প্রিয় বেলা
১১.
সূদুর হতে কোয়েল পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। পাষাণ সূর্যটির আজ একটু দয়া হয়েছে বোধহয়। তেজ নেই অত। বেলা রিকশায় উঠে ওড়নাটা কোলে গুটিয়ে বসল। রিকশা চালক তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
—“কেমন আছেন মা? আইজকা এত দেড়ি কইরা আইলেন যে? শরীর সুস্থ আছে?”
বিনিময়ে হাসলো বেলাও, “জি চাচা। ঠিক আছি। আসলে ঘুমাচ্ছিলাম তো। আসতে সত্যিই দেড়ি করে ফেলেছি।”
—“ওহ্! আমি আরও ভাবছিলাম আফনি আর আইবেনই না। যাত্রী একখান উঠাইতেও নিছিলাম। শুধু দামে পটে নাই।”
বেলা বিনয়ী ভঙ্গিতে বললো,
—“আপনার আমার জন্য শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকার প্রয়োজন নেই চাচা। আমি কোন সময় টিউশন করি না করি, তার ঠিকঠিকানা আমার নিজেরও জানা নেই। আপনি কষ্ট করে আর দাঁড়িয়ে থাকবেন না।”
এ কথার পিঠে শব্দ করে হাসলো রিকশা চালক করিম। বললো,
—“আরে কি কন মা? কষ্ট কিসের? আদ্র স্যার আমারে বিশ্বাস কইরা কাজখান দিসে, এইডাই আমার জন্যে অনেক। উনি না থাইকলে এই রিশকাডাও চালাইতে পারতাম না। পরিবার নিয়া না খাইয়া মরতে হইতো।”
বেলা শুনলো। তবে কিছু বললো না। ট্রাফিকের লালবাতি জ্বলে উঠতেই থেমে গেল সব গাড়ি। সেই সঙ্গে তাদের রিকশাও থেমে গেছে। বেলা বিরক্ত হলো খুব। এমনিতেও আজ বের হতে দেড়ি করে ফেলেছে সে। তার ওপর এই জ্যাম! বিরক্তিতে বারকয়েক তপ্ত নিশ্বাস ফেললো সে। দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যান্ত্রিক শহরটাকে দেখতে লাগলো। জ্যাম ছাড়তে এখনো ক্ষীণ দেড়ি। যানবাহনের ভীড় খুব।
এদিক-ওদিক নজর ঘুরাতে ঘুরাতে হঠাৎ ডান পাশের ফুটপাতে দৃষ্টি স্থির হলো বেলার। আদ্র ইয়ানিদ তার দলবল নিয়ে ফুটপাত দিয়ে হাঁটছে। পরনে সাদা পাঞ্চাবী। ফর্সা মুখটা ঘেমে রক্তিম রঙ ধারণ করেছে। চোখে কি ভয়ংকর তীক্ষ্ণতা। যেন কোনো বিষয়ে ভীষণ বিরক্ত সে। নাকমুখ কুঁচকে পাশের ছেলেটাকে ধমক দিচ্ছে একটু পরপর। সবার হাতেই অনেকগুলো কাগজ, কার্ড। বেলা চেয়েই রইলো। আঁখিজোড়া দৃষ্টি ফেরাতে নারাজ। রিকশা চালক আদ্রকে দেখতে পেলেন। উৎফুল্ল মনে হেসে বললেন,
—“মা, ওইটা আদ্র স্যার না? সাইমনে তো ভোট হইবো। ওইটার লাইগাই বাইর হইছে মনে অয়। খাঁড়ান, উনারে ডাকি।”
বেলা সঙ্গে সঙ্গে মানা করে উঠলো,
—“দরকার নেই চাচা। উনি হয়তো ব্যস্ত।”
রিকশা চালক হতাশ হলো। তবুও বেলার মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে বললো, “আইচ্ছা। আফনি যা ভালো মনে করেন।”
আদ্র বেলাকে দেখতে পায় নি। ব্যস্ত পায়ে চলে গিয়েছে সেখান থেকে। বেলা অন্যমনস্ক হয়ে পরে। ভাবে, কি কঠিন লোককে নিজের মন দিতে বসেছে সে। যার সাথে স্বাধীন ভাবে দেখা করা নিষেধ, কথা বলা নিষেধ। এই নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতিই মানুষের ঝোঁক থাকে বেশি। বেলারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে। একে একে চলতে শুরু করেছে সকল যানবাহন।
__________
সন্ধ্যা সাতটা বেজে পয়তাল্লিশ। রাত হয়ে গেছে প্রায়। চিন্তিত বেলা বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। বাহিরের অবস্থাও ভালো নয়। বৃষ্টি হচ্ছে। মুষলধারে বৃষ্টি। বেলা একবার নূপুরের দিকে তাকালো। মেয়েটির লেখা শেষ প্রায়। একটু পর খাতাটা তাকে দিতেই বেলা দ্রুত দেখে নিলো লেখাটি। কিছু বানান শুধরে দিলো। শেষে পড়া দাগিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠতে নিলেই নূপুরের মা ঢুকলেন রুমে। বেশ কাঠখোট্টা মহিলা তিনি। খুঁতখুঁতে স্বভাবের। বেলা তাকে দেখে মৃদু কণ্ঠে সালাম দিলো। মহিলা সালামের উত্তর নিলো না। গমগমে স্বরে বললো,
—“তুমি এমন করলে তো হচ্ছে না বেলা। এত গাফলতি করলে আমার মেয়েকে পড়ানোর দরকার নেই। প্রতিদিন, প্রতিদিন দেড়ি করে আসলে আমার মেয়ে বাকি পড়া পড়বে কখন?”
বেলা একপলক নূপুরের দিকে তাকালো। সে চুপচাপ মাথা নিচু করে খাতা দাগাচ্ছে। অত্যন্ত নম্র স্বরে বেলা বললো,
—“আমিও মানুষ আন্টি। মাঝে মাঝে দেড়ি হতেই পারে। কিন্তু তাই বলে আমি তো ইরেগুলার নই। পারলে শুক্রবারও পড়িয়ে যাই ওকে।”
উনার ভালো লাগলো না বেলার কথাগুলো। মুখ কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বললেন,
—“এতসব আমি জানি না। তুমি যদি টাইম মতো না আসতে পারো তাহলে আমার মেয়ের জন্য অন্য টিচার খুঁজতে বাধ্য হবো আমি।”
বেলার এবার প্রচন্ড রাগ হলো। তবে তা প্রকাশ করলো না সে। খুব শান্ত ভাবে হ্যান্ডব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
—“তবে নতুন টিচার খোঁজা শুরু করে দিন আন্টি। আমি আর নূপুরকে পড়াতে পারছি না।”
নূপুরের মা চোখ বড় বড় করে তাকালেন। বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললেন,
—“মানে? কি বলছো এসব? কয়েকদিন পর আমার মেয়ের পরীক্ষা। আমি এখন নতুন টিচার পাবো কোথায়?”
বেলা মুচকি হেসে প্রতিউত্তর করলো,
—“তা আপনার আগে ভাবা উচিত ছিল আন্টি। আসি। ভালো থাকবেন।”
বেলা বেড়িয়ে পরলো ঠিকই কিন্তু ভেতরে ভেতরে চিন্তায় ভীতুগ্রস্ত সে। বাহিরের অবস্থা আশংকাজনক। এদিকটায় রিকশা, সিএনজির দেখা মেলা মানে মূল্যবান কিছু পাওয়া। তারওপর ছাতাও আনেনি সে। জবুথবু হয়ে নূপুরদের বাড়ির সদরের দিকটায় দাঁড়ালো বেলা। ব্যাগ থেকে ফোন বের করলো। ডায়াললিস্ট থেকে আদ্রর নম্বর বের করলেও কল দিতে ভীষণ দ্বিধাবোধ করছে সে। সামনে তাকিয়ে একবার বৃষ্টি পরখ করে নিলো বেলা। এরপর অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধেই কল লাগালো আদ্রকে।
একবার রিং হলো, দু’বার রিং হলো, তৃতীয় বারের সময় কল ধরলো আদ্র। তবে কিছু বললো না। বেলা মিনমিনে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—“হ্যালো। শুনছেন আপনি?”
আদ্রর গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন,
—“কোথায় আপনি? বাসায় পৌঁছেছেন?”
—“না। বৃষ্টির কারণে বের হতে পারছি না।”
—“করিম আঙ্কেল নিতে আসেন নি আপনাকে?”
—“আসেন নি বোধহয়। আমি দেখছি না উনাকে। এখানে গাড়িঘোড়াও নেই। আমি বুঝতে পারছি না কিভাবে যাবো।”
সে কোমলস্বরে বললো,
—“আপনি এখন কোথায়?”
—“স্টুডেন্টের বাসায়ই আছি।”
আদ্র কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিলো, “ওখানেই থাকুন। আসছি আমি।”
–
আধঘণ্টা পার হয়ে গেল। আদ্রর দেখা নেই। ক্ষীণ ভয়টা এবার মারাত্বক হলো যেন। শীতও লাগছে প্রচন্ড। বেলা বাসার একটু ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালো। সিঁড়ির কাছে।
আদ্র এলো তার কিয়ৎক্ষণ পরই। বাসার কোথাও বেলাকে না দেখতে পেয়ে নিমিষেই বুক ভারী হলো তার। অস্থির চিত্বে আশপাশটায় আবারও চোখ বুলালো। নিশ্বাসের গতি এলোমেলো। হৃদযন্ত্রের আওয়াজ অস্বাভাবিক দ্রুত। বেহিসাবি হয়ে উঁচু কণ্ঠে ডাকতে লাগলো বেলাকে। প্রচন্ড বৃষ্টির মাঝে সেই ডাকটি অস্পষ্ট হলেও শুনতে পেল বেলা। সে দ্রুত পদে বেড়িয়ে এলো বাসা থেকে। আদ্রর পরনে এখনো সেই সাদা পাঞ্চাবী। যা বৃষ্টিতে ভিঁজে তার গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে। চোখের শিরা-উপশিরা লাল আভায় সিক্ত। হাঁপাচ্ছে সে। স্থির দৃষ্টি বেলার মুখপানে। বেলা আলতো করে ডাকতে চাইলো, “আদ্র—।”
আদ্র সময় নিলো না। এগিয়ে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তাকে। কাঁধে কপাল ঠেকিতে চুপ করে রইলো অনেক্ষণ। বেলা তার কাঁপা হাতটি আদ্রর পিঠে রাখলো। আশ্বস্ত করে বললো,
—“অস্থির হবেন না। আমি ঠিক আছি।”
আদ্র শুনলো না। ওভাবেই রইলো। তারপর একটু শান্ত হতেই নিষ্প্রাণ স্বরে আওড়ালো,
—“আমি আপনাকে অনেক খুঁজেছি বেলা।”
_____________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা