়ে দেখছে ওকে। কেন এভাবে দৌড়ে যাচ্ছে ও সেটাই কৌতুহল সবার…

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here