#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে -স্বর্ণালী তালুকদার(নামের এক তৃতীয়াংশ)
#অন্তিম_পর্ব
( অন্তিম পর্বটা অনেকটা বড়।তাই ফেইসবুকের মেইন অ্যাপ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করবেন।হ্যাপি রিডিং🌺)
______________________
– সকাল না হওয়া অবধি আপনি কোনো ফ্লাইটই পাবেন না ম্যাম।
– কেন?আমি তো একটু আগেই টিকিট কাটলাম।
– আজকে রাতের যত ফ্লাইট ছিল সব ক্যান্সেল করে দেওয়া হয়েছে ম্যাম।
– কেন?
– সেটা আমি জানি না ম্যাম।তবে আপনাকে এতটুকু বলতে পারি,অর্ডারটা মন্ত্রীমহল থেকেই এসেছে।
শুকনো মুখে এয়ারপোর্ট থেকে বেড়িয়ে আসে গোধূলি।টিকিট কাটার পর হঠাৎ করে ফ্লাইট ক্যান্সেল হয়ে যাওয়ায় বেশ অবাকই হয়েছে ও।তবে ওর কিছু করার নেই। যেহেতু সরকারি আমলাদের অর্ডার সেহেতু হয়তো কোনো রাষ্ট্রীয় কাজের জন্যই তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।কিন্তু ওকে তো যে করেই হোক আজ রাতের মধ্যেই এ শহর ছাড়তে হবে!রাস্তায় রিকশা, সিএনজি বা অটোরিকশা কোনোটাই পাচ্ছে না।আর মনেও হয় না কোনো কিছু পাওয়া যাবে বলে।তবুও গোধূলি এদিক সেদিক চোখ বুলালো।কিন্তু সারা রাস্তাই ফাঁকা।একটা যানবাহনের ছায়াও দেখতে পেলো না।গোধূলি দ্রুত পা চালিয়ে হাটছে।গন্তব্য বাস স্টপ!
বাস স্টপ থেকেও হতাশ হয়েই ফিরতে হলো গোধূলিকে।বাসের নাকি ধর্মঘট চলছে!রাতে বেলা কিসের ধর্মঘট?শহরের ধর্মঘট চলছে?কই এমন কোনো নিউজ তো ও শুনে নি।বাস ড্রাইভারদের বকতে বকতে পুরো রাস্তা এসেছে গোধূলি।এখন তাঁর লক্ষ্য সিএনজি স্টেশন।সেখানে শতেক খানিক সিএনজি ছাড়া প্রাণের কোনো অস্তিত্বই পেল না।অতএব এই যাত্রাপথও বন্ধ!শেষ মেশ উপায় না পেয়ে পা চালাতেই শুধু করে গোধূলি।অন্তত শহর থেকে তো আগে বের হওয়া যাক!কিন্তু এই আত্মবিশ্বাসও বেশিক্ষণ স্থানী হলো না!নিশুতিরাতে কুকুর তাড়া করে ঠিকঠাক মানুষটার কাছেই নিয়ে এসেছে।বলিষ্ঠ বুকের সাথে ধাক্কা খেয়ে কিছুটা পিছিয়ে যায় গোধূলি।নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা তোলে চকিত দৃষ্টিতে তাকায় সামনের দিকে।সামনের মানুষটাকে দেখতে পেয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
– এর থেকে তো কুকুরের দৌঁড়ানি খাওয়াটাই ভালো ছিল!
– হোয়াট!এই মেয়ে…..
দীপ্ত ওর পুরো কথা বলার আগেই গোধূলি জ্ঞান হারায়।টালমাটাল হয়ে পড়ে যেতে নিলেই দীপ্ত ওকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়।
____________________
দীপ্ত গোধূলিকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে।গোধূলিকে ওর রুমে নিয়ে এসে শুইয়ে দেয় দীপ্ত।গোধূলিকে অজ্ঞান দেখে ভড়কে যান শিখা বেগম আর রাবিয়া বেগম।মেয়েকে জড়িয়ে ধরে শিখা বেগমের সে কি কান্না।কুকুরের তাড়া খেয়ে যে উনার মেয়ের এই হাল হয়েছে দীপ্ত অলরেডি দশবার বলেছে।কিন্তু তাও তিনি অস্থির হয়ে ফের জানতে চাইলেন তাঁর মেয়েকে কুকুরে কেন তাড়া করলো?কোথায় গিয়েছিল ও?দীপ্ত গোধূলির দিকে চোখ রাঙিয়ে চাপা গলায় বললো,
– মামী তোমার মেয়ে যে একটু বেশিই শান্তশিষ্ট সেটা কি তুমি জানো না!
দীপ্তের কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান শিখা বেগম।দীপ্ত কি বলছে উনি কিছুই বুঝতে পারছেন না।কান্না থামিয়ে ভ্রুকুটি করে তাকালেন দীপ্তের দিকে।চোখ মুখ মুছে দীপ্তকে উল্টো প্রশ্ন করে বললো,
– মানে?
– মানে হলো তোমার মেয়ে এই রাতের বেলায় শহর দেখতে বেড়িয়েছিল!বাসায় ফেরার পথে কুকুর তাড়া করে আর ভয় পেয়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়।
– ও কি একা গিয়েছিল?
– ভাগ্যিস আমি ছিলাম!নয়তো একা গেলে এখনো রাস্তায়-ই পড়ে থাকতো!
দীপ্তের কথার প্রত্যুত্তরে শিখা বেগম কিছু বলেন নি।কারণ তিনি তাঁর মেয়েকে খুব ভালো করেই চিনেন।ও ওইরকম! মন খারাপ হলেই বাসার ভেতর মন টিকে না।আর তখন ওর মন ভালো করার জন্য ওকে বাড়ির বাহিরে নিয়ে যেতে হয়।হয়তো আজও তেমন কিছু হয়েছিল! কিন্তু তাও একটা প্রশ্ন রয়েই যায়।দীপ্ত গোধূলির সাথে থাকা সত্ত্বেও কুকুর ওকে তাড়া করলো কিভাবে?পরমুহূর্তেই ভাবেন,তখন হয়তো দীপ্ত ওর সাথে ছিল না। শিখা বেগম আর কিছু জিজ্ঞাস না করে শুধু বললো,
– বাবা তুমি ওর পাশে বসো কেমন,আমি একটু আসছি।
শিখা বেগম চলে যেতেই দীপ্ত ফোঁস করে দম ছাড়লো।আসল গল্পটা না হয় শিখা বেগমের অজানাই থাক!দীপ্ত চোয়াল শক্ত করে গোধূলির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে।দীপ্ত ঘর থেকে চলে যেতেই সাজ্জাদ সাহেব আসলেন।গোধূলি বাবাকে দেখে বিছানা থেকে উঠে বসলো।সাজ্জাদ সাহেব ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে মেয়ের পাশে বসলেন।গোধূলি নিজের কাজে লজ্জামিশ্রিত ভয়ে মাথা নিচু করে নেয়।
– তিন বছর আগে আমি ঠিক এই ভয়টাই পেয়েছিলাম!
করুন স্বরে বলা কথাটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই বিস্ফোরিত চোখে বাবার দিকে তাকালো গোধূলি।বাবার এই কথার মানে ওর কাছে অজানা।গোধূলি প্রশ্নাতীত চোখে তাকিয়ে আছে ওর বাবার দিকে।সাজ্জাদ সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,
– হ্যাঁ।এই কথা তুই আরো তিন বছর আগেই জেনে যেতি।আর তুই যদি সবটা জেনে যেতি তাহলে আজ যেটা করলি তিন বছর আগেও ঠিক এমনটাই করতি!
গোধূলি আশ্চর্য হয়ে গেছে।ওর বাবা এইসব কি বলছে কিছুই ও বুঝতে পারছে না।উনারা না বললে তিন বছর আগেই ও কিভাবে জেনে যেতো?তিন বছর আগে ঠিক কি ঘটেছিল?গোধূলি অবাক স্বরে বললো,
– মানে?
সাজ্জাদ সাহেব ক্ষুদ্র একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
– যিনি তোর জন্মদাতা পিতা ছিলেন।উনি বিয়ে করার পর বাবা ডাক শোনার সৌভাগ্য হয় নি তার।সন্তানের আশায় দুটো বিয়ে করেও নিঃসন্তান ছিলেন তিনি।তোর মায়ের মৃত্যুর খবর অনেক পরে শুনেছিল সে।সাথে এটাও জানতে পেরেছিল তাঁর মতো তাঁর প্রেমিকাও তাদের বাচ্চাটাকে অস্বীকার করে নি ওইদিন।দশ মাস,দশ দিন, দশ দন্ড সমাজের সাথে লুকোচুরি যুদ্ধে জয়ী হয়ে ওই সন্তানকে এই সুন্দর পৃথিবীর আলো দেখিয়েছে সে।নিঃসন্তান পিতা সেদিন দিশেহারা হয়ে ছুটে গিয়েছিল তুই যে হসপিটালের জন্মগ্রহণ করেছিলি সেই হসপিটালে।কিন্তু সেখানে গিয়ে তোর কোনো হুদিশ পায় নি।
সাজ্জাদ সাহেব এতটুকু বলেই একটু থামেন।গোধূলি টলোমলো নয়নে উৎসুকভাবে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে।সাজ্জাদ সাহেব ক্ষুদ্র একটা শ্বাস ফেলে বললো,
– তোর অপারেশনের জন্য যখন এবি নেগেটিভ ব্লাড পাওয়া যাচ্ছিলো না তখন দীপ্ত ছুটে গিয়েছিল রক্ত জোগাড় করতে।অনেক চেষ্টার পর একটা ব্লাড ব্যাংক থেকে জানায় যে একজন আছেন যিনি এবি নেগেটিভ ব্লাড ডেনেট করতে চান।ওইদিন তোকে তোর পিতাই রক্ত দিয়েছিল!কোনা এক সময় তোকে ইচ্ছাকৃতভাবে মেরে ফেলতে চাইলেও ওইদিন কিন্তু তিনিই তোকে বাঁচিয়ে ছিল,তার রক্ত দিয়ে!কিন্তু তখন আমি না উনি কেউই জানতাম না যে উনিই তোর বাবা।তোর অপারেশনের পরে যখন নামাজ পড়তে মসজিদে যাই তখন তোর মায়ের আর শিখার ডেলিভারি করা সেই ডাক্তারের সাথে দেখা হয়ে যায়।তিনি আমার পূর্ব পরিচিত ছিলেন তাই এত বছর পরেও আমাকে চিনতে পেরে যায়।একসময় তিনি তোর কথা জানতে চান।আর আমাদের আলাপচারিতায় অতীতের অনেক কথায় বলে ফেলি।সেইদিন সেই মসজিদে তোর বাবাও ছিলেন।উনি আমাদের সব কথা শুনে কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন।উনি খুব চতুরতার সাথে তোর আর উনার একটা ডিএনএ টেস্ট করিয়ে নেন।ব্যাস!উনি কনফার্ম হয়ে যান তুইয়েই তার সেই মেয়ে।উনি আমার কাছে এসে খুব কান্নাকাটি করেছিলেন তোকে একটা বার দেখার জন্য,দেখেও ছিলেন।উনি লজ্জায় তোর সামনে দাঁড়ানোর সাহস পায় নি।হঠাৎ একদিন উনি এসে আমাকে বললো,তোকে উনি নিয়ে যেতে চায়,তার সাথে।আমি আপত্তি জানালে উনি আমাকে থ্রেড দিয়ে বলে,অতীতের সব সত্য তোকে বলে দিবে!সে বলে সেই তোর আসল পিতা।কিন্তু আমারও তো বাবার মন।সন্তান হারানোর কষ্টটা বোধহয় আমার থেকে আর কেউ বেশি জানে না।আমি চাই নি তুই কখনো এই সত্যের মুখোমুখি হও।ভয় হতো খুব,পাছে তুই যদি আমাদের ভুল বুঝে চলে যাস!তাই হুট করেই দীপ্তের সাথে তোর এনগেজমেন্ট করে ফেলি।যাতে তুই এই বাঁধন ছিড়ে কোথাও যেতে না পারিস।হ্যাঁ,হয়তো আমি তোর মতামত নেই নি,তোকে জানায়ও নি।আমি যদি বলতাম, তোকে দীপ্তকে বিয়ে করতে হবে তাহলে তুই এক কথায় রাজি হয়ে যেতি, আমি সেটাও জানি।কিন্তু আমি তোর এনগেজমেন্টের কথাটা কাউকেই আগে জানাই নি,শুধু তোর বাবাই ছাড়া।আমি যদি ঘটা করে তোর এনগেজমেন্ট সবাইকে জানিয়ে করতাম তাহলে ওই লোকটা জেনে যেতো।তোকে বলে দিতো এক ভয়ানক সত্যি।তুই হয়তো সব ছেড়ে চলেও যেতি!তখন আমাদের কি হতো?তোর আম্মু আর আমি কি নিয়ে বেঁচে থাকতাম?
এখন তুই বল তোকে এই জানতে না দিয়ে কি আমি অন্যায় করেছি?
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে শেষ করেন সাজ্জাদ সাহেব।গোধূলি বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দেয়।সাজ্জাদ সাহেব অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন।মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তিনিও নীরবে চোখের জল ফেলছেন।গোধূলি কিছুক্ষণ পরে বাবাকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসে চোখে জল মুছতে মুছতে শক্ত গলায় বললো,
– এখন কোথায় আছেন তিনি?
গোধূলির কথায় আঁতকে উঠলো সাজ্জাদ সাহেব।তবে কি গোধূলি তাদেরকে ছেড়ে চলে যাবে?কথাটা ভাবতেই অজানা ভয়ে বুকটা হাহাকার করে উঠলো।আহত চোখে মেয়ের দিকে তাকাতেই গোধূলি মৃদু হেসে বললো,
– ভয় পেয়ে না আব্বু।আমি তোমারই মেয়ে ছিলাম, আছি আর পরজন্ম বলে যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে আগামী সাত জন্ম পর্যন্ত আমি তোমারই মেয়ে হয়ে থাকবো।
চোখ চকচক করে উঠলো সাজ্জাদ সাহেবের।মেয়েকে বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরলেন।গোধূলিও বাবাকে জড়িয়ে ধরলো।পরমুহূর্তেই বললো,
– উনাকে শুধু একটা বার দেখবো আব্বু।আব্বু আমি শুধু একবার সেই মানুষটাকে দেখতে চাই।যে মানুষটা আমার জন্মদাত্রী মাকে অস্বীকার করেছে,আমাকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেছে।ভালোবাসার নামে তাকে কলঙ্কিত করে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল।আমার মাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে।আমি শুধু একটা বার এক নজর সেই মানুষটাকে দেখতে চাই।তার মেয়ে হিসেবে নয়!তিনি আমাকে একবার জন্ম দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু তার অনিচ্ছায়!আরেকবার আমাকে বাঁচিয়েছেন তার ইচ্ছায়!অস্বীকার করলেও তার সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক!তার কাছে আমি রক্তের ঋণে ঋণি!অন্তত তাকে এই কৃজ্ঞতাটা জানানো উচিত,উনি যদি আমাকে অস্বীকার না করতেন তাহলে হয়তো তোমার মতো আব্বুকে আমি পেতাম না।আম্মুর মতো আম্মুকেও পেতাম না।আমার এই সুন্দর পরিবারটাকে আমি পেতাম না।তাকে এই জন্য কৃজ্ঞতা জানানো উচিত,উনি রক্ত না দিলে হয়তো সে যাত্রায় আমি মারাও যেতে পারতাম!আমি মারা গেলো তোমাদেরকে হারিয়ে ফেললাম।আর কখনো তোমাদের দেখতে পেতাম না।আব্বু আম্মু বলে ডাকার সুযোগও পেতাম না।আব্বু আমি একটা বার ওই মানুষটিকে দেখতে চাই,আব্বু একটাবার।
গোধূলির বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাতর গলায় বলা অনুরোধ ফেলতে পারেন নি সাজ্জাদ সাহেব।মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে আশ্বস্ত করেন তিনি গোধূলিকে নিয়ে যাবে।
______________
গোধূলির উপর সবাই নীরব রাগ অভিমান দেখিয়েছে।গোধূলি অনেক কষ্টে তাদের মান ভাঙিয়েছে।এখন গোধূলির অতীত সম্পর্কে সবারই সবটা জানা।গোধূলির জায়গায় ওরা থাকলেও হয়তো এটাই করতো।গোধূলির কাছে পরাস্ত হয় সবাই।কেউই আর মান করে থাকতে পারলো না।
বিয়েটা না হওয়া অবধি গোধূলি ওর বাবার বাড়িতেই ছিল।লজ্জা আর ভয়ে বিয়ের আগের একটা সপ্তাহ একবারের জন্যও দীপ্তের সামনে পড়ে নি ও।তবে লজ্জার থেকে ভয়টাই বেশি ছিল।কারণ অর্ধেক কথা শুনেই সেন্টি খেয়েছিল কিনা!যখন জানতে পারে ওইদিন ওর শোনা অসম্পূর্ণ কথাটাই শেষ কথা ছিল না।তখন থেকেই ভয়ের মাত্রাটা আরো বেশি করে বাড়তে শুরু করে।গোধূলি ওর বিয়ের শপিং করেছে সাজ্জাদ সাহেবের হাত ধরে ধরে।যাতে দীপ্ত ওকে কিছু বলার সাহস না পায়।দীপ্ত শুধু দাঁত কিড়মিড়িয়ে গেছে।
খুব ধুমধামে দীপ্ত আর গোধূলির বিয়েটা সম্পূর্ণ হয়।তবে গোধূলি বিয়ের আসরে কবুল বলা নিয়ে একটু সময় নিচ্ছিল।কাঁন্না করছিল প্রচুর।কাজী বার বার গোধূলিকে কবুল বলতে বলছিল।কিন্তু গোধূলিকে কবুল বলতে বলায় আরো জোরে জোরে কাঁদতে থাকে।কেউ ইচ্ছা করে কাঁদে না।কাঁন্নাটা ভেতর থেকে আপনা-আপনিই চলে আসে।একটা মেয়ে যখন সব ছেড়ে বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি চলে যায়,তখন যে কি কষ্ট যন্ত্রণা হয় সেটা শুধু মেয়েরাই বুঝে।গোধূলির এমন কান্না দেখে দীপ্তের সহ্য হচ্ছে না। আবার খুব বিরক্তও লাগছিল।
– এই মেয়ে কি বিয়েটা না করার ধান্দায় আছে নাকি?তা না হলে সামান্য একটু কবুল বলতে এত সময় নেওয়ার কি আছে?আর এত কাঁদারই বা কি হলো?যাচ্ছে তো ওর ফুপির বাড়িতেই।দুই বছর তো দিব্যি ছিল ওইখানে!তাহলে আজ এত ঢং করার কি হলো?দেখে তো মনে হচ্ছে ওকে কেউ ভিনগ্রহে পাঠিয়ে দিচ্ছে।আর আমার দিকে এমন ভাবে তাকাচ্ছে যেন আমি মনে হয় সেই গ্রহের এলিয়েন!
দীপ্ত গোধূলির দিকে বিরক্তিকর চাহনি দিয়ে বিড়বিড় করে কথাগুলো বললো।গোধূলি অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে।কাঁন্না থামাচ্ছেই না।শেষে উপায় না পেয়ে দীপ্ত কাজী সাহেবের কাছ থেকে কলমটা নিয়ে হাতে থাকা টিস্যুটাতে কিছু একটা লিখে গোধূলির দিকে এগিয়ে দেয়।দীপ্তের এহেন কান্ডে কাজী সাহেব হতভম্ব তাকিয়ে রইলেন শুধু।উনার কিছুই বোধগম্য হলো না।গোধূলি হাত বাড়িয়ে টিস্যুটা নিয়ে যখন নাক চোখ মুছতে যাবে ওমনি দীপ্ত বিষম খেয়ে বসে।চকিত দৃষ্টিতে দীপ্তের দিকে তাকালো গোধূলি।দীপ্ত ওর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে চোখে ইশারা করল টিস্যুটা দেখার জন্য।দীপ্তের চোখ রাঙানো দেখে টিস্যু টা খুলে গোধূলি,” ওইদিনের বাড়াবাড়ির রিটার্নটা কি এখন দিয়ে দিবো?”লেখাটা চোখে পড়তেই ফটাফট তিন কবুল এক সাথেই বলে দেয় গোধূলি।গোধূলির অবস্থা দেখে ঠোঁট টিপে হাসছিল দীপ্ত।গোধূলি ওর দিকে তাকাতেই দীপ্ত ওর মুখের হাসি গায়েব করে দিয়ে ভ্রু কুচকে ইশারায় জিজ্ঞাস করে,কি?গোধূলি দীপ্তের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়।ভয়ে তো দীপ্তকে মুখে কিছু বলতে পারছে না কিন্তু মনে মনে চোদ্দগুষ্টির নাম উদ্ধার করে তবেই ছেড়েছে।
____________
একটু আগে তুলি গোধূলিকে দীপ্তের ঘরে বসিয়ে দিয়ে রেখে গেছে।তুলি বলে গেছে ও যেন এখান থেকে এক পা ও না নড়ে।
– ধ্যাৎ!এত ভারী লেহেঙ্গা কি এতক্ষণ পড়ে রাখা যায় নাকি?সেই যে কখন তুলার বাচ্চা এই এলিয়েনের গুহায় রেখে গেল এখনো তো কারোর আসার নামই নেই।না পাচ্ছি এলিয়েনের দেখা না পাচ্ছি মানুষের দেখা অসহ্য! বড্ড খিদেও তো পেয়েছে!ও ফুপি আমাকে কিছু খেতে দাও তো!খুব জোরে খিদে পেয়েছে আমার!ফুপি….!এত জোরে জোরে ডাকছি কেউ সাড়া দিচ্ছে না কেন?ধ্যাৎতেরিকি!দেখি তো সবাই কই গেলো!
– গোধূলি!
গম্ভীর কণ্ঠে নিজের নাম উচ্চারিত হতেই পা টা তাড়াতাড়ি করে আবার বিছানায় উঠিয়ে নেয় গোধূলি। অনেকক্ষণ একা একা বসেছিল বলে বোরিং লাগছিল আর খুব খিদেও পেয়েছিল।দীপ্তি বেগমের সাড়া না পেয়ে ও বিছানা থেকে নেমে দেখতে যাচ্ছিল।কিন্তু তার আগেই দীপ্তের ডাকে থমকে যায়।গোধূলি চমকে গিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে ব্যালকনির দরজাটায় দীপ্ত হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।এক ঝলক দেখেই চুপ করে ঠিক আগের জায়গায় বসে পড়ে গোধূলি।অনেকক্ষণ চলে গেছে দীপ্তের কোনো সাড়াশব্দ নেই বলে গোধূলি আবার পিছনে ফিরে।কিন্তু এ কি!দীপ্ত কোথায়?পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে নেয় গোধূলি।পুরো রুম ফাঁকা।রুমের কোথাও দীপ্ত তো দূর,দীপ্তের ছায়াও দেখতে পাচ্ছে না গোধূলি।বেশ অবাক হয় গোধূলি।একটু আগে স্পষ্ট মানুষটাকে দেখতে পেলো ও। এখন কোথাও দেখতে পাচ্ছে না কেন?তাহলে ও কি ভুল দেখেছে?
– উহুম উহুম!
গোধূলির ভাবনার মাঝেই আগমন ঘটে দীপ্তের।দীপ্তের কন্ঠ পেয়েই চমকে উঠে গোধূলি।গলা খাঁকারির আওয়াজ পেয়ে ফট করে পিছনে ফিরতেই চোখাচোখি হয়ে যায় দুজনের।সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নেয় গোধূলি।এই ঘরে দীপ্তের অবস্থান ওর হার্টবিট ক্রমশ বাড়িয়ে দিচ্ছে।ভয় আর লজ্জা দুটোই খুব করে ঘিরে ধরেছে গোধূলিকে।
চারপাশে রজনীগন্ধা আর গোলাপ দিয়ে ডেকোরেশন করা খাটের ঠিক মাঝখানটায় বসে আছে গোধূলি।বাসর রাত নিয়ে একটা মেয়ের যেমন হাজারটা স্বপ্ন থাকে তেমন অনেকটা লজ্জা আর এক আকশ ভয়ও থাকে।যেটা এই মুহূর্তে গোধূলি অনুভব করতে পারছে।ওর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে ধীর পায়ে এগোয় দীপ্ত।দীপ্তের অবস্থান গোধূলি ওর খুব কাছে বুঝতে পেরে একটু নড়েচড়ে বসে গোধূলি।
– কিছু একটা ভুলে যাচ্ছিস না?
দীপ্তের কথায় গোধূলি আশ্চর্য হয়ে তাকায়।পরমুহূর্তেই দীপ্তের কথার মানে বুঝতে সক্ষম হয় গোধূলি।জিভে কামড় দিয়ে চটজলদি বিছানা থেকে নেমে দীপ্তের সামনে এসে দাঁড়ায়।মাথায় থাকা ঘোমটাটা আরেকটু ভালো করে টেনে নিয়ে দীপ্তকে সালাম করে।দীপ্তের মুখে লাগাতার সেই স্মিত হাসি।গোধূলি সালাম শেষ করে উঠে দাঁড়াতেই দীপ্ত গোধূলিকে হাত ধরে নিয়ে বিছানায় বসাতে বসাতে বললো,
– আর কবে বড় হবি তুই শুনি?
গোধূলির মুখ কিঞ্চিৎ হা হয়ে গেল।দীপ্তের কথার মাথা মন্ডু কিছুই ওর বোধগম্য হলো না।তাই দীপ্তের মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।দীপ্ত গোধূলির মুখে এক লোকমা খাবার দিয়ে বললো,
– বাসর ঘরে বসে থেকে কেউ শাশুড়িকে এই ভাবে চিৎকার করে ডাকে?
দীপ্ত গোধূলির মুখের ভেতর খাবার পুরে দিতেই গোধূলির আঁখিদুটি বেড়িয়ে আসার উপক্রম।মুখে খাবার নিয়ে দীপ্তের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে দীপ্তের হাতে একটা কাচ্চির প্যাকেট!আরেকটা পাশে রাখা।গোধূলিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে দীপ্ত বলে উঠলো,
– মুখের খাবারটা চিবিয়ে তাড়াতাড়ি হা কর।আমারও বড্ড খিদে পেয়েছে!
দীপ্ত ওকে একের পর এক লোকমা মুখে তুলে দিচ্ছে।কেউ কোনো কথা বলছে না।গোধূলি শান্ত মেয়ের চুপচাপ বসে খাচ্ছে আর ভাবছে,উনি কি করে জানলেন আমার কাচ্চিবিরিয়ানি পছন্দ?পরমুহূর্তেই তাচ্ছিল্যে হেসে বললো,ধুর আমিও না!যে মানুষটা আমার পায়ের নখ থেকে মাথার চুল অব্দি খবর রেখেছে,আমার পছন্দের অপছন্দের কথা জানা তো তার জাস্ট একটা তুড়ির ব্যাপার।
– উহু হয় নি!
গোধূলি আশ্চর্য হয়ে দীপ্তের মুখের দিকে তাকায়।তাকানোর ভঙ্গিটা এমন যে,দীপ্ত কি বললো ও বুঝতে পারে নি।গোধূলির চাহনিতে দীপ্ত মুচকি হেসে হাতে থাকা অবশিষ্ট খাবারটুকু মুখে তুলে দিয়ে বললো,
– একটি চোখের পলক পড়তে যতক্ষণ লাগে ঠিক ততক্ষণ।
দীপ্তের কথার বিনিময়ে গোধূলি শুধু অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল।স্মিত হেসে মুখের খাবারটা শেষ করে।বেড সাইডের টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা বাম হাতে নিয়ে গোধূলিকে খাইয়ে দেয় দীপ্ত।তারপর ওর হাত ধুয়ার জন্য ওয়াশরুমে চলে যায়।গোধূলি শুধু দীপ্তকেই দেখে চলেছে।দীপ্ত ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই চোখাচোখি হয়ে যায় দুজনের।চোখ সড়িয়ে নিয়ে মাথা নিচু করে নেয় গোধূলি।দীপ্ত এগিয়ে গিয়ে গোধূলি সামনে দাঁড়িয়ে খানিকটা শীতল কণ্ঠে বললো,
– শুধু কি তাকিয়ে থাকলে হবে?
দীপ্তের দিকে আহাম্মকের মতো তাকিয়ে আছে গোধূলি।
– আমিও তো বড্ড তৃষ্ণাক্ত!
গোধূলি মাথা নামিয়ে নেয়।পাশে হাতরিয়ে হাতের কাছে কিছু না পেয়ে তাকিয়ে দেখে বিরিয়ানির প্যাকেটা নেই।সামনের টেবিলে উপর দুটো খালি প্যাকেট রাখা দেখে কপাল কুচকে আসে গোধূলির।সেকেন্ড খানেক পরেই গোধূলি বুঝতে পারে দীপ্ত ওকে দুই প্যাকেট খাবারই খাইয়ে দিয়েছে।এখন যদি ওর পেট খারাপ হয়?গোধূলি চোখ বড় বড় করে দীপ্তের দিকে তাকালো।
– আমার কি দোষ!আমি তো কাউকে জোর করে খাওয়াই নি!
কথাটা বলে গা ছাড়া ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দীপ্ত।গোধূলির বরাবরই কাচ্চি খুব পছন্দ।তাই বলে দুই প্যাকেট কাচ্চি একাই সাবার করে দিলো!লজ্জায় পড়ে যায় গোধূলি।উনি যে বললেন উনারো খিদে পেয়েছে।তাহলে এখন?উনি কি খাবেন না?গোধূলি বিছানা থেকে নেমে এসে বললো,
– আপনি বসুন,আমি আপনার জন্য খাবার নিয়ে আসছি।
গোধূলি চলে যেতে নিলেই দীপ্ত পিছন থেকে গোধূলির হাত ধরে আটকে দেয়।পিছনে ফিরে দেখে দীপ্ত ওর দিকে তাকিয়ে আছে।গোধূলির জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে দীপ্ত ধীর কন্ঠে বললো,
– কোথায় যাচ্ছিস তুই?
– আপনার জন্য খারাব আন…….
দীপ্ত গোধূলির ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে গোধূলিকে চুপ করিয়ে দেয়।অন্য হাতে গোধূলির কোমড় ধরে অনেকটা কাছে টেনে নিয়ে আসে।শিউরে উঠে গোধূলি।কোমড় ছেড়ে দিয়ে গোধূলির দু’গাল হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করে নেয় দীপ্ত।শীতল কন্ঠে বলে উঠলো,
“রামধনুর ওই সাত রঙেতে
সাজিয়ে তোমার মন
নতুন রূপে মুগ্ধ করো
তৃষ্ণার্ত দুই নয়ন”
অবাক চোখে দীপ্তের দিকে তাকিয়ে আছে গোধূলি।এই মানুষটার মনে কত আকুলতা!ঠিক কতটা ব্যাকুলতা নিয়ে এতগুলো বছর অতিবাহিত করেছেন উনি।আমি কি তার তৃষ্ণা মেটাতে পারবো?পারবো!পারতে হবে।তার প্রাপ্তি তাকে তার কাছে সমর্পণ করতে আজ বাধ্য।কারণ সেও তো খুব করে তাকে কাছে চায়।আপন করে নিতে চায়।আজ নিজেকে বিলিয়ে দেবো।
– মে আই?
দীপ্তের কথায় ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আসে গোধূলি।গোধূলি চুপ করে আছে।মৌনতা সম্মতির লক্ষণ।
নেশালো চোখে দীপ্ত গোধূলির দিকে তাকিয়ে আছে।পিটপিট চোখে গোধূলির চাহনি,অতিরিক্ত কাঁন্নার করার ফলে গোধূলির ওই ফোলা ফোলা চোখ,ভ্রুদ্বয়ের মাঝখানে কিঞ্চিৎ ভাঁজ,লজ্জায় রাঙা হয়ে যাওয়া গাল আর গোলাপি ঠোঁট,দীপ্ত আর নিজেকে সামলাতে পারলো না।নিজের ওষ্ঠদ্বয় গোধূলির ওষ্ঠদ্বয়ে ডুবিয়ে দেয়।হতভম্ব হয়ে গেছে গোধূলি।চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে নিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গোধূলি।বাসর ঘরে বরের চুমো খাওয়াটা প্রত্যাশিত থাকলেও এই মুহূর্তে ও সেটা মোটেও এক্সপেক্ট করে নি।মিনিট পাঁচেক পরেও গোধূলির কোনো রেসপন্স না পেয়ে দীপ্ত ওকে ছেড়ে দেয়।ছাড়া পেয়ে গোধূলি লজ্জায় মাথা নিচু করে নিয়ে ঘনঘন শ্বাস ফেলতে থাকে।দীপ্ত গোধূলির দিকে ঝুকে কানে কানে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
– চড়াইপাখির কি আরেকটু সময় প্রয়োজন?
দীপ্তের কথা শুনে আঁতকে উঠে গোধূলি।সত্যিই তো!মুখে যতই বলুক না কেন যে,ও নিজেকে দীপ্তের কাছে সঁপে দিবে তাও মনের কোণে কোথাও না কোথাও ভয় কাজ করছে।না পারছে নিজেকে কমফোর্ট করতে আর না পারছে দীপ্তেকে কমফোর্টেবল করতে!ওউ তো খুব করে দীপ্তকে কাছে চায়।কিন্তু পারছে না।লজ্জা আর ভয় ওকে ঘিরে ধরেছে।
গোধূলিকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দীপ্ত ওর প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর খুঁজে নিয়ে চলে যেতে নিলেই গোধূলি ওর হাত ধরে আটকে দেয়।দীপ্ত নিজের হাত থেকে গোধূলির হাতটা আলতো করে ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,
– ইটস ওকে,টেক ইউর টাইম।আমি না হয় আরেকটু অপেক্ষা করলাম।অপেক্ষা করতে করতে এখন আমার সয়ে গেছে।
দীপ্তের বলা শেষের কথাটা গুলো গোধূলির বুকে তীরের মতো গিয়ে আঘাত করেছে।দীপ্তের কথায় চাপা কষ্ট অভিমান স্পষ্ট।চোখ ছলছল করছে গোধূলির।গোধূলিকে দেখে দীপ্ত উৎকন্ঠিত স্বরে গোধূলির দু’গাল ধরে বললো,
– আরে তুই কাঁদছিস কেন?বুঝতে পারছি মানিয়ে নিতে তোর একটু সময় দরকার।বললাম তো,তোর যত সময় নেওয়ার আছে তুই নে।আমি শত যুগ অপেক্ষা করতে পারবো।শুধু আমাকে ছেড়ে চলে যাস না।সহ্য করতে পারবো না।
গোধূলি মাথা নিচু করে চুপ করে আছে।দীপ্ত আবার বলতে শুরু করে,
– দিনটা ছিল পহেলা ফাল্গুন।সবাই আমাদের বাড়িতে এসেছিলি।তুই বায়না ধরেছিলি নানাজান তোদের সাথে কানামাছি খেলুক।নানাজান রাজি হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তার শর্ত ছিল বাড়ির সবাইকেই খেলতে হবে।আমার এক্সাম ছিল তাই আমি খেলতে না গিয়ে ঘরে বসে স্টাডি করছিলাম।খিলখিল করে হেঁসে উঠা অচেনা মানুষের সেই চিরচেনা হাসি কর্ণকুহরে প্রবেশ করে।মনের ভুল ভেবে ফের পড়ায় মন দিলাম।কিন্তু না!সেই হাসির আওয়াজ ক্রমশ আমার মনকে মাতাল করে দিচ্ছে।কর্ণকুহরে সুরের ঝংকার তুলছে।টেবিলে বসে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হলো না।কিছুক্ষণ স্থবির হয়ে বসে বুঝার চেষ্টা করলাম শব্দের উৎপত্তিস্থল।নিচে গার্ডেন থেকে শব্দটা ভেসে আসছে।মুহুর্তেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াই।ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে কম্পিত হাতে জানালার পর্দাটা সড়াতেই বসন্তের কোকিলকে দেখতে পেয়েছিলাম সেদিন।প্রথমবারের মতো!সেদিন রাস্তায় যাকে দেখতে না পেয়ে শুধু তার হাসির আওয়াজ শুনতে পেয়েই এতটা মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম শুধু একটা বার দেখবো বলে।আর আজ সেই হৃদয় হরনী আমার সামনে।বুকের ভেতরটা আচমকায় মোচড় দিয়ে উঠে। হার্টবিট ক্রমশ বেড়েই চলেছে। মনে হয়েছিল ছুটে গিয়ে সবার সামনে জাপটে জড়িয়ে ধরি।ওই দিন বসন্তের কোকিল হয়ে তুই আমার সামনে এসেছিলি চড়াইপাখি।তুই আমার ছিলি আছিস আর আজীবন থাকবি।আমি অপেক্ষা করতে পারবো কিন্তু উপেক্ষা নয়।
দীপ্ত গোধূলির কপালে চুমো দিয়ে চলে যেতে নিলেই গোধূলি দীপ্তের কলার চেপে ধরে।দীপ্ত ভ্রু কুচকে গলার দিকে তাকিয়ে গোধূলির মুখের দিকে তাকাতেই গোধূলি ওর ঠোঁট জোড়া দিয়ে দীপ্তের ঠোঁট জোড়া আঁকড়ে ধরে।দীপ্তের কলার ছেড়ে দিয়ে বাম গালে এক হাত রেখে অন্য হাতে দীপ্তের চুল মুষ্টি বদ্ধ করে নেয়।দীপ্ত কোনো রেসপন্স করছে না।চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।গোধূলি দীপ্তের ঠোঁটে শক্ত করেই একটা কামড় বসিয়ে দেয়।দীপ্তের দুই হাত ধরে ওর কোমড় জড়িয়ে দেয়।কিন্তু গোধূলি এই সংকেত গুলো যেন দীপ্তের জন্য যতেষ্ট ছিল না।টায় ওইভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।পা উঁচিয়ে রেখে বরকে চুমো খাওয়া গোধূলির পক্ষে সম্ভব না।বেটা এলিয়েন!আমার কোমড় জড়িয়ে ধরলে কি হতো?একটু আগে তো ঠিকই কোমড় জড়িয়ে ধরে চুমো খাওয়া হয়েছে।আমি কি এত উঁচুতে নাগাল পাই?পা ব্যাথা হয়ে গেছে আমার।গোধূলি কথা গুলো মনে মনে আওড়ালো।অভিমান করে দীপ্তকে ছেড়ে দেয়।ছাড়া পেয়ে দীপ্ত চলে যেতে নিলেই গোধূলি বললো,
– আপনি ভালোবাসেন আমায়?
হুট করে গোধূলির এমন প্রশ্নে দীপ্ত একটু আশ্চর্য চোখে গোধূলির দিকে তাকায়।দীপ্ত বুঝতে পারছে গোধূলি ওকে আটকানো জন্যই এই প্রশ্নটা করেছে।সেটা গোধূলিকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে।বড্ড বেশি ছটফট করছে।হাতের আঙুলের ভাঁজে আঙুল দিয়ে মোচড়াচ্ছে।দীপ্ত ঠোঁট টিপে হেসে শীতল কন্ঠে বললো,
– “ভালোবাসি” মুখে না বলেও ভালোবাসা যায়।
গোধূলি চুপ হয়ে গেছে।দীপ্ত আবারো চলে যেতে নিলে গোধূলি হুড়মুড়িয়ে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।দীপ্ত ভ্রু কুচকে তাকায় গোধূলির দিকে।গোধূলি দীপ্তের উপর চোখ রাঙিয়ে কাটকাট গলায় বলে উঠলো,
– কোথায় যাচ্ছেন আপনি?আপনি কি বুঝতে পারছেন না কিছু?
গোধূলির শাসানো শুনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দীপ্ত গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
– কি বুঝবো?যা ফ্রেশ হয়ে গিয়ে শুয়ে পর।
দীপ্ত ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে নিলেই গোধূলি দীপ্তের কলার আবার চেপে ধরে।
– আমার বেবি লাগবে!আমি ঘুমাবো না এখন।
কথাটা অনেকটা জোরেই চিল্লিয়ে বলে গোধূলি।বিষম খেয়ে যায় দীপ্ত।গোধূলিকে ফের বলে,
– আমার এক্ষুনি বেবি লাগবে!শুনতে পাচ্ছেন আপনি?
দীপ্ত গোধূলির মুখ চেপে ধরে একটু ধমকানোর স্বরে বললো,
– এই মেয়ে চুপ।এইসব কথা কেউ এইভাবে চিল্লিয়ে বলে?আর এক্ষুনি বেবি লাগবে মানে?এটা কি মামা বাড়ির আবদার নাকি?
দীপ্তের ধমক খেয়ে কাচুমাচু মুখ করে মাথা নিচু করে দাঁড়ায় গোধূলি। দীপ্ত মাথা নিচু করে গোধূলির মুখ দেখে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বললো,
– সত্যি করে বল তো, তোর আবার বাসর টাসর করার ফিলিংস হচ্ছে না তো!
গোধূলি গোল গোল চোখ করে দীপ্তের দিকে তাকায়।শুকনো একটা ঢোক গিলে আমতা-আমতা করে বললো,
– মো মোটেই নাহ্!
দীপ্ত ঠোঁট টিপে হেসে গোধূলির দিকে ঝুকে কানে কানে ফিসফিস করে জোর গলায় বললো,
– আরে হচ্ছে হচ্ছে!ঠিক বুঝতে পারছি আমি।এটা তো আগেই বলতে পারতি যে, তোরও বাসর করার ফিলিংস হচ্ছে!শুধু শুধু এতক্ষণ ধরে সময় নষ্ট করছিস।ভাঙবি তবু মচকাবি না!মাঝখানে বেবিকে অব্দি টেনে আনলি?আগে বললে তো এতক্ষণে অর্ধেক প্রসেস কমপ্লিট হয়ে যেত!
দীপ্তের কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় গোধূলি।হা করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।দীপ্ত গোধূলির কোমড় জড়িয়ে একটু কাছে টেনে নিয়ে গলায় স্বর উঁচু করে বললো,
– বাই দ্যা ওয়ে,ওইদিন তুই যেন কি একটা কথা বলার জন্য আফসোস করছিলি?
দীপ্তের প্রশ্নে কান গরম হয়ে আসে গোধূলির।নিজ মুখে কি করে দীপ্তের সামনে বলবে সে কথা?তখন তো আবেগের বসে চিঠিতে লিখে ফেলেছিল।ভেবেছিল হয়তো আর কোনোদিন দীপ্তের সামনে আসবে না ও।মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে গোধূলি।দীপ্তের বুকে গোধূলির গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে।মাথা নিচু রেখেই রিনরিনে স্বরে বললো,
– সব কথা বলার প্রয়োজন হয় না কখনো কখনো সামনের মানুষটিকে কিছু কথা বুঝে নিতে হয়।
গোধূলি কথা শুনে স্মিত হাসে দীপ্ত।গোধূলির মাথা টা ওর বুকের বা পাশে চেপে ধরে শীতল কণ্ঠে বললো,
– তাই যদি হয় তবে বল তো, আমার মন কি বলছে?
গোধূলি দীপ্তের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে ভেতর দিকে একটা দীর্ঘ শ্বাস টানে।পর পরেই দীপ্তের দীপ্তের বুকের উপর থেকে মাথাটা তুলে নিয়ে তাকায় দীপ্তের দিকে।দীপ্তের চোখে চোখ রেখে মিষ্টি হেসে নরম কন্ঠে বললো,
– তার চড়াইপাখিকে সে আপন করে পেতে চায়।সম্রাজ্ঞী বিহীন তার রাজ্যটা হাহাকার করছে, সে কথাটাই বার বার জানান দিচ্ছে এই হৃদযন্ত্রটি!তবে তাই হোক!সম্রাটের হাতে সম্রাজ্ঞী আজ নিজেকে উৎস্বর্গ করে নিজের অস্তিত্বের বিলীন করতে প্রস্তুত।
কথাটা শেষ করতেই গোধূলিকে কোলে তুলে নেয় দীপ্ত।আচকায় এমন হওয়ায় দীপ্তের গলা আঁকড়ে ধরে গোধূলি।লজ্জায় মুখ লুকায় দীপ্তের বুকে।দীপ্ত গোধূলি ডুব দিলো ভালোবাসার অতল গভীরে।অতঃপর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে স্বার্থকতা পায় দীপ্ত গোধূলি।
~ সমাপ্ত🌸
_____________________
[ আসসালামু আলাইকুম পাঠকমহল,
#দীপ্ত_গোধূলি’র অন্তিম পর্ব।তাই আজকে কিছু কথা, কিছু স্বীকারোক্তি না দিলেই নয়।
স্বর্ণালী আমার মূল নামের এক তৃতীয়াংশ।মানে আমার আরো দুটো নাম আছে।মোট তিনটা নামের সমন্বয়ে আমার আসল নাম। আইডি বা পেইজে শুধু স্বর্ণালী ব্যবহার করা হয়েছে।তবে ভবিষ্যতে যদি কখনও প্রয়োজন হয় তবে অবশ্যই নিজের পুরো নাম দেবো, ইনশাল্লাহ।
এবার আসি মূল স্বীকারোক্তিতে,
আমি লেখিকা হিসেবে একদমই নবীন।#দীপ্ত_গোধূলি আমার প্রথম লেখনী।আমার লেখা প্রথম গল্প।#দীপ্ত_গোধূলি’র মাধ্যমেই ভার্চুয়াল জগতে আমার লেখিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ।#দীপ্ত_গোধূলি গল্পের নাম অনুসারেই মৌলিক দুটি চরিত্র দীপ্ত আর গোধূলি।এই জুটিকে কেন্দ্র করেই কাহিনী এগিয়েছি।গল্পের স্বার্থে আরো অনেকগুলো চরিত্র ছিল।প্রত্যেকটা চরিত্রকে সর্বোচ্চ সুন্দরতায় ফুটিয়ে তোলার তীব্র চেষ্টা করেছি। কতটুকু পেরেছি, জানিনা।তবে লেখনীতে উত্থানপতন ছিল অনেক, ভুলভ্রান্তিও হয়েছে, কখনো কখনো হয়তো ছন্দপতনও হয়েছে,স্বীকার করছি। নিজস্ব ব্যস্ততা,গ্যাপ সব মিলিয়ে হয়তো সেভাবে গুছিয়ে উঠতে পারি নি।তবুও আপনারা মানিয়ে নিয়েছেন, নিচ্ছেন।রেসপন্সও করেছেন,করছেন।আপনাদের ভালোবাসাতেই এগিয়েছি ৪৪ পর্ব অবধি।লেখনীর স্বার্থকতা, ব্যর্থতা অনুভব করতে,আজকে অন্তিম পর্বে এসে #দীপ্ত_গোধূলি’র সব পাঠকের একটু সাড়া চাইছি।দু লাইন মন্তব্য জানাবেন না?
আপনাদের প্রত্যেকের জন্য রইলো শুভকামনা।দোয়া করবেন আমার জন্যও।ভালোবাসা অবিরাম….🌺]