প্রিয় বেলা
৩১.
এসির তাপমাত্রা অতিরিক্ত কমিয়ে কী-বোর্ডের ইংরেজী অক্ষরগুলোয় অতি দক্ষতার সঙ্গে আঙুল চালাচ্ছে আদ্র। ব্ল্যাঙ্কেট গায়ে পাশেই জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে বেলা। বলিষ্ঠ দেহের পেশিবহুল বাহুর সঙ্গে প্রগাঢ় ভাবে লেপ্টে আছে। ভীষণ আদুরতা নিয়ে। ঘড়িতে বারোটা বেজে বিশ মিনিট তখন। তন্দ্রা যেন খুব তাড়াতাড়িই চলে এসেছে আজ। আষ্টেপৃষ্টে নেত্রপল্লবে এঁটে আছে। চোখ মেলে থাকা দায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অথচ আদ্রর কাজ শেষ হতেই চাচ্ছে না। চোখ বুজে আবারও হামি দিয়ে উঠলো বেলা। পিটপিট করে একবার জানালা গলিয়ে বাহিরে তাকালো। ঘন কালো আঁধার ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ক্ষীণ বিরক্তিতে লহু ভাঁজ পরলো কপালের মাঝ বরাবর। হালকা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—“আপনার কাজ কখন শেষ হবে? ঘুমাবেন না?”
ব্যস্ত আদ্র একপলক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। মুচকি হাসলো। ঝুঁকে গিয়ে অধরের উষ্ণ, গাঢ় স্পর্শ দৃঢ় ভাবে এঁকে দিলো ললাটের একপাশে। পরক্ষণেই তীব্র আলোয় ভরা ল্যাপটপের স্ক্রীনে স্থির দৃষ্টি ফেলে বললো,
—“তোমার কি ঘুম এসেছে? এলে ঘুমিয়ে যাও। কাজটা শেষ করতে আরও এক-আধ ঘণ্টা লাগবে আমার। জেগে থেকো না। ঘুমাও।”
বেলা একদমই শুনলো না যেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ আদ্রর কাজ করা দেখলো। কাজ করার সময়ও লোকটা ভ্রু কুঁচকে রেখেছে। চোয়াল শক্ত, চোখে তীক্ষ্ণ ভাব। একটু আগের নমনীয়তার ছিঁটে ফোঁটাও নেই। নেত্রকোণের কাঁটা দাগটা স্ক্রিনের সরাসরি আলোয় জ্বলজ্বল করছে যেন। আদ্র চুল কেটেছে। আগের থেকে অনেকটা ছোট দেখাচ্ছে ঝাঁকড়া চুলগুলো। মসৃণ গালকে অমসৃণ করা খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলো হালকা ঘন হয়ে গজিয়েছে। ওষ্ঠযুগল মৃদু নড়ছে। বেলা চেয়ে রইলো। আনমনে বললো,
—“আপনি চুল কেটেছেন কেন?”
—“ভালো লাগছিল না। বেশি বড় হয়ে গিয়েছিল। এখন পার্ফেক্ট আছে।”
—“একদমই না। বরং তখন বেশি ভালো লাগতো।”
আদ্র বাঁকা চোখে তাকালো। ঠোঁটে দীপ্ত হাসি রেখে শুধালো,
—“এখন ভালো লাগে না?”
আমতা আমতা করলো বেলা। উত্তর দিতে পারলো না। দৃষ্টি এলোমেলো হলো। অস্থির হলো বক্ষস্থল। নিজের ওপর খুন রাগ হলো তার। সে এত লজ্জা পায় কেন? এই যে, লোকটার সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছে না। তার আগেই অসভ্য গালদু’টো গরম হয়ে উঠছে, প্রচন্ড ভারি লাগছে। উফফ! এ কেমন অসহ্য যন্ত্রণা?
আদ্র বেলার কেশবহুল মাথায় আলতো হাত বুলালো। কোমলস্বরে বললো,
—“শুধু শুধু জেগে আছো কেন? ঘুমিয়ে যাও বেলা।”
বেলা অবুঝ মেয়ের ন্যায় বললো তখন, “আপনার বুকে মাথা না রাখলে আমার ঘুম আসে না।”
ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা অল্প হাসিটা বিস্তর হলো। ল্যাপটপটা ছোট্ট টি-টেবিলে নিঃশব্দে রাখলো সে। বিছানায় শুয়ে বেলাকে নিজের বুকে চেপে ধরলো। অদৃশ্য ক্ষমতাবোধ নিয়ে। দূর্বল চিত্তে। কানের পেছনে গোছানো চুলগুলো আবারও গুঁজে দিয়ে নরম সুরে আওড়ালো,
—“এবার ঘুমাও। চোখ বন্ধ করো।”
বেলা চোখ বুজলো না। চোখের পাতা ঝাপটালো দু’তিনবার। বেশি করে তাকিয়ে অবাক স্বরে প্রশ্ন করলো,
—“আপনার কাজ শেষ হয়ে গেছে?”
—“না। পরে করবো।”
বেলা খানিক্ষণ নিশ্চুপ রইলো। কি যেন ভাবলো মনে মনে। মুহুর্তেই উত্তেজিত হয়ে বললো, “বিয়ের পর না মেয়েদের বাবার বাড়িতে যেতে হয়? আমি কালকে যাই?”
কথাটা খুব একটা ভালো লাগলো না আদ্রর। চেহায়ায় অসন্তোষ ভাব ফুটে উঠলো খুব স্পষ্ট ভাবে। রোষপূর্ণ গলায় ভীষণ বিরক্তি নিয়ে সে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
—“কেন যাবা?”
—“বিয়ের পর সবাই যায়।”
—“তুমি যাবা না।”
বেলার ভ্রু কুঁঞ্চিত হলো। হতবিহ্বল হয়ে প্রফুল্লহীন কণ্ঠে বললো, “এভাবে বলছেন কেন? বাবার বাড়ি তো পাশেই। গেলে কি হয়?”
আরেকটু কুঁচকালো তার সুর্দশন, গৌড়বর্ণ মুখশ্রী। দিশেহারা চোখজোড়া গম্ভীর হলো। থমথনে হলো কণ্ঠ,
—“পাশে হলে যেতে হবে কেন? বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলো। দরকার হলে বাবা, মাকে এখানে নিয়ে আসো। ওখানে যাওয়ার কি দরকার?”
হতবুদ্ধী বেলা কি বলবে ভেবে পেল না। নেত্রেজোড়ায় একরাশ বিস্ময় সৃষ্টি হলো। জিজ্ঞাসু অভিব্যক্তিতে তাকিয়ে রইলো সে।
আদ্র তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। বেলার স্নিগ্ধ মুখপানে তাকিয়ে কোনোরুপ জোড় করতে পারলো না। ভীষণ অনিচ্ছা নিয়ে হার মানলো, “কতক্ষণের জন্য যেতে চাও?”
—“এখনো ঠিক করিনি।”
—“আমি আসার আগে চলে আসবে, কেমন?”
চিন্তিত, বেকুল কণ্ঠের অসীম পাগলামোর পিঠে বেলা আলতো মাথা দুলালো মাত্র। অতি সন্তপর্ণে মুখ লুকালো বিস্তর বুকে। মোলায়েম স্বরে আদ্র আবারও বললো,
—“আমি চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি বেলা। জেগে থেকো না। ঘুমাও।”
ঘড়ির কাটা টিকটিক করে ঘুরে গেল। সময়ের গভীরতা বাড়লো। বেলা ঘুমিয়ে গেছে। দৃঢ় নিশ্বাসের ছোঁয়া বুকে উত্তাল উষ্ণ উম্মাদনা তৈরি করছে। আদ্র তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো তার প্রিয় বেলাকে। দীর্ঘক্ষণ, অনিমেষ, একমনে। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হলো তার। মোহিত হলো তৃষ্ণায় কাতর চক্ষুদ্বয়। গলা শুকালো। আলিঙ্গন আরেকটু ঘনিষ্ট করতে গিয়েও আবার থেমে গেল সে। অনেকগুলো কাজ এখনো বাকি আছে। কিছু ডকুমেন্ট রেডি করা হয়নি। খুব সাবধানে বুক থেকে মাথা সরিয়ে বেলাকে বালিশে ওপর শুইয়ে দিলো আদ্র। ল্যাপটপের কী-বোর্ডে আবারও গুতোগুতি শুরু করলো।
–
গুলাগুলির আওয়াজে ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে জনগণ। নিস্তব্ধ পরিবেশে বৃষ্টিহীনই বাজ পরছে যেন। প্রচন্ড শব্দ কানে আঘাত করছে। পাখিদের হাহাকারে ভরা ছোটাছুটি একগাছ থেকে অন্যগাছে যাওয়া অব্দিই সীমিত। যে যেভাবে পারছে কলেজ ছেড়ে ছুটে পালাচ্ছে। আশপাশ ঘেঁষছে না একদমই।
গাড়ি থেকে বের হতে হতে প্যান্টের পেছন থেকে সিলভার রঙের ভারি বন্দুকটি হাতে নিলো আদ্র। দ্রুত পায়ে কলেজের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,
—“কলেজের পেছন দিক দিয়ে সবার বের হওয়ার ব্যবস্থা করো আকিব। তন্ময়কে বলো ছেলেদের নিয়ে ওখানে যেতে। দাঁড়িয়ে থেকো না। দ্রুত যাও।”
হন্তদন্ত পায়ে আকিব তন্ময়ের কাছে দৌঁড় লাগালো। পুলিশরা আগেই এসে গেছেন। ড্রাগসসহ ইখতিয়ারকে হাতে নাতে ধরলেও হঠাৎ গুলাগুলির কারণে আহত হয়ে মাটিতে পরে ছিলেন প্রায় তিনচার জন। আদ্র বন্দুক তাক করলো ক্যাম্পাসের দিকটায়। অভ্যস্ত হাতে ট্রিগার চাপতেই সূক্ষ্ণ সোনালী রঙের গুলিটি বেরিয়ে এলো। কালবিলম্ব না করে প্রচন্ড তীব্র গতিতে এলাকার বখাটে ছেলেটির ডান হাতের মধ্যিখানে গিয়ে বিঁধলো। হাত থেকে ধারালো দা পরে গেল তার। অসহনীয় যন্ত্রণায় অন্যহাত দিয়ে বাহু চেপে কুকিয়ে উঠলো। নিচে ধপ করে শুয়ে পরলো। বিশুদ্ধ মাটি দূষিত রক্তে নোংরা হলো মুহুর্তেই।
আকিব চলে এসেছে। গাছের পেছনে লুকিয়ে থাকা ইখতিয়ারকে দেখতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে গুলি ছুঁড়লো সে। নিমিষেই কানের পাশ গলিয়ে চলে গেল তা। কানের লতি টনটন করে উঠলো। ভয়ে একমুহুর্তের জন্য জড়োসড়ো হয়ে গেলেও পরক্ষণেই লাফিয়ে গাছের আড়াল থেকে বেড়িয়ে এলো ইখতিয়ার। সুযোগটা কাজে লাগিয়ে তাকে দু’জন পুলিশ অফিসার ধরে ফেললেন। হাঁটু গেড়ে বসিয়ে বন্দুক ছিনিয়ে নিলেন। আচমকা সব ঘটায় কিছুই করতে পারলো না সে। প্রবল ক্রোধে চেঁচিয়ে উঠলো শুধু। ধমকাধমকি করতে লাগলো ছেড়ে দেওয়ার জন্য।
এরপর সবটা শান্ত। বিপক্ষদলের অন্য ছেলেদেরও ধরে ফেলা হয়েছে ততক্ষণে। কিছুসংখ্যক পালিয়েও গেছে। ফাঁকা মাঠটাতে এক এক করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে ড্রাগসের বিশাল বিশাল কার্টন। সূদুরে সংবাদিকরা ভীর জমাচ্ছে। তাদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।
হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে ইখতিয়ারকে আদ্রর সামনে আনতেই রাগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো সে। বিশ্রী মুখটা আরও বিশ্রী ভাবে কুঁচকে ফেললো। প্রথমেই মন্দ কণ্ঠে গালিগালাজ করলো কিছুক্ষণ। গগনবিহারী চিৎকার দিয়ে উঠলো,
—“কাজটা তুই ভালো করিস নাই আদ্র। তোর বাপের মতো তোকেও যন্ত্রণা দিয়ে মরবো আমি।ছাড়বো না কাউকে। মাত্র দুইদিন! দুইদিন লাগবে আমার জেল থেকে বের হইতে। তারপর দেখব তুই কি করিস। তোর না একটা প্রেমিকা আছে? সাবধানে দেখে রাখিস। বলা তো যায় না, মন চাইলে তুলেও আনতে পারি।”
ইখতিয়ার থামলো। মুখ থেকে একদলা থুতু ফেললো মাটির সবুজ, সতেজ দুর্বাঘাসে। অনেকটা তাচ্ছিল্য করেই। বিকৃত হেসে। আকিব তৎক্ষণাৎ কনস্টেবলের উদ্দেশ্যে ধমক লাগালো,
—“সমস্যা কি আপনাদের? একে নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? তামাশা করাতে চাচ্ছেন নাকি দেখতে? তাড়াতাড়ি এই নোংরা লোককে নিয়ে গাড়িতে যান। যাচ্ছেন না কেন?”
ইখতিয়ার চলে গেল। গাড়িতে ওঠার পূর্বে আবারও তাকালো আদ্রর দিকে। সেই চালক-চতুর চোখে। ঠোঁটে অসহ্যকর হাসিটা। আদ্র কঠিন নেত্রে তাকিয়ে রইলো শুধু। কিছুই বললো না। আকিব একটু অবাকই হলো এতে। দৃষ্টি তুলে তাকালো। দেখলো, আদ্র চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের সাদা শিরা-উপশিরাগুলো আস্তে আস্তে রক্তিম রঙ ধারণ করছে। গাম্ভীর্যের মাত্রা বেড়ে ভয়ানক রাগের পূর্বাভাস পাচ্ছে সে। কপালের রগ ফুলে বেরিয়ে এসেছে। আকিব ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—“ভাবীকে এত কিছু বললো ওই জানোয়ারটা। আপনার বাবাকেও বলেছে। ওকে কি এভাবেই ছেড়ে দিবেন ভাই?”
আদ্র উত্তর দিলো না। দৃষ্টিও সরালো না শুণ্য মাঠ হতে। আকিব আবারও কিছু বলবে তার পূর্বেই ফোন বেজে উঠলো তার। স্ক্রীনে ‘VABI’ নামটা ভাসছে। আকিব দেড়ি করলো না। ফোন এগিয়ে ছটপট বললো, “ভাবী ফোন দিয়েছে ভাই।”
আদ্র তাকালো ফোনটির দিকে। নিলো। রিসিভ করে কানে রাখতেই ওপাশ থেকে অস্থির বেলার কণ্ঠস্বর শোনা গেল,
—“হ্যালো, আকিব ভাইয়া? কোথায় আপনারা? উনাকে ফোন দিচ্ছি আমি। ধরছেন না। উনি কি ঠিক আছেন? উনাকে একটু দিন না। আমি কথা বলবো।”
আদ্র শুনলো শুধু। প্রতিউত্তর করলো না। ওপাশে থাকা বেলা জবাব না পেয়ে আরও অস্থির হয়ে উঠলো। অজানা ভয়ে বুক কাঁপলো। জোড় গলায় আবারও বললো সে,
—“হ্যালো? কথা বলছেন না কেন? উনি কি আপনার পাশে আছেন? ঠিক আছেন তো? হ্যালো?”
চোখ ভিঁজে এলো। কণ্ঠে ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়ে ভেঙ্গে আসলো যেন। কান্নারত হয়ে উঠলো। এ পর্যায়ে গম্ভীর গলায় উত্তর দিলো আদ্র,
—“আমি ঠিক আছি বেলা। কাঁদবে না। একটুখানি অপেক্ষা করো। আসছি।”
বেলার কান্না থামলো না। দীর্ঘ অভিমানে ডুকরে উঠলো। তপ্তশ্বাস ফেলে আদ্র ঢিমে যাওয়া কণ্ঠকে শক্ত করে বললো, “কাঁদতে মানা করেছি বেলা। আমার ভালো লাগছে না তো।”
______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা