প্রিয় বেলা
৩৪.
জ্বরের ঘোরে আবোলতাবোল বকছে বেলা। শরীরের উষ্ণতা দ্বিগুণ বেড়ে তেজস্বী হয়ে উঠছে। আদ্রর সঙ্গে লেপ্টে আছে খুব গভীর ভাবে। গায়ে দু’টো কম্বল জড়ানো। এসির তাপমাত্রা কমিয়ে দেওয়া। উত্তপ্ত বেলার সংস্পর্শে এসে ঘাড়, গলা, কপাল ঘেমে একাকার হয়ে আছে আদ্রর। বাহিরে তখনো বৃষ্টি চলমান। বজ্রপাত হতেই তীব্র আলোয় আকাশ ঝলসে উঠছে সেকেন্ড কয়েকের জন্যে। গুড়ুম, গুড়ুম আওয়াজে মুখরিত হয়ে আছে আশপাশ। প্রকট ভাবে শোনা যাচ্ছে এর তীব্রতা। দৈবাৎ ক্ষীন নড়েচড়ে উঠলো বেলা। গাল ঘঁষলো বিস্তর শক্ত পুরুষালি বুকে। দূর্বল হাতে শার্ট খামচে ধরলো। বিড়বিড় করে কি যেন বললো। বুঝতে পারলো না আদ্র। আদুরে ভাবে আগলে ধরলো তাকে। চুলের ভাঁজে হাত বুলিয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
—“কি হয়েছে বেলা? খারাপ লাগছে? বেলা? আমার দিকে তাকাও।”
বেলা তাকালো না। হাঁসফাঁস করতে লাগলো। নেত্রপল্লব খিঁচে বুজে রাখা। মুখশ্রী রক্তশূণ্য হয়ে ভীষণ ফর্সা দেখাচ্ছে। ফ্যাকাসে হয়ে আছে অধরযুগল। কম্পিত কণ্ঠে খুব অস্পষ্ট ভাবে থেকে থেকে সে কোনোমতে বললো,
—“আমার মাথা ব্যথা করছে আদ্র। আমি সহ্য করতে পারছি না।”
বক্ষস্থলে যেন হঠাৎই পাথরের আবির্ভাব ঘটলো। প্রচন্ড ভারী হয়ে উঠলো নিমিষেই। আপনা-আপনি ডান হাতের পাতা বেলার ললাট স্পর্শ করলো। আগের চেয়ে গরম লাগছে। ক্ষীণ কম্পয়মান শরীর খুব ভাবে কাঁপিয়ে তুলছে তার ভেতরটা। অশান্ত, অস্থির কণ্ঠ শান্ত, স্বাভাবিক করে আদ্র শুধালো,
—“বেশি খারাপ লাগছে? দেখি, আমাকে ছাড়ো। আমি ঔষধ খুঁজে আনছি।”
বেলা বিন্দুমাত্র সরলো না। অবাধ্য হলো। খামচে ধরা হাতটার শক্তি আরও বাড়িয়ে আহাজারি করে উঠলো,
—“আপনি যাবেন না। কোথাও যাবেন না।”
—“ঔষধ খেতে হবে তো বেলা। ব্যথা বেড়ে যাবে না?”
—“বেড়ে যাক। তবুও যাবেন না।”
প্রেমিকার নাছোরবান্দা স্বভাবে মুহুর্তেই পরাজিত হলো প্রেমিক পুরুষ। পরাস্ত নয়নে বেলার কাতর মুখশ্রীর পানে চেয়ে রইলো খুব করে, অনেক্ষণ লাগিয়ে। সিক্ত নেত্রজোড়া পরখ করলো। মায়াবী মুখখানায় আরও একবার আহত হলো খুব বাজেভাবে। ক্ষতবিক্ষত হলো হৃদযন্ত্র। কোমলস্বরে বললো,
—“আচ্ছা, যাচ্ছি না। এই তো আছি। কাঁদে না।”
নিষ্ঠুর অশ্রুকণা কি শুনলো তা? একদমই না। প্রিয় মানুষটার আরেকটু আহ্লাদ পেতেই তরতর করে গতিপথ বাড়িয়ে দিলো। শার্ট ভিঁজিয়ে দিলো অতি সন্তপর্ণে।
সময় গড়িয়েছে। বৃষ্টি থেমেছে কিছুক্ষণ হলো। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। রবির শেষ কিরণ জানালা গলিয়ে আদ্রর সারা মুখে ছড়িয়ে আছে। একটু আগেও চোখের পাতা তন্দ্রার কারণে মেলতে না পারলেও এখন সে পালিয়েছে। কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না। বেলার কান্নার আভাস নেই। তার বুকে গুটিয়ে শুয়ে আছে সে। নিশ্বাস নিচ্ছে ঘন ঘন। চুল এলোমেলো হয়ে গেছে আবার। আদ্র চুলগুলো এলোমেলোই রাখলো। ঠিক করলো না। অবিন্যস্ত বেলার খুব গভীরে ডুবলো। আঁচলের ভাঁজে ভাঁজে দৃষ্টি ঘুরালো। অন্যরকম গলায় ডাকলো,
—“বেলা।”
ক্ষীণ কন্ঠস্বরে উত্তর দিলো বেলা,
—“জি।”
—“ব্যথা কমেছে?”
বেলা মাথা ঝাকালো। তবুও আবার প্রশ্ন করলো আদ্র, “সত্যি কমেছে?”
—“হ্যাঁ।”
—“তবে আমি যদি একটু বেহায়া হই?”
নিঃসঙ্কোচ আবদারের পিঠে বেলা চমকালো, ভড়কালো, বিহ্বল হলো। তৎক্ষণাৎ নজর তুলে তাকালো। বিমূঢ়তায় কি বলবে ভেবে পেল না। পলক ঝাপটালো। লাজুক রাঙা হলো গাল। চোখ দু’টো নুইয়ে গেল। নীরবে সম্মতি পেতেই দূর্বোধ্য হাসলো আদ্র। আদুরে ভাবে কাছে টেনে নিলো বেলাকে।
–
সকাল থেকে বেলা রান্নাঘরে কাজ করছে। আদ্রর সামনে আসছে না। গলা উঁচিয়ে কয়েকবার ডাকার পরও মেয়েটার আসার নাম নেই। এতে মারাত্ত্বক বিরক্ত আদ্র। চোখ, মুখ ভীষণ কুঁচকানো। ভ্রঁ বাঁকানো। ধপধপ পায়ে ড্রইংরুমে এসে সোফায় বসলো সে। রান্নাঘরে আড়নজরে তাকালো। কিন্তু বেলার দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। যেন অদৃশ্য হওয়ায় প্রাণপণ প্রতিজ্ঞা করেছে মেয়েটা। আয়াজ বসে বসে আদ্রকে পর্যবেক্ষণ করছিল। আদ্রর দেখাদেখি সেও রান্নাঘরে একবার উঁকি দিলো। জিজ্ঞেস করলো,
—“বেলাকে খুঁজছিস ভাই?”
আদ্রর গম্ভীর কণ্ঠ, “না।”
আয়াজ মুচকি হাসলো,
—“ঝগড়া করেছিস?”
—“না।”
—“তাহলে?”
—“লজ্জা পাচ্ছে। সামনে আসতে চাইছে না।”
গম্ভীর কণ্ঠের হাস্যকর অভিযোগ। আয়াজ নিজেকে আটকাতে পারলো না। জোরে জোরে হেসে ফেললো। হো হো করে। শব্দ হলো খুব। ঠাট্টা করে বললো,
—“তুই লজ্জা দিয়েছিস কেন? মেয়েটা তো আর তোর মতো নির্লজ্জ না।”
আদ্র তীক্ষ্ণ নেত্রে তাকালো। দৃঢ়তা নিয়ে প্রশ্ন করলো,
—“আমি নির্লজ্জ?”
আয়াজ জবাব দিলো না। আগের মতোই হাসতে লাগলো। তবে এবার নিঃশব্দে। হঠাৎ-ই জোরে জোরে বেলাকে ডেকে উঠলো সে। বেলা একটু অবাক হলো। হাতের কাজ রেখে ইতস্তত পায়ে ছুটে আসলো। আদ্র তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো শুধু, বেলার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসা। মেয়েটাকে সে অনেক্ষণ ধরে ডাকছে। আসা তো দূর জবাব পর্যন্ত দেয় নি। অথচ আয়াজের এক ডাকেই সামনে হাজির। বাহ্!
আদ্রর গাম্ভীর্য ভাব বাড়লো। তিক্ত হলো মন, মস্তিষ্ক, বিগড়ানো মেজাজ। তাকে দেখে বেলা চুপসে গেল। লাজুকপাতার মতো জড়োসড়ো ভাবে দাঁড়ালো। আড়ষ্ট কণ্ঠে আয়াজকে বললো, “কিছু বলবেন না ভাইয়া?”
আয়াজ দাঁত বের করে হাসলো,
—“হ্যাঁ, ভাইয়া তোমাকে ডাকছিল।”
পলক ঝাপটে বেলা নমনীয় চোখে আদ্রর দিকে তাকালো। অথচ লোকটা অন্যদিকে চেয়ে আছে। খুব কি রেগে আছে তার ওপর? গলা নামিয়ে বেলা জিজ্ঞেস করলো,
—“কিছু বলবেন?”
—“আলমারি থেকে আমার পিস্তল নিয়ে আসো।”
—“জি?”
বেলার মতো অবাক হলো আয়াজও। চোখের বিস্তরতা বাড়লো। বেলা কথা বাড়ালো না। রাশভারি আদ্র ইয়ানিদকে একপলক দেখে ধীর পায়ে রুমে চলে গেল। নকশা করা কাঠের আলমারি খুললো। একটু ঘাটাঘাটি করতেই কাপড়ের আড়ালে সিলভার রঙের বন্দুকটি পেয়ে গেল। হাতে নিলো। কি ভীষণ ভারী সেটা। দেখে বুঝা যায় না। একটুখানি দেখতেই তো!
আলমারি বন্ধ করতে নিলেই পেছনে পরিচিত মানুষটার অস্তিত্ব থমকে দিলো তাকে। ভরাট কণ্ঠের গাঢ় স্বর শুনতে পেল,
—“বন্দুকের গুলিতে নিজের লজ্জাকে মারতে পারবেন বেলা? তবে পালাতে পারবেন৷ নয়তো ছেড়ে দিচ্ছি না।”
______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা