#ভুলোনা_আমায়
#অন্তিম_পর্ব
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)
তপ্ত গরমের বিদায়ের পর কনকনে শীতের আগমন ঘটে। চারিদিকে কুয়াশা আচ্ছন্ন হয়ে আছে,এক স্থানে থাকা অবস্থায় আরেক স্থানের কিছুই দেখার সুযোগ নেই। পুকুরের পানি থেকে কেমন ধুঁয়ার মতো উঠছে, চারিদিকে কোন পশু পাখির গতগম্ব নেই। শীতের আভাসে সবাই সবার নীড়ে অবস্থানরত।যখন সূর্য মামা উদিত হবে তখন সবাই তাদের নীড় ছেড়ে বের হবে এই তাদের পণ ।
টুসি পুকুর পাড়ের ঢেলনাতে বসে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে পুকুরের ধুঁয়া উঠা পানির দিকে। পাতলা একটা চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে নিজেকে। মনে হচ্ছে শীতেরা তাকে ছুঁতে পারছে না।শীত নিবারণ নিয়ে নেই কোন ভাবান্তর।মাত্রই ভোরের আলো ফুটেছে, তার উপর শীতের সকাল বোঝাই যাচ্ছে কতো শীত।সকলে নামায পড়ে কম্বল অথবা লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে আর সে শীতকে অবজ্ঞা করে, এখানে বসে অনিমেষ চাহনিতে তাকিয়ে আছে পুকুরের পানিতে।
যখন মানুষের মনে কষ্ট পাহাড় সম তৈরি হয়, তখন শরীরের কষ্ট অনুভব হয় না।আর কষ্ট থেকেই মানুষ আত্ম’হ’ত্যার মতো পাপ করে বসে। তখন শরীরের কষ্টের কথা ভাবেনা, মনের কষ্টগুলোই বড় হয়ে উঠে। অথচ আল্লাহ তা’আলা বলেন,
— তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু এবং যে কেউ সীমালঙ্ঘন করে আত্মহত্যা করবে তাকে অগ্নিতে দগ্ধ করব এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ[১]
আত্মহত্যাকারীর জন্য পরকালে কঠোর আজাবের ঘোষণা এ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট বোঝা যায়।আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, নবিজি সা: বলেছেন,-‘যে ব্যক্তি পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে অনুরূপভাবে আত্মহত্যা করতেই থাকবে এবং এটিই হবে তার স্থায়ী বাসস্থান। যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহত্যা করবে, তার বিষ তার হাতে থাকবে, জাহান্নামে সে সর্বক্ষণ বিষ পান করে আত্মহত্যা করতে থাকবে। আর এটা হবে তার স্থায়ী বাসস্থান। আর যে ব্যক্তি লৌহাস্ত্র দিয়ে আত্মহত্যা করবে, সে লৌহাস্ত্রই তার হাতে থাকবে, জাহান্নামে সে তা নিজ পেটে ঢুকাতে থাকবে,আর সেখানে সে চিরস্থায়ীভাবে থাকবে[২]
হজরত জুন্দুব বিন আব্দুল্লাহ রা: রাসুল সা: থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন,- ‘একজন ব্যক্তি জখম হলে, সে (অধৈর্য হয়ে) আত্মহত্যা করে। এর প্রেক্ষিতে আল্লাহ বললেন, ‘আমার বান্দাহ আমার নির্ধারিত সময়ের আগেই নিজের জীবনের ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আমি তার ওপর জান্নাত হারাম করে দিলাম।[৩]
উপরিউক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে আত্মহত্যার মতো জঘন্য পাপ দুটি নেই।তাই আমরা যতই দুঃখ কষ্টে পুড়ে ছাই হইনা কেন আমাদের মনে রাখতে হবে এই দুনিয়া চিরস্থায়ী নয়,আমরা কেবল কিছুদিনের অতিথি কেবল। কোরআন শরীফ এর এই আয়াত টা মনে রাখতে হবে, “জেনে রেখো,আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে”[৪]
.
.
হঠাৎ দুটো গরম হাতের স্পর্শে বিদ্যুৎ পিষ্টের ন্যায় চমকে উঠে টুসি।হাত দুটো ছাড়িয়ে পিছনে ঘুরে দাঁড়ায় টুসি। সামনে থাকা ব্যক্তিকে দেখে আঁখি দুটো আপনাআপনি বড় হয়ে গেল। “লেখিকা ইসরাত বিনতে ইসহাক” সামনে থাকা ব্যক্তির অধরপল্লবে মৃদু হাসি দুলছে। শীতের কারণে মাথায় হুডি দেওয়া, দুই হাত পকেটে গুঁজে রাখা।
টুসি’র এলোমেলো মস্তিষ্ক যখন স্থির হয়ে আসে তখন পাশ কেটে চলে যাওয়া ধরে। সোহান তখন দ্রুত টুসি’র বাম হাতটা আঁকড়ে ধরে। রাগে দুঃখে হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নেয় টুসি। এতে করে খুব ব্যাথিত হয়ে করুন চাহনিতে তাকিয়ে থাকে সোহান।
নিরবতা ভেঙ্গে বলে,
— আমাকে কোন ভাবেই মাফ করা যায় না? আমি তো জানতাম না তুমি অসুস্থ ছিলে,জানলে সেদিন কখনোই ওভাবে কথা বলতাম না।তা ছাড়া তুমি তো জানো আম্মার প্রতি কতটা দূর্বল আমি। আব্বা মারা যাওয়ার পর খুব কষ্ট করে আমাদের পড়াশোনা করে মানুষ করেছেন তার কথা কি করে অবিশ্বাস করতাম বলো? তবে আর কখনো এমন ভুল হবে না ইনশা আল্লাহ। তোমাদের দুজনের সব কথা প্রথমে শুনবো তারপর যা বলার বলবো। তবুও আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ। আমি আর সহ্য করতে পারছি না, তোমার কন্ঠস্বর শুনতে পাইনা বলে আমার হৃদয় পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।প্লিজ একটু কথা বলো?
টুসি’র চোখ পানি টলটল করছে,তাই নিজেকে আড়াল করতে দৌড়ে ঘরে চলে যায়।
.
গতকাল বিকাল সাড়ে পাঁচটায় সোহান দেশে ফিরে। তারপর বাসায় ফিরে দেখে রোকেয়া বেগম মনমরা হয়ে একা বসে আছে। সোহান কে দেখতে পেয়ে ভুত দেখার মত চমকে উঠে। সোহান কুশল বিনিময় করে টুসি’র কথা তুলে। তখন রোকেয়া বেগম নিজের ভুল স্বীকার করে টুসি’কে ফিরিয়ে আনতে বলে।মিরার কথা জিজ্ঞাসা করলে রোকেয়া বেগম জানায় সে বাপের বাড়ি গিয়ে বসে আছে, আরমানকে বলেছে আলাদা বাসা ভাড়া না নিলে সে এ বাসায় ফিরবে না। এদিকে আরমান সদ্য জন্ম নেওয়া মেয়েকে ছেড়ে থাকতে পারবে না বলে রোকেয়া বেগমের হাতে পায়ে ধরে অন্যত্র বাসা ভাড়া করে চলে গিয়েছে! সেই থেকে রোকেয়া বেগম কাজের মহিলা কে নিয়ে বাসায় একা আছেন।
হয়তো এভাবেই তার অন্যায়ের শাস্তি পাচ্ছেন তিনি।
তারপর সোহান টুসি কে ফিরিয়ে আনতে যাবে বললে রোকেয়া বেগম বললেন,তিনিও সাথে যাবেন।সোহান অমত না করে রোকেয়া বেগম কে তৈরি হতে বলে নিজের রুমে গেল। রুমটা কেমন অন্ধকারে ডুবে আছে। কত মাস যাবত কেউ থাকে না বলে কেমন শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে। এমনিতে রোকেয়া বেগম কাজের মহিলা কে দিয়ে ঝাড়ু মুছা করিয়েছেন এটুকুই।যাই হোক হাতে থাকা টলি ব্যাগটা থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে একটা ছোট ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল সোহান। তারপর টলি ব্যাগটা রুমের একপাশে রেখে দিয়ে বাহিরে এসে রোকেয়া বেগম কে তারা দিয়ে বললো,
— আম্মা তাড়া তাড়ি চলো না হয় গাড়ি পেতে বেগ পেতে হবে।
অতঃপর এই ভোরে গ্রামে এসে পৌঁছায় তারা। রোকেয়া বেগম কে তার বাড়িতে রেখে এসে সোহান এ বাড়ি চলে আসে। এসে দরজায় কড়াঘাত করতে রোজিনা বেগম দরজা খুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। সোহান সালাম দিলে তার বিষ্ময় ভাব কাটে, তারপর সোহান কে কঠোর গলায় বলেন,
— এখানে কেন এসেছো তুমি? আমার মনে হয় তোমার এখানে আসার কোনো প্রয়োজন নেই আর!চলে যাও!
সোহান করুন কন্ঠে বলে,
— আমি ভুল করেছি মামি, আমাকে এই প্রথম বারের মতো মাফ করে দিন। কথা দিচ্ছি আর কখনো এমন ভুল করবো না ইনশা আল্লাহ। আপনারা আমাকে মাফ না করলে আমার আল্লাহ যে আমাকে মাফ করবেন না।
রোজিনা বেগম শুনলেন না, তিনি ঘরের ভিতর চলে গেলেন। তখন টুসি’র দাদি আসে, বৃদ্ধা মলিন মুখশ্রী করে বললেন,
— তোমার থেইকা এমন ধারা কাম আশা করি নাই ভাই! তুমি কেমনে পারলা আমার কলিজার টুকরা নাতনিরে কষ্ট দিতে?
সোহান বৃদ্ধার হাত দুটো ধরে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বললো,
— দাদি আমার ভুল হয়ে গেছে, আমাকে মাফ করে দিন প্লিজ? দেখেন শুধুমাত্র নিজের অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হয়ে দেশে চলে এসেছি। আমার আরো কয়েক বছর পর দেশে ফিরার কথা ছিল এবং কি বলেছি আর বিদেশে যাবো না! দেশে থেকেই কাজ করবো। আমার পরিবর্তে অন্য কাউকে নিয়োগ করা হবে বিদেশে ব্যাবসায় পরিচালনা করার জন্য।প্লিজ দাদি ওর সাথে আমাকে দেখা করার সুযোগ করে দিন প্লিজ? আমি আপনার কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।
সোহান কে এতোটা বিচলিত দেখে বৃদ্ধা বললেন,টুসি পুকুর পাড়ে বসে আছে।যা শুনে খুব অবাক হয় সোহান।এই শীতের মাঝে মেয়েটা পুকুর পাড়ে বসে কি করে?যে মেয়েটা কিনা এতো ঘুম কাতুরে, এখন তো তার লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকার কথা।আর না ভেবে সোহান বৃদ্ধা কে “জাযাকিল্লাহু খাইরন” বলে দ্রুত পায়ে পুকুর পাড়ে চলে যায়। বৃদ্ধা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তার নাতনির এখন যদি একটু মন ভালো হয়..
.
.
সন্ধ্যাবেলা বৈঠক বসে! সেখানে টুসি’র পরিবারের সকলে উপস্থিত। মহিলারা পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা শুনছে।
অপরদিকে সোহানের আম্মা,মামা, মামাতো ভাই সকলে উপস্থিত আছেন।
স্বপন তালুকদার প্রথমেই কথা তুলেন দেনাপাওনা নিয়ে! তিনি সোহানের দিকে আঙুল তুলে বললেন,
— আমার মেয়েকে দুই হাত উজাড় করে সমস্ত ফার্নিচার দিতে চেয়েছিলাম আমি! কিন্তু তুমি বলেছিলে এসব যৌতুকের আওতায় পরে তাই তুমি নিতে চাও না। অথচ সেদিন তোমার আম্মা সামান্য একটা পানির জগ নিয়ে আমার মেয়েকে কথা শুনালেন। মেয়েটা অসুস্থ হয়ে পরে ছিল একটা বার গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন নাই! তুমিও তোমার আম্মার কথা শুনে আমার মেয়েকে কথা শুনাতে ছাড়লে না, এরপরেও আমি কোন ভরসায় আমার মেয়েকে তোমার এবং তোমার আম্মার হাতে দিতে পারি?
তারপর বাদবাকি সবার উদ্দেশ্যে বললেন,
— আপনারাই এর জবাব দিন আমি কি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে মেয়ে কে আর দিব না?
সোহান মাথা নিচু করে বলে,
— কথাটা বলতে কষ্ট হচ্ছে তবুও বলছি, মানুষজনকে টাকা পয়সা দিয়ে কতক্ষন ভালো থাকা যায়? আপনি মানুষকে দিয়ে খাইয়ে যত লোভ দেখাবেন সে ততই আপনার থেকে প্রত্যাশা করবে।তার চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলবে।তাই দিয়ে খাইয়ে কখনো ভালো থাকা যায় না।যে সম্পর্কে কোন চাহিদা থাকে না, থাকে মায়া,মহাব্বত, ভালোবাসা সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় আজীবন।
যাই হোক আমি কথা দিচ্ছি ভবিষ্যতে একই কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না ইনশা আল্লাহ।
সোহানের কথা শেষ হলে তার মামা দুলাল তালুকদার মিনতি করে বললেন,
— ভাইজান আমার বোনটা ভুল করে ফেলছে এবারের মতো মাফ চাই। আমাদের ফিরিয়ে দিবেন না দয়া করে।
এরপর বাকিরা এটা ওটা বলে তর্কে যাওয়ার আগে স্বপন তালুকদার সবাই কে থামিয়ে বললেন,
— ঠিক আছে আমি মাফ করে দিচ্ছি, তবে আমি আমার মেয়ের চোখের পানি দ্বিতীয় বার সহ্য করবো না।
অতঃপর সব কিছু মিটমাট হয়ে যায় “আলহামদুলিল্লাহ”।
.
.
অন্ধকার ঘরে ঢুকে ফোনের ফ্লাস জ্বালিয়ে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দেয় সোহান। তারপর ঘরের দরজা বন্ধ করে এগিয়ে যায় সামনে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছে। কাছে গিয়ে কোন কথা না বলে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। সামনে থাকা ব্যক্তিটি ডুকরে কেঁদে ওঠে। সোহান তাকে ঘুড়িয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
— আর নয় প্লিজ। অনেক কাঁদতে হয়েছে আমার জন্য। আমাকে মাফ করে দাও..এই বলে পা ধরার জন্য উদ্যত হলে টুসি ঝাপটে ধরে সোহান কে। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলে,
— আমাকে এমন অপরাধী করবেন না। আপনার বিরহ আমি সহ্য করতে পারিনি বলে সেদিন আম্মার মুখে মুখে তর্ক করে ফেলেছিলাম। আমাকে মাফ করে দিন..
সোহান টুসি’কে চুপ করিয়ে বললো, পুরোনো কথা আমরা ভুলে যাবো কেমন? তবে কি জানো সম্পর্কে অভিমান থাকা ভালো তাহলে আরো গভীর ভাবে উপলব্ধি করা যায়।টুসি বিরতিহীন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। সোহান হেসে অজস্র আদরে ভরিয়ে দেয় তার প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখশ্রী জোরে।এর প্রতিদানে টুসিও চুপ থাকে না….
________
রেফারেন্স:-
[১](সূরা আন নিসা আয়াত-২৯,৩০)
[২](বোখারি ও মুসলিম)
[৩](বোখারি)।
[৪][সূরা বাক্বারাঃ২১৪]
__________
🍀 সমাপ্ত 🍀
(আসসালামু আলাইকুম।
অতঃপর গল্পটার ইতি টেনে দিলাম।আপনারা যারা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমার পাশে ছিলেন, সাপোর্ট+ভালোবাসা দিয়েছেন তাদের কে “জাযাকিল্লাহু খাইরন”💚
সবশেষে,
সবার কাছে আমার আবদার নতুন গল্প না দেওয়া পর্যন্ত “#ভুলোনা_আমায়”🥰)