#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ০৮
.
শুন্য অনুভূতি নিয়ে খাটের এক কোনায় চুপচাপ বসে আছি। এই মুহুর্তে সমস্ত কিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে আমার। হঠাৎ কি থেকে কি হয়ে গেল বুঝেও কিছুই বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে কোন স্বপ্ন দেখছি, আর না হয়তো ঘোরের মাঝে ডুবে আছি। কিন্তু না, এসব কিছুই সত্যি আর কিছুক্ষণের মধ্যে ঘটে যাওয়া এসব কিছুই বাস্তব। আসলেই কি তাই? এই অবাধ্য মনটাকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না। কি হচ্ছে এগুলো আমার সাথে, কেনই বা হচ্ছে?
তাসফি ভাইয়ের ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। কোন তারা তাসফি ভাইয়াকে জড়িয়ে আমাকে এত বাজে বাজে কথা বলে যাচ্ছে? কি করেছি আমারা? তাসফি ভাই কেন আমার রুমে আসতে যাবেন যে সবাই এত বাজে পরিস্থিতিতে নিয়ে গেছে ব্যাপারটা। আমার তো কিছুই মনে পরছে না। আর বিয়ে? বিয়ের কথাটা কেনই বা উঠছে? কি এমন হয়েছে যে আমাকে এই মুহুর্তেই বিয়ে দিতে হবে? তাসফি ভাই কি বলে গেলেন এসব? সবাই এই মুহুর্তে আমাকে রাজী করাতে ব্যাস্ত হয়ে গেছে তাসফি ভাইয়েকে বিয়ে করতে। বিয়ে কি ছেলে খেলা নাকি? যে বললেই হয়ে গেল। আর নিতে পারছি না এসব। মাথা ব্যাথাটা তিরতির করে বেড়ে চলছে বহুগুণে। চারদিকের এত আওয়াজ আর সহ্য হচ্ছে না আমার।
“আহ্….”
দু-হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে মৃদু আত্মদান করে উঠলাম। কিছুতে সহ্য করতে পারছি এখন তাদের কথাগুলো। উনাকে এতদিন ভাই বলে মেনে এসেছি। আর সবচেয়ে বড় কথা জন্মের মতো ভয় পাই উনাকে, কিভাবে রাজি হবো এই বিয়েতে আমি? প্রশ্নই আসে না। কোন ভুল তো করি নি আমরা যে বিয়ের মতো এত বড় একটা সিধান্ত এত তাড়াতাড়ি নিতে হবে?
আমার আওয়াজে রুম জুড়ে পিনপিনতায় ছেয়ে গেল। চুপ হয়ে গেছে সবাই। ছোট দাদী, রোজী ফুপু কাকু সহ ওরা সবাই রুম থেকে বেড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। ছোট দাদীর ছেলে আনিস কাকু ওই বদমাইশ রাজিবের সাথে আমার বিয়ের কথা তোলার পরেই যখন তাসফি ভাইয়া আমাকে বিয়ে করার কথা বলে তখনই ওরা সবাই রুম ত্যাগ করে। আসিন কাকু ইনিয়ে বিনিয়ে বড় চাচা ও আব্বুর কাছে রাজিবের সাথে বিয়ের কথা তুললেও তাসফি ভাই জোরে একটা হুংকার ছেড়ে চলে যায়। তারপরই ওরাও আর কথাটা তোলার সাহস পাই নি। কিন্তু তাসফি ভাইয়ের কথাটাকে গুরুত্ব দিয়ে সবাই গুঞ্জন শুরু করে। আমি বারণ করা সত্বেও পরিবারের সবাই এসে এক এক করে বোঝাতে শুরু করে আমাকে। থেমে যাওয়া মাথা ব্যাথাও বেড়ে গেল তাদের অত্যাচারে। নিচ দিকে তাকিয়ে থাকলেও বুঝতে পারলাম বড় চাচা এসে বসেছেন আমার কাছে। আলতে করে আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন,
“মাথা ব্যাথা করছে মা?”
চোখ তুলে তাকালাম বড় চাচার দিকে। মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আব্বু। তাদের নিরাশ না করে মাথা নাড়িয়ে হ্যা’ বললাম।
“হঠাৎ এমন কিছু হবে আমারা কেউই বুঝতে পারিনি রে মা। কেউ বিশ্বাস না করলেও তোমার উপর আমার পুরো আস্থা আছে। আমি জানি তোরা এমন কিছু করবি না, যাতে আমাদের সম্মান নষ্ট হয়। তাসফি আর তোর উপর আমার পুরো বিশ্বাস আছে মা।”
বড় চাচার কথা শুনে চোখ দুটো আবারও ছলছল করে উঠলো। আমাকে সত্যিই বিশ্বাস করেছেন উনি। এটাই আমার জন্য বড় কিছু। যে করেই হোক বিয়েটা আমাকে আটকাতেই হবে, বড় চাচাকেও বোঝাতে হবে যাতে তাসফি ভাইয়ের সাথে আমায় বিয়েটা যেন না দেয়।
“বড় বাবা আমি সত্যিই কিছু করিনি। এসব কিছুই মিথ্যা। যতটুকু মনে আছে আমি তো নিচে জ্ঞান হারিয়েছিলাম, হঠাৎ জাগা পেয়ে দেখি আমি রুমে। আর সবাই রুমে দাঁড়িয়ে যা তা বলে যাচ্ছে। তাসফি ভাইয়াই বা কেন আমার রুমে আসবেন? আপনিই বলেন।”
“দেখ মা, আমি বুঝতে পারছি তোর মনের অবস্থাটা। কিন্তু এখন পরিস্থিতিটা এতটাই বিগড়ে গেছে যে কিছুতেই হাতের লাগালে আনতে পারছি না। রোজী আর আনিসকে তো জানিসই তুই। মায়ের সাথে ওরাও এই পরিস্থিতিটা বিগড়ে দিচ্ছে। রাজিবের সাথে বিয়ের কথাটা তুলতেও দু’বার ভাবলো না। গ্রামের এত আত্মীয়-স্বজন বাসায় থাকার জন্য কিছু করতেও পারছি না।”
বড় চাচার কথাগুলো শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে। কতটা অসহায় হলে এমন ভাবে কথাগুলো বলতে পারেন উনি। যে মানুষটার কাছে সবকিছুর সমাধান এক নিমিষেই হয়ে যেত, সেই মানুষটা এভাবে কথাগুলো বলছে? পরিস্থিতিটা ঠিক কতটা বিগড়ে গেছে আন্দাজ করে নিলাম। বড় চাচা আবারও বললেন,
“এই মুহুর্তে কোন কিছু দিয়েই কোন সমাধানে আনতে পারছি না মা। আনিস যখন রাজিবের সাথে তোর বিয়ের কথা বললো তখন নিজেকে ঠিক কতটা অসহায় লাগছিলো তা বলে বোঝাতে পারবো না। কিন্তু তাসফি মনে হয় আমার মনের অবস্থা ধরতে পেরেছিলো, তা না হলে কেনই বা তোকে বিয়ে করার কথাটা বললো তাসফি।”
চুপচাপ বড় চাচার কথাগুলো শুনে যাচ্ছি। তাদের কিছু বলার মতো কোন কথায় খুঁজে পাচ্ছি না। এবার আব্বু বলতে লাগলো,
“জেনে শুনে কিছুতেই রাজিবের মতো একটা লম্পটের হাতে তোকে তুলে দিতে পারি না। তোকে নিয়ে ওদের উদ্দেশ্য ঠিক কি সেই খুব ভালোভাবেই জানি আমারা। আনিসের কথাটা শুনে আমিই বলতে চেয়েছিলাম তোর সাথে তাসফির বিয়ের কথাটা, কিন্তু তাসফি আগেই কথাটা বলে আমাদের হালকা করলো। তোর সম্মান, আমাদের পরিবারের সম্মান বাঁচাতে এটাই এখন শেষ উপায় আম্মু, তুই রাজী হয়ে যা।”
“আমি উনাকে বিয়ে করতে পারবো না আব্বু।”
ছলছল চোখে তাকিয়ে কথাটা বলে উঠলাম। এখন বড় চাচা সহ আব্বুও শুরু করেছেন। কি করবো আমি এখন? যে মানুষটাকে দেখা মাত্রই ভয়ে কেঁপে উঠি তার সাথে সারাজীবন কিভাবে কাটাবো আমি। আমাকে তো সবসময় ধমকের উপরেই রাখেন উনি। আর উনি, উনিও তো আমার ও পরিবারের সম্মান বাঁচাতে বাধ্য হয়েছেন।
“কেন পারবি না? তাসফি সবদিক থেকেই পারফেক্ট একটা ছেলে। আমাদের বাড়ির ছেলে বলে বলছি না, হাজার খুজলেও ওর মতো একজনকে পাওয়া যাবে না। তাহলে সমস্যা কোথায় তোর? ছোট থেকেই তো দেখে আসছিস ওকে।”
“সেই জন্যই তো চাইছি না আব্বু।”
“কোন মামুনি, আমার ছেলেটা কি খুব বেশিই খারাপ? নাকি তুমিও ওকে ভুল বুঝছো?”
পাশে বসে আমার একহাত ধরে বললেন ফুপা। আসহায় চোখে তাকিয়ে রইলাম। কি করে বোঝাবো তাদের ছেলে পারফের্ক্ট হলেও আমি কোন কিছুতেই ওনার জন্য পারফের্ক্ট নই।
“আপনারাই এবার কিছু করেন ভাই। এই তো আমার কথা কখনোই শুনে না। আপনারাই বোঝান ওকে। এত কিছু আমি আর নিতে পারছি না।”
বড় চাচা ও ফুপাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলেই চলে গেল আব্বু। ফুপা আমার দিকে তাকিয়ে আবারও বলতে লাগলেন,
“রাগটা সবসময় নাকের ডগায় থাকলেও মনটা অনেক নরম ওর। তোমাকে অনেক ভালো রাখবে দেখে নিও। তোমার আব্বু ও বড় বাবাইকে আর টেনশন দিও না মামুনি, আমাদের কথা ভেবে রাজি হয়ে যাও।”
মাথা হাত নাড়িয়ে ফুপা ও বড় বাবা চলে গেলেন। হতাশ হয়ে তাকিয়ে আছি তাদের যাওয়ার পানে। ফাঁকা রুমে বসে আছি আর ভেবে চলেছি তাদের বলা কথাগুলো। কি করা উচিত আমার? আজকের এই ঘটনাটা যে কতটা প্রভাব ফেলেছে সবার প্রতি খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছি আমি। আব্বুরা আসার পরেই সবাই রুম ত্যাগ করেছিলো। একটু পর বড়মা আসলেন। পাশে বসে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। সারাদিন বকাঝকা করলেও ভীষণ ভালোবাসে আমাকে। আব্বু আম্মুর কথা না শুনলেও এই মানুষগুলোর কথা কখনোই ফেলতে পারি না। আমার সব চাওয়া এই মানুষগুলো পূরণ করলেও নিরূপায় হয়ে গেছে।
“তোর মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি মা। কিন্তু আমাদের কিছুই করার উপায় নেই। ওই মহিলাটা নিজেদের স্বার্থে এমনভাবে তোকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে যে কি বলবো। রিমি রিফাকে টার্গেট করতে পারে নি বলে তোকেই বেছে নিয়েছে। কিন্তু ওরা তো জানে না তাসফি ওদের সফল হতে দিবে না, তোর কোন ক্ষতি হতে ও দিবে না। তুই ওর সাথে অনেক সুখে থাকবি দেখিস। আজকে না বলছিস কিন্তু এক সময় ঠিকই বলবি তাসফি তোর জীবনে বেস্ট একটা অংশ। এতটুকু ভরসা আমাদের উপর রাখতে পারিস মা।”
.
নিশ্চুপ নিস্তব্ধতায় ঘেরা মধ্যরাতকে সাক্ষী রেখে তিন অক্ষরের শব্দটা তিনবার বলে, একটা কাগজে নিজের নাম লিখে রামিয়াত রূপা থেকে হয়ে গেলাম মিসেস তাশরিফ রওনাফ তাসফি। একদম ঘোরের মাঝেই এতটুকু সময় কেটে গেছে আমার। এতগুলো মানুষকে কিভাবে নিরাশ করতাম আমি? তাদের ভালোবাসা ও সম্মানের কাছে আমার আত্মত্যাগ অতি নগন্য।
স্বার্থসিদ্ধির জন্য জঘন্যতম কাজ করতেও পিছুপা হয় না অনেকে। আজ তার আবারো প্রমাণ পেয়ে গেলাম। কি হয় তাদের এমন কিছু করে? শুধু এলোমেলো হয়ে যায় কারোর সাজানো গোছানো জীবন। আমার জীবনটাও কিছু মুহুর্তেই এলোমেলো হয়ে গেল, জুড়ে গেল অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে তাসফি ভাইয়ের সাথে। কি হবে এর শেষ পরিণতি? এই অন্ধকার নিস্তব্ধ রাতের মতোই কি ছেয়ে যাবে আমার জীবন? নাকি রাত শেষে নতুন সকালের মতো একটুকরো আলোর দেখা পাবো?
হঠাৎ কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল আমার ভাবনাগুলো। রিফাপু দাঁড়িয়ে আছে শুকনো মুখে। হঠাৎ কি থেকে কি হয়ে গেল সেটাই হয়তো ভাবছে আপু। হয়তো অনেক কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। হালকা একটা হাসি দিলাম রিফাপুকে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আমাকে দেখতে লাগলো শুধু, আর ধরে রাখতে পারলাম না নিজেকে। এই মুহুর্তে এই মানুষটাকে খুব বেশিই প্রয়োজন ছিলো আমার । রিফাপুকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলাম।
.
.
(চলবে…..)
আজকের পর্ব হয়তো অনেক এলোমেলো হয়েছে। ভুলত্রূটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
[পাঠক বার্তাঃ অনেকে পাঠকের কাছে ‘মেঘে রোদে কানামাছি’ গল্পটা খুব ভালো লেগেছে। অসুস্থতার কারণে ২৮ পর্বের পর অফ করে দিয়েছিলাম। অনেকে গল্পটার জন্য কন্টিনিউ করার জন্য বলছেন। তাই নতুন ভাবে প্রথম পর্ব থেকে আমার গ্রুপেই শুধু পোস্ট করা হবে গল্পটা। যারা পড়তে চান তারা জয়েন হয়ে যাবেন।]
গ্রুপ লিংক কমেন্টে।