#মিশে_আছো_মুগ্ধতায়
#লেখনীঃআরভি_আহিয়াদ_তিহু
#পর্বঃ40
সন্ধ্যা 7:30
মেঘদের বাসার পুরো ছাদটা বেশ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। চারপাশে বিভিন্ন রঙের লাইটে পরিবেশটা রঙিন হয়েছে উঠেছে। আজকের পার্টির মধ্যে মনি হচ্ছে দুই জোড়া কাপল। যাদের ঠোটের কোনে ফুটে আছে এক চিলতে মুচকি হাসি। এই হাসিই সবাইকে জানান দিচ্ছে যে আজকের এই দিনটায় তারা কতোটা খুশী। আজকে মিহিরের সাথে সাঈফার আর আহিরের সাথে সাড়িকার এ্যানগেজমেন্ট। ফাইনাললি এতো ঝড় ঝাপটার পর ওদের ভালোবাসা আজকে পূর্নতা পেতে চলেছে। আপাততো ওদের এ্যানগেজমেন্ট টা করিয়ে রাখা হবে। তারপর যখন সাড়িকা, সাঈফার স্টাডি কম্পিলিট হবে তখন সবাই মিলে ধুমধাম করে ওদের বিয়ের আয়োজন করবে।
মিহির আর সাঈফা দাড়িয়ে দাড়িয়ে গেস্টদের সাথে কথা বলছিলো। তখনই পিছন থেকে সাজিদ এসে মিহিরের কাধে হাত রেখে বললো
“ব্রো আমি তো এতোদিন একটা গুড নিউজের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু এখন তো দেখি দুই দুইটা গুড নিউজ চলে এসেছে। তাহলে এবার তো আমার তোমাদের থেকে দুইটা ট্রিট পাওয়া উচিৎ তাইনা?”
সাজিদের কথা শুনে মিহির কিছু বলতে যাবে তার আগেই পাশ থেকে সাড়িকা বলে উঠলো
“ইশশশ শখ কতো! তুই তো আমাকে সিজ্ঞেল রেখেই এখান থেকে চলে গিয়েছিলি। আমি নিজেই নিজের বরকে পটিয়ে নিয়েছি। তাহলে তোকে কেনো ট্রিট দিতে যাবো? যা ভাগ এখান থেকে।”
সাড়িকার কথা শুনে সাজিদ ভেংচি কেটে বললো
“তোর থেকে কে ট্রিট চেয়েছে? আমি তো আমার জিজুদের কাছ থেকে ট্রিট চেয়েছি। তুই কেনো আমাদের মাঝখানে নাক গলাচ্ছিস? যা সর এখান থেকে।”
সাড়িকা দাত কিড়মিড় করে বললো
“একদম সরবো না। আমি জানি, আমি এখান থেকে সরলেই তুই আমার বরকে একদম ফতুর বানিয়ে ছেড়ে দিবি। তাই আমি এখান থেকে এক পাও নড়ছি না।”
সাজিদ কপাল চাপড়ে আহিরের দিকে তাকিয়ে বললো
“ব্রো তুমি বিয়ে করার জন্যে আর কোনো মেয়ে পেলে না? শেষ পযর্ন্ত কিনা এই শাকচুন্নিটাকে নিজের জন্যে পছন্দ করলে? এই মেয়ে তো বিয়ের পর তোমার সাথে ঝগরা করে করে তোমার মাথা খারাপ করে দিবে।”
সাজিদের কথা শুনে সাড়িকা অগ্নি দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো। আহির মুচকি একটা হাসি দিয়ে সাজিদের কাধে হাত রেখে বললো
“আমাদের কথা ছাড়ো। তুমি এবার নিজের কথা বলো। বিয়ে শাদি করবে না নাকি? বয়স তো কম হলো না। এইবার বিয়ে করে ঘরে টুকটুকে একটা বউ নিয়ে আসো।”
সাজিদ মৃদ্যু হেসে বললো
“এই জীবনে সেটা আর কখনো সম্ভব না। আমি আমার মনটা অলরেডি একজনকে দিয়ে দিয়েছি। আর সে আমার ওই ছোট্ট মনটা নিয়ে অনেক দূরে চলে গেছে। তাই এখন আর আমার হৃদয়ে অন্য কাউকে জায়গা দেওয়ার মতো এক কোনা জায়গাও অবশিষ্ট নেই। যতোদিন বাচবো ততোদিন তার স্মৃতি নিয়েই বাচবো। আর যেদিন আল্লাহর মর্জি হবে সেদিন সব কিছুর মায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে চলে যাবো।”
সাজিদের কথা শুনে সাড়িকা, সাঈফা, আহির, মিহির ওদের চারজনের মুখেই কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেলো। ওরা চারজন শুধু ড্যাবড্যাব করে সাজিদের দিকে তাকিয়ে রইলো। ওদেরকে এভাবে শুকনো মুখে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সাজিদ খানিকটা রাগ দেখিয়ে বললো
“দেখেছো আজকে তোমাদের লাইফের এতো বড় একটা স্পেশাল দিন। আর তোমরা কিনা আমার দেবদাস মার্কা কথা শুনে এখানে শুকনো মুখ করে দাড়িয়ে আছো? আরেহ ভাই চলো সবাই একসাথে মিলে এই স্পেশাল দিনটা ইনজয় করি।”
কথাটা বলে সাজিদ এগিয়ে গিয়ে আহির আর মিহিরের হাত ধরে টানতে টানতে ওদেরকে স্টেজের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। ওদের তিনজনের পিছনে পিছনে সাড়িকা আর সাঈফাও গেলো।
এতোক্ষন মেঘ দূরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে সাজিদের বলা সব কথা গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো। আর মনে মনে ভাবছিলো, কাউকে মন থেকে একবার ভালোবাসলে মানুষ বোধহয় এমন স্টুপিডই হয়ে যায়। নির্দিষ্ট কারো মায়ায় একবার আটকে গেলে ওই মানুষটাকে ছাড়া দ্বিতীয়বার হয়তো আর কারো মুগ্ধতায় আটকানো যায় না। তাই তো এতো কিছুর পরেও মেঘ এখন পযর্ন্ত আহানকে বিন্দুমাত্রও ঘৃনা করতে পারেনি। আহানের প্রতি ওর পাহাড় সমান রাগ আছে ঠিকই। কিন্তু ‘ও’ হাজার চেষ্টা করেও কেনো যেনো আহানকে একেবারে নিজের মন থেকে সরিয়ে ফেলতে পারছে না। যতোবার ভাবছে আহানের মতো জঘন্য একটা মানুষকে চির জীবনের মতো ভুলে যাবে, ততোবার মেঘের রুহ কেপে উঠছে। ‘ও’ এটাই বুঝতে পারছে না, যাকে এতোটা ভালোবাসে তাকে কিভাবে চিরতরে নিজের মন থেকে মুছে ফেলবে? আর কীভাবেই বা তাকে ঘৃনা করবে?
মেঘের এসব ভাবনার মধ্যেই ছোট্ট এক জোড়া হাত এসে মেঘের হাতের আঙুল গুলোকে স্পর্শ করলো। মেঘ ঘাড় ঘুড়িয়ে পাশে তাকিয়ে দেখলো হাসি, হাসি মুখ করে ওর হাতের আঙুল ধরে ইহান দাড়িয়ে আছে। ইহান হলো হিয়ান আর আলিশার একমাএ ছেলে। ওর বয়স মাএ দু-বছর। কিন্তু বয়সের তুলনায় ছেলেটা মারাত্মক সুপার ফাষ্ট বাচ্চা। এই বয়সেই সে খুব ভালো করে জানে যে কাকে কী বলে ইমপ্রেস করতে হবে, কার সাথে কীভাবে ভাব জমাতে হবে, কাকে কী বলে ডাকলে চকলেট পাওয়া যাবে। ওকে এসব কাউকে শিখাতে হয় না। ‘ও’ নিজেই সবাইকে মানুষ পটানোর ফর্মুলা শিখিয়ে বেড়ায়। আলিশা আর হিয়ানের মতে ইহান হলো ওদের জন্যে লাকি চার্ম। কারন ইহানের জন্মের পরপরই ইহানের নানা-ভাই আলিশা আর হিয়ানের বিয়েটা মেনে নিয়েছিলো।
মেঘ হাটু ভাজ করে ইহানের সামনে বসে ওর গাল টেনে দিয়ে বললো
“কী হলো বাবাই? কিছু বলবে?”
মেঘের প্রশ্নে ইহান অমায়িক একটা হাসি দিয়ে মেঘের গলা জড়িয়ে ধরে বললো
“আমাতে তোলে নাও পিপি। আমি তোমাল তোলে উতবো।”
মেঘ ইহানের গালে একটা হামি দিয়ে বললো
“আমি তো এখন তোমাকে কোলে নিতে পারবো না, ইহান শোনা।”
ইহান মেঘের গলা ছেড়ে দিয়ে ঠোট উল্টে বললো
“তেনো পিপি?” (কেনো পিপি)
মেঘ নিজের চেহারাটা একদম ইহানের মতো করে বললো
“কারন আমার শরীরটা একদম ভালো নেই বাবা। আমি যদি এখন তোমাকে কোলে নেই তাহলে আমার অনেক ব্যাথা লাগবে।”
মেঘের কথা শুনে ইহান মেঘের দিকে কিছুক্ষন গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে দৌড়ে সাড়িকা, সাঈফার কাছে চলে গেলো। ইহানের কান্ড দেখে মেঘ ফিক করে হেসে দিলো। তারপর বসা থেকে দাড়িয়ে নিজের পেটের উপর আলতো করে হাত রাখলো। ডাক্তার বলেছে মেঘের প্রেগনেন্সিতে অনেক কমপ্লিকেশন আছে। তাই বেবী ডেলিভারী হওয়ার আগ পযর্ন্ত ওকে যথা সম্ভব সাবধানে থাকতে হবে। নাহলে বেবী আর ওর দুজনেরই লাইফ রিস্ক হয়ে যেতে পারে।
_________________________
রাত 10:00 টা
দু-জোড়া কাপলের একে একে রিং বদলের পালা শেষ হওয়ার পরে আজম রহমান কিছু এনাউন্সমেন্টের জন্যে সবাইকে স্টেজের কাছে ডাকলেন। সবাই বেশ কৌতূহল নিয়ে ওনার কথাগুলো শোনার জন্যে প্রস্তুত হলো। সেই মুহূর্তে ছাদের সব লাইট বন্ধ হয়ে গিয়ে একটা স্পর্ট লাইট গিয়ে আজম রহমান আর ওনার পাশে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটার উপরে পড়লো। ছেলেটা যে A.k. সেটা সবার বুঝতে বেশি সময় লাগলো না। মেঘ ভ্রু কুচকে বোঝার চেষ্টায় আছে যে ওর বাবা কী করতে চাচ্ছে। মেঘের ভাবনার মধ্যেই আজম রহমান হাতে মাইক নিয়ে হাসি মুখে বলে উঠলেন
“এতোদিন তোমরা সবাই যাকে A.k. বলে ভেবে এসেছো সে আসলে তোমাদের সবার আদরের আহান। যে এতোদিন তোমাদের মধ্যেই ছিলো। অথচ তোমরা কেউই ওকে চিনতে পারোনি।”
আজম রহমানের কথাটা সবার কানে আসতেই পার্টিতে উপস্থিত সবাই হতোবম্ভ হয়ে গেলো। আহান নিজের মুখ থেকে মাস্ক’টা খুলে আজম রহমানের দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হেসে বললো
“যেভাবে কথাটা বললে তাতে তুমি মনে হয় আমাকে চিনতে পেরেছিলে? তুমি তো নিজেও আমাকে চিনতে পারোনি। ভাগ্যিস আমি তোমাকে বলেছিলাম, নাহলে তো তোমার অবস্থাও এতোক্ষনে সবার মতোই হয়ে যেতো।”
আহানের কথা শুনে আজম রহমান হেসে দিয়ে সামনে তাকালেন। সামনে তাকাতেই উনার আরেক দফা হাসি পেলো। কারন সবাই এখনো ভুত দেখার মতো করে চমকে আহানের দিকে তাকিয়ে আছে। এর মধ্যেই মিড়া রহমান ছুটে এসে আহানকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেদে দিলেন। বাকি ফ্যামিলি মেম্বাররাও সবাই গিয়ে আহানকে ঘিরে ধরলো। কিন্তু মেঘ কাউকে কিছু না বলে নিঃশব্দে ওখান থেকে নিচে নেমে আসলো। এইবার যা করার ওকেই করতে হবে।
________________________
রাত 11:00 টা
ড্রইংরুমে বসে অসহায় ফেইস করে মিড়া রহমানের দিকে তাকিয়ে আছে আহান। মিড়া রহমান সেই কখন থেকে আহানকে ননস্টপ বকা দিয়ে যাচ্ছে। আর আহান ভদ্র বাচ্চার মতো গালে হাত দিয়ে কাদো কাদো ফেইস করে মিড়া রহমানের দিকে তাকিয়ে আছে। মা-ছেলের কান্ড দেখে বাকিরা সবাই মুখ টিপে টিপে হাসছে। সবাইকে মিটিমিটিয়ে হাসতে দেখে মিড়া রহমান ধমক দিয়ে সবাইকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে উঠলো
“কোথায় তোমরা সবাই ওকে বকা দিবে, তা না করে তোমরা সবাই মিটমিটিয়ে হাসছো? ওকে কিছু বলতে পারছো না?”
মিড়া রহমানের কথা শুনে আহান বসা থেকে উঠে ওনার কাছে এগিয়ে এসে পিছন থেকে ওনাকে জড়িয়ে ধরে কাদো কাদো কন্ঠে বললো
“এটা কী বলছো মামনী? তোমার বকা শুনেই তো আমার চোখে পানি এসে পড়েছে। এইবার এরা সবাই মিলে যদি আমাকে বকা দেয়, তাহলে তো আমি কান্না করতে করতে একদম সাগর বানিয়ে ফেলবো।”
মিড়া রহমান অভিমানী কন্ঠে খানিকটা রাগ দেখিয়ে বললো
“খবরদার একদম মামনী, মামনী বলে ঢং করতে আসবি না। এতোদিন তো একবারও মামনীর কথা মনে পড়েনি। মামনী বেচে আছে, নাকি মারা গেছে সেটাও খোজ নেওয়ার কেউ প্রয়োজন মনে করিস নি। তাহলে এখন কেনো মামনীর কাছে ফিরে এসেছিস? চলে যা এখান থেকে।”
মিড়া রহমানের কথা শুনে আহান হেসে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মেঘ সুটকেস হাতে নিয়ে সিড়ি থেকে নামতে নামতে কাঠ কাঠ গলায় বলে উঠলো
“তোমাদের ঢং আর আদিক্ষেতা শেষ হলে আমি কিছু কথা বলতে পারি?”
মেঘের কথায় ঘাড় ঘুড়িয়ে সবাই সিড়ির দিকে তাকালো। মেঘ নিচে এসে সুটকেস টা এক সাইডে রেখে হ্যান্ড ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে আহানের সামনে এসে দাড়ালো। আহান মিড়া রহমানকে ছেড়ে দিয়ে মেঘের সামনে দাড়িয়ে ওর দিকে ভ্রু কুচকে তাকালো। মেঘ হাতে থাকা কাগজটা আহানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো
“এই নিন আমাদের ডিবোর্স পেপার। এতে একটা সাইন করে দিন। বাকিটা আমি বুঝে নিবো।”
আহান মেঘের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে টি-টেবিলের উপর রেখে দিয়ে মুচকি হেসে বললো
“এসবের এখন আর কোনো প্রয়োজন নেই। সব ঝামেলা অলমোষ্ট শেষের দিকে। এখন আমরা নতুন করে আবার সবটা শুরু করতে পারবো।”
মেঘ হো হো করে হেসে দিয়ে বললো
“হোয়াট? নতুন করে আবার সবটা শুরু করবো? কার সাথে? আপনার মতো একটা জানোয়ারের সাথে? যে কিনা নিজের নতুন বউকে মাঝ রাতে একা রাস্তায় ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলো।”
আহান মলিন হেসে অপরাধির ভঙ্গিতে বললো
“আই অ্যাম সরি মেঘ। আমি সেদিন ইচ্ছে করে তোমাকে রাস্তার মধ্যে একা ফেলে রেখে যাইনি। বাধ্য হয়ে আমাকে সেদিন চলে যেতে হয়েছিলো। প্লিজ তুমি আমাকে সবটা এক্সপ্লেইন করার একটা সুযোগ দেও। আমি তোমাকে সবটা বুঝিয়ে বলছি।”
মেঘ তাচ্ছিল্য হেসে বললো
“আপনাকে আর কিচ্ছু বোঝাতে হবে না মিঃ খান। আমি আপনার আর কোনো কথাই শুনতে চাই না। আপনার মতো একটা প্রতারকের জন্যে আমার লাইফে আর বিন্দুমাত্রও জায়গা নেই। আই যাষ্ট হেট ইউ।”
ড্রইংরুমে উপস্থিত সবাই এতোক্ষন অবাক হয়ে আহান আর মেঘের কথাগুলো শুনছিলো। ওরা ভেবেছিলো আহানের আসার খবর শুনে সবচেয়ে বেশি খুশী হবে মেঘ। কিন্তু ওরা যা ভেবেছিলো এখন তো তার উল্টোটা হচ্ছে। ওদের অবাকের মাএা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে আহান সবার সামনেই হুট করে এগিয়ে গিয়ে মেঘকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তারপর অসহায় কন্ঠে বললো
“মেঘ পরী প্লিজ, গিভ মি অন মোর চান্স। আমি জানি আমি তোমাকে অনেক হার্ট করেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো তখন আমার হাতে কিছুই ছিলো না। আমি পরিস্তিতির চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে তোমার প্রতি অতোটা রুড হয়ে গিয়েছিলাম।”
আহান কথাটা শেষ করতেই মেঘ আহানকে জোড়ে একটা ধাক্কা দিলো। আকষ্মিক ধাক্কা দেওয়ায় আহান মেঘের থেকে দু-কদম পিছিয়ে গেলো। মেঘ রাগে অগ্নি মূর্তি ধারন করে নিজের গায়ের সর্ব শক্তি দিয়ে আহানের গালে ঠাটিয়ে একটা চড় মেরে দিলো। ঘটনার আকষ্মিকতায় ওখানে উপস্থিত সব মানুষ বসা থেকে দাড়িয়ে গেলো। রাগে মেঘের হাত-পা থরথর করে কাপছে। আহান শুধু স্টাচু হয়ে শূন্য দৃষ্টিতে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘের হাতের পাচটা আঙুলের দাগ আহানের গালে বসে গেছে। মিড়া রহমান মেঘকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মেঘ হাত দিয়ে ইশারা করে ওনাকে থামিয়ে দিলো। তারপর রাগি কন্ঠে দাতে দাত চেপে বললো
“ডোন্ট ডেয়ার মিঃ আহান খান। আপনি আমাকে ভুলেও কখনো স্পর্শ করবেন না। একবার আমি আপনার নাটকীয় কথা শুনে যেই ভুলটা করে ফেলেছি। এইবার আর আপনার কথায় গলে গিয়ে আমি সেই ভুলটা জীবনেও করবো না। সো আমার থেকে যতোটা দূরে থাকবেন, ততোটাই আপনার জন্যে ভালো হবে। মাইন্ড ইট!”
কথাটা বলে মেঘ এগিয়ে গিয়ে সুটকেস হাতে নিয়ে দরজার দিকে হাটা দিলো। আহান চোখ জোড়া বন্ধ করে দু-হাতের আঙুল গুলো মুঠোবন্ধি করে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো। মিড়া রহমান এগিয়ে গিয়ে মেঘের সামনে দাড়িয়ে বললেন
“তোমার কী হয়েছে মেঘ? আহানের সাথে এরকম বিহেব করেছো কেনো? আর এতো রাতে সুটকেস হাতে নিয়েই বা কোথায় যাচ্ছো?”
মেঘ কাটাকাটা গলায় বললো
“কোথায় যাচ্ছি জানি না। তবে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। যতোদিন পযর্ন্ত ওই জানোয়ারটা এই বাড়িতে থাকবে ততোদিন পযর্ন্ত আমি এই বাড়ির চারপাশেও পা রাখবো। গুড বাই মাম্মাম।”
কথাটা বলে মেঘ হনহন করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। মিড়া রহমান হতবম্ভ হয়ে আহির আর মিহিরের দিকে তাকালো। আহির আর মিহির ধপ করে সোফার উপর বসে পড়লো। ওরা কী করবে নিজেরাও বুঝতে পারছে না। তাই দুজনেই ড্যাবড্যাব করে আহানের দিকে তাকিয়ে আছে। সবাইকে এমন স্তব্দ হয়ে বসে থাকতে দেখে সাজিদ প্যান্টের পকেট থেকে গাড়ির চাবি বের করতে করতে সবাইকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে উঠলো
“তোমরা কেউ কোনো চিন্তা করো না। আমি দেখছি মেঘ কোথায় গেছে। তোমরা এদিকটা সামলাও, আমি যেভাবেই হোক মেঘকে নিয়ে তারপর এখানে ফিরবো। ডোন্ট ওয়ারি গাইস।”
সাজিদের কথা শুনে সবাই একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। কারন ওরা সবাই বেশ ভালো করেই জানে যে সাজিদ একবার যখন বলে গেছে ‘ও’ মেঘকে নিয়ে আসবে। তারমানে যেভাবেই হোক ‘ও’ মেঘকে নিয়েই তারপর এখানে ফিরবে।
____________________
সাজিদ দ্রুত নিচে এসে গেট দিয়ে বের হতেই দেখলো মেঘ সুটকেস হাতে নিয়ে মেইন রোডের পাশে দাড়িয়ে আছে। ‘ও’ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে মেঘের পাশে দাড়ালো। তারপর শান্ত কন্ঠে বললো
“আচ্ছা তোরা দুই ভাই-বোন কথায় কথায় এতো রেগে যাস কেনো বলতো? আর তোদের দুজনের হাতটা এতো আগে আগে চলে কেনো? তোরা দুজনের একজনও মানুষকে কিছু এক্সপ্লেইন করার সুযোগ দিস না। কথায় কথায় ডিসুম-ডাসুম করে মানুষের নাক ফাটিয়ে দিস, গাল লাল করে দিস। মানুষকে মারা ছাড়া তোদের দুজনের আর কোনো কাজ নেই?”
সাজিদের কথা শুনে মেঘ রাগি দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো। মেঘকে এভাবে তাকাতে দেখে সাজিদ ইনোসেন্ট ফেইস করে বললো
“ওভাবে তাকাচ্ছিস কেনো? আমি কী ভুল কিছু বলেছি? প্রায় দেড় মাস আগে তোর ভাই আমাকে মেরেছিলো। অথচ সেই মারের দাগ আমার মুখ থেকে এখনো যায়নি। আমি এমনিতেই নিজের মুখে কোনো স্পট সহ্য করতে পারি না। কিন্তু তোর ভাই আমাকে মারতে মারতে আমার পুরো বডিটাকে একদম স্পটের ফ্যাক্টরি বানিয়ে দিয়েছে।”
সাজিদের কথার মধ্যেই মেঘ ওকে থামিয়ে দিয়ে বিরক্তির স্বরে বললো
“সাজিদ প্লিজ যা এখান থেকে। আমার এখন এসব কথা শুনতে একদম ভালো লাগছে না। প্লিজ লিভ মি এ্যালোন।”
“হ্যা যাবো তো। কিন্তু তুইও আমার সাথে ভিতরে চল। এতো রাতে আমি কিছুতেই তোকে একা ছাড়বো না। প্লিজ ভিতরে গিয়ে একটা বার আহান ভাইয়ার কথা গুলো শোন। ওনাকে সবটা এক্সপ্লেইন করার একটা সুযোগ দে। তারপর তোর যেদিকে মনে চায়, তুই সেদিকে চলে যাস। ”
মেঘ কঠিন গলায় বললো
“ওনার কথা শোনা তো দূরের থাক, আমি ওনার মুখটাও কখনো দেখতে চাই না।”
কথাটা বলে মেঘ সুটকেস হাতে নিয়ে সামনের দিকে হাটা দিলো। আর সাজিদ ওর পিছনে পিছনে আসতে আসতে ওকে বিভিন্ন ভাবে বোঝাতে লাগলো। ওরা হাটতে হাটতে কিছুটা দূরে চলে আসতেই হঠাৎ করে দুটো গাড়ি এসে মেঘ আর সাজিদকে দু-পাশ থেকে ঘিরে ফেললো। সাজিদ আর মেঘ দুজনেই ভ্রু কুচকে গাড়ি দুটোর দিকে তাকালো। এর মধ্যেই দুটো গাড়ি থেকে কতোগুলো কালো পোষাক পড়া লোক বের হয়ে মেঘের হাত চেপে ধরলো। সাজিদ দ্রুত মেঘকে ছাড়ানোর জন্যে এগিয়ে যেতেই ওরা সাজিদকে মারতে শুরু করলো। সাজিদকে মারতে দেখে মেঘ জোড়ে চিল্লিয়ে উঠলো।
আচমকা কারো চিৎকার কানে আসতেই মেঘদের বাসার সামনের গেটে দাড়িয়ে থাকা দারোয়ান লোকটা ভিতর থেকে বের হয়ে রাস্তায় আসলো। এসেই দেখতে পেলো কয়েকজন লোক মিলে সাজিদকে অনবরত মেরে যাচ্ছে। আর মেঘকে টেনে গাড়িতে উঠানোর চেষ্টা করছে। লোকটা কী করবে কিছু বুঝতে না পেরে দ্রুত বাসার ভিতরে চলে গেলো।
এদিকে মেঘ ছটফট করছে দেখে কালো পোষাক পড়া লোকগুলো ক্লোরোফর্ম দিয়ে মেঘকে অজ্ঞান করে গাড়িতে তুলে গাড়ি স্টার্ড দিলো। বাকি লোকগুলো সাজিদকে মারতে মারতে আধমরা করে রাস্তার মাঝখানে ফেলে রেখে অন্য গাড়িতে করে নিজেদের গন্তব্যে চলে গেলো।
সাজিদ নিজের নিস্তেজ দেহটা নিয়ে শোয়া থেকে উঠার চেষ্টা করতে লাগলো, কিন্তু পারলো না। ওর নাক মুখ দিয়ে অনবরত রক্ত বের হচ্ছে। এরমধ্যেই দারোয়ান লোকটা আহানদের সবাইকে নিয়ে রাস্তায় চলে আসলো। ওরা রাস্তায় এসে দেখতে পেলো সাজিদের রক্তাক্ত দেহটা রাস্তার উপরে ছটফট করে যাচ্ছে। আর ওর থেকে কিছুটা দূরে মেঘের সুটকেস, হ্যান্ড ব্যাগটা পড়ে আছে। সাজিদকে ছটফট করতে দেখে আহানরা সবাই সাজিদের দিকে আসার জন্যে দ্রুত দৌড় দিলো। কিন্তু ওরা আসার আগেই একটা দ্রুতগামী প্রাইভেট কার এসে সাজিদকে পিশে দিয়ে চলে গেলো। মূহুর্ত্তের মধ্যে সাজিদের ছটফট করা শরীরটা সবার চোখের সামনেই একদম নিস্তেজ হয়ে গেলো।
#চলবে…..