প্রিয় বেলা
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
২.
চোখে ঠান্ডা পানির স্পর্শ অনুভব করতেই চোখ মেলে তাকালো বেলা। তবে আশপাশটা কেমন ঝাপসা দেখছে সে। আঁখিজোড়া বড্ড জ্বালা করছে। মাথার সূক্ষ্ণ যন্ত্রণায় উঠে বসার জো নেই। ধীরেধীরে চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক হলো। চারিদিকের অচেনা, অপরিচিত দেওয়াল, সিলিং আর মানুষগুলোকে দেখে বেলা প্রথমেই বুঝলো না সে কোথায় আছে। পরে যখন নিজের মাথার কাছে রেখাকে বসে থাকতে দেখল, তখনই যেন আস্তে আস্তে সব মনে পরতে লাগলো তার। জ্ঞান হারানোর মতো বিশ্রী কাণ্ড ঘটিয়ে ভীষণ লজ্জা নিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল বেলা। রেখা উদগ্রীব হয়ে তার মাথায় হাত বুলালেন। মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
—“এখন কেমন লাগছে বেলা? তুমি ঠিক আছো?”
বেলা ক্ষীণ মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো। আড়চোখে একবার আপাদমস্তক দেখে নিলো আশপাশটা। অনুষ্ঠানের সবাই কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। যেন সবার কেন্দ্রবিন্দু একমাত্র বেলাই। বেলার লজ্জা বাড়লো। গলার সঙ্গে থুতনি ঠেকিয়ে দৃষ্টি পুরোপুরি ঝুঁকিয়ে বসে রইলো সে। রেখা আবার বললেন,
—“ক্ষুধা লেগেছে বেলা? কিছু খাবে?”
বেলা অতি মৃদুস্বরে জবাব দিলো,
—“খেতে ইচ্ছে করছে না আন্টি—। আমি এখানে কতক্ষণ ধরে আছি?”
এ কথায় আয়াজ হাসতে হাসতে উত্তর দিলো,
—“বেশিক্ষণ হয় নি। আধঘণ্টা। তুমি যে আমাদের দুই ভাইকে দেখে এভাবে ভয় পেয়ে জ্ঞান হারাবে, আমরা তো কল্পনাও করিনি। আর কিছুক্ষণ জ্ঞানহীন থাকলেই তো তোমার মাকে ডাকতে যেতে হতো আমার।”
বেলা আরেকদফা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল। আয়াজের কথার প্রতিউত্তরে বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারলো না। তবে চোরা দৃষ্টিতে আদ্রের দিকে তাকালো একবার। আয়াজ আর আদ্র দুজন পাশাপাশিই বসে আছে। তাদের মধ্যিখানে নিশ্চিন্তে বসে বসে আপেল খাচ্ছে বিহান।
বেলা দৃষ্টি সরাতে গিয়েও সরালো না। ক্ষীণ পর্যবেক্ষণ করলো ওদের দুই ভাইকে। আয়াজ থেকে আদ্র একটু স্বাস্থ্যবান। হাতগুলো পেশিবহুল। আয়াজের মতো অত বেশি চিকন না। ওদের গায়ের রঙেও ক্ষীণ ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। দুজনেই ফর্সা হলেও আদ্র উজ্জ্বল গৌর বর্ণের অধিকারী। বেলা এবার সরাসরি আদ্রর মুখপানে তাকানো চেষ্টা করলো। এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাকালো আদ্রও। বেলা হকচকালো, অপ্রস্তুত হলো। দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো আবার। গাল দু’টো গরম হয়ে যাচ্ছে তার। ভারী ভারী লাগছে। সেই রক্তিম গালদু’টোর দিকেই একমনে চেয়ে রইলো আদ্র। মেয়েটার চেহারা ভীষণ মায়াবী। পানির ছটায় পাঁপড়িগুচ্ছ ভিঁজে একে অপরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। সুন্দর দেখাচ্ছে। আদ্রর চোখ সরাতে ইচ্ছে করছে না। মনের খুব গোপনে সে আনমনেই আওড়ালো,
—“শুনো মেয়ে, তোমার চোখ দু’টো অদ্ভুদ সুন্দর। আমার চেয়ে চেয়ে দেখতে ক্লান্তি আসছে না।”
_____
পরেরদিন থেকে ভীষণ বৃষ্টি। কিছুক্ষণ পরপরই সুদূর হতে মেঘের গুড়ুম গুড়ুম ডাক শোনা যাচ্ছে। স্বচ্ছ পানিতে রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। গ্রাম বাংলায় এ দিনে কাঁচা মাটির ঘ্রাণে চারদিক মৌ মৌ করে। আকাশে কাক, পক্ষীর সাক্ষাত একেবারেই নেই। বেলা বিরক্ত ভঙ্গিতে ছাতাটা শক্ত করে ধরলো। সকালে বৃষ্টি কম থাকায় ভার্সিটির কাজে বের হয়েছিল সে। এখন মারাত্ত্বক বিপদে পরে গেছে। প্রবল বর্ষণের তেজে রাস্তা পুরো ফাঁকা। রিকশা, সিএনজি যাত্রীতে ভরপুর। মাঝে মাঝে বাস-স্টেশনের ছাউনিতে কিছু মানুষকে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি কমার অপেক্ষা করতে দেখা যাচ্ছে। তাদের সঙ্গ দিতেই বেলাও দ্রুত পদে ছাউনির নিচে গিয়ে দাঁড়ালো।
পরনের কামিজের নিচের অংশ ভিঁজে গেছে তার। ছাতা বন্ধ করে সেটা একটু ঝেরে নিলো বেলা। হঠাৎ চেনা এক ভরাট কণ্ঠ কানে এলো,
—“হ্যাঁ, আমি আসছি একটু পর। ওকে বেঁধে রাখ। একটু উত্তম-মধ্যম না খেলে ও সোজা হবে না।”
এটুকু শুনেই চটজলদি পাশ ফিরে তাকালো বেলা। নিজের পাশে আদ্রকে দেখে চমকে উঠলো খুব। কিন্তু বুঝতে পারছে না, এটা কি আদ্রই? নাকি আয়াজ? দ্বিধান্বিত চাহনিতে কিছুপলক সেদিকে চেয়ে রইলো সে। আনমনেই মুখ ফঁসকে প্রশ্ন করলো,
—“আপনি আয়াজ ভাইয়া নাকি আদ্র?”
আদ্র তখনো খেয়াল করেনি বেলাকে। প্রশ্ন শুনে বেলার দিকে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে এলো তার। ফোনের ওপাশের ব্যক্তিকে ‘আসছি’ বলে কান থেকে ফোন নামালো। গম্ভীর স্বরে বললো,
—“আদ্র।”
—“ওহ্! আমি বেলা। আপনার সঙ্গে কাল দেখা হয়েছিল আমার। চিনতে পেরেছেন?”
পকেটে ফোন ভরে আদ্র ঠাট্টার সুরে বললো,
—“চিনেছি। আমাকে দেখে যে ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল, আপনি সেই বেলা না?”
প্রশ্নের জবাব দিতে পারলো না বেলা। লজ্জাবোধে তৎক্ষনাৎ মাথা নুয়ালো। পরিচিত বিধায় এভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকাটা সমীচীন বলে মনে হয় নি তার। তাই কথা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু কথা বলতে গিয়ে এই লোক কি-না তাকেই অপমান করে দিলো! মনে মনে খুব রাগ হলো বেলার। আদ্রকে অসভ্য উপাধিতে ভূষিত করতে দু’বার ভাবলো না সে।
পরিবেশ তখন অল্প কোলাহল আর অল্প নিস্তব্ধতায় সম্মিলিত। তখনের অপমানের পর বেলা আর একটা কথাও বলেনি। চুপ করে দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষা করছে। আদ্র পকেট থেকে ফোন বের করে তা আবার চাপতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখছে বেলাকে। সরব খেয়ালে এলো, বেলা হাঁচি দিচ্ছে বারবার। একটু কেঁশে আদ্র প্রশ্ন করলো,
—“বৃষ্টি যখন সহ্য হয় না, তখন বাহিরে বের হয়েছেন কেন?”
বেলা উত্তর দেবে না, দেবে না করেও শেষে ছোট্ট করে উত্তর দিলো,”কাজ ছিল একটু।”
বলতে বলতে আবারও হাঁচি দিলো সে। হুট করে হাসি পেয়ে গেল আদ্রর। ঠোঁট বাঁকিয়ে অল্প হাসলোও সে। তবে তা বেলার অজান্তে। বেলাকে বললো,
—“সেদিন তুমি বারান্দায় কি করছিলে?”
আদ্রের হঠাৎ তুমি বলা খেয়ালে আসেনি বেলার। সে অবুঝের মতো জিজ্ঞেস করলো,
—“কোন দিন?”
—“পরশু।”
বেলার চোখে একরাশ বিস্ময় এসে হাজিরা দিলো এবার। পিটপিট করে তাকিয়ে সে আবারও জিজ্ঞেস করলো,
—“তার মানে, সেটা আপনি ছিলেন?”
—“অবশ্যই। আমি ছাড়া আর কে হবে?”
আদ্র এমন ভাবে বললো, বেলা না হেসে পারলো না। খিলখিল শব্দে বিস্তর হাসলো। আদ্র চেয়ে, চেয়ে দেখলো সে হাসি। নির্নিমেষভাবে, নিভৃতে। তার কেমন গলা শুকিয়ে আসতে লাগলো। মুগ্ধ হলো নেত্র। শান্ত কণ্ঠে আদ্র বললো,
—“বেলা, শুনছো? চোখের পাশাপাশি তোমার হাসিটাও ভীষণ সুন্দর।”
___________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা