প্রিয় বেলা
১০.
নির্জন, নিস্তব্ধ চারিপাশ। আকাশে জ্বলজ্বল করছে অসংখ্য তারা। দূর থেকে মৃদু আলোর ক্ষীণ ছটা পরছে বেলার মুখশ্রী জুঁড়ে। বাতাসে প্রেমময় ঘ্রাণ। অথচ মলিন তার আঁখিজোড়া। মাথা নত করা। ধীরে ধীরে চোখ তুলে আদ্রর দিকে তাকালো সে। খুব আস্তে করে বললো,
—“আপনি সত্যিই পাগল হয়ে গেছেন। কি বলছেন আপনি নিজে জানেন?”
আদ্র ভ্রু কুঁচকালো, “জানবো না কেন?”
—“আপনি দয়া করে এসব কথা আর বলবেন না। আমার কাছ থেকে দূরে থাকুন।”
আদ্র পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। স্বাভাবিক স্বরে বললো,
—“নিজের অস্তিত্ব থেকে দূরে সরে যেতে বলছেন বেলা?”
যেন কোথাও খুব জোড়ে বাজ পরলো। সেই শব্দে কেঁপে উঠলো বেলার সর্বাঙ্গ। শিরা-উপশিরায় তৈরি হলো অস্থির কম্পন, শিরশির অনুভূতি। আদ্রর চোখে না পাওয়া আকুলতা। দৃষ্টি গভীর সমুদ্রের ন্যায়। কতগুলো অব্যক্ত কথার অভিব্যক্তি। বেলার মন যেন নিমিষেই পাথরে পরিণত হলো। যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে সে শক্ত কণ্ঠে বললো,
—“আপনি ভুল করছেন।”
—“একদম না।”
—“রাজনীতিবিদরা খারাপ হয়।”
—“কে বলেছে?”
—“বাবা।”
—“আপনারও তাই মনে হয়?” অবাক হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো আদ্র।
বেলা সময় নিলো না। আদ্রর চোখে চোখ রেখে আগের ন্যায়ই জবাব দিলো, “হ্যাঁ।”
আদ্র থমকালো। চেহারায় এক মুহুর্তের জন্য বিস্ময় ভাব বাড়লেও পরক্ষণেই তা ফিকে পরে গেল। মুখশ্রী হলো গম্ভীর, দাম্ভিকতায় পূর্ণ। ঠোঁটে হাসির রেশ মাত্র নেই। চোয়ালে শক্ত দার। তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে সে ভীষণ কঠিন গলায় বললো,
—“তবে পছন্দ করা শুরু করে দিন বেলা আহসান। এই রাজনীতিবিদেরই হবেন আপনি।”
বেলা বেশিক্ষণ আদ্রর পানে তাকিয়ে থাকতে পারে না। চোখ জ্বালা করছে তার। কণ্ঠ কাঁপছে। আদ্র থেকে দূরে সরতে চাইলে সে স্বেচ্ছায় সরে যায়। একপলক বেলার দিকে অনিমেষ চাহনি নিক্ষেপ করে রেলিং টপকে চলে যায় ওই ছাদে।
বেলা এতক্ষণ ঘোরে ছিল। এইমাত্র সম্বিৎ ফিরলো তার। দ্রুত ছাদের মেঝে থেকে কাপড়গুলো উঠিয়ে ছাদ থেকে যাওয়ার জন্য উদ্যাগী হলো। পেছন থেকে আদ্রর থমথমে গলা শোনা গেল,
—“আমি কিন্তু আমার কথার অমান্য করি না বেলা। আপনি শুধু আমারই হবেন।”
বেলা দাঁড়ায় না। ব্যগ্র হয়ে সামনের দিকে একেকটা পা ফেলে।
__________
আলমারি থেকে একটা অল্প কাজ করা শাড়ি বের করে তা পরে নিলো বেলা। তার শাড়ি পড়া হয় না অত। তাই আলমারিতে শাড়ির সংখ্যাও খুবই নগন্য। মায়ের শাড়িগুলো অতিরিক্ত ভারী। ওসব পড়তে ভালো লাগে না তার। নিজেকে কেমন একশত কেজি ওজনের মহিলা মনে হয়।
শাড়ির কুঁচি অল্পসল্প ঠিক করে চুলগুলো খোঁপা করে নিলো সে। সাজ বলতে একটু কাজল। পাশের বাসায়ই তো যাবে সে। সেখানে এত সাজগোজ করতে হবে কেন? আয়নার দিকে একপলক তাকালো বেলা। নিজের প্রতিচ্ছবিতে এক সাধারণ রমণীকে দেখা যাচ্ছে। যার কেশগুলো খোঁপা করা সত্ত্বেও খুব এলোমেলো, অগোছালো, নিয়ন্ত্রণহীন। দু’হাত উঁচিয়ে কোনোভাবে আবারও খোঁপা করে নিলো সে। একহাতে কুঁচি সামলে রুম থেকে বের হয়ে ড্রইংরুমে আসলো। প্রভা বেগম বিহানের চুল আঁচড়ে দিচ্ছিলেন। বিহানও বেলার রঙয়েরই একটা পাঞ্চাবী পরে আছে।
বেলাকে ভীষণ সাদাসিধে পোশাকে থেকে একটু রেগেই গেলেন তিনি। কপাল কুঁচকে মৃদু ধমক দিয়ে বললেন,
—“এটা কি ধরণের শাড়ি পরেছিস বেলা? মুখে তো কিচ্ছু লাগাসই নি মনে হয়। তুই কি আমার নাক কাটাতে চাচ্ছিস সবার সামনে? বিয়ে বাড়িতে কেউ এভাবে যায়?”
বেলা বিরক্ত হয়ে বললো,
—“পাশের বাড়িতেই তো যাবো মা। সেখানে এত সাজার কি আছে? শাড়ি পরতে বলেছ পরেছি। তাছাড়া বিয়ের অনুষ্ঠান তো আর হচ্ছে না। আরুর আক্ত হবে শুধু।”
মেয়ের কথায় অসন্তুষ্ট হলেও প্রকাশ করলেন না প্রভা বেগম। ক্ষীণ রয়েসয়ে বললেন,
—“আচ্ছা, না সাজলি। অনতত শাড়িটা তো পালটা! আলমারির একদম সামনেই আমার নীল শাড়িটা আছে। ওটা পর গিয়ে, যা।”
বেলা এবার তীব্র প্রতিবাদ জানালো, “মা, আজকে আরুর বিয়ে। আমার না। নীল শাড়িটা কত কাজ করা তুমি জানো না? ছোটখাটো একটা কাঁচের লাইট লাগবে আমাকে।”
বলে প্রভা বেগমকে সুযোগ না দিয়ে আবার বিহানকে বললো,
—“তোর কি রেডি হওয়া হয়েছে? হলে আয়। আমি এখনই বের হবো।”
বিহান তড়িৎ গতিতে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বেলার কাছে আসতে আসতে বললো,
—“আমি রেডি। চলো।”
যাওয়ার আগে একবার মায়ের দিকে তাকালো বেলা। তিনি মুখ ফুলিয়ে বসে আছেন। তা দেখে সে হাসলো একটু। জিজ্ঞেস করলো, “তোমরা কখন ওখানে যাবে মা?”
প্রভা বেগম হতাশ গলায় বললেন,
—“তোর বাবা অফিস থেকে আসলেই যাবো।”
__________
নিস্তব্ধ বাড়িটা হুট করেই মানুষে ভরে গেছে। তাদের কাউকেই চেনে না বেলা। কয়েক হাত দূরে এখনো কিছু লোক গাঁদাফুল দিয়ে বাড়ি সাজাতে ব্যস্ত। বিহানের হাত ধরে এদিক-ওদিক তাকালো সে। ভীষণ অস্বস্থি হচ্ছে তার। রেখাকেও কোথাও দেখছে না। এরমধ্যে বিহানও হাত ছাঁড়ার জন্য বারবার বলছে। রেগে গিয়ে বেলা চোখ রাঙিয়ে তাকালো,
—“এমন শুরু করেছিস কেন বিহান? চুপচাপ দাঁড়াতে পারিস না? কি হয়েছে?”
বিহান তখন নাকমুখ কুঁচকে উত্তর দিলো, “ওইযে, ওখানে মনেহয় আয়াজ ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। চলো উনার কাছে যাই।”
বিহানের ইশারাকৃত স্থানে বেলাও তাকালো। দূর থেকে আদ্রর চোখের দাগটা নজরে এলো না তার। সুতরাং আদ্রকে আয়াজ ভেবেই সেদিকে এগোলো সে। আদ্র তখন ফোনে কি যেন করছিল। বেলা মৃদু স্বরে ডেকে বললো,
—“আয়াজ ভাইয়া, রেখা আন্টি কোথায় জানেন?”
আদ্র ফোন থেকে চোখ সরালো। আপাদমস্তক দেখে নিলো বেলাকে। তারপর প্রচন্ড অনীহা প্রকাশ করে ফোনের স্ক্রীনে দৃষ্টি স্থির করলো আবার। বেলা আদ্রর সূক্ষ্ণ দাগটা দেখতেই চুপসে গেল। নেত্রজোড়া হলো অস্থির। আদ্র এখনো গালে ব্যান্ডেজ করে নি। সে মনে মনে ভাবলো, এত বেপরোয়া কেন লোকটা?
তক্ষুণি আদ্র গম্ভীর স্বরে বললো, “উপরের প্রথম রুমটায় আম্মু আছে। আরুর কাছে।”
এরপর আর কিছু বলে নি আদ্র। বেলাকে ‘ধন্যবাদ’ বলার সময়টুকুও দেয় নি। চোখ ধাধানো উপেক্ষা করে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে মাত্র। আদ্রর এহেন উদ্ভট আচরণে কিংকর্তব্যবিমুঢ় বেলা। কাল সন্ধ্যায়ও এমনই উপেক্ষা করেছিল আদ্র। বেলা বুঝতে পারছে না, আদ্র এমন ব্যবহার করছেই বা কেন?
ভাবনার অকুল পাথারেই হাত ছেড়ে দৌঁড়ে অন্যদিকে চলে গেল বিহান। সবার সম্মুখে বেলা ধমক দিতে পারলো না। বিহানকে রেখেই উপরে চলে গেল। সিঁড়ির কাছের রুমটায় একবার উঁকি দিতেই রেখাকে দেখতে পেল। আরুকে গহনা পরিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি। উৎফুল্লতায় মুখশ্রী জ্বলজ্বল করছে উনার। ঠোঁটে অমায়িক হাসি। রুমের দরজায় চোখ পরতেই বেলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সঙ্গে সঙ্গে ডেকে উঠলেন রেখা,
—“ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন বেলা? এদিকে আসো।”
বেলা আস্তেধীরে উনার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। রেখা প্রফুল্ল মনে আবারো বলে উঠলেন,
—“দেখো তো বেলা, আমার মেয়েটাকে সুন্দর লাগছে না?”
বেলা আরুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো, “জি আন্টি। আরুকে ভীষণ সুন্দর লাগছে।”
আরু মাথা নিচু করে লাজুক হাসলো। একপলক বেলার দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনাকেও খুব সুন্দর লাগছে আপু।”
–
বরপক্ষ এসে পরেছেন। তা নিয়ে তোড়জোড় একটু বেশিই শুরু হয়ে গেছে চারপাশটায়। বেলা সবার সঙ্গে ড্রইংরুমের পাশটায় যাচ্ছিল। হঠাৎ কেউ তার হাত ধরে আঁটকে দিলো। টেনে নিয়ে যেতে লাগলো সামনের দিকে। বেলা ভীতু নয়নে হাতটির মালিকের দিকে তাকালো। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। পরনে কালো রঙের পাঞ্চাবী। চুল ভেঁজা। এইমাত্র গোসল করে এসেছে বোধহয়। বেলা তৎক্ষণাৎ বুঝে ফেললো এটা আদ্র। সে তাকে বাড়ির পেছনের দিকটায় নিয়ে এসেছে। লম্বালম্বি বারান্দায়।
বেলার হাত ছেড়ে দিলো সে। কপালের ভেঁজা চুলগুলো একহাতে ঠেলে বললো, “এত সাধারণ ভাবে না আসলেও পারতেন বেলা। এভাবে আমাকে অশান্ত না করলেও পারতেন।”
বেলা ঠোঁট কামড়ালো। অপ্রস্তুত হলো খুব। ভড়কালো। বলতে চাইলো, “আপনি তখন ওভাবে কথা বলছিলেন কেন?”
—“আপনিই তো বলেছেন দূরে থাকতে।”
—“কিন্তু আমি—” থেমে গেল বেলার কণ্ঠ। আদ্র এগিয়ে এলো। ছুঁয়ে দিলো বেলার নেত্রপল্লব। বেলা চমকিত হয়ে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। পাঁপড়িগুচ্ছে বৃদ্ধাঙ্গুল চালাতে চালাতে আদ্র অস্বাভাবিক শান্ত স্বরে বললো,
—“সামনে ইলেকশন বেলা। আমি যখন-তখন, যে কারো সামনে আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারবো না। শত্রুরা ওত পেতে থাকে আমার ক্ষতি করার জন্য। আপনাকে আমার সঙ্গে দেখলে আপনারও ক্ষতি করতে চাইবে। আমি সেটা অবশ্যই চাইবো না বেলা।”
আদ্র থামলো। বেলা তখনো চোখ মেলে নি। শক্ত মনে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রর খুব নিকটে। অতি ঘনিষ্ঠে। আদ্র বেলার বন্ধ চোখে চেয়ে থেকে ঢিমে যাওয়া স্বরে আবার বললো,
—“বেলা, আপনি আমার দূর্বলতা নন, শক্তি হবেন। অপ্রিয় নন, প্রিয় বেলা হবেন।”
___________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা