প্রিয় বেলা – পর্ব ৫

0
607

প্রিয় বেলা

৫.
ল্যাপটপে টানা কয়েক ঘণ্টা কাজ করে আদ্রর ঘাড়টা ব্যথায় টনটন করে উঠলো যেন। পরনের হালকা পাওয়ারি চশমা খুলে ঘাড় এদিক-ওদিক নাড়ালো সে। শেষের ই-মেলগুলোয় একদফা চোখ বুলিয়ে ল্যাপটপটা সশব্দে বন্ধ করে দিলো। টেবিলে এখনো কফির মগ থেকে ধোঁয়া উঠছে। যাক! ঠান্ডা হয় নি এখনো। টেবিল থেকে কফি নিয়ে বারান্দায় পা বাড়ালো আদ্র। আজকে একটু রোদ উঠেছে। বৃষ্টির দেখা নেই সকাল থেকে। আশপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে হঠাৎ পাশের ছাদে চোখ আটকে গেল তার। আদ্রর বারান্দা থেকে ছাদটি সরাসরি দেখা যায়। রেলিংয়ে ঠেশ দিয়ে দাঁড়িয়ে, বেলা উদাস মনে চেয়ে আছে আকাশ পানে। আঁখিজোড়ায় একরাশ বিষণ্ণতা কিংবা যন্ত্রণা। আদ্র চেয়েই রইলো। কফি ঠান্ডা হয়ে গেল এ ফাঁকে। খাওয়া আর হলো না।

আয়াজ তখন আদ্রের রুমে ঢুকতে ঢুকতে চেঁচানো গলায় বললো,
—“ভাই তোর ল্যাপটপ একটু নিচ্ছি। আমারটায় চার্জ নেই।”
আদ্র শুনলো। ঘোর কেটে গেল তার। জবাব দিলো,
—“টেবিলে আছে। নেয়।”
ওমনি আগের ন্যায়ই আয়াজের কণ্ঠ ভেসে আসলো, “পেয়েছি।”

আদ্র ভাবলো আয়াজ চলে গেছে। বেলার দিকে আবারও আচ্ছন্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কফির মগে চুমুক দিলো সে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ, মুখ কুঁচকে ফেললো। কফি না, এ যেন ঠান্ডা পানসে পানীয়। বিচ্ছিরি স্বাদ। কোনোমতে মুখেরটুকু গিলে ছোট্ট টেবিলটায় কফির মগটা রেখে দিলো সে। সরব পেছন থেকে আয়াজ বলে উঠলো,
—“ভাই, ওটা বেলা না?”

আদ্র ফিরে তাকালো। ভ্রু কুঞ্চিত করে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “তুই যাস নি?”
আদ্রর পাশে দাঁড়িয়ে আয়াজ উত্তর দিলো,
—“না। তুই কি করছিস দেখতে এলাম। এখন আবার বেলার সাথেও দেখা হয়ে গেল। কিন্তু মেয়েটাকে এত আপসেট দেখাচ্ছে কেন? দাঁড়া ডাক দেই।”

বলে ডাক দিতে নিলেই তৎক্ষণাৎ ধমক দিয়ে উঠলো আদ্র, “সমস্যা কি? নিজের কাজে যা।”
আয়াজ অবাক হলো খুব, “সমস্যা মানে? আর তুই আমাকে এভাবে ধমকাচ্ছিস কেন ভাই? ভুলে যাস না, তুই আমার মাত্র তিন মিনিটের বড়।”
আদ্র বিরক্ত গলায় বললো,
—“তোর নটাংকি শেষ হয়েছে? নাকি যাবি?”
—“শেষ হয় নি। আমি এখন বেলাকে ডাকবো এবং তোর সামনেই ওর সাথে কথা বলবো।”
—“মার খেতে না চাইলে এখান থেকে যা আয়াজ।”

কথা বলার মাঝে বেলার দিকে না চাইতেও চোখ চলে গেল আদ্রর। বেলা তখন কেন যেন হাসছিল। মলিন হাসি। তবুও কি অপরুপ লাগছিল! আদ্র তার দৃষ্টি ফেরাতে পারলো না। বেলায় স্থির হয়ে গেল। আটকে গেল খুব বাজে ভাবে। বুঝে পেল না, মেয়েটাকে তার এত কেন ভালো লাগে? মেয়েটা তো স্বাধারণ। খুবই সাধারণ। ভাবনার অকুল পাথারেই আয়াজ নাক কুঁচকে ঠাট্টার স্বরে বললো,
—“এই তুই বেলার দিকে এমন কুদৃষ্টি দিচ্ছিস কেন? মেয়েটাকে তো অসুস্থ বানিয়ে দিবি। তাড়াতাড়ি নজর সরা। সরাচ্ছিস না কেন?”

আদ্র মোটেও বিরক্ত হলো না এবার। বরং শান্ত চাহনিতে আয়াজের দিকে তাকালো। স্বাভাবিক গলায় বললো,
—“কেন বিরক্ত করছিস?”
আয়াজ উত্তর দিলো না। আড়মোড়া ভাঙ্গার ভঙ্গিতে হাত দুটো মেলে চলে গেল সেখান থেকে।

__________

রাস্তার একপাশে এক আধবয়সী মহিলা ঝাঁড়ু দিচ্ছে। অনলে ধূলোবালির সংমিশ্রণ। রোদের তেজ প্রখর। নিজ এলাকায় ঢুকতেই মহিলাটির দিকে নজর পরলো বেলার। সেমুহুর্তে উনিও তাকালেন। অমায়িক হেসে বললেন,
—“ক্যান আসো বেলা মা? টিউশনের থেইকা আসছো নাকি?”
বেলাও হেসে জবাব দিলো,
—“জি খালা। কিন্তু আপনি এসময় ঝাড়ু দিচ্ছেন যে? ঝাড়ু তো সবসময় সকালে দিতে দেখেছি আপনাকে।”
—“কি আর কমু মা। আমার বউ পোয়াতি ছিল। কাল রাইতে পোলা হইছে একখান। ওইহানে ছিলাম কাল রাইত থেইকা। মালিকরে ফোন কইরা কইছিলাম আইজকা আইতে পারুম না। হেয় কয়, তাইলে টাকা কাইটা নিবো। দিতো না। তাই আইতে হইছে এই বিহালে। আমরা গরিব মানুষ। কি আর করমু।”

বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। উনার গায়ের শাড়িটি বেলা কালকেও পরে আসতে দেখেছে, আজও একই শাড়ি পরে এসেছেন তিনি। মুখটা শুকিয়ে কাঠ। শরীরের একেকটা হাড্ডি গোনা যাবে। বেশ জীর্ণশীর্ণ। বেলার খুব মায়া হলো। মলিন গলায় সে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কিছু খেয়ে এসেছেন খালা?”
তিনি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসলেন যেন। ঝাড়ু দিতে মনোযোগী হয়ে বললেন, “আর খানা! বউয়ের পিছেই সব টাকা চইলা যাইতেছে। খাওয়ানের টাকা পামু কই।”

বেলার ব্যাগে দুই’টা কলা ছিল। টাকা অত নেই। ব্যাগ থেকে কলা দু’টো নিয়ে মহিলাটির দিকে এগিয়ে গেল সে। হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তার। ডান পায়ে চাপ দিতে পারছে না। পাটা আলগা করে হাঁটতে হচ্ছে। তা দেখে খালা অবাক হয়ে বলে উঠলেন,
—“এভাবে হাঁটতাছো ক্যান বেলা? তোমার পাও থেইকাও তো অনেক রত্ত পরতাছে। ছিলছে কিভাবে?”
বেলা একটু করে হাসলো,
—“রিকশা থেকে নামার সময় আঁচড় কেটে গেছে খালা। ঠিক হয়ে যাবে। আপনি এ কলা দু’টো রাখুন। কাজ শেষে খেয়ে নিবেন। নিন।”

খালা কলাগুলো নিলেন। কৃতজ্ঞতায় চোখে জল টলমল করে উঠলো উনার। মুখ ভরে হেসে মাথা দুলালেন।

__________

পায়ের ব্যথা বাড়ছে। হাঁটতে ভীষণ বেগ পেতে হচ্ছে বেলার। এই বিপদের মুহুর্তে পথটাও যেন শেষ হচ্ছে না। একটু দূরেই আয়াজকে দেখতে পেল সে। আদ্রও ছিল। সে গাছের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাগী মুখশ্রীতে ফোনে কথা বলছে খুব উচ্চস্বরে। যা বেলা অতদূরে থেকেও ক্ষীণ স্পষ্ট শুনতে পারছে।
আয়াজ একদম সামনে পরে যাওয়ায় তাকে না দেখার ভান করে পাশ কাটাতে পারলো না বেলা। ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি নিয়ে বললো,
—“কেমন আছেন আয়াজ ভাইয়া?”

আয়াজ মিষ্টি হেসে বললো,
—“ভালো আছি। কিন্তু তুমি কিভাবে চিনলে আমি আয়াজ?”

বেলা অপ্রস্তুত হলো। চোখ পিটপিটালো বেশ কয়েকবার। থেমে থেমে বললো,
—“আপনি আদ্র ভাইয়া থেকে চিকন। ওভাবেই চিনেছি।”
আয়াজ দুষ্টু হাসলো। ভ্রু নাঁচিয়ে বললো,
—“কিন্তু তা তো আমরা একসাথে থাকলে বুঝবে। অত দূরে দাঁড়ানো আদ্র ভাইকে আমার সঙ্গে পার্থক্য করা, আমার মতে একদেখায় অসম্ভব। কেউই এ পর্যন্ত করতে পারেনি। তাই— আমাকে আসলে কিভাবে চিনলে তা সত্যি সত্যি বলে দাও তো বেলা।”

বেলা ভড়কালো, হকচকালো। ভীষণ বাজে ভাবে ফেঁসে গেল যেন। লজ্জায় গাল রক্তিম হচ্ছে। তার আভাস তীব্র ভাবে পাচ্ছে সে। জবাবে কিছুই বলতে পারলো না বেলা। শুধু হাসফাস করতে লাগলো। আয়াজ ঠোঁট চেপে হেসে আবার বললো,
—“বলছো না যে? তাড়াতাড়ি বলো বেলা। কুইক!”

বেলা আড়চোখে একবার আদ্রর দিকে তাকালো। ফোন কানে সে ওরদিকেই তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে। বেলার অস্বস্থি হতে লাগলো। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। আয়াজ আবারও তাগাদা দিতেই চোখ খিঁচে বন্ধ করে বেলা একনিশ্বাসে বলে ফেললো,
—“আদ্র ভাইয়ার বাম চোখের পাশে একটা কাটা লাগ আছে। ওটা আপনার নেই।”

হাসির প্রবল আওয়াজ কানে ঝংকার তুলতেই চোখ মেলে তাকালো বেলা। লজ্জায় এবার মাথা একদম নিচু করে ফেললো। আয়াজ নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে সশব্দে হাসছে। বেলা তার অস্বস্থি বাড়তে দিলো না। চলে যাওয়ার জন্য বেশ কয়েক কদম আগাতেই পেছন থেকে আদ্রের ভরাট কণ্ঠ আটকে দিলো তাকে।

—“দাঁড়ান। ব্যথা পেয়েছেন কিভাবে বেলা?”

বেলা দাঁড়াতে চাইলো না। কোনোমতে উত্তর দিলো,
—“রিকশা দিয়ে নামতে গিয়ে।”
এরপর আবারো হাঁটতে নিলে ধমক দিয়ে উঠলো আদ্র,
—“আপনাকে দাঁড়াতে বলেছি বেলা।”
বেলা মৃদু কেঁপে উঠলো। পেছনে ফিরার আগেই আদ্র তার পাশাপাশি এসে হঠাৎ বুকে আগলে নিলো তাকে। একহাতে কোমড় আঁকড়ে ধরলো। অন্যহাতে মাথা চেপে ধরলো বক্ষস্থলের ঠিক বা’পাশটায়। আকস্মিক হওয়ায় বেলা ভয় পেল খুব। বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে বলতে চাইলো,
—“কি করছেন আদ্র ভাইয়া?”

কিন্তু আদ্র বলতে দিলো না সেকথা। আরও শক্ত করে ধরে কোমলস্বরে বললো,
—“ওড়না দিয়ে মুখ ভালোভাবে ঢেকে নিন বেলা। রোদে তাকাতে পারছেন না আপনি।”

__________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here