তুমি আমার -পর্ব ২৪

0
487

#তুমি_আমার
#পর্ব_২৪
#লেখনীতে_নাজিফা_সিরাত

এতসব কাহিনীর মাঝে হঠাৎ আরুর ফোনে একটা কল আসে।আননোন নাম্বার সে ফোনের দিকে তাকিয়েও কল রিসিভ করে না।রুমের মধ্যে পায়চারী করতে ব্যস্ত।সিরাত আবেশকে নিয়ে ভাবনার অন্ত নেই তার।কি থেকে কি হয়ে গেলো।এবার কি আলাদা হয়ে যাবে সিরাত আবেশ।ওর ভাবনার মাঝেই ম্যাসেজ আসে।বিরক্তি নিয়ে ফোনের কাছে যায় ম্যাসেজ চেক করে চোখ বড় বড় করে তাকায় সে।ম্যাসেজটি ছিলো,

‘প্লিজ আরোহী একটা বার তোমাদের বাসার পেছনে আসবে।ভেবে নাও এটাই তোমার কাছে আমার শেষ চাওয়া।আমার কাছে সময় নেই প্লিজ তাড়াতাড়ি।রাদিফ’।এই সময়ে এমন ম্যাসেজ দেখে আরুর মেজাজ চরমে উঠলো।আবার সময় নেই কথাটি ভেবেই ধক করে উঠলো।তাড়াহুড়া করে ছুটলো সে।

রাদিফ আরু দাঁড়িয়ে আছে মুখোমুখি।রাদিফ কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে আরুর উদ্দেশ্যে বললো,

‘সরি আরোহী তোমাকে বিরক্ত করার জন্য।আসলে এ ছাড়া আমার কাছে আর কোনো উপায় ছিলো না।তবে বিলিভ মি আর কখনও ডিস্টার্ব করবো না’।আরু রাদিফের দিকে ভালোভাবে তাকালো।ছেলেটার আগের সৌন্দর্য বিলীন হয়ে গেছে মনে হয়।পূর্বের ন্যায় ড্যাশিং লাগছে না।হালকা শুকিয়েছে হয়তো।মনে হয় ডায়েট করে ডাক্তার মানুষ।চোখ সরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

‘কি বলবেন তাড়াতাড়ি বলুন।আমার তাড়া আছে’।রাদিফ ফিচেল হাসলো।মেয়েটার তার সামনে আসলেই সবসময় তাড়া থাকে।হয়তো এসবের জন্য নিজেই দায়ী।তাই সময় নষ্ট না করে একটি গিফট বক্স এগিয়ে বললো,

‘এটা দিতেই ছুটে আসা আমার।আর কখনও তোমার সাথে দেখা হবে না। কারণ আমি হতে দেবো না।ইতিমধ্যে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তোমায় পারলে ক্ষমা করে দিও।আর তোমার কাছে আমার অনুরোধ প্লিজ এটা গ্রহণ করো।তোমার যখন যেদিন ইচ্ছে হয় সেদিন খুলে দেখো।তাড়াহুড়োর কিছু নেই’।

‘আপনার দেওয়া জিনিস আমি নিব কেন’?কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে একরোখা জবাব দিলো আরু।রাদিফ অনুনয়ের সুরে বললো,’প্লিজ আরোহী দেখে যদি ইচ্ছে হয় তাহলে ফেলে দিও সেটা একান্ত তোমার ইচ্ছা’।

আরু কথা বাড়ালো না।হাতে তুলে নিলো সেটি।রাদিফ এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে আরুর দিকে।আজই শেষ দেখা ওকে।আর কখনও সামনে থেকে দেখার সৌভাগ্য হবে কিনা আদৌও জানে না সে।মায়াবিনীর বিরহে আজকেই দেশ ছাড়বে।এখনও কাউকে জানায় নি।যাওয়ার ঘন্টাখানেক আগে জানাবে।নইলে কেউ কিছুতেই ওকে যেতে দেবে না।কিন্তু এখানেও থাকতে পারবে না সে।চোখের সামনে ভালোবাসার মানুষ অন্য কারোর সাথে কিছুতেই সহ্য হবে না।এর চেয়ে দূরে যাওয়া টাই উওম।জীবনটা হয়তো আট দশটা মানুষের মত সহজ সরল ভাবে চলতে পারতো কিন্তু উপরওয়ালা বুঝি এটা চান না।সকল না পাওয়া গুলো হয়তো তার নামেই বরাদ্দ। মায়াবিনীকে নিয়ে জীবন পার করা হলো না তার।তবে আফসোস নেই কারণ সে ভালো থাকুক তার ভালোবাসাকে নিয়ে।নিজে না হয় না পাওয়াটাকে সুখ ভেবে নিয়ে গেলো।আজ আবারও খুব অবাধ্য হতে ইচ্ছে করছে রাদিফের।শেষ বারের মত ছুতে মন চাইছে।তাই করুন সুরে বললো,

‘আরোহী একটা বার হাগ করবে আমায়।প্লিজ’।রাদিফের কাজকর্ম কেমন সন্দেহজনক লাগছে আরুর কাছে।লোকটা অস্বাভাবিক আচরণ করছে।চোখ দুটো ছলছল করছে।এমন করুণ কণ্ঠস্বর শুনে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো।রাদিফ অপেক্ষা না করে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওকে।আরু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।যতই হোক ভালোবাসার মানুষের স্পর্শ খারাপ লাগছে না ওর।আরুও হাত রাখলো ওর পিঠে।কিছুক্ষণ পর নিজে থেকেই ছেড়ে দিলো।সরি বলে কপালে একটা চুমো একে এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে প্রস্থান করলো।আরু স্তব্ধ লোকটার হলোটা কি..?যাওয়ার সময় স্পষ্ট চোখে জল দেখেছে সে।যেগুলো লুকানোর জন্যই তাড়াহুড়ো করে পালালো।

থমথমে পরিবেশ নিস্তব্ধতা বিরাজমান পুরো বাড়িময়।ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছে সবাই।আজ মিঃ খানের মনে হচ্ছে নিজ ছেলেকে গলা টিপে মেরে ফেলতে।এরকম ছেলে থাকার চেয়ে না থাকাই উওম।আগেরবার বিশ্বাস করেও করেন নি কিন্তু এবার অবিশ্বাসের কোনো জায়গাই নেই।অশনি শর্ট টপস আর জিন্স পরে মায়ের বুকে মাথা রেখে ন্যাকা কান্নায় বুক ভাসাচ্ছে।আবেশের দৃষ্টি সিরাতের উপর আর সিরাতের দৃষ্টি মাটিতে নিবদ্ধ।পাথরের মতো শক্ত হয়ে আছে সে।আরু ওর কাছে বসে আছে।আজ তারও কিছু বলার নেই।বারবার ভাইয়ের এই রূপ অবিশ্বাস করতেও পারছে না।সিরাতের সাথে না হয় মিসআন্ডাসটেন্ডিং কিন্তু এবার।এবার কি হলো।বারবার তো চোখের দেখা ভুল হতে পারে না।আবিদ আর তিন্নি এক সাইডে দাঁড়িয়ে আছে।আবিদের মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে ভাইয়ের ব্যবহারে কতটা কষ্ট পেয়েছে সে।আরুর মা নীরবে চোখের জল ফেলছেন।বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে এমন লম্পট ছেলে জন্ম দিয়েছেন তিনি।অশনির মা নীরবতা ভেঙ্গে বললেন,

‘ভাইজান এবার কি হবে।আমার মেয়েটা কোথায় যাবে।সমাজে মুখ দেখাবে কি করে।কে বিয়ে করবে ওকে।আবেশ না তোমার গর্ব ছিলো সেই ছেলে আজ তোমার মাথা মাটির সাথে মিশিয়ে দিলো।আগেরবার একটা মেয়ের সাথে অসভ্যতামি করার কারণে বিয়ে পর্যন্ত দিলে।বউ ঘরে তুলতে না তুলতে আরেক মেয়েকে নিয়ে বিছানায় ছি ছি।আমার বলতেও মুখে আটকাচ্ছে।এই ছেলের জন্ম দিয়েছো।আজকাল আবেশ নামক পশুটাকে তোমার ছেলে ভাবতেও ঘেন্না হয়’।

আবেশের বাবা নীরবে চোখের পানি ফেলছেন।আজ এত বড় অপমান শুধুমাএ ওই ছেলেটার জন্য হলো।আবেশ চোখ বন্ধ করে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলেছে।আবিদ নিচু সুরে বললো,

‘পি মনি তুমি এইভাবে বাবাকে অপমান করতে পারো না।মুখ সামলে কথা বলো।মানলাম আমার ভাই দোষী কিন্তু তোমার মেয়ে তো কচি খুকি নয়।সে কেন একজন বিবাহিত ছেলের সাথে বেড শেয়ার করলো।নোংরা যদি হয়ে থাকে সেটা তোমার মেয়ে।জেনেশুনে একটা মেয়ের ঘরে আগুন দিয়েছে’।অশনির মা থমকের সুরে বললেন,

‘এসব বলে ভাইয়ের কুকর্ম লুকাতে পারবি না।তোর ভাইয়ের বিয়ের আগে থেকে আমার মেয়ের প্রতি কুনজর ছিলো।ও ফুসলিয়ে ফাঁসলিয়ে আমার মেয়ের জীবন ধ্বংস করে দিলো।মেয়েটা ছোট তাই এতসব বুঝে নি কিন্তু তোর ভাই তো অবুঝ নয়’।প্যাঁচ প্যাঁচ করে কাঁদছে অশনি।ওর কান্নার শব্দ আবেশের কানে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করছে।নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে।তবুও চুপচাপ।ও দেখতে চায় জল কতদূর এগোয়।আবেশের বাবা বললেন,

‘দেখ বোন অশনি আমার ভাগ্নি হলেও আমার মেয়ের মত।আমার ঘরে গতকালই আমি লক্ষ্মী তুলেছি।তাই এই ভাবনা বাদ দে।আমার ঘরের লক্ষ্মী আমি তাড়াতে পারব না।এখন তুই কয়েকদিনের মধ্যে পাএ জোগাড় কর আমি নিজে দায়িত্ব নিয়ে ওর বিয়ে দেবো’।

‘কেন ভাইজান তোমার কি আমাদের ভিখারি মনে হয়।আমার মেয়ের বিয়ে দিতে অক্ষম আমি।এসব আমি মানিনা’।পাশ থেকে অশনি বললো,

‘তাড়াতে হবে না মামু।আমরা দুজন না হয় মিলেমিশে থাকবো।তবুও আবেশকে ছাড়বো না আমি।যে আমার এতবড় সর্বনাশ করেছে তার সাথেই ঘর করবো’।

মিঃ খান সহ সকলের মাথায় যেন বাজ পরলো।কি বলে এই মেয়ে।আবেশ মেঝের দিকে তাকিয়ে দিব্যি হাসছে।সিরাত এখনও চুপ সকলের কথোপকথন মনযোগ সহকারে শুনে যাচ্ছে। এমুহূর্তে সে একজন শ্রোতা মাএ।আরু উওেজিত কন্ঠে বললো,

‘না না এটা হতে পারে না।অশনি তুমি কি পাগল হয়ে গেছো’।মিঃ খান দীর্ঘশ্বাস ফেলে অশনিকে আবারও সুধালেন,

‘যা বলছো ভেবে বলছো তো’?সাথে সাথে জবাব এলো,’অবশ্যই মামু’।মিঃ খান আর আবেশ করুন চোখে তাকালো সিরাতের দিকে।আবেশ নিজ আসন ছেড়ে সিরাতের সামনে হাঁটু গেরে বসে হাতে হাত রাখলো।সকলের উদ্দেশ্যে বললো,

‘সিরাত আমি জানি তোমার সাথে আমার বিয়েটা কীভাবে হয়েছিল কিছুই ভুলিনি।তুমিও ভুলনি নিশ্চয়।আজকে সবাই আমাকে অবিশ্বাস করছে আমার পুরো ফ্যামিলি কেউ বিশ্বাস রাখতে পারেনি।এসবে আমি তোয়াক্কা করি না।তুমি বলো তুমি কি চাও।আমাকে বিশ্বাস করো নাকি তুমিও সবার মতো আমাকে দুশ্চরিএ ভাবছো।বলো সতীন নিয়ে সংসার করতে চাও’?আবেশের ছলছল চোখ দুটি সিরাতকে অনেক কিছু বুঝাতে চাইছে।কিন্তু সিরাত বুঝবে কিনা সেটা আবেশের অজানা।তখন অশনি বললো,

‘সমস্যা হবে কেন।কই সতীন নিয়ে সংসার করতে আমার তো কেনো আপওি নেই’।এতক্ষণে মুখ খুললো সিরাত।আবেশের হাত ধরে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

‘কিন্তু আমার আপওি আছে’।এটাই যেন স্বাভাবিক ছিলো সকলের মুখ দেখে বোধগম্য হলো সিরাতের।অশনি আর অশনির মায়ের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো।সকলের অগোচরে হাসছে দুজনে।অশনি কাঁদো কাঁদো ফেইস নিয়ে সিরাতের সামনে দাঁড়িয়ে হাত ধরে বললো,

‘বিশ্বাস করো সিরাত আমি এমনটা চাই নি।সংসার জুড়তে না জুড়তে ভেঙ্গে যাচ্ছে এসব সত্যি চাই নি।কিন্তু কোথা থেকে যে কি হয়ে গেলো।প্লিজ এখান থেকে গিয়ে ভেঙ্গে পরো না।তুমি।খুব ভালো মেয়ে আবেশের থেকে বেটার কাউকে ডিজার্ব করো’

সকলে অবাক চোখে তাকালো অশনির দিকে।ভিতরে ভিতরে এক কথা বললেও বাইরে কেউ প্রকাশে সাহস জুগাতে পারছিল না অথচ অশনি সেই অসাধ্য কাজটুকুও আদায় করে ফেললো।সত্যি কি সিরাত চলে যাবে।সিরাত মৃদু হেসে ওর হাত থেকে হাত সরিয়ে বললো,

‘তোমাকে কে বললো আমি সংসার ছেড়ে চলে যাবো।আমার সংসার ফেলে আমি কোথায় যাব।অশনি তোমার বুঝতে ভুল হচ্ছে’।

সকলের চোখ খুশিতে চিকচিক করে উঠলো।আবেশ এক চিলতে হাসলো।আরু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো এতক্ষণে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে সে।অশনি অবাক চাহনী নিক্ষেপ করে বললো,

‘তাহলে কি বলছো তুমি।সতীন নিয়ে সংসার করবে না আবার সংসার ফেলেও যাবে না এসবের মানে কি।দেখ আমার সাথে এই নোংরামি করার পর আমি তো আবেশ কে ছেড়ে দেবো না।দরকার হলে ওর নামে কেস ফাইল করবো।তবুও ছাড়বো না’।

‘ছেড়ো না কোলে নিয়ে বসে থাকো।বাই দ্যা ওয়ে বাবা মা ভাইয়া প্রথমেই তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইছি।আমি চাইনি এসব ব্যাপারে আপনাদের সামনে খোলাখুলি আলোচনা করতে।কিন্তু আজ যখন আমার স্বামীর বিরুদ্ধে এতবড় ইলিগেশন এসেছে তখন এসব কথা না বলে পারছি না।।সরি’।

সকলের উৎসুক হয়ে সিরাতের কথা শুনছে।মাথা নাড়িয়ে কথা বলার জন্য সবাই সম্মতি জানালো।সিরাত আবেশের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

‘আমি নিজের থেকে বেশি আপনাকে বিশ্বাস করি।তার কারণ কি জানেন কারণ এর আগে দুইবার আপনার সাথে রাত কাটিয়েছি আমি।প্রথমত আমি হারিয়ে যাওয়ার পর আর দ্বিতীয় বার আমাদের বিয়ের পূর্বের দিন।কিন্তু কখনো আপনি আমায় বাজেভাবে স্পর্শ করেন নি।পবিএ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে স্বামী স্ত্রীর মর্যাদা পেয়েও আপনি আমার সাথে কিছু করেন নি।অথচ যেদিন আমায় এই বাড়িতে আমাকে নিয়ে আসলেন সেদিন আপনি অন্য একটা মেয়ের সাথে….থাক আর বলছি না।এসব আমি বিশ্বাস করি না।আমি জানি আপনি নির্দোষ ইচ্ছে করে কেউ আপনাকে ফাঁসাচ্ছে।যেভাবে আমাকে আপনাকে আগের বার ফাঁসানো হয়েছিলো।অথচ সবাই কতকিছু ভেবেছিলো আমাদের ফেইস দেখে।আমি সিওর এবারও কিছু হয়নি শুধু লোক দেখানো।কেউ উনার রিপুটেশন খারাপ করার জন্য এসব করেছে।আপনার মাথা বাবার মাথা নিচু করার জন্য।’

বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকালো অশনি।এবার কি তবে তীরে এসে তরী ডুবে যাবে।না না এটা হতে দেওয়া যাবে না।এভাবে পরিস্থিতি হাতের বাইরে যেতে পারে না।তার আগেই এর ইতি টানতে হবে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here