#ভুলোনা_আমায়
#পর্ব-১৬
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)
কাঠের জানালা গলিয়ে বাহিরের তাকিয়ে আছে টুসি, ঘরের সাথে পেয়ারা গাছটায় দোয়েল পাখি বসে আছে। মাঝে মাঝে পাতা থেকে পোকা শিকার করে খাচ্ছে।
রোজিনা বেগম মেয়ের নিরবতা দেখে অধৈর্য হয়ে পরলেন। আদুরে গলায় মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— বলনা মা সোহানের সাথে কোন ঝামেলা হয়েছে? তোর অসুস্থতার খবর নিতে একবার ও কল করলো না কেন?
টুসি’র শরীর শিউরে উঠে, এখনো জ্বর পুরোপুরি কমেনি। মায়ের কথায় জবাব না দিয়ে চুপ করেই বসে আছে। তখন তার দাদি নিছাপুছা দিয়ে জিজ্ঞাসা করে বইন তোর দাদিরে কবি না কি অইছে?ক না বইন কি অইছে?
টুসি নিরবে চোখের পানি ফেলে বলতে শুরু করে। তারপর প্রথম থেকে সবটা বললো।বলা শেষে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে।আর বলে আম্মু বিশ্বাস করো এর বেশি কিছু বলিনি আমি।
মেয়ের এমন বাঁধ ভাঙা চিৎকারে নিজেকে সামলাতে পারলো না রোজিনা, পানিতে ঝাঁপসা হয়ে এলো চোখ দুটো। সে তো জানে তার মেয়ে অবুঝ হলেও কখনো মিথ্যা কথা বলে না।পাশে বসে থাকা বৃদ্ধা মহিলা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,
— রোকেয়া এমন কাম করছে আমার নাতনির লগে? আজকে অয় আমার নিজের মাইয়া না বলে এই কাম করতে পারলো! আমার মাইয়া অইলে এই কাম কক্ষনো করতো না।
রোকেয়া বেগম পাশের ঘরের চাচাতো বোন হয় স্বপন তালুকদারের। আগে সম্পর্কটা এরকম ছিল।স্বপন তালুকদার পুরোনো বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়ি তৈরি করে চলে এসেছে, রোকেয়া বেগমদের বাড়ি থেকে।তো একদিন রোকেয়া বেগম এর ভাই দুলাল তালুকদার বিয়ের ব্যাপারে প্রস্তাব রাখে। স্বপন তালুকদার প্রথমেই নাকুচ করে দেয় কিন্তু বাড়ির লোকজনের কাছে রোজিনা বেগম শুনেছেন সোহান খুব ভালো ধার্মিক ছেলে। ধার্মিক ছেলে তো কখনো খারাপ হয় না তাই রোজিনা বেগম সবাই কে বোঝান। সেই থেকেই বিয়ের সূচনা হয়।
বর্তমানে রোজিনা বেগম নিজের কপাল নিজে থাপ্পাড়ান। নিজেকে দোষারোপ করেন ভাবেন তিনি যদি আগ্রহ না দেখাতেন তাহলে তার মেয়ের জীবনটা নষ্ট হতো না।
এদিকে মা দাদির থেকে সবকিছু শুনে স্বপন তালুকদার এবং আনাস আর বুখারী খুব খেপে আছে। পারে তো সোহানের পরিবার কে ধ্বংস করে দেয়!আনাস আর বুখারী তো সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে তাদের বোনকে আর বাসায় পাঠাবে না। পাঠিয়ে দিবে ডিবোর্স পেপার।
.
.
দশ দিন পর,
আনাসের ফোনে কল করে সোহান!আনাস বিদেশি নাম্বার দেখে চিনতে পারে না প্রথমে।পরে যখন সোহান সালাম দিয়ে বলে ভাইজান আমি সোহান বলছি! তখন চিনতে পারে, চিনতে পেরে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে আনাস বলে আমি কাজে ব্যস্ত আছি। কি দরকারে কল করেছো তাড়াতাড়ি বলো?
সোহান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
— আজকে তিন চার দিন যাবত টুসি’র ফোন বন্ধ পাচ্ছি। ওরে একটু বলবেন ফোনটা যেন অন করে?
— আমার বোনের সাথে তোমার কোন কথা আছে বলে আমি মনে করি না। আমার বোন মরলো না বাঁচলো কই এতো দিন তো একবার ও খোঁজ খবর নিলে না। এখন কিসের কথা?
সোহান খুব কষ্ট পেলো টুসি’র মরা বাঁচা নিয়ে এভাবে বলাতে।তাই বললো,
— ভাইয়া প্লীজ এভাবে বলবেন না, আমি সবসময় ওর জন্য দো’আ করি আল্লাহ তা’আলা যেন ওরে সর্বদা সুস্থ রাখেন।
— এতো গুলো দিন যাবত বোনটা আমার মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে কই একবার ও কল করে জানতে চাইছো তুমি?যাই হোক আমাদের বোনকে আমরা খুব যত্নে রাখবো সেই তৌফিক আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন। আশা করবো তুমি কোন যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না।
তারপর আনাস কল কেটে দেয়। এদিকে সোহান পাগল প্রায়।তার প্রিয়তমা স্ত্রীর কি হয়েছে? সোহানের সাথে রাগ করে আবার উল্টো পাল্টা কিছু করে বসেনি তো? ইয়া আল্লাহ আমি এই ভিনদেশে থেকে কি করবো? কিভাবে টুসি’র খবর নিব?
সোহানের কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। নিজেকে নিজেই পিটাতে ইচ্ছে করছে।টুসির কি হয়েছে?এসব চিন্তায় উল্টো পাল্টা কথা মাথায় আসছে। খুব অনুতপ্ত ফিল করছে।তার বোঝা উচিৎ ছিল যার সাথে রাগ দেখাচ্ছে সে একজন নাবালিকা মেয়ে। এখনো তার মস্তিষ্ক পরিপক্ক হয়ে উঠেনি। ঠিক ভুল বুঝতে শিখেনি। তাছাড়া রাগারাগী করাটা কোন সলিউশন না।সব সময় মাথা ঠান্ডা রেখে বিবেচনা করে দেখতে হয়। দুই পক্ষেরই কথা শুনতে হয়। কথায় আছে এক হাতে তালি বাজে না ঠিক তেমনি এক পক্ষের সমস্ত দোষ থাকে না।
.
.
আমাদের সমাজে এমন কিছু মানুষ আছে যারা মনে করে মায়েরা কোন অন্যায় করতে পারে না। আমার শিক্ষক বলতেন, মানুষ অন্যায় করবে না তো কি গরু ছাগল অন্যায় ভুল করবে? ঠিক তেমনি মানুষ মাত্রই ভুল।আমরা সবাই ভুল ত্রুটি করে থাকি। হয়তো কেউ জেনে বুঝে করি আর কেউ না জেনে করি।
আবার অনেকে আছে মা অন্যায় করেছে জেনেও চুপ করে থাকে,তারা মনে করে মা কে কিছু বললে মা কষ্ট পাবেন। কিন্তু অপর প্রান্তের মানুষটার ও যে কষ্ট বলে কিছু আছে তা কখনোই বুঝতে পারে না। কেননা সে পরের ঘরের মেয়ে।তার কষ্ট বলে কিছু থাকতে নেই। সেই পরের ঘরের মেয়েটার শ্বশুরবাড়িতে কোন মূল্য আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কেননা সে শ্বশুরবাড়ি আসার সময় বাপের বাড়ি ত্যাগ করে তো আসেই সাথে যৌতুক নামের মালপত্র নিয়ে আসতে হয়। অথচ বাবা মা তার আদরের নারী ছেঁড়া ধন টাই দিয়ে দিচ্ছে,এর থেকে মূল্যবান আর কি হতে পারে?
মেয়েরাই মেয়েদের মূল্য দিতে জানে না, সেখানে বাদবাকি মানুষের কথা কি আর বলবো?আজো আমাদের সমাজে কন্যা সন্তান জন্ম নিয়েছে শুনলে মানুষ মুখ বাকায়।অথচ তারাও কিন্তু একজন নারী।
আল্লাহ আজ্জা ওয়াজাল তার অসীম জ্ঞান দ্বারা কোন কিছুকে সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি যা চান তাই ই সৃষ্টি করেন এবং এভাবে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, কাকে তিনি পুত্র সন্তান দান করবেন, কাকে কন্যা সন্তান দান করবেন, কাকে উভয়ই দান করবেন আর কাকে বন্ধ্যা রাখবেন। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে আল কুরআনে বলেছেন, “তিনি যা চান সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা তাদেরকে পুত্র ও কন্যা উভয়ই দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করেন। তিনি তো সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।[১]
আল্লাহ তা’আলা আল কুরআনে স্পষ্টভাবে কন্যা সন্তানকে “সুসংবাদ” হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন, “আর যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়; তখন তার চেহারা কালো হয়ে যায়। আর সে থাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত।[২]
উপরিউক্ত হাদীস থেকে বোঝা যায় কন্যা সন্তান ঘরে সুসংবাদ ভয়ে আনে। এবং আল্লাহ তা’আলা তার ইচ্ছাতেই কন্যা সন্তান বা পুত্র সন্তান দান করেন।যারা এ নিয়ে মন খারাপ করে বা কটাক্ষ করে কথা বলে তাদের উপর আল্লাহ তা’আলা অসন্তুষ্ট হন।
আল্লাহ তা’আলা সবাই কে বোঝার তৌফিক দান করুন আমিন।
.
.
সোহান খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছে,টুসির কি হয়েছে? এখন কেমন আছে?তা না জানা পর্যন্ত শান্তি নেই।তাই গ্রামে মামাতো ভাই মিনহাজ তালুকদার কে কল করে সবটা খুলে বলে। সবটা শুনে মিনহাজ তালুকদার কথা দেয় খবর নিয়ে সোহানকে জানাবেন।”লেখিকা ইসরাত বিনতে ইসহাক” অতঃপর একজন মহিলা কে দিয়ে খবর নিয়ে সোহান কে তিনি টুসি’র অসুস্থতার খবর জানান।
টুসি’র টায়ফয়েড হয়েছে শুনে সোহান খুব ভেঙ্গে পরে,মেহুল কে সবটা জানায়।মেহুল তার আদরের ভাবীর খারাপ অবস্থা শুনে তার বর কে নিয়ে দুদিনের জন্য গ্রামে আসে।
টুসিকে দেখে খুব ব্যাথিত হলো,টুসি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। এখন অবশ্য আগের থেকে অনেকটা ভালো আলহামদুলিল্লাহ।
মেহুল সবার সাথে কুশল বিনিময় করে টুসি’র সাথে বসে কথা বলছে এর মধ্যে সোহান কল করে।মেহুল কিছু না বলে কল রিসিভ করে ফোনের ক্যামেরা টুসি’র দিকে তাক করে রাখে। সোহান অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার প্রিয়তমা স্ত্রীর দিকে, আজকে প্রায় বিশ দিন পর দেখছে তাকে। কেমন মলিন মুখশ্রী হয়ে আছে, চোখ জোড়া ঢেবে গিয়েছে। চাপা গায়ের রঙ হয়ে গিয়েছে। গায়ে পরিহিত কামিজটা ঢিলেঢালা হয়ে গিয়েছে।
টুসি’র এমন করুন অবস্থা দেখে সোহানের চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে।যা দেখে মেহুল বলে উঠলো,
— ভাইয়া তুমি কাঁদছো? কেঁদো না ভাইয়া ভাবী এখন আগের চেয়ে সুস্থ আছে আলহামদুলিল্লাহ।
মেহুলের কথায় চমকে তাকায় টুসি!তার বুঝতে বাকি থাকে না ফোনের অপর প্রান্তের মানুষটা কে!তাই সাথে সাথে মেহুলের থেকে ফোনটা নিয়ে কল কেটে দেয় টুসি।মেহুল অনেক বলেও টুসি’কে বোঝাতে পারে না যে তার ভাই ভুল করেছে সে এখন খুব আফসোস করছে। একটাবার মাফ চাওয়ার সুযোগ চায় সে। কিন্তু না টুসি কথা বলবে না মানে বলবেই না। শেষে মেহুল আশাহত হয়ে ফিরে যায় তার শহরে।
.
.
কেটে যায় দিন পেরিয়ে মাস।টুসি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠে। তবে সারাক্ষণ মনমরা হয়ে বসে থাকে।ভাবীরা কতো কথা বলে মন ভালো করতে চায় কিন্তু ব্যার্থ হয়ে ফিরে আসে।এর মাঝে রোকেয়া বেগম কল করে রোজিনা বেগমের সাথে তার কাজের অনুতপ্ত প্রকাশ করে। কিন্তু তালুকদার বাড়ির সবাই কঠোর হয়ে বসে আছে তারা কিছুতেই আর মেয়ে দিবেন না।টুসি’র এস সি রেজাল্ট প্রকাশিত,টুসি এ-গ্রেড পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে।আর মেহুল পেয়েছে এ-প্লাস। দু’জনের রেজাল্ট ই আলহামদুলিল্লাহ ভালো হয়েছে। ভর্তির সময় হলে মেহুল ঢাকায় ভর্তি হয় আর টুসি’কে গ্রামের এক কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়।টুসি নিয়মিত কলেজে আসা যাওয়া শুরু করে, এতে করে যদি কষ্ট গুলো কিঞ্চিৎ ভুলে থাকা যায় তাহলে ক্ষতি কি?
অপরদিকে সোহান কয়েক মাসের ছুটিতে দেশে আসার জন্য বন্ধবস্ত করছে!….
_______
রেফারেন্স:-
[১][আশ-শূরা ৪২/৪৯,৫০]
[২] [আন-নাহাল ১৬/৫৮]
_______
#চলবে.. ইনশা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম।
আজকে বলেছিলাম গল্পটা শেষ করবো কিন্তু দুনিয়ার কাহিনীর জন্য শেষ হলো না, শব্দ সংখ্যা বেশি হয়ে গেলে ফোনের নোটে লেখা সম্ভব হবে না,পরে তাড়াহুড়ো করে শেষ করতে গেলে অব্যক্ত রয়ে যাবে।তাই আরেকটা পর্ব লিখতে হবে।যাই হোক কেমন হয়েছে জানাবেন কিন্তু….”জাযাকিল্লাহু খাইরন”।