#মিশে_আছো_মুগ্ধতায়
#লেখিকাঃআরভি_আহিয়াদ_তিহু
#পর্বঃ12
লোকটা কোনো দিক না তাকিয়ে সোজা মায়ার দিকে এগিয়ে গেলো। তারপর ওর কাছে গিয়ে ওর পাশে হাটু গেরে বসে পড়লো। মায়া কিছুক্ষন ছলছল দৃস্টিতে লোকটার দিকে তাকিয়ে থেকে ওনাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেদে দিলো। মায়ার এমন কান্ডে সবাই আরো এক দফা অবাক হলো। লোকটা মায়ার মাথায় আলতো করে হাত রেখে শান্ত কন্ঠে বললো
“আমাকে না বলে এখানে কেনো এসেছো মামনি? তুমি জানো না, তোমার বাবাইয়ের তুমি ছাড়া আর কেউ নেই? তাহলে কেনো তুমি এই কাজটা করলে?”
মায়া কাদতে কাদতে বললো
“আমি এখানে থাকবো না বাবাই। তুমি আমাকে এখনি এখান থেকে নিয়ে চলো। আমি আর কখনো এখানে আসতে চাই না।”
মায়ার “বাবাই” ডাকটা সবার কানে বজ্রপাতের মতো বারি খেলো। ওরা কেউই বুঝতে পারছে না মায়া আজম রহমানকে বাবাই বলে কেনো ডাকছে। আর আজম রহমানই বা কেনো মায়াকে মামনী ডাকছে! ওরা কেউ এটাই ভেবে পাচ্ছে না যে মায়া আজম রহমানকে চিনেই বা কিভাবে?মায়ার কথা শেষ হতেই আজম রহমান ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে বললেন
“আমি তো তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই এসেছি। তোমাকে এখানে আর এক মুহূর্তও থাকতে হবে না। তুমি তোমার বাবাইয়ের সাথে এখনি ফিরে যাবে।”
কথাটা বলে আজম রহমান মায়াকে টেনে বসা থেকে উঠিয়ে দাড় করালেন। মিড়া রহমান মায়াকে রাস্তার উপর জোড়ে ছুড়ে মারার কারনে ওর দুই পায়েরই হাটু ছিলে রক্ত বের হচ্ছে। আজম রহমান মায়াকে এক হাতে জড়িয়ে রেখে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। গাড়ির কাছাকাছি এগিয়ে যেতেই হুট করে মিড়া রহমান দৌড়ে এসে আজম রহমানের সামনে দাড়ালেন। তারপর কাপা কাপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন
“এই মেয়েটা তোমাকে বাবাই বলে ডাকছে কেনো? তোমরা কি আগে থেকেই একে অপরের পরিচিত?”
মিড়া রহমান কথাটা বলে আজম রহমানের মুখের দিকে তাকালো। তাকিয়েই আৎকে উঠলো। আজম রহমান ওনার দিকে অগ্নি দৃস্টিতে তাকিয়ে আছে। মিড়া রহমান আজম রহমানকে আরো কিছু বলতে যাবেন তার আগেই আজব রহমান দাতে দাত চেপে বললেন
“সামনে থেকে সরে দাড়াও মিড়া। নাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।”
মিড়া রহমান আজম রহমানের কথায় পাএা দিলেন না।উল্টে উনি জেদি কন্ঠে বললেন
“আগে তুমি আমার প্রশ্নের অ্যান্সার দেও। বলো এই মেয়েটা তোমাকে বাবাই বলে কেনো ডাকছে? কে হয় ‘ও’ তোমার ?”
আজম রহমান শক্ত কন্ঠে বললেন
“আমি তোমার কোনো প্রশ্নের অ্যান্সার দিতে বাধ্য নই। আর ‘ও’ আমার কে হয় সেটা তোমার না জানলেও চলবে। তাই লাস্ট বারের মতো বলছি সামনে থেকে সরে দাড়াও।”
“নাহ! আমি যতোক্ষন পযর্ন্ত না আমার প্রশ্নের কোনো অ্যান্সার পাচ্ছি ততোক্ষন পযর্ন্ত তোমার সামনে থেকে সরবো না। তুমি আগে আমাকে এটা বলো যে এই মেয়েটা তোমাকে বাবাই কেনো ডাকলো?”
মিড়া রহমান কথাটা শেষ করার সাথে সাথে পিছন থেকে অভি বলে উঠলো
“আপনার সব প্রশ্নের অ্যান্সার আমি আপনাকে দিচ্ছি।”
কথাটা বলে অভি এগিয়ে এসে মিড়া রহমানের সামনে দাড়ালো। মিড়া রহমান প্রশ্ন বোধক চাহনিতে অভির দিকে তাকালো। বাকিরাও সবাই উৎগ্রিব হয়ে আছে অভির কথা শোনার জন্যে। অভি লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো
“মায়াই হচ্ছে মেঘ। এতোদিন যাকে আপনারা মেঘ ভেবে এসেছেন সে হচ্ছে আমার ছোট ফুপির মেয়ে জেড়িন। আর মায়া হচ্ছে আপনার আর চাচ্চুর একমাএ মেয়ে তাসনুবা সায়াজ মেঘনা।”
অভির কথাটা সবার কানে পৌছাতেই ওখানে উপস্থিত সবাই স্তব্দ হয়ে গেলো। কেউ যেনো নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। আজকে সবাই শুধু একের পর এক অবাক হয়ে যাচ্ছে। আহির,মিহির স্টাচু হয়ে দাড়িয়ে আছে। আপাততো ওরা কিছু বলার মতো ভাষাই খুজে পাচ্ছে না। আহান সোজা হয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। এসব তো একদিন হওয়ারই ছিলো। সত্য তো কখনো চাপা থাকে না। একদিন না একদিন সত্য ঠিকই সবার সামনে চলে আসে। মিড়া রহমান হতবিহ্বল দৃস্টিতে অভির দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। তারপর অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলে উঠলো
“না এটা কিছুতেই হতে পারে না। আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না।আমি আমার মেয়েকে চিনতে কখনোই ভুল করতে পারি না।”
অভি মিড়া রহমানকে আরো কিছু বলতে যাবে তার আগেই আজম রহমান তাচ্ছিল্যের স্বরে অভিকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো
“ছাড় তো অভি। কাকে কি বলছিস? ওকে এসব বলে আদৌ কি কোনো লাভ আছে নাকি? ওর বিশ্বাস করায় আর না করায় তো আমাদের কিছুই আসে যায় না তাইনা?”
অভি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো
“হ্যা চাচ্চু তা অবশ্য ঠিক। বাট তোমার বোন আর তার অতি আদরের গুনধর মেয়ে যেই ডার্টি প্লান টা করেছিলো। সেটা যদি সাকসেস ফুল হতো তাহলে কিন্তু অনেক বড় একটা প্রভলেম হলেও হতে পারতো।”
অভির কথা শেষ হতেই আজম রহমান উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। তারপর তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললেন
“এদের সাহস দেখে আমি বারবার অবাক হয়ে যাই। এতোটা স্পর্ধা এরা পায় কোথা থেকে?”
কথাটা বলে আজম রহমান জেড়িনের দিকে তাকালেন। জেড়িন একপাশে ভয়ে জড়সড় হয়ে দাড়িয়ে আছে। আজম রহমান জেড়িনের দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের স্বরে বললো
“তুমি আর তোমার মা এখন অবদি নিজেদের সোধরাতে পারলে না তাইনা? এতোগুলো বছর কেটে গেলো অথচ তোমরা আজও নিজেদের পাল্টাতে পারলে না। তোমার মা নিজে তো মানুষ হলোই না। তোমাকেও ভালোভাবে মানুষ করতে পারলো না।”
আজম রহমানের কথা শুনে জেড়িন ভয়ে একদম গুটিয়ে গেলো। আজম রহমান বললেন
“আর শেষ পযর্ন্ত কিনা তুমি এখানে আমার মেয়ে সেজে এসে আমার নিজের মেয়েকেই এতোদিন ধরে অপমান করে গেলে? আমার মেয়ের ব্যাপারে তোমার বিন্দুমাত্রও ধারনা আছে? তুমি আমার মেয়ের ব্যাপারে কোনো কথা বলা তো দূরে থাক, আমার মেয়ের সামনে দাড়ানোর যোগ্যতা পযর্ন্ত রাখো না। বুঝেছো?”
আজম রহমানের কথা শেষ হতেই অভি বললো
“চাচ্চু একে এসব কথা বলে লাভ নেই। তার থেকে বরং পুলিশ ডেকে দুই মা,মেয়েকে ধরে জেলে ঢুকিয়ে দেও। কয়েকদিন জেলের ভাত খেলেই সমস্ত বদ বুদ্ধি মাথা থেকে শুরশুর করে বেড়িয়ে যাবে।”
অভির কথা শুনে জেড়িন দ্রুত পায়ে অভির সামনে এসে তোতলাতে তোতলাতে বললো
“পুলিশ ডেকে জেলে ঢুকিয়ে দিবে মানে কি? কি বলছো তুমি এসব? এইটুকু সময়ের মধ্যে এভাবে পাল্টি খেয়ে গেলে কি করে? তুমি তো এই প্লানে আমাদের সাথে জড়িত ছিলে? তুমিও সম্পত্তির লোভের জন্যেই এখানে আমার সাথে এসেছিলে।তাই ভুলে যেওনা যে আমাদের পুলিশে দিলে তোমাকেও আমাদের সাথে পুলিশে দেওয়া হবে।”
জেড়িনের কথা শুনে অভি ফিক করে হেসে দিলো। তারপর হাসতে হাসতে বললো
“এতোদিন আমি শুধু তোকে গবেট মনে করতাম। বাট এখন আমার তোকে দেখে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মনে হচ্ছে। কারন এতোদিন ধরে চাচ্চুর প্রোপার্টি,টাকা,অফিস সবকিছু আমি সামলে রেখেছি। আমার যদি সম্পত্তি নেওয়ারই থাকতো তাহলে আমি চাইলেই যেকোনো সময়ে চাচ্চুর সব সম্পত্তি নিজের নামে করে ফেলতে পারতাম। তাই কাকি মনির সম্পত্তি নেওয়ার জন্যে আমার এখানে এসে এতো নাটক করার কোনো দরকার ছিলো না।এই সামান্য কথাটা এতোদিনে তোদের মাথায় ঢুকলো না?”
জেড়িন চোখ জোড়া রসগোল্লার মতো বড় বড় করে অভির দিকে তাকিয়ে বললো
“মানে?”
অভি লম্বা একটা একটা নিশ্বাষ নিয়ে বললো
“মানে হলো আমি তোকে যা যা বলেছিলাম সব কিছু মিথ্যা। আমি এখানে কোনো সম্পত্তি হাতানোর লোভে আসিনি, মেঘের খেয়াল রাখার জন্যে এসেছি। কয়েক মাস আগে চাচ্চু কিছু জরুরি কাজের জন্যে সিজ্ঞাপুরে গিয়েছিলেন। যাওয়ার আগে আমাকে বলে গিয়েছিলেন আমি যাতে সব সময় মেঘের খেয়াল রাখি। কিন্তু চাচ্চু চলে যাওয়ার কিছু দিন পরেই বাবার অসুস্থতার খবর শুনে আমি বাংলাদেশে চলে আসি। এখানে আসার পর থেকে বাবাকে নিয়ে ভিষন ব্যাস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। মেঘের খোজ খবর নেওয়ার সময় একদমই পাইনি। সেই সুযোগে মেঘ দিশাকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছে। চাচ্চুকে বা আমাকে কিছু জানানোর প্রয়োজন অবদি মনে করেনি। গার্ডদের বলে এসেছে ‘ও’ আমার সাথে দেখা করতে আসছে। আর সবাই ওর কথা বিশ্বাসও করে নিয়েছে।”
সবাই বেশ মনোযোগ দিয়ে অভির কথা শুনছে। আজম রহমানও উদগ্রিব হয়ে আছেন মেঘের এখানে আসার রিজনটা জানার জন্যে। কারন মেঘ এখানে কেনো এসেছে সেটা উনি কিছুতেই বুঝতে পারছে না। মেঘ ওনাকে সব সময় বলতো ‘ও’ জিবনে কখনোই ওর মায়ের অথবা ওর অন্য কোনো ফ্যামিলি মেম্বারদের সাথে দেখা করতে চায় না। তাহলে হঠাৎ কি এমন ঘটলো যে ‘ও’ কাউকে কিছু না বলেই হুট করে মায়ের কাছে এসে নিজের পরিচয়টাই পাল্টে ফেললো? এই বিষয়টা নিয়ে আজম রহমান বেশ চিন্তায় আছে।অভি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো
“আমি যখন একটু ফ্রি হয়েছিলাম তখন গার্ডদের ফোন করে মেঘের খবর জানতে চেয়েছিলাম। তখন ওরা আমাকে সবটা জানায়। ওদের কথা শুনে আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছিলো। আমি সাথে সাথে মেঘের নম্বরে কল দেই। কিন্তু ওর সিমটা বন্ধ ছিলো। তারপর আমি ওকে মেসেঞ্জারে কল দেই। প্রথমে মেঘ আমাকে বলেছিলো যে ‘ও’ ভার্সিটি থেকে টুরে এসেছে। আর ওর ফোনটা নাকি চুরি হয়ে গেছে। তারপর আমার ধমক খেয়ে ‘ও’ আমাকে সব সত্যিটা বলে দিয়েছিলো। আমি সবটা শোনার পরেও ওকে ফিরে যাওয়ার জন্যে অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু ‘ও’ আমার কোনো কথাই শোনেনি। তাই বাধ্য হয়ে আমি এখানে আসার সিন্ধান্ত নেই। ভেবেছিলাম এখানের আশেপাশে কোনো একটা হোটেলে উঠে দূর থেকে মেঘের খেয়াল রাখবো। কিন্তু তখনই আম্মুর থেকে আমি জেড়িন আর ফুপির সব প্লানের ব্যাপারে জানতে পারি। তাই আমিও চোরের উপর বাটপারি করার জন্যে ষড়যন্ত্র করার একটু নাটক করে জেড়িনের সাথে এখানে চলে আসি।”
আজম রহমান ভ্রু কুচকে বললেন
“তোমার মা এদের এসব কর্ম কান্ডের ব্যাপারে সব জানতেন? তাহলে এতোদিন আমাকে কিছু বলেননি কেনো”
“আম্মু কিছুদিন আগেই এসব জানতে পেরেছিলেন চাচ্চু। তবে ওনার কাছে কোনো প্রুফ ছিলো না। তাই তোমাকে কিছু জানাতে পারেনি।”
অভির কথাটা শেষ হতেই দিশা এগিয়ে এসে সন্দীহান কন্ঠে অভিকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো
“সবই তো বুঝলাম। বাট আংকেল কিভাবে জানলো আমরা এখানে আছি?”
অভি একটা বাকা হাসি দিয়ে বললো
“চাচ্চুকে আমি ফোন করে এখানে ডেকেছি। কারন আমি আগে থেকেই আন্দাজ করতে পেরেছিলাম যে এখানে এমন একটা সিচুয়েশন তৈরি হতে পারে। আমি তো আমার বোনকে বেশ ভালো করেই চিনি। তাই ‘ও’ যে ওর নাম ভাঙিয়ে জেড়িনকে কোনো প্রোপার্টি নিতে দিবেনা সেটাও বেশ ভালো করে বুঝতে পেরে ছিলাম। আর এসব করতে গেলে যে এখানে বিশ্রি একটা কান্ড ঘটতে পারে তাও জানতাম। তাই চাচ্চুকে ফোন করে সবটা বলে এখানে আসতে বলি। যাতে পরিস্থিতি বিগরে যাওয়ার আগেই চাচ্চু এখানে এসে সবার সামনে সবটা ক্লিয়ার করে। কিন্তু আফসোস চাচ্চু আসতে একটু দেড়ি করে ফেলেছে।”
এইটুকু বলে থামলো অভি।আহান চিন্তিত মুখে দাড়িয়ে আছে। ‘ও’ এতোক্ষন অভির কথা গুলো বেশ মনোযোগী হয়ে শুনলেও ওর কাছে এখনো একটা বিষয় ক্লিয়ার না। সেটা হচ্ছে মেঘের এখানে আসার কারনটা। অভি সব কিছু বললেও মেঘের এখানে আসার কারনটা এড়িয়ে গেছে। আর এই বিষয়টা আহানকে বেশ ভাবাচ্ছে। আহান মাথা উঠিয়ে মেঘের দিকে তাকালো। মেঘ এখনো আজম রহমানের বুকে মুখ গুজে কেদে যাচ্ছে। ওর সারা শরীরে ধুলো লেগে আছে। আহান মাথাটা নিচু করে একটা মলিন হাসি দিলো। ‘ও’ সবটা জেনেও আজকে মেঘের জন্যে কিছুই করতে পারেনি। মেয়েটা আজকে শরীরের সাথে সাথে মনেও বড্ড আঘাত পেয়েছে। এই আঘাতের ক্ষতটা যে কতোটা গভীর সেটা আহান একটু হলেও আন্দাজ করতে পারছে।
আজম রহমান অভিকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো
“অনেক হয়েছে অভি এবার আমাদের এখান থেকে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আমি দিশা আর মেঘকে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি ওদের ফ্লাটে গিয়ে ওদের জিনিস পএ নিয়ে আসো।”
আজম রহমানের কথায় সম্মতি জানিয়ে অভি বাড়ির ভিতরে চলে গেলো। অভি যেতেই আজম রহমান মেঘকে নিয়ে গাড়িতে উঠার জন্যে পা বাড়ালেন। ঠিক তখনই মিড়া রহমান দৌড়ে এসে আজম রহমানের সামনে ওনার পথ আটকে দাড়িয়ে পড়লেন। তারপর কান্নাভেজা কন্ঠে বললেন
“যাওয়ার সময় হয়ে গেছে মানে কি? তুমি আমার কাছ থেকে আমার মেয়েকে নিয়ে কোথাও যেতে পারবে না।”
মিড়া রহমানের কথা শুনে আজম রহমানের এতোক্ষনের শান্ত থাকা চেহারাটা রাগে লাল হয়ে গেলো। তিনি হুংকার দিয়ে বললেন
“খবরদার যদি ভুলেও আমার মেয়েকে নিজের মেয়ে বলে দাবি করেছো তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।”
মিড়া রহমান অসহায় কন্ঠে বললেন
“মেঘ তো আমারও মেয়ে আজম। মানছি আমি একটা ভুল করে ফেলেছি। তাই বলে তুমি আমার থেকে আমার মেয়েকে কেড়ে নিতে পারো না।”
আজম রহমান দাতে দাত চেপে বললো
“আমি কি পারি, আর কি পারিনা সেটা তোমার ধারনার বাইরে মিড়া। আর তুমি ভুল করোনি, মস্ত বড় অন্যায় করেছো। আজ অবদি যেই মেয়ের গায়ে আমি একটা নখের আচড় অবদি কাটি নি,তুমি তার শরীর থেকে রক্ত ঝরিয়েছো। তাকে আঘাত করেছো। যার ঠোটে এক চিলতে হাসি ফোটানোর জন্যে আমি সবকিছু করেছি,তোমার জন্যে তার চোখ থেকে পানি পড়েছে। ইউ নো হোয়াট মিরা? আজকে তোমার জায়গায় যদি অন্য কেউ থাকতো তাহলে আমার মেয়েকে চড় মারার অপরাধের শাস্তি হিসেবে আমি তার হাতটাকে কুচি কুচি করে কেটে ফেলতাম।”
আজম রহমানের কথা শেষ হতেই মিড়া রহমান কাদতে কাদতে হাটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়লেন। উনি জানেন, উনি আজকে যেই ভুলে করেছে সেই ভুলের কোনো ক্ষমা হয়না। কিন্তু নিজের মেয়ের শরীরে আঘাত করার পর ওনার নিজের কলিজাটাও যে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে সেটা উনি বাকিদের কি করে বোঝাবেন? মিড়া রহমানকে কাদতে দেখে আজম রহমান তাচ্ছিল্য হেসে বললেন
“এখন এসব কান্নার নাটক করে কোনো লাভ নেই। তুমি এতোদিন আমার মেয়ের সাথে যেই ব্যাবহার টা করেছো তার জন্যে আমি কখনো তোমাকে ক্ষমা করতে পারবো না। তুমি আমার কলিজায় আঘাত করেছো মিড়া,এর শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে।”
কথাটা বলে আজম রহমান হনহন করে হেটে গিয়ে মেঘকে নিয়ে গাড়িতে উঠলেন। আজম রহমানকে গাড়িতে উঠতে দেখে দিশাও গাড়িতে উঠার জন্যে পা বাড়ালো। কিন্তু কিছুটা দূর গিয়ে ‘ও’ আবার পিছনে ফিরে এসে জেড়িনের সামনে দাড়ালো। তারপর হাত দিয়ে জোড়ে জেড়িনের গাল চেপে ধরে দাতে দাত চেপে বললো
“তুই এতোদিন আমাদের যেই অপমান করেছিস আমি চাইলে তারজন্যে এখনি তোকে একটা শিক্ষা দিতে পারি। বাট দিবোনা। কারন তোর জন্যে ভবিষ্যতে আরো স্পেশাল কিছু অপেক্ষা করছে। সেটার জন্যে মানুষিক ভাবে নিজেকে তৈরি রাখিস। বেস্ট অফ লাক।”
কথাটা বলে দিশা জেড়িনকে একটা ধাক্কা দিয়ে হনহন করে হেটে গিয়ে গাড়িতে উঠলো। দিশা গিয়ে গাড়িতে উঠতেই গাড়ি স্টার্ড দিয়ে একে একে তিনটা গাড়িই শা করে চলে গেলো। গাড়ি গুলো চলে যেতেই মিড়া রহমান হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে হাউমাউ করে কেদে দিলেন। মিহির মাথাটা হাত দিয়ে চেপে ধরে রাস্তার উপরেই ধপ করে বসে পড়লো। আহির এখনো সোজা হয়ে দাড়িয়ে আছে। এতোক্ষন এখানে যা যা হয়েছে সেসব ওর কাছে একটা স্বপ্নের মতো লাগছে। সাড়িকা,সাঈফা,আলিশা, হিয়ান ওরাও শকড হয়ে দাড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে ঠিক কি বলা উচিৎ সেটা ওদের কারোরই জানা নেই। আহান জোড়ে জোড়ে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে বড় বড় পা ফেলে বাড়ির ভিতরে যাওয়ার উদ্দ্যেশ্য পা বাড়ালো। এখানে দাড়িয়ে থেকে সবার ড্রামা দেখার ওর বিন্দু মাএও ইচ্ছে নেই।
মিড়া রহমান কিছুক্ষন কান্নাকাটি করার পর হুট করেই চুপ হয়ে গেলেন। ওনার অশ্রুসিক্ত চোখ জোড়া মুহূর্তের মধ্যেই অগ্নি রূপ ধারন করলো। উনি বসা থেকে দাড়িয়ে জেড়িনের সামনে গিয়ে দাড়ালেন। তারপর কোনো কিছু না বলে নিজের গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে জেড়িনের গালে পরপর পাচটা চড় বসিয়ে দিলেন। একসাথে এতোগুলো চড় খাওয়ার পর জেড়িনের চোখের সামনে সব কিছু অন্ধকার হয়ে গেলো। ওর মাথাটা বনবন করে ঘুড়তে শুরু করলো। জেড়িনের গাল জোড়া ভিষন জ্বলে যাচ্ছে। ওর মনে হচ্ছে কেউ ওর গালের চামরা কেটে তাতে মরিচ দিয়ে দিয়েছে। ওর চোখ থেকে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে। গালে আঙুলের ছাপ গুলো একদম কাটা দাগের মতো বসে গেছে। কিন্তু এসব দেখেও মিড়া রহমানের রাগটা বিন্দুমাএও কমলো না। উনি জেড়িনের হাত পিছনে নিয়ে গিয়ে শক্ত করে মুচরে ধরে দাতে দাত চেপে বললেন
“আমার সাথে এমন নোংরা একটা গেম খেলার আগে তোর বিবেকে একটুও বাধলো না? তোকে তো ছোট বেলায় আমি আমার নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করতাম। তাহলে তুই কিভাবে আমার সাথে এরকম একটা নাটক করতে পারলি? অবশ্য করতে পারবি নাই বা কেনো,তুইও তো তোর মায়ের মতো একটা কালশাপ। তোরা জিবনে শুধুমাএ মানুষের দূর্বলতার সুযোগ নিতে শিখেছিস। এছাড়া তো আর কখনো কোনো ভালো কাজ তোদের দ্বারা সম্ভব হয়নি। তবে একটা কথা ভালো করে মনে রাখিস, তোদের জন্যে যদি আমি আমার মেয়েকে হারিয়ে ফেলি তাহলে তোদের লাইফ আমি জাহান্নামে পরিনত করবো।”
কথাটা বলে মিড়া রহমান জেড়িনকে ধাক্কা মেরে রাস্তার উপরে ফেলে দিয়ে হনহন করে ভিতরে গিয়ে গেটটা আটকে দিলেন। তারপর কর্কশ কন্ঠে জেড়িনকে বললেন
“আজকের পর থেকে তোকে যদি আর কখনো আমার বাড়ির চারপাশেও দেখি তাহলে আমি তোর কি অবস্থা করবো ভাবতেও পারবি না।”
#চলবে……