#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ০২
.
দুরুদুরু বুক নিয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই মনের ভয় দূর হয়ে গেল। ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো আমার। এতক্ষণে যে ভয়টা পাচ্ছিলাম মুহুর্তেই আষাঢ়ের ন্যায় কে*টে গেল যেন। কিন্তু হাতটা ধরে রাখা মানুষটির পাশের ব্যাক্তিকে দেখে হাসিটা যেন গায়েব হয়ে গেল আমর। এই একটা মানুষ যাকে ভালোবাসলেও তাসফি ভাইয়ার পরেই এনাকে অনেক বেশিই ভয় পাই। হুটহাট বড়মাকে ভয় পেলেও আলাদা একটা সম্মানবোধ থেকেই মান্য করি তার কথাগুলো। শুরু আমি না, পরিবারের ছোট বড় সকলেই রাজী হয়ে যায় ওনার কথায়। বড়মা আমাকে ভালোভাবে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিয়ে বললেন,
“কিছুতেই শাড়ি ছাড়া অন্য কিছু নাকি পড়বি না? সেই তো পড়তেই হলো। শুধু শুধু ছেলেটার একগাদা টাকা নষ্ট।”
মনে মনে যেটা ভেবেছিলাম ঠিক সেটাই। বড়মাকে দেখার পর ঠিকই বুঝেছিলাম, আমাকে এমন কিছুই শুনতে হবে। আর বলবেই না বা কেন? তার অতি আদরের ছেলেটা যে জামাটা কিনেছে। কেন রে? আমি কি ওই বজ্জাত লোকটাকে কিনতে বলেছিলাম, আমার জন্য এই জামাটা? আর এখন সব দোষ আমার হয়ে গেল? যদিও আমার চয়েসের মাত্রা একদমই জিরো লেভেলের। তবুও হাজারটা দোকান ঘুরে ঘুরে একটা শাড়ি পছন্দ হয়েছিলো, কিন্তু শাড়িটা পরার পর এমন কিছু হবে তা একদমই কল্পনাতে আনতে পারি নি।
বড়মার কথার একদম প্রতিউত্তর করলাম না আমি। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম, আর আমার হাত ধরে সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফুপি। আমাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফুপি বড়মাকে বললেন,
“ভাবী, এভাবে বলছো কেন? ছোট মানুষ তো, সবার শাড়ি পরা দেখে ওর ও তো একটু আধটু ইচ্ছে হবে এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না?”
ফুপির করার প্রতিত্তোরে বড়মা বলে উঠলো,
“ছোট মানুষ সেই জন্যই তো ওর কোনটাতে ভালো হবে, কোনটাতে খারাপ হবে সেগুলো তো বুঝি। শাড়ি পরছে ভালো কথা, নিজের শরীরের কোথায় কি বেড়িয়ে আছে একটু তো খেয়াল রাখবে নাকি? ছেলেগুলো রাজিবের বন্ধু বলে তাসফি চুপ করে আছে। দেখলি তো কত কি করে শান্ত করলাম ছেলেটাকে। তাছাড়া যে কি বাঁধিয়ে দিতো আল্লাহ মালুম। মেয়েগুলোকে নিয়েও পারি না আমি, কত লোকজন বাহিরে থেকে এসেছে, একটু সাবধানে থাকবে তো নাকি।”
বড়মার কথাগুলো অতি লেভেলের খাঁটি হলেও ভীষণ রকমের বিরক্ত লাগছে এখন আমার কাছে। এমনিতেই কতটা দেরি হয়ে গেল, এখন না গেলে যে উনার অতি আদরের বজ্জাত ছেলেটা যে আমার কি হাল করবে, সেটা বড়মাকে কিভাবে বোঝাবো আমি? এখন ফুপিই আমার একমাত্র শেষ ভরসা। ফুপির দিকে তাকাতেই যেন আমার মনের কথাটা বুঝতে পারলো। বলে উঠলো,
“এখন রাখো তো এসব ভাবী। দেখো, ওকে কত সুন্দর লাগছে। শুধু গলাটা অনেক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। তুই বরং চল আমার সাথে।”
বড়মাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমাকে নিজের সাথে টেনে সাথে করে নিয়ে গেল ফুপি। বড়মার থেকে ছাড়া পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম যেন। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফুপি আমাকে রুমে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে আলমারি থেকে কিছু একটা বের করে আনলো। হাতের বক্স থেকে মুক্তোর মতো একটা মালা বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিলো। ভেবেছিলাম বড়মার থেকে বাঁচাতে হয়তো ফুপি একটা বাহানা দিয়ে নিয়ে এসেছে আমাকে। কিন্তু এখন তো দেখি সবটাই তার উল্টো। মালা নামক জিনিসটার প্রতি কোন প্রকার আগ্রহ না থাকলেও অবাক হয়ে তাকালাম একবার মালাটার দিকে। অসম্ভব রকমের সুন্দর একটা মালা।
“এভাবে তাকিয়ে না থেকে পড়ে নে তো এটা।”
“তুমি তো জানোই ফুপি এই মালা টালা আমার একদম পরতে ভালো না। আমি এমনি ঠিক আছি।”
“সবাই কত সেজেছে, আর তুই কি না একটা মালাও পরতে চাইছিস না। এটা কেমন কথা বল তো? গলাটা কেমন খালি খালি লাগছে। আমি কোন কথা শুনতে চাই না, তোকে পরতেই হবে এটা।”
আরও কয়েকবার বারণ করলেও আমার আমলে নিলো না ফুপি। ফুপির এত জোড়াজুড়ি তার মধ্যে এত সুন্দর একটা মালা, আর কিছুতেই লোভ সামলাতে পারলাম না। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন মালাটা কাল বিয়েতে পরবো।
“আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। এটা তোমার কাছে রেখে দাও কালকে পড়বো ওটা। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে এখন আমায় যেতে দাও, তা না হলে তোমার ছেলেটা যে আমার কি হাল করবে ভাবতে চাইছি না।”
আমার কাতর কণ্ঠে কথাটা শুনে হেঁসে উঠলো ফুপি। আলতো করে মাথায় হাত ছুঁয়ে দিয়ে বললো,
“এবার কিছু বললে সোঁজা এসে আমাকে বলবি, তারপর আমিও দেখবো আমার মেয়েটাকে কিছু বলার সাহস পায় কি করে ও।”
এবার আমিও হেঁসে উঠলাম। ফুপিকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললাম,
“ঠিক আছে বলবো। এবার সত্যিই অনেক দেরি হয়ে যাবে, গেলাম আমি।”
ফুপিকে কথাটা বলেই আর দাঁড়ালাম না ওখানে। ভাবতে লাগলাম ঠিক কতক্ষণ আগে রিফাপু আমাকে জামাটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে জলদি করে নিচে যাবার জন্য বলে গেছে। উফ্! ওই বজ্জাত লোকটা যদি সেটা কাউন্ড করে তাহলে আমি আজ শেষ। কি হবে এখন আমার? কে বাঁচাবে আমাকে? না, আর ভাবতে পারছি না। এখন তো জান বাঁচানো আমার জন্য ফরজ। গ্রাউন্ড জামা, দু’পাশে ঝুলানো ওড়না সাথে উঁচু হিল পরে কষ্ট হলেও দ্রুত পায়ে সিড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম নিচে। মনে হচ্ছে যত তারাতাড়ি নিচে যাবো ততই যেন আমার জন্য মঙ্গলজনক।
দোতলা থেকে এক প্রকার দৌড়ে পুরো সিঁড়ি বেয়ে ভালোভাবে নামলেও শেষ সময়ে আমার জন্য যে এক বিরাট দুর্দশা অপেক্ষা করছিলো ভাবতেই পারি নি। তাড়াহুড়োয় শেষ সিঁড়িতে পা না দিয়ে হঠাৎ ফ্লোরে পা টা গিয়ে পরলো। সাথে পরনের ওড়নাটাও শত্রুতা করলো যেন আমার সাথে। পায়ের সাথে পেঁচিয়ে হুর-মুর করে সোজা নিচে পড়তে নিলাম। চোখটা খিঁচে বন্ধ করে নিয়ে এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো আজকে আমি শেষ, গত এক মাস হাসপাতালের বের্ডে নিজেকে কল্পনাও করে নিলাম। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডর ব্যবধানেই মনে হলো আমি তো নিচে পড়ে যায় নি, বরং কেউ জড়িয়ে নিয়েছে নিজের সাথে।
কোমরে শক্ত পুক্ত একটা হাতের অস্তিত্ব পেয়ে আস্তে আস্তে চোখটা খুলে ফেললাম। কোমর জড়িয়ে রাখা হাতের মালিককে দেখার জন্য মাথাটা উঠিয়ে দেখতেই কেঁপে উঠলাম যেন। ভয় ভয় মুখটা আরও ভয় পেয়ে চুপসে গেল আমার। শেষে কি না আমি এই বজ্জাত লোকটার কাছেই পরলাম। কি হবে এখন আমার? কে বাঁচাবে আমাকে? বাহিরে গেলেও হয়তো কিছুটা রক্ষা পেতাম রিফাপুর সাথে থেকে। কিন্তু এখন? বিড়ালের ন্যায় মিনমিনিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে লাগলাম,
“ভভভাইয়া আসলে আ..আমি তো….”
ছেড়ে দিলেন তাসফি ভাই আমাকে। ছেড়ে দেওয়ায় যেন স্বস্তি পেলাম যেন। হঠাৎ ভারী কণ্ঠে গম্ভীর গলার আওয়াজে আবারো কেঁপে উঠলাম।
“হাত-পা ভেঙ্গে পুরো বিয়ে বাড়ির আনন্দটাই মাটি করার জন্য এভাবে দৌড়াচ্ছিলি? হাত-পা ভাঙে রিমির বিয়ে ছেড়ে তোর পিছনে সবাই ছোটাছুটি করুক, সেটাই চাচ্ছিস এখন? সারাদিন এত লাফালাফি করিস কেন? বেয়াদব!”
আল্লাহ্ বাঁচাও আমাকে। এই লোকটার কথার উত্তরে এখন আমার কি বলা উচিত সেটাই ভেবে পাচ্ছি না। আমি কি ইচ্ছে করে হাত-পা ভা*ঙ্গার প্ল্যান করেছি নাকি? এই বজ্জাত লোকটার জন্যই তো তাড়াহুড়ায় এমন হলো। ভিতু চোখে তাসফি ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলাম,
“আআসলে তাসফি ভাইয়া আমি দেখি নি, হঠাৎ ওড়নায় পা জড়িয়ে…..”
কথাটা শেষ করার আগে এবারো আমাকে এক রাম ধমক দিয়ে চুপ করে দিলেন।
“চোখ কি আকাশে থাকে তোর যে দেখতে পাস না? গাধী কোথাকার এ….”
হঠাৎ চুপ হয়ে গেলেন তাসফি ভাইয়া। তীক্ষ্ণ নজরে তাকালেন আমার দিকে। আমাকে ঝাড়তে ঝাড়তে এভাবে চুপ হয়ে যাবার কারণটা ঠিক ধরতে পারলাম না। তাহলে কি আমার পিছনে? উফ্ এবার খুব করে জব্দ হবে তাসফি ভাইয়া। এই একটা মানুষের সামনেই আমাকে কিছু করতে বা বলতে পারেন না ভাইয়া। খুশি মনে পিছনে তাকিয়ে একবিন্দু আশার আলো নিভে গেল আমার। কাউকেই দেখতে পেলাম না। ভেবেছিলাম ফুপাকে দেখে হয়তো চুপ হয়ে গেছেন কিন্তু না, আমার ধারণাটা পুরোপুরিই ভুল প্রমাণিত হলো।
আমার ভাবনার ছেদ আবারও ভেঙে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলেন,
“না শাড়ি, না ওড়না কোন কিছুই ঠিক জায়গায় থাকে না তোর। যৌবন কতটা ঝলছে পরছে সেটা ছেলেদেরকে দেখানোই একমাত্র কাজ হয়ে উঠেছে তোর, তাই না?”
চমকে উঠলাম আমি। চকিত চাহনিতে নিজের দিকে তাকিয়ে থম মেরে দাঁড়িয়ে গেলাম যেন। এতক্ষণ আমি ওনার সামনে এভাবে ছিলাম? কান্না পাচ্ছে আমার। বড়মা ঠিকই বলেন, কোন কিছুই আমি খেয়াল করে দেখি না। ওড়নাটা যে কখন একপাশ থেকে পরে গিয়ে ঝুলে আছে বুঝতেই পারি নি। এই বজ্জাত লোকটাকে এখন আমি কি বলে বোঝাবো? যে আমি ইচ্ছে করে কিছুই করি নি, একদম এক্সিডেন্টলি ভাবে ঘটে গেছে সবটা। ঘাড় থেকে মাথাটা যে এখন আলাদা হবে ঠিকই বুঝতে পারলাম। তাসফি ভাইয়া কিছু বলার জন্য হাত উঠিয়ে এগিয়ে আসতেই ছোট কণ্ঠে চিৎকারের করে ভেসে আসলো,
“লুপপপা আআআপু….”
.
.
চলবে….