#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে -স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব -৩৮
গোধূলির যখন ঘুম ভাঙে তখন সকাল সাতটা।সজাগ হয়ে নিজেকে মেঝেতে বসে বিছানায় হাত রেখে হাতের উপর মাথা রেখে শুয়ে থাকতে থেকে বেশ অবাকই হয়েছিল গোধূলি।তবে ঠিক কি কারণে ও এইভাবে বসে আছে তা মনে করতে বেশি কাঠ খড় পুড়াতে হয় নি।দীপ্তের দেওয়া ডায়েরিটা তখনও ওর হাতে যা রাতের সব ঘটনা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যতেষ্ট ছিল।কালকের কথা ভাবতেই গোধূলির বুক চিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে।হাতের উপর ওইভাবে শুয়ে থাকার কারণে হাত ব্যাথা হয়ে গেছে।হাত ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।হাতে থাকা ডায়েরিটা আলমারিতে রেখে সোজা ওয়াশরুমে চলে যায়।
শাওয়ার নিয়ে তবে ওয়াশরুম থেকে বের হয়।সেই নবীন বরনের পর থেকে এক দিনও ভার্সিটিতে যায় নি।গোধূলি আজ ভার্সিটিতে যাবে বলে মনোস্থির করলো।আলমারি থেকে কালো রঙের একটা থ্রিপিস বের করলো।আলমারির দরজা বন্ধ করার সময় নজর পড়ে দীপ্তের সেই সবুজরঙা ডায়েরিটির উপর।কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দেয়।ক্ষুদ্র একটা শ্বাস ফেলে চলে যায় ড্রেসিং টেবিলের সামনে।
ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই সবাই রিসোর্ট থেকে বাসায় চলে আসে।রায়ানরা ওদের বাড়িতে চলে গেছে।আর আদিবারা সবাই ওদের বাড়িতে চলে এসেছে।শিখা বেগম মেয়ের খুঁজে গোধূলির রুমে গিয়েছিলেন।কিন্তু গোধূলিকে পায় নি।গোধূলি তখন শাওয়ার নিচ্ছিলো।লতিকা সবার সকালের নাস্তা তৈরী করছে।সবাই ফ্রেশ হওয়ার জন্য নিজেদের রুমে আছে।ইহান সবেই ফ্রেশ হয়ে এসে নাস্তা করার জন্য ডাইনিং টেবিলে বসলো।ঠিক তখনই গোধূলিকে রেডি হয়ে নিচে আসতে দেখে ইহান অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করে,
– কোথাও বেরুচ্ছিস?
– হুম!
চাপা স্বরে বললো গোধূলি।গোধূলির উত্তর শুনে কপাল কুঁচকে আসে ইহানের।কালকে ওইরকম একটা সিচুয়েশনে পড়ে আজকে গোধূলির এতটা স্ট্রংলি বিহেভিয়ার ইহানকে ভাবাচ্ছে।ইহান বিস্মিত হয়ে বললো,
– কোথায়?
– ভার্সিটিতে যাবো।
ধীর কন্ঠে বলল গোধূলি।ইহান একটু না অনেকটাই অবাক হয়,গোধূলি ভার্সিটিতে যাবে শুনে।তবে মনে মনে ভাবে,ভার্সিটিতে গেলে হয়তো ওর মনটা অন্তত ভালো থাকবে।স্মিত হেসে বললো,
– ও আচ্ছা। চল তোকে আমি দিয়ে আসি।
•
গোধূলি আর ইহান ব্রেকফাস্ট করে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়।পুরো রাস্তায় গোধূলি কোনো কথা বলে নি।ইহান অবশ্য একবার জিজ্ঞাস করেছিল ও ঠিক আছে কিনা।তখন গোধূলি বলল ও ঠিক আছে।তারপর ইহান আর কোনো কথা বলে নি।গোধূলিকে ভার্সিটির সামনে নামিয়ে দিয়েই ইহান চলে গেছে।গোধূলি ক্যাম্পাসে ঢুকতেই দেখা হয় ওর বেস্ট ফ্রেন্ড তুলির সাথে।তুলি গোধূলিকে দেখতে পেয়েই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো।তার পর দুই বান্ধবী গিয়ে ক্যানটিনে বসলো।গোধূলিকে অন্যমনস্ক দেখে তুলি ভাবছে গোধূলি হয়তো ওর উপর রেখে আছে।তাই বিচলিত কন্ঠে বলল,
– সরি ইয়ার!আমি চেষ্টা করেছিলাম আদিবাপুর এনগেজমেন্ট পার্টিতে যাওয়ার জন্য।কিন্তু পাপার শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিল তাই যেতে পারি নি রে।আমি তোকে ফোন করেছিলাম।কিন্তু তোকে ফোনে না পেয়ে টেক্সট করে দিয়েছিলাম!দেখিস নি?
– আমি তোর পর রেগে নেই তুলি!
গোধূলির শীতল কণ্ঠে সোজাসাপটা জবাবে তুলি বেশ খুশি হয়।কিন্তু গোধূলিকে কেন জানি অন্যদিনের মতো স্বাভাবিক লাগছে না।তুলি ভ্রু কুঁচকে বললো,
– তাহলে মুখটা এমন বাংলার পাঁচ এর মতো করে রেখেছিস কেন?
……..
মুখ গোমড়া কেন তোর?গোধূলি!
…….
গোধূলি তুলির কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিচ্ছে না দেখে তুলি ফের বললো,
– গোধূলি!তোর শরীর ঠিক আছে তো?
তুলির কথার সাথে হুট করে তুলিকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে দেয় গোধূলি।তুলি ভড়কে যায়।আচমকায় গোধূলির এইভাবে কান্না করার কারণ ও বুঝতে পারছে না।তুলি গোধূলির মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।অনেক কষ্টে গোধূলির কান্না থামিয়ে ওকে সোজা করে বসিয়ে চোখ মুখ মুছে দিয়ে উৎকন্ঠিত স্বরে জিজ্ঞাস করে,
– কি হয়েছে গোধূলি?
……..
– আমাকে ক্লিয়ারলি কিছু না বললে কি ভাবে বুঝবো বল তো?
অতিরিক্ত কান্না করার জন্য গোধূলি হেচকি উঠে গেছে।যার ফলে গোধূলি কোনো কথাই বলতে পারছে না।গোধূলিকে আরেকটু শান্ত করার জন্য তুলি বলল,
– ওকে রিল্যাক্স।আগে তুই শান্ত হো।দেন আমাকে বলিস।
…….
– এই নে পানি।একটু চোখে মুখে ছিটিয়ে আয়।
গোধূলি তুলির কাছ থেকে ওয়াটারপট টা নিয়ে একটু পানি খেয়ে মুখে ছিটিয়ে নিয়ে তারপর আবার এসে তুলির কাছে বসে।তারপর গোধূলি শুরু থেকে শেষ অব্দি সবটা তুলিকে বলে।তুলি গোধূলির কথা শুনে বিশ্বাসই করতে পারছে না যে, এত কিছু হয়ে গেছে।ও ভাবছে গোধূলি হয়তো মজা করছে।কিন্তু এই মুহূর্তে গোধূলি যে মজা করার মুডে নেই সেটাও বুঝতে পারছে।তাও কনফার্ম হওয়ার জন্য তুলি গোধূলির দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বললো,
– গোধূলি তুই আমার সাথে মজা করছিস তাই না?
গোধূলি দীর্ঘ একটা শ্বাস টেনে গম্ভীরমুখে বললো,
– আমার এনগেজমেন্টটা সত্যেই হয়ে গেছে তুলি!
– সিরিয়াসলি?
– হুম!
তুলি অবাকের উপর অবাক হচ্ছে।তুলি ওর নিজের কানকে বিশ্বাসই করতে পারছে না।এনগেজমেন্ট হয়েছে এটা কোনো বড় ব্যাপার না।কিন্তু যার এনগেজমেন্ট সেই জানে না!স্ট্রেইঞ্জ!
– আমি এই এনগেজমেন্টটা মানতে পারছি না তুলি।একে তো আমাকে জানানো হয় নি তার উপর যার সাথে এনগেজমেন্ট হয়েছে তাকে নিজের স্বামী হিসেবে কোনোদিনই চিন্তা করি নি!
তুলি কিছুক্ষণ ভাবার পর বলে,
– ওই যে ছেলেটা আই মিন তোর উডবি,তাকে কি তুই আগে থেকেই চিনতি?
– আমিও চিনি আর তুইও চিনিস!
তুলির কথায় গোধূলি শীতল কণ্ঠে বললো।গোধূলির কথায় তুলি অবাক হয়ে বলল,
– হোয়াট!আমিও চিনি মানে?কিভাবে?
– নবীন বরনের দিন আমাকে যে নিয়ে এসেছিল তার কথা মনে আছে তোর?
– মনে থাকবে না কেন।ভার্সিটিতে তোর সাথে দেখে আমি যখন তোকে ওইদিন জিজ্ঞাস করলাম তখন না তুই বললি উনি তোর ফুপির ছেলে!
– হুম।
– তো কি হয়েছে?
– উনার সাথেই আমার এনগেজমেন্টটা হয়েছে।
গোধূলির কথা শুনে তুলি মুখে হাত দিয়ে অবাক হয়ে বললো,
– কি!
– হুম।
– তাহলে তো তোর খুশি হওয়ার কথা!
– মানে?
– ছেলে তো মাশাল্লাহ।দেখতে শুনতে ভালো হ্যান্ডসাম আর….
পুরো কথা শেষ না করেই তুলি থেমে যায়।গোধূলি ভ্রুকুটি করে বললো,
– আর?
– আর হটও!
গোধূলিকে চোখ টিপ দিয়ে কথাটা বলে তুলি।গোধূলি তুলির দিকে চোখ রাঙিয়ে আঙুল উঁচিয়ে বললো,
– তুলোর বাচ্চা!একদম আমাকে রাগাবি না বলে দিলাম।
– যাক বাবা! আমি আবার তোকে কখন রাগালাম।আমি তো জাস্ট সেটা সত্যি সেটাই বললাম।তুই তো এমন বিহেভ করছিলি যে তোকে ধরে বেঁধে কোনো এলিয়েনের সাথে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে!
– এলিয়েনের সাথে হলেও ভালো ছিল!
– এত সুন্দর জামাই পেয়ে আবার ঢং করো হু!
কথাটা শেষ করেই মুখ ভেংচি দিয়ে অন্যপাশে ঘুরে বসে তুলি।পরমুহূর্তেই আবার ঘুরে বলে,
– তা তিনি কোথায়?
– চলে গেছে!
– ওহ!তোকে পিক করতে আবার আসবে?
– না!
– তাহলে?
– উনি লন্ডনে চলে গেছেন!
– কি!
– আরে আস্তে! বস চুপ করে।এতে চিৎকার করার আছে আর এতো অবাক হওয়ারই বা কি আছে আজব!বিদেশে কি কেউ যায় না নাকি!
গোধূলির কথা শুনে তুলি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাস করলো,
– মানে?
তারপর গোধূলির আবার তুলিকে সবটা বলে।তুলি এতক্ষণ গালে হাত দিয়ে গোধূলির কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলো।তারপর হতাশার সুর দিয়ে বলে,
– বেটা তো দেখছি পুরাই আনরোমান্টিক!তা না হলে কেউ এনগেজমেন্ট করার পাঁচ ছয় ঘন্টা পরেই বিদেশ চলে যেতে পারে!এমন রসকষ হীন মানুষ তো আমি আমার বাপের জন্মেও দেখি নি।কিন্তু বেটা তো দেখতে সেই লেভেলের হ্যান্ডসাম!তাহলে কেইসটা কি হলো?ধুর তোর কপালটাই খারাপ!
তুলি আবার অন্যদিকে মুখ করে বসে।পরমুহূর্তেই আবার ঘুরে বলে,
– এই এই এক সেকেন্ড!তখন যেন তুই কি বললি?দীপ্ত ভাইয়া মানে আমার জিজু তোকে তার ডায়েরি দিয়ে গেছে!তাহলে এইটাই কি তার সেই সিক্রেট ডায়েরি?
গোধূলি আশ্চর্য হয়ে বলে,
– মানে?
– আরে তোর মনে নেই ওইদিন মানে আমাদের অনুষ্ঠানের দিন যে একটা ভাইয়া বলেছিলেন!
– কি বলেছিলেন?
– আরে ইয়ার ভুলে গেলি?
– তুলি হেয়ালির না করে ক্লিয়ারলি বল।
– তোর জামাই নাকি কবি!অনেক ডায়েরি লিখে।খুব সিক্রেট,কেউ জানে না।তা সেই সিক্রেট ডায়েরির রহস্য কি এবার উন্মোচন হবে নাকি হুম?
তুলি ভ্রু নাচিয়ে কথাটা বললো।তুলির কথায় গোধূলি চোখ পাকিয়ে কড়াগলায় বললো,
– ফাস্ট অফ অল উনি আমার জামাই না!সো,বারবার এই তোর জামাই তোর জামাই করবি না!আর উনার সিক্রেট ডায়েরি উনি আমাকে দিতে যাবেন কেন?
– ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন ইনডিরেক্টলি উনি তোর জামাইয়েই লাগে!আর তুইয়েই তো বললি!লন্ডন যাওয়ার আগে তোকে তার ডায়েরি দিয়ে গেছে!
– হে তো!তাই বলে কি সেই ডায়েরি তার সিক্রেট ডায়েরি হয়ে গেলো?
– সেটা তো ডায়েরি খুললেই বুঝতে পারবি।তা কোথায় দেখি!
গোধূলি কপাল কুচকে তাকায় তুলির দিকে।তুলি গোধূলির দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়েই যাচ্ছে।গোধূলি বিরক্তির স্বরে বললো,
– বোকার মতো কথা বলিস না তো তুলি!
– মানে?
– ডায়েরি কি আমি সাথে নিয়ে ঘুরবো নাকি?বিকালে আমাদের বাসায় যাস।পরে দেখে নিস তোর ওই সো কল্ড সিক্রেট ডায়েরিতে কি আছে,না আছে!
তুলি বেশ খুশি হয়ে উৎফুল্লতার সাথে বলে,
– ওকে ডান!
– হুম!এখন চল ক্লাসে যাই।আমি তো এখনো ক্লাস রুমগুলোই চিনি না!
– সো হোয়াট?মেহ হু না!তুমহারি বেস্টু!
গোধূলি তুলির গাল টিপে হেসে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।তুলিও গোধূলিকে জড়িয়ে ধরে।তুলির কাছে সবকিছু শেয়ার করে এখন বেশ হালকা লাগছে গোধূলির।কিছুক্ষণ পর দুই বান্ধবী নিজের আলিঙ্গন থেকে বেড়িয়ে পা বাড়ায় ক্লাসের দিকে।
চলবে…..