#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ৩০.
.
শুনশান রাতের অন্ধকারে শোঁ শোঁ আওয়াজে ছুটে চলেছে দূরগামী বাস টা। মাঝে মাঝে অপর গাড়ীর সাথে পাল্লা দিতে প্রচন্ড আওয়াজ তুলে যাচ্ছে। রাতের প্রায় তিনটা বাজে। এখনও দুই ঘন্টার মতো সময় লাগবে আমাদের নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে। বরাবরের মতোই এবারও লং জার্নিতে আমার হাল বেহালে পরিণত হয়েছে। জানালা দিয়ে আসা বাতাসের ঝাঁপটায় ছাড়া ছাড়া চুলগুলো মুখের উপর আছড়ে পরছে থেকে থেকে। কিছু চুল গুলো হয়তো তাসফির চোখে মুখে গিয়েও বারি লাগছে। হিজাব আঁটকে আসলেও বাস ছাড়ার এক ঘন্টা পর তাসফি-ই হিজাবটা খুলে দিয়েছেন। একটু শরীর খারাপ এবং রাত হওয়ায় আমিও আর বারণ করি নি। নির্বিকার ভাবে ওনার পেট জড়িয়ে বুকে মুখ লুকিয়ে আছি, আর তাসফি আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছেন।
রাতের সাড়ে দশটায় ঢাকা থেকে বাস ছাড়লেও এখন পর্যন্ত মাত্র এক ঘন্টার মতো ঘুমিয়ে ছিলাম। তারপর পুরো রাস্তা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে, ওনার বুকে মুখ গুঁজে থেকেই কেঁটে গেছে। আর উনি, উনি তো পুরো রাস্তায় জেগে কাটিয়ে দিয়েছেন। আমি একটু নড়াচড়া করে মাথা উঠাতে চাইলেই উনি কি হয়েছে বলে উঠলেন। আমি কিছু না বলে আবারও উঠতে নিলাম। ওনার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,
“আর কতক্ষণ লাগবে?”
“এই তো আর দেড় ঘন্টার মতো। শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে? ঘুমানোর চেষ্টা কর একটু।”
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে ‘তেমন খারাপ লাগছে না’ বোঝালাম। উনি আমাকে আবারও ঘুমাতে বলে চুপ হয়ে গেলেন। বুঝতেই পারছি প্রচন্ড রকমের ঘুম লাগছে ওনার, কিন্তু আমার জন্য হয়তো সারারাত জেগেই কাটাতে হচ্ছে। কিছুটা খারাপ লাগলো ওনার কথা ভেবে। তাই নিজের খারাপ লাগাটাকে পাত্তা না দিয়ে ওনার সাথে, এক কথা দুই কথা বলতে বলতে গল্প করা শুরু করলাম। উনিও বুঝতে পেরে তাল মিলিয়ে গেলেন আমার সাথে। কিছুক্ষণ গল্প করার পর হঠাৎ কিছু একটা ভেবে বললাম,
“একটা কথা বলি?”
“জিজ্ঞেস করার কি আছে, বল।”
“আচ্ছা, আমাদের বিয়ে কবে হবে?”
আমার আহ্লাদী স্বরে কথাটা শুনতেই কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকলেন, তারপর কেমন করে যেন খুকখুক করে কেশে উঠলেন। আমি ব্যস্ত ভঙ্গিতে কি হয়েছে বলে পানির কথা বলতেই উনি নিজেকে শান্ত করে মাথা ঝাঁকিয়ে না বললেন। আমি আবারও ওনাকে ‘কি হয়েছে আপনার?’ বলতেই উনি আমার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলেন,
“বিয়ে করা বউ যদি হঠাৎ করে বলে উঠে ‘আমাদের বিয়ে কবে হবে?’ তাও যদি অন্ধকার রাতের এই চলন্ত বাসের মধ্যে, তাহলে কি হওয়া উচিত? বাসের কেউ শুনলে কি ভাববে? আমাকে পাবলিকের মার খাওয়ানোর পয়তারা করছিস? বেয়াদব!”
“আশ্চর্য তো, আমি তো বলতে চাইলাম, আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হবে কি না? আর আপনি উল্টো পাল্টা সব বলে যাচ্ছেন? আমার কি ইচ্ছে হয় না বউ সাজার? শুধু আমি কেন, প্রতিটি মেয়ের-ই তো বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে। আর আমাদের বিয়েটা কি-ভাবে হয়েছে ভুলে গেলেন? ছোট থেকে কত্তো কি ভেবে রেখেছিলাম আমার বিয়েতে এটা করবো, ওটা করবো। আর বিয়েটা হলো তো হলো কিভাবে, ওটা কি বিয়ে ছিলো নাকি? হু!”
কাটকাট গলায় কথাগুলো বলে জোরে একটা নিশ্বাস নিলাম। তাসফির দিকে তাকিয়ে দেখি মুচকি হেঁসে তাকিয়ে আছেন। আমি চোখ ফিরিয়ে জানালার দিকে তাকাতে নিলেই উনি মুখটা ধরে ওনার দিকে ঘুরিয়ে নিলেন। বললেন,
“আমার একবার বিয়ে করা বউটা যে আমাকে আবারও বিয়ে করার জন্য এত উতলা হবে, তা জানা ছিলো না। তুমি বললে একবার কেন, শত-শত বার শুধু তোমাকেই বিয়ে করতে রাজি আছি।”
কিঞ্চিৎ লজ্জা পেলাম এবার। পাগলের মতো এভাবে বিয়ের কথাটা কেন বললাম নিজেই বুঝতে পারছি না। এখন উনি সুযোগ পেয়ে আমাকে খোঁচা দিতে শুরু করবেন। ওনার দিকে তাকাতেই উনি চোখ টিপ দিয়ে আবারও বললেন,
“সেই সাথে শত-শত বার বাসর টাও করা যাবে।”
আমার দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়া লজ্জার হাত থেকে বাঁচার জন্য ওনার বুকে আবারও মুখ গুঁজে চুপ করে থাকলাম। কতটা অসভ্য ছেলে হলে এসব কথা সারাক্ষণ বলতে পাবে।
.
ঢুলুঢুলু ঘুম ঘুম চোখে তাসফি হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি দরজার সামনে। ঘুমের কারণে মনে হচ্ছে এখানেই শুয়ে পরি। বাসে পুরো রাস্তায় ঘুম না লাগলোও বাস ছেড়ে নামার পর রিকশায় ওঠার পর যখন রিকশা চলতে লাগলো, মাত্র ভোর হওয়ার মৃদু বাতাসে জেঁকে ধরতে শুরু করলো সারারাতের না হওয়া ঘুমটা।
দরজা খোলার শব্দে মিটমিট চোখে তাকাতেই দরজার সামনে ফুপিকে দেখতে পেলাম। আমাকে দেখে একটু অবাক হয়ে গেছে। হয়তো ভাবছে আমি এখনে কেন? আমার তো বাসায় যাবার কথা ছিলো। আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে তাসফি কে ছেড়ে ফুপিকে জড়িয়ে ঘুম ঘুম কণ্ঠে বললাম, ‘কেমন আছো?’ ফুপিও জড়িয়ে নিয়ে আমাকে এটা ওটা জিজ্ঞেস করতে লাগলো। তারপর তাসফির দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলে উঠলো,
“ওকে বাসায় না নিয়ে গিয়ে এখানে আনছিস কেন? জানিস না লং জার্নিতে ওর কতটা সমস্যা হয়। ওই বাসা কাছে রেখে এতদূর নিয়ে আসার কি মানে? এতক্ষণে একটু বিশ্রাম নিতে পারতো না মেয়েটা?”
“তোমার ভাতিজি শ্বশুর বাড়ি আসার জন্য পাগল হয়ে গেছিলো, তাতে আমার কি দোষ? ফুপি ভাস্তি দু’টোই এক তোমরা, সবসময় আমাকে জ্বালিয়ে মারো।”
বলেই খ্যাকখ্যাক করে উঠলেন উনি। ওনার চিল্লানি শুনে আমার গাড়ো ঘুমটা হালকা হয়ে গেল কিছুটা। তবুও দুজনকে শান্ত করার জন্য বললাম, ‘ঘুম লাগছে আমার’। এতেই যেন কাজ হলো অনেকটা। ফুপি ওনার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আমার হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগলো নিজের রুমে। ফুপা হয়তো ফজরের নামাজের জন্য মসজিদে গেছেন। আমাকে নিয়ে যাওয়া দেখে তাসফি এসে হুট করে আমার আরেক হাতটা টেনে ধরলেন। ফুপির হাত থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নিতেই ফুপি কিছু বলতে চাইলেন, কিন্তু তার আগেই উনি বলে উঠলেন,
“আমার বউ আমার রুমে যাবে, তুমি কেন টেনে নিয়ে যাচ্ছো? এতদিনে বাসায় আসার পর আমার খোঁজ-খবর তো নিলেই না, আবার আমার বউকে নিয়ে গিয়ে আমাকে বউ ছাড়া করবার পয়তারা করছো? সেটা তো হতে দেওয়া যাবে না।”
“তাসফি…. তুই কিন্তু বিরক্ত করছিস, ওকে আমার সাথে যেত্….”
উনি কিছু না শুনে আমাকে টেনে নিয়ে আসলেন ওনার রুমে। আমি আহাম্মকের মতো শুধু দেখে গেলাম মা ছেলের কান্ডগুলো। কতটা অসভ্য হলে ফুপির সামনে এভাবে কথাগুলো বলতে পারেন? মুখে কিছু বলতে না পারলেও মনে মনে খুব বাজে ভাবে একটা গালি দিলাম। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ধমকে উঠে বললেন,
“হা করে তাকিয়ে আছিস কেন? যা ফ্রেশ হয়ে আয়। এতক্ষণ তো ঘুমের কারণে উল্টে পরে গেলি, এখন কি হলো?”
ওনার কথার পাল্টা জবাব দেবার ইচ্ছে বা শক্তি কোনটাই নেই আমার মাঝে। কোন রকম ভাবে ফ্রেশ হয়ে এসে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। ঘুমটা আবারও গাড়ো হয়ে আসতেই হঠাৎ অনুভব করলাম ভারী কিছুর অস্তিত্ব। আর এই ভারী কিছু টা যে কি হতে পারে, সেটা বুঝতে সময় লাগলো না। হালকা হেঁসে এক হাত দিয়ে ওনাকে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা চালিয়ে গেলাম।
.
প্রায় মিনিট পাঁচেকর মতো আম্মুকে জড়িয়ে ধরে আছি। আর সে নাকের, পানি চোখের পানি এক করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। আমার যেন এই ব্যাপারটা হজম করতেই কষ্ট হচ্ছে, যে আম্মু আমাকে দেখার পর এতটা উতলা হয়ে পরেছে। সবসময় আম্মুর বকা খেতে খেতেই বাসায় সময়টা কেটে যেত আমার। কিন্তু আজকে যে ভিন্ন কিছু দেখবো সেটা ভাবতেই পারি নি। আসলেই, দূরে থাকলে সবার ভালোবাসার গুরুত্বটা শতগুণে বেড়ে যায়।
সকালে ঘুমানোর পর দশটার দিকে ঘুমটা ভেঙে গেছিলো। বাসার সবার সাথে কথা বলে, ফুপা ফুপির সাথে সারাদিন সময় কাটিয়ে বিকেলে তাসফির সাথে এ বাসায় আসি। ফুপিকে আসতে জানায় কালকে আসবে।
আম্মুর কান্না তে বিরক্ত হয়ে বলে উঠলাম,
“ওও… আম্মু, এখন তো থামো। যেভাবে কান্না করছো, মনে হচ্ছে মরে গেছি আমি, এভাবে কান্না করার কি আছে?”
“চুপ… এসব কি কথা বার্তা, হ্যাঁ? আগে মা হ, তারপর বুঝবি মা হবার কি জ্বালা।”
“তুমি এখন এসব কান্নাকাটি বন্ধ করো। আর আমাকে নিয়ে পরে আছো, তোমাদের আদরের ছেলের কথা ভুলে গেলে নাকি?”
বলেই ওনার দিকে তাকালাম। অবাক হলাম কিছুটা, কেমন জানি চোখ মুখ লাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।ওনার এভাবে তাকানোর মানেটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমার কথা শুনে বড়মাও সায় দিলেন তাতে। সাথে সাথে ব্যস্ত হয়ে পরলো দুজনে তাসফিকে নিয়ে। আর এদিকে আমি ব্যস্ত হয়ে গেলাম রিফাপুর সাথে।
সকালের সাথে আড্ডা দিয়ে তাসফি নিজের বরাদ্দকৃত রুমে আসতেই আমিও উঠে আসলাম সবার মাঝে থেকে। কেন জানি মনে হচ্ছে অনেকটা রেগে আছেন আমার প্রতি, সেটা ওনার চোখ মুখ দেখে কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছি। রুমে এসে ‘কি হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করলোও কোন উত্তর দিলেন না উনি। আমি আরও কয়েকবার ওনার সামনে দাঁড়িয়ে একই ভাবে বলে উঠলাম। উনি হঠাৎ রেগে গিয়ে ধমকে উঠে বললেন,
“কি হবে আমার? তোকে কি বলেছি, কিছু হয়েছে আমার? তাহলে বারবার জিজ্ঞেস করছিস কেন?”
“কি হয়েছে আপনার? হঠাৎ এমন ভাবে করছেন কেন? কোন কিছু নিয়ে রেগে আছেন কি আমার উপর?”
“বললাম তো কিছু হয় নি। আর তোর প্রতি রেগে থাকারও কোন কারণ নেই। এতদিন পর বাসায় আসছিস পরিবারের সাথে আড্ডা দে, মজা কর, আমাকে নিয়ে এত ভাবতে হবে না তোর।”
আমাক কিছু বলতে না দিয়েই ওয়াশরুমে ঢুকে গেলেন উনি। আমি হা হয়ে গিলতে লাগলাম ওনার বলা কথাগুলো। হঠাৎ কি হলো সেটাই ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর সবাই ওনাকে থাকার কথা বললেও উনি সবাইকে খুব সুক্ষ ভাবে বারণ করে দিলেন। আমি কিছু বলতে চাইলে, আমার কথাগুলো কানেই তুললেন না। দশটার পর বেরিয়ে গেলেন বাসার উদ্দেশ্যে। তাসফি চলে যাবার পর থেকেঔ আমার মনটা কেমন যেন খচখচ করতে লাগলো। রিফাপুর রুমে গিয়ে আপুর সাথে দু’একটা কথা বললেও সেখানে মন টিকলো না আমার। রুমে এসে পুরো রুম জুড়ে পায়চারি করে ফোন দিলাম ওনাকে। অপর পাশে রিং হলেও রিসিভ করলেন না। আরও দু’বার কল দেবার পর উনি রিসিভ করতেই আমি ‘হ্যালো’ বলে উঠলাম। উনি ভারী গলায় ‘আমার ঘুম লাগছে খুব, পরে কথা বলি’ বলেই কল কেটে দিলে।
ওনাকে আর না ঘাটিয়ে বিষন্ন মন নিয়ে শুয়ে পরলাম বিছানায়। কাল সারারাত জেগে ছিলেন ঘুম লাগাটাই স্বাভাবিক। মনটাকে বুঝ দিলেও কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করলো আমার। খুব করে মিস করতে লাগলাম আমার ফেলে আসা সংসারটাকে। আমাদের ঘর, ঘরের প্রতিটি জিনিস গুলোকে। সেই সাথে, আমার বজ্জাত তাসফি কে।
.
.
(চলবে….)
ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন, আর ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন।🖤