তুমি বললে আজ – পর্ব ১২(শেষাংশ)

0
927

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ১২ ( শেষাংশ )

.
গালে কিছুর স্পর্শে কেঁপে উঠলাম কিছুটা। গভীর ঘুমটা আলগা হয়ে গেল আমার। আরও গভীর ভাবে গালে স্পর্শ পেতেই ঘুমটা পুরোপুরি ছুটে গেল, কিন্তু চোখ দুটো কিছুতেই খুলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। আবারও একই ভাবে গালে ছোঁয়া পেয়ে নড়োচড়ো চোখ খুলতে লাগলাম। সামনের মানুষটাকে দেখে ধরফর করে বিছানায় উঠে বসলাম। তাসফি ভাইয়া, উনি এখানে কখন এলেন? কেন এলেন? কিছুক্ষণের জন্য হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। গভীরভাবে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। আমার চমকে উঠা দেখে তিনিও একটু নাড়াচাড়া করে বললেন,

“রিল্যাক্স রিল্যাক্স এত ভয় পাচ্ছিস কেন? কি হলো হঠাৎ করে তোর?”

উনার কথায় ঘোর কাটলো আমার। তাসফি ভাইয়া তো আমাকে পড়ানোর জন্য এসেছিলেন, প্রচন্ড ক্লান্ত শরীর নিয়ে হঠাৎ আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছিলেন। তারপর বড়মা আসলেন, আমাকে অনেক কিছু বুঝিয়ে দরজা লক করে চলে গেলেন। আর আমি? আমি তো বড়মার কথার সমীকরণ মেলানোর চেষ্টায় ছিলাম। বড়মার কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছিলাম টেরও পাই নি। এক এক করে সবকিছু মনে পরতে লাগলো আমার। সমস্ত কথা মনে পরতেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম একটা। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি সাড়ে নয়টা বাজতে চললো। সন্ধ্যা থেকে এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম ভাবতেই অবাক লাগছে। তাসফি ভাইয়ার দিকে তাকাতেই দেখলাম কেমন করে জানি তাকিয়ে আছেন উনি। উনার এবারের তাকানো দেখে চোখ নামিয়ে নিচে তাকালাম। হাঠাৎ খেয়াল হলো এতক্ষণ তাসফি ভাইয়ার গায়ের সাথে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে গেছিলাম। কথাটা মনে হতেই যেন একরাশ লজ্জা এসে ভীর জমালো আমার মনে।

“যেভাবে লজ্জা পাচ্ছিস, মনে হচ্ছে বাসর ঘরে বসে আছিস। সত্যি সত্যি আমাদের বাসর হলে যে কি করবি? আল্লাহ মালুম!”

কথাটা বলে আফসোস করতে লাগলেন উনি। এদিকে আমি চমকে উঠলাম খানিকটা। কি বলছেন কি উনি? ছি! কি অসভ্য কথাবার্তা। তাসফি ভাই যে এমন অসভ্য রকমের কথাবার্তা বলতে পারেন জানা ছিলো না আমার। আমি কটমট চোখে তাকালাম উনার দিকে। উনি গুরুত্ব দিলেন না আমাকে। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই উনি আমাকে উপেক্ষা করে আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে দাঁড়ালেন। হাত-পা নাড়াতে নাড়াতে বললেন,

“তুই যে দিন দিন এত ভারী হচ্ছিস সেটা কিন্তু দেখে বোঝার উপায় নেই। উফ্! বাবা হাত-পিঠ একদম তুঙ্গে উঠেছে তোর ভরে। একদম ছোটখাটো একটা হাতির বাচ্চা।”

“হাতির বাচ্চা? কে হাতির বাচ্চা? আমাকে দেখে কি তাই মনে হচ্ছে আপনার? ৪২ কেজি ওজনে আমাকে দেখে আপনার তাই মনে হচ্ছে? আপনি কি?”

প্রচন্ড রাগে স্থির থাকতে পারলাম না যেন। গটগট করে বলে ফেললাম কথাগুলো। আমার কথায় হেঁসে উঠলো তাসফি ভাই। উনার হাসিটা দেখে রাগের মাত্রা বেড়ে যেতে লাগলো যেন। হাসতে হাসতে বলে উঠলেন,

“যেভাবে ঘাড়ে চেপে ছিলি, তাতে আর আমার দোষ কোথায় বল? আমার জায়গায় রিফা থাকলেও এই কথাই বলতো।”

“আর আপনি? আ..আপনি যে আপনার এই বিশাল দেহ নিয়ে আমার কোলে ঘুমিয়ে ছিলেন তার বেলায়? আমার কি অবস্থা হয়েছে জানেন? আপনাকে তো হাতির বাচ্চা বলা যায় না, আপনি তো নিজেই একটা হাতি।”

কথাগুলো বলে যেন আনন্দিত হয়ে উঠলো আমার মন। উফ্ ভাবা যায় এই অসভ্য লোকটাকে আমি এই কথাগুলো বললাম। উফ্! রূপা তুই দিনদিন ব্যাপকভাবে সাহসী হয়ে যাচ্ছিস। উনার করা কাজ এবং উনার বলা কথাগুলোয় আজ থেকে তাসফি ভাইয়ের নামের পাশে অসভ্য পদবি টাও যুক্ত হয়ে গেল।
হঠাৎ করে তাসফি ভাইয়া আমার একদম কাছে চলে এসেছেন। নিজের ভাবনায় মসগুল থাকায় কখন এসেছেন বুঝতেই পারি নি আমি। আমার দিকে একটু ঝুকে আস্তে করে বলে উঠলেন,

“সামান্য মাথা রেখেছি তোর কোলে তাতেই এভাবে বলছিস? তাহলে এই আমিকে কিভাবে সহ্য করবি সারাজীবন? কিভাবে নিবি এই আমার পুরো শরীরের ভার?”

এতক্ষণ রাগ বশিভূত হলেও এখন চমকে উঠলাম আমি, কেঁপে উঠলো আমার শরীর। এসব কি বলছেন উনি? মানে কি এসব কথার? এগুলো বলে কি-ই বা বোঝাতে চাচ্ছেন? কিছুই ঢুকছে না উনার ভাষ্যমতে আমার এই ছোট্ট মস্তিষ্কে। কথা বের হচ্ছে না আমার মুখ থেকে। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি উনার দিকে।

“তুই চরম লেভেলের একটা গাঁধা। তোর মতো গাঁধার ছোট্ট মস্তিষ্কে কিছুতেই এই কথাগুলো ঢুকবে না। সো চাপ নিস না।”

.
সেদিন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না আমার। একটা ঘোরের মাঝে চলে গেছিলাম যেন। আমার সেই ঘোর কেটেছিলো তাসফি ভাইয়া রুম ছেড়ে যাবার পর আম্মুর আগমনে। রুমে এসেই একগাদা বকা ছুড়ে দিয়েছিলো আমার উপর। আমার অন্যায়, কেন আমি তাদের আদরের ছেলে রুমে পাঠানো খাবার খায় নি, আর সেটা আমি কেন দেখি নি। উনি কেন ড্রয়িং রুমে গিয়েই খাবারের আবদার করলেন? এতে যে আমার কোন দোষ নেই সেটা বুঝতেই চাইলো না। কিন্তু আম্মুর কথায় বুঝতে পেরেছিলাম বড়মা আম্মুকে কিছুই বলে নি, সেটা ভেবে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলাম।

সেদিন রাতে বড়মা ও আম্মুর জোড়াজুড়ি তে এখানেই থাকতে হয়েছিলো তাসফি ভাইকে। পরের দিন বিকেলে আমাকে পড়াতে না আসলেও পরশু দিন ঠিকই চলে এসেছিলেন। প্রতিদিন উনাকে দেখার অভ্যাস হওয়ায় সেদিন না আসায় কেমন যেন একটা অনুভব হচ্ছিলো উনার প্রতি।
একদিন পর উনাকে দেখে উনার করা কর্মকাণ্ড এবং বড়মার কথাগুলো বারবার মনে হচ্ছিলো। সেদিন উনাকে খুব করে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলাম আমি। যার ফলস্বরূপ উনার দেওয়া প্রতিটা প্রশ্নের উত্তরগুলো ভুল হয়ে গেল। এক বার, দু’বার তারপর আরও কয়েকবার একই ভুল হলো আমার দ্বারা। সেদিন প্রথমে কিছু না বললেও শেষ দিকে রেগে গেলেন তাসফি ভাই, অনেক কথা শোনালেন আমাকে। একসময় প্রচন্ড রেগে বললেন,

“তোর মতো গাঁধাকে কখনোই ঠিক করা সম্ভব না আমার দ্বারা। সেটা প্রমাণ করে দিলি তুই। অযথাই আমার বিসিএস এর পড়া ছেড়ে মূল্যবান সময় নষ্ট করে, মামা মামীদের সম্মানের জন্য তোকে মানুষ করতে এসেছিলাম। কিন্তু আজকে তুই আমাকে নিরাশ করে দিলি রূপা। আশাহত আজ আমি, একদম ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তোর দ্বারা আমার ইচ্ছেগুলো পূরণ করতে চেয়ে। থাক তুই তোর মতো, আর ভার্সিটির গন্ডি পেরোনোর আশা ছেড়ে দে।”

কথাগুলো বলেই আর থাকেন নি তাসফি ভাই সেদিন। চমকে উঠেছিলাম উনার শেষ বলা দুই বাক্য শুনে। আমার দ্বারা কিসের ইচ্ছে পূরণ করতে চান উনি? তাহলে কি উনার সাথে আমি অপ্রত্যাশিত ভাবে জুড়ে গেছি বলেই কি এই কথাগুলো বললেন? আমাকে কি বুঝিয়ে দিলেন আমি উনার যোগ্য ন-ই। হঠাৎ কিছু একটা হলো আমার। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম কিছুতেই তাসফি ভাইয়ের কাছে আর অপমানিত হবো না আমি। যে করেই হোক উনার কথা ভুল প্রমাণিত করে ভার্সিটিতে এডমিশন নিতেই হবে আমার। তবে সেটা তাসফি ভাইয়ার ভার্সিটিতেই হোক। উনাকে বোঝানোর জন্য যে আমিও পারি।
সেদিন থেকে গভীরভাবে মনোযোগ দিলাম পড়াশোনার প্রতি। ভেবেছিলাম উনি হয়তো আর আসবেন না কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণিত করে ঠিকই চলে এসেছিলেন পরের দিন। আমাকে পড়াশোনার প্রতি সিরিয়াস মুডে দেখে হয়তো অবাক হয়েছিলেন কিছুটা, কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলেন নি। আমিও রাগ ও জেদের বসে দিন-রাত পড়াশোনার উপরেই কাটিয়ে দিয়েছি একমাস। যথারীতি এডমিশন পরীক্ষাগুলো তেমন ভালো না দিলেও তাসফি ভাইয়ের পড়াশোনা করা ভার্সিটিতে মোটামুটি ভালোই পরীক্ষা দিয়েছিলাম। কয়েকটা ভার্সিটিতে চান্স না আসায় সবাই আসা ছেড়ে দিয়েছিলো আমার ভার্সিটিতে পড়ার। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে তাসফি ভাইয়ার সেই নামকরা ভার্সিটিতে ২৩৫ তম তে চান্স হয়ে যায়।

সেদিন সবার মুখে এক অবিশ্বাস্য হাসি লেগেছিলো যেন। তাসফি ভাইও হয়তো অনেক অবাক হয়েছিলোন। কিন্তু আমি উনার চোখে মুখে অবাক হওয়ার রেশ পর্যন্ত পাই নি। শুধু দেখতে পেয়েছিলাম একরাশ খুশির ঝলক। হয়তো উনি বুঝতে পেরেছিলেন এমন কিছুই হবে। সেদিন আমিই অনেক অবাক হয়েছিলাম উনার আত্নবিশ্বাসী চেহারা দেখে।

.
“রূপা! এই রূপা। বাইরে আয়।”

আম্মুর ডাকে ভাবনাগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে হলো আমাকে। সেদিন তাসফি ভাইয়াকে এতটা আত্মবিশ্বাসী দেখে অদ্ভুত মায়ায় আঁটকে গেছি আমি। উনাকে সহ্য করতে না পারলেও, রাগ অভিমান নিয়েও মায়া কাটিয়ে উঠতে পারি নি কোন মতোই। এডমিশন রেজাল্টের পর আর দেখা হয় নি উনার সাথে। আজকে আসার কথা তাসফি ভাইয়ের, হয়তো এসেও গেছেন। তাই আম্মু ডেকে চলছে বাইরে যাবার জন্য।
আমাকে নিয়েই মিটিং করবে সবাই। বিষয় আমার ভর্তি নিয়ে, সাথে থাকা খাওয়া সমস্ত কিছু। ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখলাম আমাকে নিয়েই কথা হচ্ছে। তাসফি ভাইয়া চুপচাপ বসে আছেন সোফায়। এদিকে সবাই চিন্তায় পরে গেছে ঢাকা শহরে আমাকে রাখার জন্য। একা একা কিভাবে থাকবো? কিভাবে চলাফেরা করবো? কি খাবো না খাবো? এসব নিয়েই। কিন্তু যে করেই হোক তাসফি ভাইয়ার পড়াশোনার গত হওয়া ভার্সিটিতেই আমি এডমিশন নিবো। সবার এসব চিন্তার কারণগুো তো কোন ফ্যাক্ট না। হোস্টেলে উঠলেই সকলের চিন্তার অবসান ঘটবে। সাথে আমার কয়েকটা ক্লাসমেটও ওই ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে, তাই আর টেনশনের কোন অবকাশই নেই৷ এসব বলার জন্য মুখ খুলতে নিলাম। কিন্তু আমার মনের কথাগুলো মুখে এসেই আটকে গেল। আমি কিছু বলার আগেই তাসফি ভাইয়া বললেন,

“মামা, মামী তোমরা অযথাই শুধু শুধু টেনশন করছো। কিন্তু এতকিছু টেনশনের মাঝে এটাই ভুলে যাচ্ছে যে আমিও ঢাকাতেই থাকি, আর সেটা নিজের বাসাতেই। আর ও তো আমার ভার্সিটিতেই ভর্তি হবে।”

তাসফি ভাইয়ার কথায় সকলের মুখ আলোকিত হয়ে উঠলো। কিন্তু আমার মুখটা ফিউজ এনার্জি বাল্বের মতো চুপসে গেল। এই ছিলো তাহলে এই বজ্জাত লোকটার মনে? আম্মু খুশি হয়ে বলে উঠলো,

“এর চিন্তায় চিন্তায় একদম মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিলো কথাটা। উফ্ বাবা অযথাই মেয়েটাকে নিয়ে টেনশন করছিলাম। কালকেই নিয়ে যা ওকে, তোর সাথে থেকে তোকে দেখে তাও যদি কিছু করতে পারে।”

বলেই হাফ ছাড়লো আম্মু। আম্মুর সাথে সাথে আব্বু, বড় বাবাই, বড়মাও একই কথা বললো। আমাকে কিছু বলতে দেওয়া তো দূরে থাক, আমার উপস্থিতি যেন কেউ আমলেই নিলো না।
এবার খুব কান্না পাচ্ছে আমার। আমার সাথেই কেন সবসময় এমন কিছু হয়? তাসফি ভাইয়ার থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য, উনার করা অপমান ও খোঁচা থেকে দূরে থাকার এতকিছু করলেও শেষে কি উনার সাথেই থাকতে হবে আমার? এই অসভ্য লোকটার সাথেই কি না এখন থেকে থাকতে হবে তাও উনার বাসায়? এটা ভেবেই হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে কান্না করতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার। এই বজ্জাত লোকটার থেকে কি কখনোই মুক্তি পাবো না আমি?

.
.
চলবে…..

জানি না গল্পটা কেমন হয়েছে বা হচ্ছে। আপনাদের রেন্সপন্স আর নেক্সট নেক্সট কমেন্ট দেখে গল্পের ধারা কিছুতেই বোঝার উপায় নেই।🙁 আপনারা কেন বোঝেন না, আপনারা নেক্সট না বললেও আমি পরের পর্ব দিবো। কিন্তু নেক্সট কমেন্ট দেখে লেখার মানসিকতা হাড়িয়ে যায়। তার চেয়ে দু’লাইনে গল্পের বিষয়ে কিছু বলে যান। সেটা খারাপ মন্তব্য হোক বা ভালো। এতে আমার ভুলগুলোও শুধরে নিতে পারবো আর লেখার মানসিকতাও বৃদ্ধি পাবে। ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here