#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ১৭
.
কোমরে ভারী কিছুর অস্তিত্ব টের পেতেই সকালের গাড়ো স্নিগ্ধ ঘুমটা ভেঙে গেল। মিটমিট করে চোখ মেলে তাকাতেই জানান দিলো মিষ্টি একটা সকালের। মাথাটা কিঞ্চিৎ ব্যাথা হতে লাগলো। হয়তো অনেক বেশিই ব্যাথা হচ্ছে। কিন্তু বুঝেও বুঝতে চাইছি না আমি। সুখ নামক অনুভূতির কাছে রোজকার মাথা ব্যাথা নিছক তুচ্ছ একটা জিনিস বলে মনে হলো। এই মুহুর্তে চাই না এই তুচ্ছ বস্তুকে আমলে নিতে।
আড়মোড়া ভেঙে উঠতে গেলেও পারলাম না। আটকে গেলাম কোমরে ভারী কিছুর জন্য। সোজা হয়ে দেখতেই নজরে আসলো তাসফি ভাইয়ের শক্তপুষ্ট হাতটি। আলতো করে ছুঁয়ে রেখেছেন কোমরে। সুখময় সকালটা কেন জানি দ্বিগুণ ভালোলাগায় ছেয়ে গেল। তাসফি ভাইয়ার দিকে তাকালাম। উপর হয়ে শুয়ে আছেন বাচ্চাদের মতো করে। সকালের স্নিগ্ধতার থেয়ে ওড়নাকেই বেশি স্নিগ্ধ লাগছে। উপর হয়ে ঘুমানোর ফলে পুরো মুখটা দেখা গেল না, কিন্তু বন্ধ চোখ দুটো ঠিকই দেখা গেল।
আস্তে করে ওনার হাতটা সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে গেলাম। রুম জুড়ে পায়চারি করতে করতে গাছগুলোকে ছুঁয়ে দিতে লাগলাম। গাড়ো সবুজ পাতাগুলো জীবন্ত প্রাণ ছড়িয়ে দিচ্ছে রুম জুড়ে। রুমে থাকা সমস্ত গাছগুলোকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিয়ে বারান্দার থাই গ্লাসের কাছে আসলাম। পর্দার কিছুটা সরিয়ে আস্তে করে টেনে নিলাম থাই গ্লাসটা। মুহুর্তেই সকালের শিরশিরে দমকা হাওয়া এসে ছুয়ে দিলো। চোখ বন্ধ করে অনুভব করলাম আমি। এতদিন পর ফুরফুরে মেজাজে সকালের মিষ্টি আবহাওয়াটা অনুভব করে আরও ভরে উঠলো মন। বারান্দায় থাকা গাছগুলোও ছুঁয়ে দিতে লাগলাম। ফুলগুলো পাপড়ি মেলে মুক্ত হয়ে ছেড়ে দিচ্ছে চারদিকে। ছোট ছোট গাছগুলো দুলতে লাগলো। ভালোলাগায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল সকালটা। গত পনেরো দিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে না পারলেও ঘুম ভাঙলেই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি। রুম ও বারান্দার গাছগুলো এই পনেরো দিনে আমার অনেকটা আপন হয়ে উঠেছে। বারান্দায় এভাবেই দাঁড়িয়ে কেটে গেল কিছু মুহুর্ত। ঠিক কতক্ষণ কেটে গেল ধরাণায় আনতে পারলাম না।
হঠাৎ কারো উপস্থিতি অনুভব হলো। উপস্থিকৃত মানুষটারও জানান দিলো মন। ঠোঁটের হাসিটা বিছিয়ে গেল আরও। অবুঝ হৃদয়টা এই মানুষটার-ই অভাব অনুভব করেছিলো যেন। কেন? কেন করছিলো সেটা ঠিক জানা নেই আমার। কিছুক্ষণ চললো নীরবতা। তারপর ভেসে আসলো,
“আজকে এত তাড়াতাড়ি উঠে গেলি যে? অন্যদিন তো টেনেই তোলা যায় না তোকে।”
“কারণ আজকে আমার মন ভালো, মাইন্ড ফ্রেশ।”
“তা এই মন ভালোর কারণটা জানতে পারি কি?”
কিছুটা মন ভার হলো আমার। মুখ গোমড়া করে তাসফি ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
“আজকে যে আমার ভার্সিটির প্রথম দিন, সেটা ভুলে গেলেন আপনি? কি ভাবে পারলেন ভুলে যেতে?”
হেসে উঠলো তাসফি ভাই। অনেক শব্দ করেই হাসলেন। ওনার হাসি দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল আমার। এমনিতেই তো আমার বিষয়ে সব কথাই মনে রাখেন, তাহলে এই ছোট বিষয়টা মনে রাখতে পারলেন না? অভিমান জমা হতে লাগলো ওনার প্রতি। তখনই তাসফি ভাই বলে উঠলেন,
“নিজের সুখের মুহুর্ত গুলো কি করে ভুলে যেতে পারি, বল?”
ফ্যালফ্যাল করে তাকালাম ওনার দিকে। কি বললেন সবটাই যেন মাথার উপর দিয়ে গেল। এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমার মাথায় একটা টোকা মেরে বললেন,
“তোর মোটা মাথায় কিছু ঢোকাতে হবে না। যা ফ্রেশ হয়ে নে।”
চলে গেলেন উনি। আমাকে কিছু বলারও সুযোগ দিলো না, হু। যাই হোক, আজকে তো আমার মনটা অনেক ভালো। এই ভালো মনটাকে খারাপ বানিয়ে তো কোন লাভ নাই।
.
তাসফি ভাইয়া বাইকটা ভার্সিটির গেইটের সামনে থামাতেই আমি বলে উঠলাম,
“ভেতরে যাবেন না? এখানে থামালেন যে?”
“আমার শ্বশুর মামা তো আর প্রতিদিন সামনের গেইটটা খুলে রাখবে না। তাই পার্কিং এরিয়া গেইট দিয়েই ঢুকতে হবে।”
“সহজ করে বললেই তো হয়। এত বাঁকা কথা কেমনে বলতে পারন?”
বলেই একটা ভেংচি কাটলাম। ইশ্ কথার কি ছিরি, শ্বশুর মামা। তাসফি ভাই বললেন,
“ত্যাড়া কথা ছাড়া তো আবার তোর মাথায় ঢোকে না। তাই ত্যাড়া ভাবেই বললাম।”
“তাই বলে আ….”
“দিন দিন চরম লেভেলের বেয়াদব হচ্ছিস এটাই তার প্রমাণ। যা ভেতরে, আমি বাইক পার্কিং করে আসছি।”
দাঁতে দাঁত চেপে ধমকের সুরেই বললেন উনি। আমি আর কিছু বলার সাহস করতে পারলাম না। উফ্ আমি ভুলে যাই কেন, বজ্জাত-রা দু’একটা ভালো করে কথা বললেই তো ভালো হয়ে যায় না। তেমনটা এই বজ্জাত-বদমাশ ক্ষেত্রেও তো হবে। তাকালাম না আর ওনার দিকে। গটগট পায়ে হেঁটে ভেতরের ঢুকলাম। এক ভালোলাগা কাজ করলেও কিছুটা ভয় ভয় অনুভূতি হচ্ছে। চারদিকে কত-শত ছেলেমেয়ে, কাউকেই তো চিনি না। কলেজের তিনজন ফ্রেন্ডের চান্স হয়েছে তারাও অন্য ডিপার্টমেন্টে। এখন কোথায় আছে সেটাও ঠিক জানি না। বজ্জাত লোকটাও তো ঠিক বললো না কোথায় দাঁড়িয়ে থাকবো। ফোন করে জানার ও উপায় নেই। সকালেই রিফাপুর সাথে কথা বলে ব্যালেন্স শেষ করেছি। কি করনো? ভাবতে ভাবতে এগিয়ে যেতে লাগলাম সামনের দিকে।
.
হঠাৎ ‘এই যে ব্লাক’ কথাটা শুনে পা দু’টো থেমে গেল আমার। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে কথাটা তেমন পাত্তা দিলাম না। দু’পা এগিয়ে যেতেই আবারও কেউ বলে উঠলো,
“এই যে ব্লাক ড্রেস, এদিকে এদিকে।”
এবারও থেমে গেলাম। কেন জানি মনে হলো আমাকেই ডাকছে। বরাবরই কালো রংটা পছন্দের জন্য আজকে কালো রংয়ের প্রিয় জামাটা পরে এসেছি। কিন্তু এভাবে কে ডাকতে পারে আমাকে? কাউকেই তো তেমন চিনি না। মনের কৌতুহল দমাতে না পেরে আশেপাশে দেখতেই কয়েকজন ছেলেমেয়েদের দিকে চোখ গেল। আমার দিকেই ইশারা করে বলে উঠলো,
“হ্যাঁ হ্যাঁ তোমাকেই বলছি। এদিকে এসো।”
যেতে ইচ্ছে না হলেও অগ্যতা যেতে হলো। দশ এগারো জন ছেলে মেয়ে বসে আছে। মেয়েগুলোকে দেখে একটু সাহস পেয়েই এগিয়েছি। তাদের সামনে দাঁড়াতেই একটা মেয়ে বলে উঠলো,
“এদিক-ওদিক তাকিয়ে চোরের মতো কি খুঁজছিলে? আগে কখনো ভার্সিটিতে আসো নি?”
“না মা..মানে আমি তো….”
“ফাস্ট ইয়ার?”
সাথে সাথে মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বললাম জানালাম। এদের দেখেই মনে হচ্ছে সিনিয়র৷ আর সিনিয়ররা নতুন স্টুডেন্ট দেখে কি করতে পারে সেটার কিঞ্চিৎ ধারণা আছে আমার।
আমার মনের ধরণায় হয়তো ঠিক হলো। সবাই একে-অপরের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ইশারা করলো, তারপর সবাই কেমন যেন হেসে উঠলো। মনের কোণে ভয় ঢুকে গেল একটা। তবুও স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম। তাদের মাঝে একটা ছেলে হঠাৎ বলে উঠলো,
“হুম… ফাস্ট ইয়ার, নাম কি?”
ছেলেটার নাটকীয় ভঙ্গিতে রাগ হলো কিছুটা, সেই সাথে মনের ভয়টা কেটে গেল যেন। কিন্তু এদেরকে নিজের রাগ দেখিয়ে কিছুতেই বিপদ বাড়ানোর ইচ্ছে নেই। তাই ইচ্ছে না থাকলেও বললাম,
“রূপা! রামিয়াত রূপা।”
সামনের ছেলেগুলোর মাঝে একজন হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো। বললো,
“ওওও দোস্ত… রূপার দাম যে হারে বাড়ছে। আন্টি বানাতে গিয়ে ছেঁকা খেলাম, ভাবলাম রূপার দেখা ইহ জনমে আর দেখা পাবো না। কিন্তু এখন তো দেখি জলজ্যান্ত রূপা দাঁড়িয়ে আছে।”
ছেলেটা থামতেই সবাই হো হো করে হেঁসে উঠলো। ধপ করে আগুন জ্বলে উঠলো আমার মাথায়। মনে হচ্ছে মাথা ফাটিয়ে দেই সব কয়েকটার। ছোট বেলায় নিজের নাম নিয়ে আক্ষেপ থাকলেও এখন ভালোলাগা কাজ করে। তার মূল কারণ হিসেবে ধরা যায় হুমায়ুন আহমেদের বিখ্যাত চরিত্র রূপা।
আমি কিছু বলার আগেই আরেকটা ছেলে বলে উঠলো,
“শাফিন তুই তো দেখছিস জলজ্যান্ত রূপা-কে। আর আমি ভাবছি এমন রূপা পাইলে সোনারও প্রয়োজন পড়বে না।”
এবারো হেঁসে উঠলো সবাই। নিজের রাগটাকে আর দমাতে পারলাম না যেন, যা হবার হোক। তবুও এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপমান সহ্য করা যাবে না। অনেকটা রাগ নিয়েই বললাম,
“দেখুন আপনারা কিন্তু বারাবাড়ি করছেন, নতুন বলে যা খুশি করবেন? সেটা কিন্তু মেনে নিবো না।”
“বাহ্ তোমার তো সাহস অনেক। সিনিয়রদের সাথে এমনভাবে কথা? এরপর কি হবে জানো তো?”
তাদের মাঝের একটা আপুর কথায় এবারেও একত্রে হেঁসে উঠলো সবাই। দমে গেলাম না আমি। বরং আরও তেজী গলায় বললাম,
“অতশত জানার দরকার নেই আমার। আপনারা আগে মানুষকে নাম নিয়ে পঁচানো বন্ধ করুন, তারপরই সিনিয়র হবার দাবী করবেন।”
“জিসান, এর কিন্তু একটা ব্যবস্থা করতেই হবে তোদের।”
“সেটাই তো দেখছি। প্রথমে ভাবলাম বোকা মেয়ে, কথা বলেই ছেড়ে দিবো। কিন্তু এখন একে একটা র্যাগিং দিতেই হবে।”
সেই মেয়েটির কথায় জিসান নামের ছেলেটি সায় দিলো। র্যাগিং কথাটা শুনে কিছুটা হলেও দমে গেলাম এবার। এতক্ষণ যেটার ভয়ে চুপ করে ছিলাম ঠিক সেটাই হলো। উফ্ ভাল্লাগেনা। এতক্ষণ তো চুপচাপ দাঁড়িয়েই ছিলাম, কথাগুলো না বললেই কি হতো না। এদেরকে তো কেউ প্রতিবাদও করতে আসবে না, বরং সবাই আরো মজা লুটাবে। রূপা তুই আজকে শেষ।
সেই মেয়েটির পাশে থেকে অন্য মেয়েটি বলে উঠলো,
“দোস্ত অনেক দিন রোমাঞ্চকর কিছু দেখা যায় না, সবকিছু কেমন যেন নিরামিষ। একে দিয়ে সেই সুযোগটা করে দে।”
মেয়েটিকে সায় দিয়ে তাদের মধ্যে একটি ছেলে বললো,
“কেন নয়, তুই বলেছিস আর তা পূরণ হবে না? এটা তো হতেই পারে না। এক্ষুনি ব্যাবস্থা করছি।”
“ক্..কি করতে চাচ্ছেন কি আপনারা?”
আবারও উচ্চস্বরে হেঁসে উঠলো সবাই মিলে। এবার ভয়টা আরও জেঁকে বসেছে যেন। হঠাৎ করে বলে উঠলো,
“ওই যে সাদা শার্ট পড়া যে ছেলেটাকে দেখছো? ওই ছেলেটাকে কিস করতে হবে।”
চমকে উঠলাম আমি। বড়বড় চোখ করে সাথে সাথে পিছন ফিরে দেখলাম সাদা শার্ট পরা ছেলেটাকে। পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে অনেক লম্বা করে একটা ছেলে, যার দরুন চেহারা দেখার উপায় নাই। একপলক দেখেই সামনে তাকালাম। কি বলে এই অসভ্য ছেলেগুলো। আজ পর্যন্ত পরিবারের বাহিরে কোন ছেলে হাত ধরার সাহস পেল না আর সেখানে অচেনা অজানা একটা ছেলেকে নাকি কিস করতে হবে। সম্ভব না, কিছুতেই সম্ভব না। অনেক জোরেই বলে উঠলাম,
“অসম্ভব, কিছুতেই এটা করতে পারবো না আমি।”
“পারবে না? পারতে তো তোমাকে হবেই। তা না হলে এর পরিণতি কি হবে ধারণাও করতে পারবে না।”
জিসান নামের ছেলেটা অনেক আত্মবিশ্বাসের সুরেই বললো কথাটা। আবারও এক সুক্ষ্ম ভয় দানা বাধলো মনে। এবার আস্তে করেই বললাম,
“এমনটা করতে পারেন না আপনারা। আমি কিন্তু বিচার দিবো আপনাদের নামে।”
“ওও… আচ্ছা আগে বলবে তো বিচার দিবে। তা কার কাছে বিচার দিবে শুনি? আমাদের কেউ কিছু বলবে বলে তোমার মনে হয়? সোনা-রুপা এবার যাও, যেটা করতে…..”
“জিসান অন্য কোন ছেলেকে কিস করতে বল। একে বাদ দে।”
হঠাৎ সেই মেয়েটি জিসান নামের ছেলেটিকে আস্তে করে বলে উঠলো। জিসান নামের ছেলেটি তাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“তোর আবার কি হলো সুমি? এখন আর কোন ছেলে চেন্স হবে না আর না এই মেয়েটা।”
“আরে আগে দেখ তো সামনের দিকে।”
সুমি নামের মেয়েটার কথায় সবাই তাকালো সামনের দিকে। সামনের দিকে দেখতেই সবার চেহারা কিছুটা পরিবর্তন হলো। আমিও আর মনের কৌতুহল দমাতে পারলাম না। ছেলেটাকে দেখার জন্য পিছন ফিরে তাকালাম। তাকাতেই চমকে উঠলাম কিছুটা। মনে মনে বলে বলে উঠলাম তাসফি ভাইয়া।
.
.
(চলবে…..)
নেক্সট, নাইস কমেন্ট না করে, আপনাদের সুন্দর সুন্দর মন্তব্য করে লেখিকার মনটা অনেক ভালো করে দিবেন।😌 যেন লেখিকাও আগামীকাল আপনাদের মন ভালো করে দিতে পারে।😇 সবাইকে অনেক ভালোবাসা রইল।🖤 ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।🙂