ভুলোনা আমায় – পর্ব ৫

0
241

#ভুলোনা_আমায়
#পর্ব-০৫
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

কাজে এসে কিছুতেই মন বসাতে পারছে না সোহান।বার বার সাবা’র বলা কথাটা মনে পরছে “আমি আপনার স্ত্রীর সাথে কথা বলেছি,সে চায় না আপনার সাথে সংসার করতে”!
কথাটা যতোবার মনে পরছে ততবার অস্থির লাগছে। মনে মনে “আস্তাগফিরুল্ল” পড়ছে,যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। আল্লাহ তা’আলার কাছে শয়তান হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছে।
এমনি করে সকাল গড়িয়ে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। সোহান কিছু একটা ভেবে বাসায় মায়ের কাছে কল করলো…
.
.
রোকেয়া বেগম পাশের বাসার রাফিদা বেগমের সাথে বসে সুখ দুঃখের কথা বলছেন, তখন মেহুল দৌড়ে এসে বললো,
— আম্মা বড় ভাইয়া কল করেছে, তাড়াতাড়ি কথা বলো।

রোকেয়া বেগম কানের কাছে ফোন ধরলেন। তারপর বললেন,
— ওয়ালাইকুমুস সালাম।কিরে বাপ কিছু বলবি?
…….
— এখন ই আসবি?
…….
— আচ্ছা ঠিক আছে আমি ক‌ইতাছি। আচ্ছা আচ্ছা, ফোন কাইট্টা দে।

রোকেয়া বেগম ফোন নামিয়ে বললেন,
— মেহু যা টুসি’রে ডাইকা আন গিয়ে?
— আচ্ছা আম্মা।

একটু পর টুসি আসতেই রোকেয়া বেগম বললেন,
— তোমরা দুইজন তৈয়ার হ‌ইয়া নাও,একটু বাদে সোয়ান তোমাগরে নিতে আইবো।

টুসি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আর মেহুল উৎসুক হয়ে বললো,
— কোথায় নিয়ে যাবে আমাদের?
— হে গেলেই দেখতে পাবি,যা তাড়াতাড়ি তৈয়ার হ ।আর শোন দুজনেই কিন্তু বোরকা প‌ইরা লবি, সোয়ান বার বার ক‌ইছে।

প্রায় চল্লিশ মিনিট পর সোহান বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে নিল। তারপর খুব সুন্দর করে নিজে পরিপাটি হয়ে রুম থেকে বের হয়ে বললো চলো যাওয়া যাক?
মেহুল আর টুসি বোরকা হিজাব পা মৌজা হাত মৌজা পরে সোফায় বসে অপেক্ষা করছিল সোহানের জন্য। সোহান আসতেই টুসি’র অবাধ্য চোখ দুটো অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সোহানের দিকে।বেচারির বা দোষ কি? এতো দিন পাঞ্জাবি পরিহিত সাদাসিধে যে সোহান কে দেখেছে, সেই সোহান থেকে সম্পুর্ন ভিন্ন এক সোহান কে দেখছে টুসি! একদম ভিন্ন সাজে সজ্জিত হয়েছে সোহান।টুসি’র ভাস্যমতে এই মূহুর্তে সোহানের লুক,আকাশি কালারের শার্ট এবং কালো জিন্স পরিহিত একজন যুবক তার সামনে দাঁড়ানো। যুবকটির উচ্চতা বেশ ভালো। দেখতে শ্যাম বর্নের, মুখে চাপ দাড়ি, চুলগুলো বেশ কায়দা করে স্টাইল করা। চোখে চশমা, দেখলে একজন নিতান্ত সুদর্শন ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছে।

সোহান পকেট থেকে ফোন বের করে সময়টা চেক করে নিল। তারপর হাটতে হাঁটতে বললো,
— ফলো মি।

টুসি ভাবনার সুতো কেটে, রোকেয়া বেগম কে বলে মেহুলের হাত ধরে সোহানের পিছু পিছু এগিয়ে গেল। তারপর বাসার সামনে দাড়াতেই সিএনজি ঠিক করলো সোহান। পিছনের তিন সিটে সুন্দর করেই জায়গা দখল করলো তিনজনে, প্রথমে মেহুল মাঝখানে টুসি পাশে সোহান। অতঃপর কয়েক মিনিটের ব্যাবধানে সাহাবাগ শিশু পার্কে এসে পৌঁছায় তারা।

শিশু পার্কের প্রায় প্রত্যেকটি জিনিসের ভেতরকার নিহিত উদ্দেশ্যই হল শিশুর আনন্দ-বিনোদন নিশ্চিত করা।বলাই বাহুল্য শিশু পার্কে বাচ্চাদের আকর্ষণীয় জিনিস থাকবে। এজন্য ঢাকার এই শিশু পার্কটিতে রয়েছে বাচ্চাদের খেলাধুলা-আনন্দ-বিনোদনের জন্য ১২ টি মজার রাইড। এছাড়া বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে ঢাকা শিশু পার্কে একটি জেট বিমান উপহার দেওয়া হয়।তাই এর থেকে ভালো কোনো স্থান টুসি’র জন্য খুঁজে পেলো না সোহান।
প্রবেশদ্বারের কাছে কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে নেয় সোহান। তারপর ধীরে ধীরে ভিতরে প্রবেশ করে।টুসি গ্রামের মেয়ে হয়ায় এতো কিছু দেখার সৌভাগ্য হয়নি কখনো,তাই এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে হাঁটছে। হঠাৎ কিছুর সাথে পা লেগে হুচট খায় টুসি।পরে যাওয়া ধরলে, পিছন থেকে সোহানের সার্ট খামচে ধরে।যার ফলে পরে যাওয়া থেকে আটকায়। সোহান পিছনে ফিরে বললো,
— নিচের দিকে দেখে, সাবধানে হাটো।মেহুল তোর পিচ্চি ভাবী কে চোখে চোখে রাখিস,বলা যায় না আবার কোথাও হারিয়ে যেতে পারে।

এ কথা বলে,টুসি’র চোখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে সোহান।এতে করে লজ্জায় মাথা নিচু করে টুসি। তারপর প্রথমে উড়ন্ত নভোযানে উঠে টুসি আর মেহুল। সোহান পাশে দাঁড়িয়ে থাকে,মেহুল তাদের সাথে উঠতে বলে কিন্তু সোহান উঠে না। হয়তো টুসি বললে ভেবে দেখতো।যাই হোক, এই প্রথম বার রাইডে উঠে ভয়ে বুক ধড়ফড় ধড়ফড় করছে টুসির। মনে হয় এই যেন পরে যাবে। আল্লাহ তা’আলা কে ডেকে ডেকে অস্থির।

তারপর যখন একে একে কয়েকটি রাইডে উঠলো তখন ভয়টা কমে এলো। তখন আনন্দ অনুভব করতে শুরু করলো। মাঝে মাঝে ভয় পেলে মেহুল কে শক্ত করে ধরে রাখে।মেহুল তাই করে, দুজনের মধ্যে এ কয়েকদিনে বেশ ভাব হয়েছে,সমবয়সী কিনা।একে একে সব গুলো রাইডে চড়া শেষ হলে,সাড়ে পাঁচটার দিকে পার্ক থেকে বের হয়ে আসে তারা। তারপর ভালো রেস্তোরাঁয় নিয়ে যায় সোহান তাদের। চারিদিকে ঝলমলে লাইটিং এর আলোয় পিচ্চি টুসি’র চোখ ধাঁধিয়ে আসে। পরক্ষনেই আবার নিজেকে মানিয়ে নেয়।চোখ ঘুরিয়ে দেখতে থাকে আসে পাশের বিলাসবহুল পরিবেশ। সোহান এক্সট্রা কেবিন বুকিং করেছে তাদের জন্য।
সেখান থেকে দরজা গলিয়ে বাহিরের কাপলদের দিকে তাকিয়ে থাকে টুসি। অন্যান্য কাপল’রা নিজেদের মধ্যে হাসি ঠাট্টা করছে।একে অপরকে খাইয়ে দিচ্ছে। সেসব দেখে বড় বড় চোখে তাকায় টুসি।যা দেখে ভাই বোন একে অপরের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে হাসে। তারপর ওয়েটার মেনু কার্ড দিলে টুসি সোহানের দিকে মেনু কার্ড ঠেলে দেয় আর বলে আপনার ইচ্ছে মতো বলুন। সোহান মেনু কার্ড দেখে ওয়েটার কে বললো,
— চিকেন নাগেট,ভেজিটেবল স্যান্ড‌উইচ,ডোনাট আর লাচ্ছি দিন।
মেহুল তুই কি এগুলো খাবি নাকি অন্য কিছু?

মেহুল বললো,
— আমার জন্য লাচ্ছি’র বদলে ফ্রুট কাষ্টার্ড দিতে বলো।

তারপর সোহান ওয়েটার কে বুঝিয়ে বলে দিল,কি কি দিবে।
খাবার আসার ফাঁকে মেহুল সোহানের ফোন নিয়ে সবাই মিলে সেলফি তুললো,পরে সোহান আর টুসি’র কাপল পিক তুললো। তারপর খাবার সার্ভ করা হলে, সোহান হাতে ধরে শিখিয়ে দেয় কিভাবে কাটা চামচ ধরে খেতে হয়। প্রথমে হাত থেকে ফসকে গেলেও পরে মানিয়ে নেয়। ঠিক ভাবেই খেতে পারে।এক পর্যায়ে সোহান মুখের সামনে স্যান্ড‌উইচ ধরে,টুসি তাকিয়ে থাকলে সোহান চোখে ইশারা করে খাওয়ার জন্য। তারপর আবার মেহুল কে খাইয়ে দেয়,মেহুল ও তার ভাইকে খাইয়ে দেয়।তা দেখে টুসিও মেহুল কে খাইয়ে দেয়,মেহুল ও তাই করে। তারপর মেহুল বললো,
— ভাবী তুমি কিন্তু ভাইয়া কে খাইয়ে দিলে না? এটা কিন্তু ঠিক না।

টুসি মাথা নিচু করে বসে থাকে,যা দেখে সোহান মন খারাপ করে বললো,
— থাক লাগবে না কারো খাইয়ে দেওয়ার। আমি নিজেই খেতে পারবো।

এবার টুসি’র কিছুটা খারাপ লাগছে। মানুষটা তার জন্য এতো করে অথচ সে কিনা এইটুকুই নি করতে পারবে না? একটু খাইয়েই তো দিবে,এ এমন কি কঠিন কাজ? মনে মনে হাজার জল্পনা কল্পনা করে অবশেষে কাঁপা কাঁপা হাতে খাবার নিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় টুসি!যা দেখে বড় বড় চোখে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকে সোহান।মেহুল তখন বলে, কি হলো ভাইয়া খাবার টা খাও? তবুও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সোহান। এদিকে অস্বস্তিতে মিইয়ে যায় টুসি, শেষে না পেরে সোহানের মতো চোখে ইশারা করে খাওয়ার জন্য।যা দেখে মুচকি হেসে খাবার মুখে নেয় সোহান।

তারপর আবার সবাই খাবার খাওয়াতে মনোযোগ দেয়।টুসি তার লাচ্ছি চুমুক দিয়ে খেয়ে ডোনাট মুখে দেয়।এই সুযোগে সোহান তাদের লাচ্ছি’র গ্লাস পরিবর্তন করে দেয়।
সোহানের কান্ড দেখে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে টুসি, এদিকে মেহুল সব কিছু দেখেও না দেখার ভান করে নিজ মনে খেয়ে যাচ্ছে।টুসি’র তাকিয়ে থাকা দেখে সোহান বলে,
— প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আমাদের জন্য আদর্শ । স্ত্রীদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হবে তিনি আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন ।দাম্পত্য জীবনে প্রত্যেক স্বামীর কর্তব্য হলো, নবী করীম (সাঃ)-এর সুন্নাত পালন করা ।
স্ত্রী গ্লাসের যে স্থানে ঠোঁট রেখে পানি পান করে সেই স্থানে ঠোঁট রেখে পানি পান করা সুন্নাত[১]
যদিও তুমি গ্লাসে ঠোঁট ছুঁয়ে খাওনি তাতে কি পাইপ দিয়ে তো খেয়েছো?এটা দিয়ে খেলেই আমার একটা সুন্নাত পালন করা হয়ে যাবে “ইনশা আল্লাহ”।

হাদীস সম্পর্কে শুনে টুসি আর দ্বিধা করলো না,বাকি খাবার খাওয়ায় মনোনিবেশ করলো।
.
.
এর তেরো দিন পর,টুসি’র বাবা স্বপন তালুকদার কল করে সোহানের পুরো পরিবার কে, তার দুই ছেলের বিয়ে উপলক্ষে নিমন্ত্রণ করেন। সোহান টুসি’র কাছে ব্যাপারটা চেপে গিয়ে, বাসার বাদবাকি সবার সাথে আলোচনা করে।কে বিয়েতে যাবে আর কে যাবে না। রোকেয়া বেগম বলেছেন তার শরীর টা ভালো লাগছে না তাই তিনি এতো দূর কষ্ট করে যাবেন না, আরমান পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত তাই সে ও যাবে না বলেছে।বাকি থাকে সোহান,টুসি,আর মেহুল।তারা তিন জন যাবে,আর যাওয়া টাই হবে টুসি’র সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ….
___________
রেফারেন্স:-
[১]মুসলিমঃ৫৭৯
____________

#চলবে…. ইনশা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here