যাও পাখি বলো তারে – পর্ব ১৪

0
968

#’যাও পাখি বলো তারে’❤
#’লেখাঃ ঈশানূর তাসমিয়া মীরা❤
#’পর্বঃ ১৪
.
সবুজ ভাইয়ার গান শেষ হতেই রেয়ান উঠে দাঁড়ান। ছাদের রেলিং ঘেঁষে থ্রী-কোয়াটার পেন্টের দু’পকেটে দু’হাত রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আশপাশ দেখছিলেন উনি। আংকেলের মেয়ে দুজন হিমানী আর শ্রেয়াও উনার পিছু পিছু উঠে গেলো। রেয়ানের পাশে দাঁড়াতেই রেয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকালেন ওদের কিছু। ওরা কেমন নির্লজ্জের মতো কথা বলছে উনার সাথে। উনিও মুচকি হেসে উত্তর দিচ্ছেন। আমার সাথে তো কখনো এমন মুচকি হেসে কথা বলেন নি। সদা মুখ একটা গম্ভীর করে রাখেন। অথচ ওদের সামনে..!

ব্যাপারটা মোটেও ভালো লাগলো না আমার। মুখ ফুলিয়ে রাখলাম। ইয়াসিন ভাইয়া সুর দিয়ে গেয়ে উঠলেন,

—” পরাণ যায় জ্বলিয়া রে…
পরাণ যায় জ্বলিয়া… ”

ইয়াসিন ভাইয়ার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালাম আমি। উনি হাসছেন। সবুজ ভাইয়া ভ্রু নাঁচিয়ে বললেন,
—” কী ব্যাপার মীরা? মুখ ফুলিয়ে রেখেছো কেন?”
—” না এমনি। মাথা ব্যথা করছে তো। ”

ইয়াসিন ভাইয়া আবারও বললেন,

—” মিথ্যুক! সত্যি কোঁ। তুই জেলাস না? ”

আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,

—” আমি জেলাস হবো কেন? ”

ইয়াসিন ভাইয়া খোঁচা মেরে বললেন,

—” বোঝো না তুমি? ছোট খুকি? এতক্ষণ তো হাসি খুশিই ছিলি। ওরা ভাইয়ার কাছে যেতেই তোর মুখ পেঁচার মতো হয়ে গেছে। ব্যাপার কি? প্রেমে-ট্রেমে পড়েছিস নাকি?”

আমি রেগে বললাম,

—” চুপ থাক ভাইয়া। এমন কিছুই না। ”

ইয়াসিন ভাইয়া আর থামার? উনি উনার মতোই বকবক করে যাচ্ছেন। সেদিকে বিশেষ পাত্তা দিলাম না আমি। নিজের মাঝেই চিন্তায় পড়ে গেছি। আমি কি আসলেই জেলাস? কিন্তু কেন? ওই নিরামিষ, মুডি কিংয়ের কোনো ব্যাপারেই আমার ইন্ট্রেস নেই। থাকার কথাও না। হয়তো এটা মনের ভুল। উনি তো আমার সাথে ভালোভাবে কথা বলেন না। হয়তো এজন্যই খারাপ লাগছিল আমার। এর চেয়ে বেশি কিছু না। হওয়ারও নয়!

এর মাঝে নিচ থেকে ডাক পরে আমাদের। সবাইকে খেতে ডাকা হয়েছে! আমরাও যে যার মতো চলে যেতে লাগলাম। তবে গেল না শুধু আবদ্ধ আর রেয়ান। দীঘিকে বহু কষ্টে মানিয়ে ‘আসছি’ বলেই রেয়ানের কাছে এসেছে সে। রেয়ানের পাশে এসে দাঁড়াতেই উনি বললেন,

— “নিচে গেলি না?”

আবদ্ধ মিনমিনিয়ে বলল,
— “তুইও তো যাচ্ছিস না।”
— “ভালো লাগছে না। ”
— “ওহ্!”

কথাটুকু বলেই দুজনে চুপ। নিরবতা ভেঙ্গে আবদ্ধ আবারও বলল,
— “ভাই? এ জায়গাটা কেমন লাগছে তোর?”
— “মোটামুটি! কেন?”
— “আমার একদমই ভালো লাগছে না।”

খানিকটা হাসলেন রেয়ান। বললেন,

— “দীঘির জন্য তাই না?”

আবদ্ধ জবাব দিলো না। নিরবতা যেন সম্মতির লক্ষণ মনে হচ্ছে রেয়ানের। উনি বেশ শান্ত স্বরে আবদ্ধকে বললেন,

— “মেয়েটাকে শুধু শুধু কষ্ট দিচ্ছিস কেন আবদ্ধ? ছোটদের মতো মার খেতে চাস? তোকে কি বলেছিলাম মনে নেই? আমার কথায় অবাধ্য হলে কিন্তু পানিতে চুবাবো তোকে। মাইন্ড ইট!”

আবদ্ধ একদফা হেসে উঠল। জড়িয়ে ধরল রেয়ানকে। রেয়ান নাক কুঁচকে বললেন,
— “এভাবে জড়িয়ে ধরার মানে কি?”
— “চুপ থাক! কতদিন পর তোকে জড়িয়ে ধরলাম।”

রেয়ান অবাক হওয়ার ভান করে বললেন,

— “তোর বউ জানে তুই গে?”

আবদ্ধ ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই রেয়ান আবার বললেন,

— “ছিঃ ছিঃ আবদ্ধ দূরে যা। তুই যেমন ভাবছিস আমি তেমন না। আমার সম্মান কেড়ে নিস না।”

আবদ্ধ রেয়ানকে ছেড়ে দিলো তৎক্ষণাৎ। বিরক্তি নিয়ে বলল,

— “ভাই? এখনও এমন করিস?”

রেয়ান হাসতে হাসতে বলে উঠলেন,

— “চল নিচে। তোর বউ অপেক্ষা করছে তোর জন্য। আফটার অল তোর গে হওয়ার সুসংবাদ টাও তো দিতে হবে।”

আবদ্ধের মুখটা পাংসু হয়ে গেল। সে রেয়ানকে আরো জোড়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। যেন জড়িয়ে ধরেই হাড়-গোড় ভেঙ্গে ফেলবে রেয়ানের। তাতে রেয়ান যেন আরো জোড়ে জোড়ে হেসে দিচ্ছেন।

___________________

আংকেলরা চাকমা নৃ-গোষ্ঠীর হলেও টেবিলের সব খাবার রাখা হয়েছে বাঙালিদের পছন্দের। তবে সবজিগুলোর প্রতিটিতেই বিভিন্ন জাতের শুঁটকি দেওয়া। আমার মতে এটা খাবারকে আরও সুস্বাদু করবে। প্রচন্ড খুশি মনে চেয়ারে বসে পড়ি আমরা। আমার একপাশে ইয়াসিন ভাইয়া, মেহেরুন আর সবুজ ভাইয়া বসা। অন্য পাশটা খালি আর আমার একদম সামনে বরাবর দীঘি বসে। আমাদের সবার সামনেই একটা কলা পাতা রাখা। ভাবতেই অবাক লাগছে প্লেটের মতো এটাতে করে আমরা সবাই খাবার খাবো। যদিও আগের দিনের মানুষরা এভাবেই খেতো কিন্তু আমি কখনো কলা পাতায় ভাত খাই নি। তথাপি এটা আমার জন্য নতুন। নতুন নতুন জিনিসের প্রতি আগ্রহও থাকে প্রচুর। আমারও তাই। খুশি খুশি লাগছে কেমন। এর মধ্যে রেয়ান আর আবদ্ধও এসে পরে এখানে। আবদ্ধ এসেই দীঘির পাশে বসে পরে। সাথে সাথেই একটা মুচকি হাসি দিল দীঘি। রেয়ানও আমার পাশের চেয়ারে বসে পরেন। আমি আড়চোখে তাকালাম উনার দিকে। উনার মুখে কেমন হাসির আমেজ। খুশি মুডে আছেন হয়তো। কি সুন্দর করে কলা পাতাতেই চুপচাপ খাবার খাচ্ছেন উনি। সেদিক একবার আড়চোখে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলাম আমি। তখনই আংকেল মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলেন,

— “ছোট রাজকুমার? কোনো অসুবিধে হচ্ছে তোমার?”

রেয়ান মুচকি হেসে নম্র ভাবে বললেন,

— “না, ঠিক আছি আমি।”

আংকেলও মুচকি হেসে খাবারে মন দিলেন। তবে তার ‘ছোট রাজকুমার’ ডাকটা ঠিক বুঝতে পারলাম না আমি। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ইয়াসিন ভাইয়ার দিকে তাকাতেই উনি বুঝে গেলেন আমার প্রশ্ন। নিজ থেকেই বললেন,

— “এই আংকেল আর নানা মানে তোর দাদার সাথে উনার ভালো সম্পর্ক ছিল। জানে জিগার বন্ধু বলতে পারিস। আংকেল নানাকে রাজকুমার বলে ডাকতো। রেয়ান ভাইয়ের চেহারা অনেকটা নানার মতো হওয়ায় ভাইকে ছোট রাজকুমার বলে ডাকেন উনি।”

আমার মুখে হাসি ফুটে উঠল। ইসস! কি সুন্দর ডাক ‘ছোট রাজকুমার!’ ভাবতেই তার দিকে তাকালাম আমি। উনি খেতে খেতেই ধীর কণ্ঠে বললেন,

— “কি? না খেয়ে তাকিয়ে আছো কেন? আমাকে কি..!”

উনি বললার মাঝেই আমি বাঁধা দিলাম। কেননা আমি জানি উনি এখন বলবেন- “আমাকে কি বেশি সুন্দর লাগছে মিস?” তাই আগে আগেই উত্তর দিলাম,

— “আপনাকে সুন্দর লাগছে না।”

উনি বাঁকা হাসলেন। কিছু না বলে আবারও খাওয়ায় মনোযোগ দিলেন। খানিকবাদ পর ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন,
— “তুমি কিসে পড়ো মিস?”
— “অনার্স সেকেন্ড ইয়ার। কেন?”
উনি মুচকি হেসে বললেন,
— “পিচ্চি!”

আমার প্রচন্ড রাগ হলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
— “আমি মোটেও পিচ্চি নই।”
— “সব পিচ্চিরাই এটা বলে।”
— “কে বলেছে এটা?”
— “এইমাত্র তুমি বললে!”

আমি রেগে আর কিছুই বললাম না। দাঁতে দাঁত চেপে খাচ্ছি শুধু। হঠাৎ রেয়ান কেউ না দেখে মতো আমার কলা পাতা থেকে একটা আলু নিয়ে নিজের মুখে পুড়ে নিলেন। বিস্ময়ে চোখ দু’টো বড় বড় হয়ে এলো আমার। ঠোঁটও আপনা আপনি হা হয়ে গেছে। উনি আলু চিবুতে চিবুতে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললেন,

— “স্টপ লুক এট মি মরুভূমি! সবাই দেখবে। স্বাভাবিক হও।”

আমি স্বাভাবিক হয়েও যেন হতে পারলাম না। বারবার মনে হচ্ছে ‘ওটা কি ছিল?’ উনি আমাকে মরুভূমি ডাকলেন? অবিশ্বাস্য!

____________________

রাতে খাবার খেয়েই আবদ্ধ রুমে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে মাত্র বিছানায় বসে ছিল সে। ওমনি কোথ থেকে দীঘি এসে বসে পড়ল তার কোলে। সাথে সাথে চেঁচিয়ে উঠল আবদ্ধ,

— “আরে আরে কি করছো? সরো কোল থেকে। পাশে বসো।”

সরলো না দীঘি। ঠায় বসে রইল। আবদ্ধের বুকে মাথা রেখে আদুরে কণ্ঠে বলল,

— “ভালোবাসি আপনাকে।”

আবদ্ধ কিছু বলল না। শান্ত হয়ে গেল। বিছানার সাথে হেলান দিয়ে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে রইলো সে। দীঘি আবারো বলল,
— “আপনি গান গাইতে পারেন?”
— “না।”

দীঘি দুষ্টু হেসে বলল,

— “নাচতে পারেন?”

আবদ্ধ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
— “সাট আপ দীঘি। চুপচাপ ঘুমাও। প্রচুর ঘুম আসছে আমার।”
— “আমি চুলে হাত বুলিয়ে দি?”
— “না।”

সাথে সাথে মন খারাপ হয়ে গেল দীঘির। পরপরই আবদ্ধ দীঘিকে একটানে বালিশে শুইয়ে দিতেই চোখ দু’টো বড় বড় হয়ে গেল। আবদ্ধের দিকে তাকাতেই দেখল সে চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায়ই তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। প্রচুর লজ্জা পেল দীঘি। সাথে অজানা এক অনুভূতিও কড়া নাড়লো মনে।

______________________

চলবে…
(রি-চেক করিনি। একটু কষ্ট করে ভুল গুলো বুঝে নিবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here