প্রিয় বেলা
৩৫.
এলোমেলো, অবিন্যস্ত ঘরের আশপাশে চোখ বুলাতেই গাল ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো বেলা। সকালে রুম গোছানো হয়নি। সে তো ঘুম থেকে উঠেই পালিয়ে, পালিয়ে বেড়িয়েছে। লজ্জার অসহনীয় যন্ত্রণায় আদ্রর সামনে আসতে পারেনি। কিন্তু শেষে তো পাষাণ নেতার হাত থেকে রক্ষা মেললো না! ধরা দিতেই হলো। সোফায় অযত্নে পরে থাকা সাদা পাঞ্চাবীটা সযত্নে হাতে নিলো বেলা। বুকে চেপে ধরলো। পাঞ্চাবীতে আদ্র, আদ্র ঘ্রাণ আছে। মোহনীয়, স্নিগ্ধ ঘ্রাণ। যেন সে তার একদম কাছেই আছে। খুব কাছে। দেওয়ালে টাঙানো গুটিকয়েক ছবিগুলোর মাঝে হঠাৎ-ই একটা অচেনা, অপরিচিত ফ্রেম দৃষ্টি গোচর হলো বেলার। তারই ঘুমন্ত মুখশ্রী স্পষ্ট করে তোলা। আদ্রর প্রশস্ত বুকের একাংশ দেখা যাচ্ছে। পাঞ্চাবীটা ভাঁজ করে সোফায় রাখলো সে। এগিয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে আলতো করে ছুঁলো ফ্রেমটা। কাল রাত্রিবেলাও দেওয়ালের ক্ষীণ জায়গাটা ছিল সম্পূর্ণ ফাঁকা। তার স্পষ্ট মনে আছে। তবে কোত্থেকে এলো ছবিটা? আদ্র লাগিয়েছে? কখন? সে যখন রুমে ছিল না? ভাবনা শেষ হলো না। তীব্র ছেদে সম্বিৎ ফিরলো। আয়াজের গলা শোনা যাচ্ছে। দরজার ওপাশ থেকে সে ডাকছে,
—“ভাবী? আসতে পারি?”
চমকিত বেলা দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো ফ্রেম থেকে। চারিদিকে চোখ বুলালো। কমবেশি লাগছে। অতটাও অগোছালো নয়। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে উত্তর দিলো,
—“আসুন ভাইয়া।”
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো আয়াজ। ঠোঁটে কিঞ্চিত পরিমাণ বিস্তর হাসি। সরাসরি সোফায় বসে জিজ্ঞেস করলো,
—“কাজ করছিলে? ডিস্টার্ব করলাম?”
—“না, না। এমনিই ঘর গোছাচ্ছিলাম। আপনি কিছু বলবেন ভাইয়া?”
আয়াজ আড়মোড়া ভাঙ্গলো। হামি দিলো দু’তিনবার। কথা বলতে সময় লাগালো। ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে শুধালো,
—“ভাই কাজ দিয়েছিলো একটা। আমি করতে ভুলে গিয়েছিলাম। তোমার যেন কোন কোন বই লাগবে? আমাকে লিস্ট করে দিও। আমি এনে দেব।”
বলতে বলতে ঘুমে ঝিমিয়ে উঠলো সে। তন্দ্রায় নেত্রজোড়া খুলে রাখা যাচ্ছে না। মাথা ঝিমঝিম করছে। দু’হাতে চোখ কচলে বিরক্তি প্রকাশ করলো আয়াজ। অসন্তোষ ভাব ফুঁটে উঠলো। বিকৃত হলো চেহারা। বেলা অবাক নয়নে চেয়ে চেয়ে দেখলো তাকে। বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—“আপনি কি সারারাত ঘুমাননি?”
আয়াজের সহজ স্বীকারোক্তি, “নাহ্। চৈতির সঙ্গে কথা বলেছি। মেয়েটাকে আজকাল সময় দিতে পারছিলাম না তো। তাই কাল সারারাত ওর অভিযোগ শুনতে শুনতে আর ঘুমানো হয়নি।”
আবারও হামি দিয়ে উঠলো আয়াজ। নেত্রকোণে ক্ষীণ জলেরা ভীড় জমালো। কথা অসমাপ্ত হয়ে থেমে গেল। বেলা মুচকি হেসে বললো,
—“আপনারা বিয়ে করছেন না কেন ভাইয়া? তবেই তো সমস্যা সমাধান হয়ে যায়।”
আয়াজের মুখশ্রীতে দুঃখী, দুঃখী ভাব ফুটে উঠলো। হতাশায় নিমজ্জিত হলো মন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অত্যাধিক অসহায়ত্ব নিয়ে কাতর গলায় বললো,
—“চাইলেই তো বিয়ে করতে পারছি না ভাবী। চৈতির অনার্স শেষ হতে আরও দুই তিন বছর লাগবে। এর আগে ওর বাবা রাজি হবেন না। এ কয়যুগ ছ্যাঁকা কবি রুদ্র না হওয়া ছাড়া তো আর উপায় নেই।”
একটু থেমে আয়াজ আবার বললো, “আমি দেখি, একটু পর ঢাকা যাবো ওর সঙ্গে দেখা করতে। তখন তোমার বইও নিয়ে আসবো।”
বেলা পলক ঝাপটালো। বিমূঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “চৈতি আপু ঢাকায় থাকেন?”
—“হ্যাঁ। তুমি জানতে না?”
বেলা মাথা নাড়ালো। সে জানতো না। ততক্ষণে আয়াজের ঘুম মাথা চড়া দিয়ে উঠেছে। আস্তে ধীরে উঠে রুমে চলে গেল সে। অনেকটা ঢুলুঢুলু, নড়বড়ে পায়ে।
–
পাশের বাড়িতে ঝগড়া হচ্ছে। তীব্র থেকে তীব্রতর। কানে হর্তাল লেগে যাচ্ছে। শব্দরোধের আন্দোলন করছে প্রতিটা জীবের শ্রবণযন্ত্র। রেখা রান্না করছিলেন। বেলা ঠিক তার পাশেই দাঁড়ানো। হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দিচ্ছে। চুলার আঁচ অল্প কমিয়ে তরকারিতে আলু ঢেলে দিলেন রেখা। কি ভেবে মুচকি হেসে বললেন,
—“জানো বেলা, আদ্রর বাবা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। কোথাও যেতে দিতেন না। খুব খেয়াল রাখতেন। আমাদের কখনো বড়োসড়ো ঝগড়া হতো না। যারই দোষ থাকুক না কেন, তিনিই আগেভাগে ক্ষমা চেয়ে ঝামেলা মিটিয়ে নিতেন। কিন্তু রাজনীতির কারণে আস্তে আস্তে কেমন যেন পালটে গেলেন। ব্যস্ত থাকতেন। ব্যবসায় মন দিতে পারতেন না। আমাদের জন্য সময়ও ছিল না তার। কষ্ট করে, সবার বিরুদ্ধে গিয়ে এমপি হলেন। সেদিন কি খুশিই-না ছিলেন তিনি! চেহারা থেকে চোখই ফেরানো যাচ্ছিল না।
উনার ব্যস্ততা বাড়লো। বাহিরের থাকা শুরু করলেন। বাসায় তেমন আসতেন না। সে যে কবে আমাদের সঙ্গে অনেক্ষণ সময় কাটিয়েছেন, আমার মনে নেই। সবসময় চিন্তায় থাকতেন। আমাকে কিছু খুলেও বলতেন না। এরপর তো এক বছর বাসায়ই আসলেন না। আমার পরিবার ভাবলো, উনি আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। আর আসবেন না। সেসময়টা যে কি কষ্টের ছিল! সবাইকে ভুল প্রমাণ করে আদ্রর বাবা এলেন একদিন। ওটাকে আসলে আসা বলে না। চিরদিনের জন্য চলে যাওয়া বলে। ময়লার ডাস্টবিনে ওনার ছিন্ন শরীরটা পরে ছিল। পঁচে গিয়েছিল উনার প্রতিটা চামড়া। চেহারার মাংসগুলো গলে কেমন যে দেখাচ্ছিল! গন্ধে টেকা যাচ্ছিল না এলাকায়। এ কারণে কেউ লাশ গোসল করাতে চাচ্ছিল না। ছোট্ট আদ্র তখন কি বলেছিলো জানো? ‘মা, আমাদের কাউকে লাগবে না। আমি, আয়াজ, আরু আর তুমি মিলে বাবাকে গোসল করাবো। কিভাবে করাতে হয় সেটা তো আমি জানি না। তুমি আমাকে বলে দিও, ঠিকাছে?’
আমি কান্নায় অজ্ঞান হচ্ছিলাম বারবার। অথচ আমার ছেলেটা কতটা সাহসের সঙ্গে কথাটা বলেছিল। আমার চোখে এখনো ভাসে সেই সময়টা।”
থামলেন রেখা। নেত্রযুগল অশ্রুসিক্ত হয়ে আছে। আঁচল দিয়ে পানিটুকু মুছলেন। কৃত্রিম হেসে বললেন, “তুমি একটু তরকারিটা দেখো তো বেলা। গরম লাগছে। আমি একটু ফ্যানের নিচে গিয়ে বসি।”
রেখা চলে গেলেন। বেলা সেদিকে ম্লান চোখে চেয়ে রইলো শুধু। বুক ভারী হলো খুব। অজানা আতঙ্কে কম্পিত হলো সর্বাঙ্গ। আদ্রকে নিয়ে ভয় হলো। ভীষণ ভয়।
–
আকাশে চাঁদ নেই। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছে শত্রুতা করে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় স্পষ্ট হয়ে আছে পিচ ঢালা রাস্তা। দু’তিনটে কুকুর আধো আধো ভাবে দেখা যাচ্ছে। নিজেদের মাঝে রেশারেশি করে প্রচন্ড চেঁচাচ্ছে তারা। ঘেউ ঘেউ করছে বিরতিহীন। বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে। ঝিঝিপোকার ঝি, ঝি শব্দও কানে বাজছে। হঠাৎ শক্ত, পুরুষালি এক জোড়া হাত এসে বেলার কোমড় জড়িয়ে ধরলো। ঘর্মাক্ত বুকে ঠেকে গেল পিঠ। চমকিত হয়ে পাশ ফিরবার আগেই কাঁধে থুতনি ঠেকালো সুদর্শন লোকটা। ক্লান্ত মুখ দৃশ্যমান হলো। ঘেমে একাকার কপাল। ফর্সা ত্বকে রক্ত জমে লাল আবরণ। ললাটে লেপ্টে আছে ঝাঁকড়া চুলগুলো। বেলা টের পেল, আদ্রর শরীরে শার্ট, পাঞ্চাবী কিছুই নেই। উন্মুক্ত বলিষ্ঠ দেহ। লাজুকলতা লজ্জায় সিক্ত হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। ইতস্তত কণ্ঠে মিনমিন করলো,
—“কখন এলেন?”
—“এইমাত্র।”
—“খেয়েছেন?”
—“হ্যাঁ। তুমি খেয়েছো?”
—“জি, মা খাইয়ে দিয়েছিলেন।”
কথার পিঠে আর কিছু বললো না আদ্র। বেলাও কথা বাড়ালো না। আস্তে আস্তে মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ বেড়িয়ে এলো। অর্ধ চাঁদ। আদ্র দূরত্ব ঘুচালো। প্রগাঢ় হলো স্পর্শ। বেলা হকচকায়। বড় বড় হয় চোখ। কড়া কণ্ঠে বলতে চায়,
—“কি করছেন আদ্র? দূরে সরুন।”
আদ্র দূর্বোধ্য হাসলো। অবাধ্য হলো খুব। প্রতিউত্তরে কিছুই বললো না। বেলা আবারও অনুরোধ করলো, “সরছেন না কেন? বারান্দায় এলেই আপনি এমন কেন করেন?”
আদ্রর দৃঢ় দৃষ্টি, গাঢ় উত্তর, “তুমি লজ্জা পাওয়া বন্ধ করে দাও। আমি আর এমন করবো না।”
বেলা গাল ফুলালো। লোকটা সবসময় কথার জালে ফাঁসিয়ে দেয় তাকে। অসম্ভব শর্ত জুড়ে দেয়। কোমল, নরম হাতজোড়া দিয়ে আদ্রর কঠিন হাতটা সরিয়ে দিতে চাইলো বেলা। পারছে না। আবারও চেষ্টা করতেই সরব আদ্রর হাতে কামড়ের দাগ দেখতে পেল সে। সুগভীর দাঁতের দাগ। চামড়া ভেদ করে গেছে ক্ষতটি। রক্ত শুকিয়ে লেগে আছে। আটটা দাঁতের ছাপ সুস্পষ্ট।
বেলা উৎকণ্ঠা হলো। ক্ষতের পাশ ঘেঁষে সাবধানে হাত বুলালো। ব্যগ্রতা নিয়ে কম্পয়মান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আপনার হাতে এমন কামড়ের দাগ কেন?”
আদ্র ক্ষতস্থানে তাকালো। মনে পরলো, আজ বিকালে ইখতিয়ার তার হাত কামড়ে দিয়েছিল। পরে ব্যস্ততায় হাতটা ব্যান্ডেজ করার সুযোগ হয়নি। তপ্ত নিশ্বাস ফেললো সে। কথা পালটে প্রশ্ন করলো,
—“আজ সারাদিন কি করলে? আয়াজ বই এনেছে তোমার?”
বেলা শুনলো কি আদ্রর কথা? শুনলো না বোধহয়। ব্যথাতুর নয়নে তাকিয়ে রইলো। টলমল করলো চোখ। দমবন্ধকর কণ্ঠে বললো, “কিভাবে হলো এটা? রক্ত কেমন শুকিয়ে জমে গেছে দেখেছেন? আসুন, আমি ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি।”
আদ্র থমকে দাঁড়ানো। চোয়াল শক্ত। নেত্র অনিমেষ, পলকহীন, অনড়। সর্বত্রে গম্ভীরতা খুব ভাবে ফুটে উঠেছে। বেলার ক্রন্দনরত মুখশ্রী অদ্ভুদ দাম্ভিক শান্তি দিচ্ছে ভেতরটায়। দৃষ্টি নড়বড়ে হলো হঠাৎ। বেসামাল হলো নিষিদ্ধ ইচ্ছে। নিয়ন্ত্রণ হারা হলো। বেলাকে কাছে টেনে নিলো সে। শূণ্য মস্তিষ্কে অধরে অধর ছুঁইয়ে দিলো অধৈর্য ভঙ্গিতে।
______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা