প্রিয় বেলা
৬.
রোদে সত্যিই তাকাতে পারছিল না বেলা। কিন্তু তাই বলে জড়িয়ে ধরার মানে কি? আদ্রর কথার অবাধ্য হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো বেলা। কণ্ঠে কঠোরতা নিয়ে বললো,
—“আমি ঠিক আছি। আপনি ছাড়ুন আমায়।”
আদ্র শুনলো না। বড়সড় ধমক দিয়ে বললো, “যা বলছি তা করুন। অবাধ্য হচ্ছেন কেন?”
বেলা তবুও কথার অমান্য করলো। ভীষণ জেদি হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। যেন এই লোকের একটা কথাও না শোনার ঘোর পণ করেছে সে। আদ্র এবার আর কথা বাড়ালো না। কয়েক সেকেণ্ড অতৃপ্ত চোখে চেয়ে রইলো। কপালে রুষ্ট বলিরেখার অসংখ্য ভাঁজ। ভ্রু কুঁচকানো। নিজেই হাত বাড়িয়ে ওড়না নাক অব্দি টেনে নিলো। বেলাকে বক্ষের সঙ্গে প্রগাঢ় ভাবে জড়িয়ে এক পা এগোতেই পায়ে টান পরলো বেলার। ক্ষতস্থান টনটন করে উঠলো। কণ্ঠনালি গলিয়ে অস্পষ্ট ভাবে বেড়িয়ে এলো, “আহ! ব্যথা।”
আদ্র চকিতে তাকালো। অস্থির হলো খুব। ব্যগ্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—“কি হয়েছে বেলা?”
ব্যথায় কাতর বেলা চোখ-মুখ কুঁচকে বললো,
—“এভাবে হাঁটতে পারবো না আমি। পায়ে অনেক জ্বালা করছে।”
কোমড় থেকে হাত সরালো আদ্র। এক আঙুলে কপাল ঘোষে এদিক-ওদিক তাকালো কয়েকবার। এখানটায় মানুষজন নেই। সুদূরে ঝাড়ু দিচ্ছে সেই মহিলা। কিন্তু একটু সামনে যেতেই হয়তো জনমানবের দেখা মিলবে। দৃষ্টি ফিরিয়ে বেলার ব্যথাতুর মুখপানে স্থির হলো আদ্র। গম্ভীর গলায় আয়াজকে বললো,
—“নতুন মাক্সগুলো থেকে একটা আমাকে দে আয়াজ।”
অতি বিস্ময়ে এতক্ষণ হতভম্ব হয়ে ওদের দিকে চেয়ে ছিলো আয়াজ। আদ্রর কথায় সম্বিৎ ফিরতেই পকেট থেকে মাক্সগুলো বের করলো সে। সেখান থেকে নতুন একটা নিয়ে এগিয়ে দিলো আদ্রের দিকে। ডাকলো, “ভাই? নে।”
আদ্র না তাকিয়েই নিলো। বেলা থেকে ক্ষীণ দূরত্ব তৈরি করে স্বযত্নে মাক্সটি পরিয়ে দিলো তাকে। নাক অব্দি ওড়না টানা, এখন আবার নাক থেকে থুতনির নিচ পর্যন্ত নীল রঙা মাক্স! বেলার মুখটা ছোটখাটো একটা প্যাকেট হয়ে গেছে। চেনার উপায় নেই। ব্যথা আর গরমে অতিষ্ঠ বেলা মুখ বুঝে সহ্য করে নিলেও আয়াজ প্রতিবাদ করে উঠলো,
—“মেয়েটাকে আবার মাক্স পরালি কেন ভাই? এমনিতেই গরমে মুখ ঘেমে আছে ওর। মাক্স পরলে আরও গরম লাগবে না?”
জবাব দিতে একটু সময় নিলো আদ্র। দূরত্ব ঘুচিয়ে হঠাৎ কোলে তুলে নিলো বেলাকে। বেলা অধিক চমকে ভড়কালো, হকচকালো। ভীতু চোখ জোড়া বড় বড় করে তাকালো। আদ্র সেদিকে মোটেও পাত্তা দিলো না। সামনে এগোতে এগোতে আগের চেয়েও বেশি গাম্ভীর্য নিয়ে দাম্ভিক, ভরাট গলায় উত্তর দিলো,
—“আমাকে এলাকায় এমনিতেও খারাপ জানে সবাই। আমি চাই না আমার জন্য ওকেও কেউ খারাপ জানুক। আমি সহ্য করবো না সেটা।”
এই ঠাঠা পরা রোদেও তিরতির করে হাত, পা ঠান্ডা হয়ে গেল বেলার। শরীর মৃদু, মৃদু কাঁপতে লাগলো।
__________
আসার পথে আদ্র আর বেলার দিকে অনেকেই চোখা দৃষ্টির তীর ছুঁড়ে মেরেছে অতি ক্রুদ্ধভাবে। যদিও বেলাকে কেউ চিনতে পারেনি। কিন্তু তবুও লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে মাথা নিচু করে ছিল সে। মনে মনে ভেবে নিয়েছে, জীবন থাকতে এ জামা পরে আর কখনোই বাহিরে বের হবে না সে।
ভাবনার মাঝেই চোখ উঠিয়ে সামনে তাকালো বেলা। অবাক হলো। আদ্র তার বাড়িতে না গিয়ে এদিকে কোথায় যাচ্ছে? প্রশ্ন চাপিয়ে না রেখে বিহ্বল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠলো সে,
—“আপনি আমাকে এদিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আদ্র ভাইয়া? আমাদের বাড়ি তো সামনেরটা।”
আদ্র উত্তর দিলো না। তাকালো না পর্যন্ত। বেলা গলার জোড় বাড়িয়ে আবার বললো,
—“আশ্চর্য! কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনি? বলছেন না কেন?”
আদ্র এবারো নিশ্চুপ। আদ্রদের বাড়ির পেছনের দিকটায় আধভাঙ্গা একটা ছোট্ট ঘর আছে। ছাদ থেকে একবার দেখেছিল বেলা। ঘরটির দেওয়ালগুলো কাঠের আর ছাদ টিনের। সেই ঘরটিতেই বেলাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো আদ্র। আলতো করে সোফায় বসিয়ে দিলো তাকে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো,
—“এত হালকা কেন আপনি? খাবার খান না?”
বেলা বিদ্রুপ করতে চাইলো, “আমি মোটেও হালকা নই। ঠিকই আছি। আপনার চোখে সমস্যা।”
কিন্তু তা আর করা হলো না। সে আপাতত আশপাশটা দেখতে ব্যস্ত। বাহির থেকে ঘরটা যতটা ভাঙ্গা মনে হয়, তার থেকেও বেশি পরিপাটি এর ভেতরটা। মাঝারি আকারের একটা রুম। যার দেওয়াল জুড়ে বিভিন্ন যান্ত্রিক সরঞ্জাম। বুকসেল্ফে অনেকগুলো ফাইলের স্তুপ আর বই। ডান পাশের দেওয়ালে ছোটোখাটো একটা রান্নাঘর। আর রয়েছে একটা সোফা। যেখানে এখন বেলা বসে আছে।
একটু পর আয়াজও ঢুকলো সেই ঘরে। বেলাকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে হেসে বললো,
—“ঘরটা সুন্দর না বেলা? ভাই এখানেই থাকে বেশিরভাগ। মাঝে মাঝে রান্নাও করে।”
বেলা শুনলো। তবে কিছু বললো না। সরব আদ্র কোথা থেকে ফাস্টএইড বক্স নিয়ে তার পায়ের কাছে এসে বসলো। আঁতকে উঠে বাঁধা দিতে চাইলে মৃদু ধমক দিয়ে উঠলো সে,
—“চুপ করে বসুন বেলা।”
বেলা চুপ হয়ে গেল। অসন্তুষ্ট চাহনিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। পায়ে প্রাথমিকভাবে ব্যান্ডেজ করে তক্ষুণি উঠে দাঁড়িয়েছে আদ্র। পকেটের ভেতর থেকে লাইট জ্বলে উঠছে। কলের শব্দ কানে ঝংকার তুলছে তীব্রভাবে। অথচ ফোনটা বের করে কল রিসিভ করার প্রয়োজন বোধ করছে না আদ্র। বরং আয়াজকে বললো,
—“আমার একটু কাজ আছে। তুই ওকে ওর বাসায় দিয়ে আসিস। আর ওর বাসার কেউ ব্যান্ডেজের কথা জিজ্ঞেস করলে কিছু একটা বানিয়ে বলিস। এখন চোখ বন্ধ কর।”
সঙ্গে সঙ্গে নাক কুঁচকে ফেললো আয়াজ, “কি?”
—“চোখ বন্ধ করতে বলেছি তোকে।”
তারপর আবার বেলার দিকে তাকিয়ে আদেশের সুরে বললো,
—“আপনিও চোখ বন্ধ করুন।”
বেলা থতমত খেয়ে চোখ বুজলো। তার কিছুক্ষণের মাঝেই হঠাৎ কপালের উষ্ণ স্পর্শ কাঁপিয়ে তুললো তাকে। নিশ্বাস গাঢ় থেকে গাঢ়তর হলো। তৎক্ষণাৎ চোখ মেলে তাকালো বেলা। কিন্তু তার সামনে আদ্র নেই। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আয়াজ মিটিমিটি হাসছে। দরজা ঠেলে এইমাত্র বেড়িয়ে গেছে আদ্র।
__________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা