প্রিয় বেলা
৩২.
শরীরের ওপর চাদরের অস্তিত্ব টের পেতেই নড়েচড়ে উঠলো বেলা। জড়োসড়ো হয়ে বুকের মধ্যিখানে একেবারে মিশে যেতে চাইলো যেন। আদ্র একহাতে আগলে ধরলো তাকে। খুব সাবধানে, ভীষণ যত্নের সাথে। অন্যহাতে কপালের অবিন্যস্ত চুলগুলো গুছিয়ে পেছনে ঠেলে দিলো। পলক না ফেলে একমনে দেখতে লাগলো ঘুমন্ত বেলাকে। একটু আগেও তার জন্য কিরকম কাঁদছিল মেয়েটা! তাকে কাছে পেয়ে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল। ছাড়ছিল না। ডুকরে ডুকরে কাঁদছিল বারংবার। বিরতীহীন কান্নায় ভিঁজিয়ে দিয়েছিল পরনের শার্টটি। আদ্র তার গালে হাত বুলালো আলতো করে। ক্রন্দনরত মুখশ্রীর নিস্তব্ধতায় লাল হয়ে যাওয়া নাক, গাল, কান, খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলো। নজর গিয়ে ঠেকলো ফুলিয়ে রাখা ওষ্ঠের খুব গভীরে। আদ্র থমকালো। দৃষ্টি সরাতে অক্ষম হলো। ঘোর লেগে গেল যেন। গাল থেকে হাত নামিয়ে তা ছোঁয়ার পূর্বেই হঠাৎ তীব্র বজ্রপাতের শব্দে হুঁশ ফিরলো তার। আদুরে ওষ্ঠজোড়া আর ছোঁয়া হলো না। বেলাকে জ্বালানোর মোক্ষম সুযোগটা নিমিষেই হাত ছাড়া হয়ে গেল। নিজেকে বহু কষ্টে সংযত করলো আদ্র। তপ্ত নিশ্বাস ফেললো অনেকটা রয়েসয়ে। বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে। অনেক দিন পর। বিস্তর নভস্থলে কালো ঘন মেঘেদের দেখা নেই। তবুও দন্দের রেশ ধরে ঠিকই চেঁচামেচি করছে তারা। এক, দু সেকেন্ডের মাঝেই পুরো ঘরে কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব চলে এসেছে। বেলার শরীর মৃদু কাঁপছে। উষ্ণতার খোঁজে নিরবে অভিযোগ জারি করছে সে। আদ্র উঠে বসলো। বেলার গলা অব্দি কম্বল টেনে নিজেও শুয়ে পরলো আবার। পুরুষালি শক্ত দেহের সঙ্গে বেলার ছোট্ট, নরম দেহখানি প্রগাঢ় ভাবে জড়িয়ে নিলো।
বেশকিছুক্ষণ পর তন্দ্রা কাটলো বেলার। তবে তক্ষুণি চোখ মেললো না সে। মাথার টনটন যন্ত্রণায় দূর্বল লাগলো নিজেকে। কণ্ঠ রোধ হয়ে এলো। আদ্র কোমল স্বরে ডাকলো তখন,
—“বেলা? উঠবে না?”
বেলা নিরুত্তর। নখের ধারালো আঘাতে হঠাৎ-ই খামচে ধরলো আদ্রর বুকের একটুখানি অংশ। শার্ট ভেদ করে উন্মুক্ত ত্বক ক্ষতবিক্ষত হলো। আদ্র কোনোরুপ শব্দ করলো না। নড়লোও না। সহ্য করে নিলো চিনচিনে সূক্ষ্ণ ব্যথা। মৃদু স্বরে প্রচন্ড কাতরতা নিয়ে বেলা জিজ্ঞেস করলো,
—“নেতা সাহেব, আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন না তো কখনো?”
যেন বুকে উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ তান্ডব করছিলো। হুট করেই প্রবল ঝড়ে তান্ডবটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হলো। এলোমেলো হলো সব। ছুটাছুটি করলো। অস্থির হলো ভেতরটা। মনে মনে হাজারবার বললো,
—“কক্ষনো না। কক্ষনো না।”
জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেঁজালো আদ্র। নিষ্প্রভ স্বরে অকপটে বললো,
—“তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে আমার কোনো কালেই আসবে না বেলা। আমি ফিঁকে পরে যাবো।”
বেলা শুনলো। তবুও শান্ত হলো না তার নিষ্ঠুর মন। স্বান্তনা অব্দি পৌঁছালো না গহীন ডাকঘরে। আবারও ডুকরে উঠলো হালকা শব্দে। তৎক্ষণাৎ কড়া নজরে তাকালো আদ্র, “কাঁদতে মানা করেছিলাম বেলা। তবুও কাঁদছো না? আমার কথা কি তুমি শুনবে না বলে পণ করেছ? এত জ্বালাচ্ছো কেন?”
বেলা থামলো না। আওয়াজ ক্ষীণ বাড়ালো। আদ্রর সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়ে খুব জোড় লাগিয়ে বলতে লাগলো,
—“আমার ভিষণ ভয় হয় আদ্র। ইদানিং সেই ভয়টা আরও বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনাকে কোথাও যেতে দিতে ইচ্ছে করে না। নিজের কাছে রাখতে ইচ্ছে করে। সবসময় অজানা আতঙ্কে বুক কাঁপে। যদি আপনার কিছু হয়? এমন কঠিন পেশায় জড়ালেন কেন আদ্র? সহজ কোনো পেশা ছিল না? আমাকে এভাবে কাঁদান কেন? আমি সহ্য করতে পারি না।”
নিশ্বাস ফুরিয়ে এলো। কথা থামলো। জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিলো সে। আবারও কিছু বলতে নিলেই নিজের সঙ্গে শক্তভাবে চেপে ধরলো আদ্র। কপালে অধর ছোঁয়ালো দীর্ঘক্ষণ, বহুক্ষণ, খুবক্ষণ। গাঢ় স্পর্শে মাতোয়ারা হলো পবন, দৃঢ় হলো অনুভূতি।
জোড়ালো কণ্ঠে আদ্র আশ্বাস দিলো,
—“আমার কিচ্ছু হবে না বেলা। আমি সবসময় তোমার সঙ্গেই থাকবো।”
অভিমানি প্রিয়তমা নিমিষেই বিশ্বাস করে নিলো যেন। পলক ঝাপটাতেই অশ্রুসিক্ত নেত্র বেয়ে একবিন্দু মুক্তদানা গড়ালো। মোলায়েম স্পর্শে পানিটুকু মুছে দিলো আদ্র। প্রশ্ন ছুঁড়লো,
—“ও বাড়ি যাবে না? বিকাল হয়ে আসছে। পরে কিন্তু আমি আর যেতে দেবো না।”
বিড়াল ছানার মতো গুটিয়ে থাকা বেলার ছোট্ট উত্তর, “যাবো না।”
—“আচ্ছা। আমি কিন্তু আর পাঠাচ্ছি না। আমার কাছেই রাখবো। যেতে দিবো না। তুমি কাঁদলেও না।”
বৃষ্টি প্রবলই বাড়ছে। আওয়াজ হচ্ছে, ঝরঝর! ঝরঝর! স্পষ্ট শুনতে পারছে বেলা। এই বৃষ্টির মাঝে আদ্র কখনোই তাকে ও বাড়ি যেতে দিতো না। সে জানে। ধীরস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “ক’টা বাজে?”
বেলার কারণে কাপড় পাল্টাতে পারেনি আদ্র। ঘড়িও খোলা হয়নি। হাত উঁচিয়ে সময়টা দেখলো সে। উত্তর দিলো, “৩টা।”
দুপুর তিনটা! অনেক বাজছে। এতক্ষণ শুয়ে থাকা ঠিক হবে না। আদ্র এখনো না খেয়ে আছে। পরনের শার্ট অব্দি পালটায় নি। বেলা আর শুয়ে থাকতে চাইলো না। নিশ্চয়ই লোকটা খুব ক্ষুধার্ত। মুখ ফুটে বলছে না হয়তো। পিটিপিট করে তাকালো সে। একদফা সময় নিয়ে সুদর্শন পুরুষটিকে দেখলো। উঠে যেতে নিলেই আবারও চেপে ধরলো আদ্র। বেলা চমকালো। ভড়কালো কণ্ঠে বললো,
—“কি করছেন? উঠতে দিন।”
—“আরও কিছুক্ষণ থাকো। এখন উঠতে হবে না।”
—“কিন্তু আপনি তো এখনো খাননি। সবার বোধহয় এতক্ষণে খাওয়াও শেষ! খাবার গরম করতে হবে। গোছাতে হবে। কত কাজ!”
একরোখা আদ্র একদমই পাত্তা দিলো না সেকথায়। বেলা আবারও দিরুক্তি করতে চাইলেই সে তার শক্ত, ভারি হাত-পাগুলো বেলার একটুখানি শরীরের ওপর উঠিয়ে দিলো। কেমন দমবন্ধ হয়ে আসলো। ছটপট করলো বেলা। পরক্ষণেই আবার শান্ত হয়ে গেল। ধাতস্ত হলো এহেন অপরিচিত কান্ডে। আদ্র ততক্ষণে তার গলার মাঝে মুখ গুঁজে দিব্যি আছে।
বেলা ডাকলো, “শুনুন।”
অস্ফুট স্বরে উত্তর দিলো আদ্র, “হু।”
—“আপনি সবসময় নিজের আশেপাশে গার্ড রাখবেন। সাবধানে থাকবেন। খারাপ লোকদের সঙ্গে একদমই মিশবেন না।”
যেন ছোট্ট একটা বাচ্চাকে নিয়ম শিখাচ্ছে বেলা। আদ্রর হাসি পেল। নিঃশব্দে হাসলোও। টের পেল না বেলা।
—“আচ্ছা।”
—“টিভিতে আপনার কথা শুনে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম হয়তো আপনি—”
কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারলো না সে। আদ্রর ফোন বাজছে। স্ক্রীনে আকিবের নাম জ্বলজ্বল করছে। বেলা বেশি ভাবলো না। রিসিভ করে আদ্রর কানে রাখলো। খুব অল্প করে, আবছাভাবে আকিবকে কি যেন বলতে শুনলো সে। বুঝতে পারলো না। অথচ কথাটা শোনা মাত্র আদ্র উঠে বসেছে। বেলা একটু অবাকই হলো। তাকালো আদ্রর মুখশ্রীপানে। গম্ভীর চিত্তে সে তখন ফোনের ওপাশের ব্যক্তিকে বলছিল, “পাশের এলাকার মেন্টাল হস্পিটালটা চেনো না? নতুন হয়েছে যেটা? ইমার্জেন্সি একটা কেবিন বুক করো। বাকিটা আমি দেখছি।”
বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়েছে আদ্র। বেলা তখনো অভিনব চোখে তাকিয়ে ছিল। প্রশ্ন করার সুযোগ পাচ্ছে না। আদ্র অস্বাভাবিক শান্ত স্বরে বললো,
—“আলমারি থেকে শার্ট বের করো। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
—“কোনটা বের করবো?”
জিজ্ঞেস করলো বেলা। আদ্র একপলক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো, “তোমার যেটা পছন্দ।”
___________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা