ভুলোনা আমায় – পর্ব ৮

0
231

#ভুলোনা_আমায়
#পর্ব-০৮
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

সোহান আশেপাশে টুসি’কে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এতো ভিড়ে পাওয়া মুশকিল মনে হচ্ছে।তার‌উপর মেয়েদের ঘরে প্রবেশ করবে না সে। তাছাড়া পরিচিত কাউকে দেখতে পাচ্ছে না।তাই কোলাহল মুক্ত পরিবেশে চলে আসে। তারপর পকেট থেকে ফোন বের করে হাতে নেয় মায়ের সাথে কথা বলবে বলে.. ঠিক সেই মুহূর্তে একটা ছেলে একটা মেয়ের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়! সোহানের পাশ কাটিয়ে সামনে যেতেই, কালো রঙের মাঝে সোনালী গাউন নজরে পরে সোহানের। মাথা নিচু করে ছিল বলে নিচের অংশ দেখতে পায় সে।যখন গাউনের অংশটি নজরে তখন পরিচিত মনে হয়। কেননা টুসি এবং মেহুলের জন্য মেচিং গাউন সোহান নিজে পছন্দ করে কিনেছে।

তাও মেয়েটির ফেইস দেখেনি বলে সোহান ব্যাপারটা ততোটা আমলে নিলো না।
পুকুর পাড়ের এই শুনশান নীরবতা, সাথে প্রকৃতির হাওয়া বইছে।বেশ ভালো লাগছে তার, কিন্তু তা-ও কোথায় যেন একটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। একটু আগালেই পাকা সিঁড়ি, সোহান ভেবেছিল ওখানে গিয়ে বসবে। পরক্ষনেই মনে হলো সাথে টুসি থাকলে খারাপ হয় না।তাই আবারো তাকে খুঁজতে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। কয়েক পা এগিয়ে যেতেই পিছন থেকে অট্টহাসির শব্দ শুনতে পায় সোহান, না চাইতেও পিছনে ফিরে তাকায় সে। তখন দেখতে পায় তিনটা ছেলে সাথে চারটা মেয়ে।আর এর মধ্যে আছে টুসি ম্যাডাম। খুব হাসাহাসি করছে আর স্প্রিড ক্যানে চুমুক দিচ্ছে।
সোহান শক্ত হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।টুসি তার মতোই কথা বলতে বলতে যখন কাছে আসে তখন সোহান কে দেখে দাঁড়িয়ে বলে,
— আপনি এখানে?

সোহান চোখে মুখে কাঠিন্য ভাব ফুটিয়ে তোলা অবস্থাতেই বললো,
— আমি থাকাতে খুব বেশি অসুবিধা হয়ে গেল বুঝি?

টুসি অবুঝের মতো করে বললো,
— মানে?
— পরপুরুষের সাথে হাসি তামাশা করতে এতোটাই কমফোর্টেবল তুমি! আজকে নিজ চোখে না দেখলে সত্যি বিশ্বাস করতাম না। আমি ভাবতাম তুমি বুঝি গ্রামের সহজ-সরল একটা মেয়ে।বয়সেও অনেক ছোট,তাই ছেলেদের ব্যাপারে অনাগ্রহী। আর তাই স্বামী নামক বিপরীত মানুষটাকে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমি সম্পূর্ণ ভুল ছিলাম এতো দিন। হয়তো এই মুহূর্তের মতো আনন্দ ফুর্তি করতে চেয়েছিলে! কিন্তু বিয়ের কারণে বাঁধা পরে গেছে।তাই..

বেয়াইন এই ছেলেটা তোমাকে কখন থেকে বাজে কথা বলে যাচ্ছে,অথচ তুমি কিছুই বলছো না কেন?

পাশে থাকা একটা ছেলে বললো এই কথা। তখন সোহান চোখ তুলে তাকায়। ছেলেটার বেশভূষায় বুঝতে বাকি নেই কি ধরনের ছেলে।মাথার চুল গুলো কেমন বড় বড় কানের কিছুটা উপরে, মনে হয় যেন মুরগি আঁচর কেটেছে।যাকে বলে হানি’সিঙ্গার কার্ট। এরকম উগ্র ধরনের ছেলেদের সাথে টুসি’র এতো ভাব মেনে নিতে পারছে না সোহান।তার স্ত্রীর এরকম চলাফেরার জন্য যে,পরকালে আল্লাহ তা’আলার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আমাদের তথাকথিত সুশীল সমাজের লোকজন জেনেও অজ্ঞাত যুবকের সাথে অবাধ মেলামেশা করে। অথচ ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পুরুষের জন্য ও পর্দা ফরজ করা হয়েছে।

নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই পর্দা পালন করা ফরজ। ইসলামে উভয়কেই পর্দা পালনের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। পর্দা পালন করা মুসলিম নারীর অনন্য রুচিবোধ ও সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ। পর্দা পুরুষের উন্নত চরিত্র গঠনের মাধ্যম; পাশাপাশি নারীর মান-সম্মান, ইজ্জত-আবরুর রক্ষাকবচও বটে।আল্লাহ তাআলা নারী ও পুরুষদের প্রতি পর্দা পালনের বিষয়টি কুরআনুল কারিমে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘(হে নবি! আপনি) মুমিন (পুরুষদের) বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নিচু করে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে, এটা তাদের জন্য অধিকতর পবিত্র। তারা যা কিছু করে আল্লাহ সে বিষয়ে অবগত।এবং (হে নবি! আপনি) ঈমানদার নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নিচু রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান, তাছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে;এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত দাসি, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো কাছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।[১]
আবার নারী এবং পুরুষের পর্দার স্বরূপ কেমন হবে হাদিসে পাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি হাদিসেই প্রমাণ পাওয়া যায়।বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্ধ সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রাদিয়াল্লাহু আনহুর আগমনে প্রিয়নবির নসিহতটি সবার জন্য অত্যন্ত জরুরি।হজরত উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন আমি ও মায়মুনা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে ছিলাম। এমতাবস্থায় (দৃষ্টিহীন সাহাবি) আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে আগমক করলেন।তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা পর্দার অন্তরালে চলে যাও।আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! ইনি (আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম) কি দৃষ্টিহীন নন? ইনি তো আমাদেরকে দেখছেন না।জবাবে আল্লাহর রাসুল বললেন, তোমরা কি তাকে দেখছো না?[২]
উল্লেখিত হাদিস দ্বারা সুস্পষ্টভাবে জানা যায় যে, কোনো নারী পর্দার ভেতরে থেকে কোনো পুরুষকে দেখাও বৈধ নয়। পুরুষের জন্য যেমন নারীদের সঙ্গে অবাধ দেখা-সাক্ষাৎ বৈধ নয়; ঠিক তেমনি নারীদের জন্য পুরুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বৈধ নয়।সুতরাং নারী ও পুরুষের জন্য পর্দা পালন করা সমভাবে প্রযোজ্য। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে পর্দার পালনে কুরআন ও হাদিসের ওপর আমল করে পরকালীন জীবনের সফলতা লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।

সোহান আর মূহূর্ত বিলম্ব না করে, বিয়ে বাড়ি ছেড়ে তার শ্বশুর বাড়ির দিকে রওনা দিল।টুসি শুধু যাওয়ার পথে তাকিয়েই রইলো। সোহান কে আটকানোর বৃথা চেষ্টা করলো না,জানে করেও লাভ নেই। এখন সে যাবেই, খুব রেগে আছে যে। তবে টুসি খুব অনুতপ্ত হলো, বুঝতে পারলো তার খুব বড় ভুল হয়েছে।
হাতে থাকা ক্যান টা ছুড়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ে তার হবু ভাবী’দের কাছে চলে যায়। এখানে থাকা ছেলে মেয়ে গুলো ডাকাডাকি করলেও পিছনে ফিরে তাকায় না টুসি।
.
.
স্বপন তালুকদার তার একমাত্র জামাই’কে নিয়ে সবার আগে র‌ওনা হন। বাজার সদাই করে তবে নতুন আত্মীয়ের বাড়িতে যাবেন বলে।আর এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে টুসি এতো সাজগোজ করে বেরিয়েছে। না হয় সোহান পূর্ণ পর্দায় ঢেকে তবেই তার স্ত্রীকে নিয়ে যেত।
তারপর এখানে আসার পর কিছু ছেলে যারা মেয়ের আত্মীয় কিংবা ভাই।বেয়াইন বলে হাসি ঠাট্টায় মেতে ওঠে। যেমনটা আমাদের তথাকথিত সমাজে হর’হামেসা চলে।
টুসি যেতে না চাইলে একটা ছেলে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়।যখন সোহান দেখেছিল,ঐটা আর কেউ নয় বরং টুসি ছিল।যদি মজা মাস্তি করেছে,বেয়াই-বেয়াইন সম্পর্ক বলে। কিন্তু ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এগুলো।
.
সোহান তার শ্বশুর বাড়িতে পা রাখচেই রোজিনা বেগমের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়।এই অসময়ে জামাই কে ফিরতে দেখে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় রোজিনা। বিভিন্ন প্রশ্ন মাথায় এসে ঘুরপাক খাচ্ছে,তাই নিজেকে দমিয়ে রাখতে না পেরে জিজ্ঞাসা করে বিয়ের কাজ কি শেষ বাবা? তুমি যে একা আসলে? খাবার দাবার ঠিক ঠাক মতো খেয়েছো তো? আচ্ছা তোমার আবার শরীর খারাপ হলো না তো?

সোহান সব গুলো প্রশ্ন এরিয়ে গিয়ে বললো,
— মামি আপনি এতো ব্যাতি ব্যস্ত হবেন না, তেমন কিছু হয়নি আমি ঠিক আছি।
— তারমানে কিছু একটা হয়েছে!বলো বাবা কি হয়েছে তুমি না বললে আমার আরো দুশ্চিন্তা বাড়বে।
— তেমন কিছু না, মাথা টা একটু ব্যথা করছে। ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে। আমি একটু ঘুমানোর ট্রাই করি কেমন..

তারপর সোহান চলে গেল,দু’চালা নতুন ঘর’টাতে। ওখানেই সোহান এবং টুসি থাকে।টুপি’র সাথে রাগারাগী করে, এই ঠাডা পরা রোদ্দুরে এ বাড়িতে আসায় প্রচুর পরিমাণে মাথা ব্যথা করছে সোহানের।যার ফলে তাকিয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে।তাই আর দেরি না করে ঘরে এসে ফুল স্পীডে ফ্যান চালু করে শুয়ে রইলো।

এদিকে খাবার টেবিলে বসে আছে টুসি, তার গলা দিয়ে খাবার নামছে না। সোহান যে না খেয়ে বেড়িয়ে গেছে সে জন্য তার ও খেতে ইচ্ছে করছে না। এখন মনে হচ্ছে সোহানের সাথে চলে যাওয়া উচিৎ ছিল।এর মধ্যে মেহুল কয়েকবার সোহানের কথা জিজ্ঞাসা করে,টুসির থেকে কোন উত্তর পায়নি। এখন খাবার টেবিলে টূসি’কে আনমোনা দেখে সন্দেহ হলো কিছু একটা হয়েছে।হ‌ওয়ারি কথা কারণ টুসি যেভাবে সাজুগুজু করে বেরিয়েছে।আজ পর্যন্ত মেহুল কে এভাবে কোথাও বের হতে দেয়নি সোহান।আর এ তো তার স্ত্রী।যেখানে সোহান ব্যাতিত তার স্ত্রীর সৌন্দর্য দেখার অধিকার আর কারো নেই।
খাবার শেষে বিয়ে পড়ানো শুরু করে ইমাম সাহেব। প্রথমে আনাস এর তারপর বুখারী’র। দুই ভাই দুই বোন কে বিয়ে করছে।যদিও মেয়ে একে অপরের চাচাতো জেঠাতো বোন!, তবুও বোন ই তো।
বিয়ের কাজ শেষ করে,ব‌উ নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।টুসি বাড়ি ফিরেই সোহানের খুঁজ নিল, তার মা জানালো সোহান মসজিদে গিয়েছে।
টুসিও ফ্রেশ হয়ে মাগরিব নামায আদায় করে নেয়। তারপর তার রুমে বসে অপেক্ষা করতে থাকে…..
___________
রেফারেন্স:-
[১]সুরা নূর : আয়াত ৩০-৩১
[২](আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ, তিরমিজি, মিশকাত)
_____________

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here