#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
#সারপ্রাইজ_পর্ব
.
“বাবাই… বাবাই দেখো আমি কি পলেছি।”
মেয়ের কথায় ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটার দিকে তাকালো তাসফি। প্রচন্ড বিষ্ময়কর চোখে তাকিয়ে রইলে মেয়ের দিকে। ইতিমধ্যে তামায়া এগিয়ে এসেছে বাবার দিকে। তাসফি চট করে মেয়েকে কোলে তুলে নিলো। কিছু বলার আগেই রাহাত তামায়ার গাল টেনে নিয়ে বললো,
“এটা কি আমাদের তামায়া বুড়ি নাকি? তাসফি ভাই, তোমার মেয়ে কিন্তু বড় হয়ে গেছে। শাড়িও পড়তে শিখে গেছে, এবার তো দেখি তামায়া বুড়ির হিরো খুঁজতে হবে।”
খিলখিল করে হেঁসে উঠলো তামায়া। তার আধো বুলিতে বললো,
“ঢিসুম ঢিসুম করলে ওই হিলো?”
“হ্যাঁ তো, ঢিসুম ঢিসুম করে সেই হিরোকেই তামায়া বুড়ির জন্য আনবো।”
এবার একটু হেঁসে লজ্জা পাবার মতো করলো তামায়া। সেটা দেখে হেঁসে উঠলো সবাই। তাসফি মেয়ের গালে আলতো করে চুমু দিলো। বললো,
“আমার আম্মুটা তো দেখি লজ্জাও পেতে জানে। লজ্জা পেয়ে আরও কিউট লাগছে। আমার কিউট আম্মুকে কিউট করে শাড়ি পড়ে দিলো কে? হুম!”
আড়াই বছরের তামায়া মেরুন রঙের ছোট একটা শাড়ি পড়েছে। দু’টো কুঁচি করে আঁচলটা ব্লাউজের সাথে আঁটকে রাখা, পেছনে ছোট করে ঝুলছে। ব্লাউজটা গায়ের সাথে ঢিলা ঢিলা হয়ে আছে। ছোট ছোট চুলগুলো সুন্দর করে দু’টো ক্লিপ দিয়ে আঁটকে রাখা। মুখে কোন প্রসাধনীর সাজ নেই শুধু কপালে ছোট কালো টিপ এবং ঠোঁট মেরুন রঙের লিপস্টিক। তাতেই যেন মারাত্মক সুন্দর লাগছে তামায়াকে।
“মাম্মাম শালি পলে দিছে।”
ছোট করে জবাব দিলো তামায়া। তারপর সবার দিকে একবার তাকিয়ে তাসফির দিকে তাকালো। দু’হাতে গলা আঁকড়ে ধরে বললো,
“বাবাই তুমি লেডি হয় নি ক্যানু? সবাই লেডি হয়েছে তুমি ক্যানু হয় নি? সবাইতো পঁচা বলবে তোমাকে।”
“হবো তো মা, কাজটা একটু শেষ করি। তারপর গিয়ে রেডি হবো।”
“না না…. তুমি একুনি লেডি হবা, সবাই পঁছা বলবে আমাল বাবাই কে। তাতাই-লা নতুন জামা পলেছে, তুমিও একুনি পলবা।”
প্রচন্ড জেদ নিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলো তামায়া। তারপর মন খারাপ করে তাসফির ঘাড়ে মাথা এলিয়ে দিলো। সবাই রেডি হয়ে ঘুরছে আর তার বাবা এভাবে কাজ করছে, সেটা যেন ছোট্ট তামায়া কিছুতেই মনে নিতে পারছে না। তামায়ার মন খারাপ করা দেখে সবাই মুখ টিপে হেঁসে চলেছে, কিন্তু শব্দ করে হাসার সাহসটা কারোই হলো না। তার বাবা মায়ের ব্যাপারে, কোন কথায় যদি কেউ হেঁসে উঠে, তাহলে তামায়া যে পুরো বাসা কান্না করে মাথায় তুলবে, সেটা সবাই জানে। সাহিল বললো,
“তাসফি ভাই তুমি বরং যাও, রেডি হয়ে নাও। বাকিটা আমরা সামলে নিবো।”
তাসফি মেয়ের দিকে একবার তাকালে। এখনো মুখটাকে গোমড়া করে রেখেছে। তাসফি এবার মায়া হলো ভীষণ, ভালোও লাগলো অনেক। মেয়েটা যে বাবা কতটা ভালোবাসে তার ছোট ছোট কাজ এবং কথাতেই বোঝা যায়।
আজকে রিফার বিয়ে। সপ্তাহ খানিক আগেই রূপা ও তামায়াকে নিয়ে চলে এসেছে বগুড়া তে। তারপর থেকেই নিজ দ্বায়িত্বে সবগুলো কাজ একা হাতেই সামলে চলেছে তাসফি। যদিও রাহাত ও সাহিল তিন দিন আগেই এসেছে। তাসফির সাথে হাত লাগিয়ে কাজ করে চলেছে, তবুও সবটাই তাসফিকে সামলাতে হচ্ছে। নিজে থাকতে মামাদের উপর দ্বায়িত্ব গুলো চাপিয়ে দিতে চাই না সে।
সেই সকাল থেকে বিরতিহীন ভাবে কাজ করে চলছে তাসফি। সবদিকটা সামলে নিয়ে সবাইকে রেডি হতে বলে, আধা ঘন্টার মধ্যেই বরযাত্রী চলে আসবে বলে। সবাই রেডি হয়ে আসলেও তাসফি যেতে পারে নি। সেভাবেই কাজগুলো সামলে চলেছে। পরবর্তীতে কেউ যেতেও বলে নি। কিন্তু তামায়ার চোখে ঠিকই পরে গেল তাসফি। মেয়ে দিকে তাকিয়ে ভেবে চলেছে তাসফি, এতক্ষণ কারোর নজরে না এলেও মেয়ের নজর ঠিকই পরলো। বাবাকে খারাপ লাগছে সেটাও বুঝতে পারলো। রাগ, অভিমান, আদেশ, আবদার সবকিছু মিলিয়েই যেন তাকে রেডি হতে বললো। তাহলে কি, এটাই বাবা হবার আরেকটা তৃপ্তি? ব্যস্ত থাকায় ঠিক সময়ে বাসায় না ফিরলেও ছোট এই মেয়েটা তাকে শাসনের সুরে কথা বলে। মেয়ের কথা ও কাজেই বুঝতে পারে ঠিক কতটা ভালোবাসে তামায়া তাকে। আর তাকেই কি না একসময় পৃথিবীতে আসার আগেই…..
আর ভাবতে পারলো না তাসফি। চোখ দুটো হঠাৎ ছলছল করে উঠলো তার। শক্ত করে জড়িয়ে নিলো মেয়েকে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক হলো। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে তামায়াকে ঘাড় থেকে উঠালো। গলে আলতো করে চুমু দিয়ে বললো,
“আমার আম্মাটা যখন বলেছে, তখন তো আর কোন কাজেই হাত দেওয়া যাবে না। সবার আগে আমার আম্মুর কথা রাখতে হবে।”
এবার হাসি ফুটে উঠলো তামায়ার মুখে। সবার দিকে তাকিয়ে মেয়ের দিকে তাকালো তাসফি। বললো,
“এদের থেকেও সুন্দর করে রেডি হতে হবে, তাই না আম্মু?”
“ইয়েস বাবাই। সুন্দল কলে লেডি হতে হবে।”
“তোরা বাকিটা সামলা, আমি রেডি হয়ে আসছি।”
সবাইকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলেই আবারও মেয়ের দিকে তাকালো তাসফি। গালে আলতো একটা চুমু দিয়ে বললো,
“তোমার মাম্মাম কোথায় আম্মু?
” মাম্মাম তো শালি পলে।”
“ঠিক আছে আম্মু, তুমি তাইলে থাকো বাবাই রেডি হয়ে আসছি।”
মাথা ঝাকালো তামায়া। তাসফি মেয়েকে কোলে রেখেই বললো বাইরে না যেতে, আশেপাশেই যেন থাকে, নইলে রিফা আন্টির কাছে যেতে। তামায়া আবারও মাথা ঝাকালো বাবার কথায়। তাসফি ওকে কোল থেকে নামিয়ে দিতেই দৌড়ে রিফার রুমের দিকে চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসালো। আবারও সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো এদিকটা সামলে নিতে। বলেই আর দাঁড়ালো না তাসফি, চলে আসলো রুমের দিকে।
.
.
আস্তে করে দরজা খুলে রুমে পা রাখতেই দাঁড়িয়ে পরলো তাসফি। এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। মেরুন রঙের শাড়ির আঁচলটা ফ্লোরে লুটোপুটি করছে, ঘরেও যে একজন এসে দাঁড়িয়েছে সেদিকে কোন খেয়ালই নেই ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার। সামনের মানবীকে দেখে তাসফির ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলোও হঠাৎ তা মিলিয়ে যায়। রূপার বিক্ষিপ্ত মনে দাঁড়িয়ে থাকার কারণটা সহসায় ধরে ফেলে। কোন শব্দ না করে আস্তে করে রুমের দরজাটা লাগিয়ে দিলো তাসফি। তারপর ধীর পায়ে এগোতে লাগলো সামনে। পেছনে দাঁড়িয়ে হাত দু’টো সামনে এনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রূপাকে। রূপা ঘাবড়ালো না বরং একটু চমকে গেল। তাসফির এমন হুটহাট জড়িয়ে ধরা তার অভ্যাসে পরিণত হলেও আজকে হঠাৎ কেন চমকে উঠলো ঠিক বুঝতে পারলো না। তাসফি কিছু না বলে রূপার কাঁধের একটু নিচ বরাবর চুলের মাঝে যখন মুখ গুঁজে দিলো, চুলের মাঝেই নাক ও ঠোঁট দিয়ে স্লা*ইড করতে লাগলো, তখন কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো রূপা। তাসফি যেন তাকে বলে উঠলো, ‘আমি আছি তো রুপুসোনা। সবসময় এভাবেই আগলে রাখবো, এভাবেই ভালোবাসবো। তোমার এতটুকু সৌন্দর্য নষ্ট হলেও আমি তোমাকে আমার বাঁধন-বিহীন হবার সুযোগ দিবো না।’ কিছু না বলেও যেন অনেক কথাই বলে উঠলো তাসফি। রূপাও তার কথাগুলো সেকেন্ডের মাঝেই বুঝে গেল। তবুও মন খারাপটা পুরোপুরি ভাবে কেটে গেল না। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় তাসফির কার্যকলাপ দেখে যাচ্ছে শুধু। যদিও তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। আয়নার দিকে তাকিয়েই এতক্ষণের চেপে রাখা মন খারাপের কথাটা বলেই ফেললো রুপা।
“আমার চুলগুলো কি আর আগের মতো কখনোই বড় হবে না তাসফি?”
থেমে গেল তাসফি। যে কথাটা বউয়ের মন মাইন্ড থেকে সরানোর চেষ্টা করলো, সেই কথাটাই তার বউ বলে উঠলো। ভেবেই কপাল চাপড়ালো তাসফি। কিছুটা রাগও হলো রূপার প্রতি। মাথা উঠিয়ে এবার গালে ও গলায় নিজের ঠোঁটের স্পর্শ দিতে লাগলো তাসফি। গম্ভীর গলায় বললো,
“চুল গুলো তো পিঠ ছাড়িয়ে গেছিলো, জেদের বসে আবারও কেটে ফেললি চেন্নাই যাবার আগে। বারণ করেছিলাম না আমি, কানে নিয়েছিলি আমার কথা?”
“আমি তো ভেবেছিলাম আবারও ক্যান্স…..”
“মস্তিষ্ক বিহীন মাথায় একটু বেশি বেশি বুঝলে যা হয়। গাধী কোথাকার! গত মাসে যে তেল শ্যাম্পু এনে দিয়েছি সেগুলো নিয়মিত ইউস কর, ছয় মাসেই চুল লম্বা হয়ে যাবে।”
বলেই মাথা তুলে আয়নার দিকে তাকালো তাসফি। তার দিকেই তাকিয়ে আছে রূপা। হয়তো বলতে চাচ্ছে অনেক কথা। তাসফি সেদিকে পাত্তা দিলো না। রূপার কাঁধে নিজের থুতনি রেখে গালে গাল ঘেঁষে দিলো। বললো,
“চলো না বউ, বিয়ে করি। আমার না খুব বিয়ে বিয়ে পাচ্ছে।”
অবাক হয়ে তাসফির দিকে তাকালো রূপা। এক বাচ্চার বাবা হয়ে গেল, অথচ তার নাকি বিয়ে বিয়ে পাচ্ছে?
“এক বাচ্চার বাবা হয়ে গেছেন, মেয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে, আবার বিয়ে করার শখ কেমনে জাগে আপনার মনে? আজব!”
“বউকে আর বউয়ের সাজে দেখের ভাগ্য হলো কই আমার? তোমাকে বউয়ের সাজে দেখার জন্য হলেও আবার বিয়ে করা উচিত। তুমি বললে আজ কিন্তু সুযোগটাও আছে রুপু।”
বলেই আবারও চুমু দিতে লাগলো তাসফি। এবার প্রচন্ড বিরক্ত হলো রূপা। একে তো কষ্টে মেয়েকে রেডি করিয়ে নিজে একটু রেডি হবার সুযোগ পেয়েছে, আর এই ব*জ্জাত লোকটা এসে সব নষ্ট করে দিচ্ছে। তার উপর আবার বিয়ে করার ভুত মাথায় চাপছে। বিরক্তি নিয়ে তাসফি কে সরিয়ে দিতে দিতে বললো,
“উফ্ ছাড়েন তো, এই সময় এমন বিরক্ত করছেন কেন? রেডি হয়ে নিন তো, যান। সব সাজ নষ্ট করে ফেললো।”
ছাড়লো না তাসফি, বরং আগের চেয়েও শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। যেন রূপার কথা তার কানেই ঢুকে নি। বললো,
“আজকের এই সুযোগটা হাত ছাড়া করা ঠিক হবে না রুপুসোনা। সবকিছু রেডি আছে, তুমি বললে আজ, ঠুস করে কবুল পড়ে ঠাস করে বাসর ঘরে ঢুকে যাবো। রিফা আর সাদিক বিয়ে করে একা একা বাসর করবে, এটা তো ঠিক না। আমারও তো ইচ্ছে করে।”
“ছি! কি সব কথা বার্তা? লজ্জা লাগে আপনার, এসব কথা বলতে? অ*সভ্য অভদ্র অশ্লীল একটা ছেলে। এক মেয়ের বাবা হয়েও তার নাকি এখন বিয়ে, বাসর সবকিছু করতে ইচ্ছে করে? যান, রেডি হয়ে নিন।”
শেষ কথাটা বেশ ধমক দিয়েই বললো রূপা। নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো তাসফির থেকে। তাসফি দাঁত কেলিয়ে হেঁসে উঠলো। আবারও রূপার কাছে এসে জড়িয়ে ধরলো সামনে থেকে। নিজের মুখ এগিয়ে নিয়ে বললো,
“সবকিছু আর করতে পারলাম কই? বিয়ের সাড়ে তিন বছর হয়ে গেল, অথচ বাসর টায় এখনো করতে পারলাম না। এই নাকি আমি এত এত স্টুডেন্ট পড়ায়, বউয়ের সাথে যদি প্রেমের ক্লাস-টায় করতে না পারি, তাহলে স্টুডেন্টরা আমার থেকে আর কি-ই বা শিখবে?”
“উফ্! আপনি যে আগে আমাকে বলতেন, আমি নাকি চরম লেভেলের বেয়া*দব, সেই কথাটা যে এখন আপনার ক্ষেত্রে মানায় সেটা কি আপনি জানেন? চরম লেভেলের বেয়া*দব হয়ে যাচ্ছেন আপনি।”
দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলে থামলো রূপা। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে তাসফি কে ধমকে উঠে বলতে লাগলো,
“যান বলছি বজ্জাত লোক, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিন। অ*সভ্য বজ্জাত বদমাইশ একটা লো….”
কথাটা শেষ করতে পারলো না রূপা। তার আগেই তাসফি রূপার ঠোঁটের সাথে নিজের ঠোঁটের স্পর্শ দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। বেশ কিছু সময় পর ছেড়ে দিয়ে গালে হাত রেখে বললো,
“যাচ্ছি তো বউ, এত রাগ করার কি আছে? তুমি বললে আজ কিন্তু বউ সাথে দেখে পেতাম বউটাকে, সাথে বাসরটাও সেরে ফেলতে পারতাম। কি আর করার, সবাই আমার কপাল।”
“আপনি কিন্তু আ….”
রূপাকে কথা বলার সুযোগ দিলো না তাসফি। টুপ করে আবারও রূপার ঠোঁটে চুমু দিলো। আর এক মুহুর্তও দেরি না করে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেল। রূপাও আর নিজের রাগটা ধরে রাখতে পারলো না। হেঁসে ফেললো তাসফির করা কাজে। মনে মনে বলে উঠলো, ‘পাগল একটা’।
আবারও নিজের কাজে মন দিলো রূপা। চুলগুলো আঁচড়ে খোঁপা করে নিলো। যদিও আগের মতো ঘাড়ের কাছে বেশ বড়সড় খোঁপা হলো না। চিকিৎসা চলাকালীন চুলগুলো আর স্থায়ী হয় নি। মাথার অর্ধেকের বেশীই চুলগুলো ঝরে পড়ে গেছিলো। বাকিটা না চাইতেও কাটতে হয়েছিলো। চিকিৎসার পর আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠেছিলো, তখন আবারও চুলগুলো গজাতে শুরু করে। দুই বছরে ঘাড় থেকে পিঠ পর্যন্তও নেমে যায়। কিন্তু কয়েক মাস আগে যখন আবারও মাথা ব্যাথা শুরু হয়, চুল পড়তে শুরু হয়। তখন সমস্ত আসা ছেড়ে দিয়েছিলো রূপা। চেন্নাই যাবার রাগে দুঃখে চুলগুলো ইচ্ছে করেই কেটে ফেলে। কারোর কথাই কানে নেয় নি তখন। এমনকি তাসফি তামায়ার কথাও নয়। এখন সেই কথাগুলো ভাবলে ভীষণ আফসোস হয় তার। ইস্! যদি স্বামী আর সন্তানের কথা শুনে চুলগুলো না কাটতো তাহলে আরও একটু বড় হতো এতে দিনে। জোরে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললো রূপা। আগের কথা গুলো আর ভাবতে চায় না সে। তার সকল ভাবনা তে শুধু তাসফি, তামায়া এবং পরিবারের সবাইকে রাখতে চায়।
খোঁপা করে ঠোঁটের লিপস্টিকটা ঠিক করে নিলো। তাসফির চুমু দেবার ফলে একদম লেপ্টে গেছে। চোখের কাজলটা ঠিকঠাক ভাবে দেখে, তামায়ার মতো কপালে ছোট একটা কালো টিপ দিলো। ব্যাস আর কিছু করতে হবে না তার।
এর মাঝেই তাসফি ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়েছে। আলমারি খুলে কিছু একটা খুঁজে চলেছে। রূপা পাত্তা দিলো না সেদিকে। কিন্তু হঠাৎ তাসফির ডাকে আর ফেলতেও পারলো না।
“রুপু! আমার পাঞ্জাবিটা কই রেখেছিস?”
তাসফির কথায় বিরক্ত হলো রূপা। চোখের সামনে খাটের উপর তার পাঞ্জাবি রাখা, অথচ সে বলছে পাঞ্জাবিটা কোথায়?
“আপনি সত্যিই বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন তাসফি, দিন দিন চোখের মাথাটাও কি খেয়ে ফেলেছেন? চোখের সামনে বিছানার উপর জ্বলজ্বল করছে আপনার পাঞ্জাবি, আর আপনি কি না সেটাও দেখতে পারছেন না?”
“তোর মতো মাথামোটা গাধী বউটাকে দেখতে চোখের মাথা খেয়ে ফেলাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমার মেরুন রঙের পাঞ্জাবিটা কোথায় রাখছিস সেইটা বল, বেয়াদব!”
“কেন? আপনি না বললেন, এটা পড়বেন আজকে। তাহলে আবার ওটা খুঁজছেন কেন?”
“সেটা তোর মস্তিষ্ক বিহীন মোটা মাথায় ঢুকবে না। যেটা বলছি তাড়াতাড়ি কর।”
আর কিছু বললো না রূপা। চোখ মুখ কুঁচকে আলমারি কাছে এগিয়ে আসলো। সামান্য খুঁজতেই পেয়ে গেলো মেরুন রঙের পাঞ্জাবিটা। তাসফির দিকে বাড়িয়ে দিতেই চট করে নিয়ে নিলো। সময় নষ্ট না করে পড়তে লাগলো। রূপা আয়নার সামনে এসে খোঁপাটা ঠিক করতে লাগল। এর মাঝেই তাসফি পাঞ্জাবি পরে রূপার পিছনে এসে দাঁড়ালো। খোঁপায় কিছু একটা পড়াবার চেষ্টা করতে লাগলো। রূপা বুঝতে না পেয়ে আয়নায় তাকালো। বেলি ফুলের গাজরা নিয়ে পড়াবার চেষ্টা করছে তাসফি। হাসলো রূপা, সে জানে তাসফি একটু সময় নিয়ে ঠিকই পড়িয়ে দিবে। কিছুক্ষণ সময় ব্যায় করে পড়িয়েও ফেললো। তারপর তাকালো আয়নার দিকে, জড়িয়ে ধরলো রূপাকে। তাসফির গলার নিচে মাথা ঠেকে আছে তার। তাসফি আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো মাথায়, সামনে তাকিয়েই আস্তে করে বললো,
“এখন পারফেক্ট লাগছে, একদম আমার বউ আমার বউ লাগছে।”
“হুম হয়েছে এবার। এখন তো চলেন, সাদিক ভাইয়ারা তো চলে আসবে এখন। ওদিকে মেয়েটা যে কি করছে।”
তাসফিও আর কিছু বললো না তাকে। রূপার কথায় সায় দিয়ে ছেড়ে দিলো। জেল দিয়ে চুলগুলো ঠিক করে আঁচড়ে নিলো। সেন্টের বোতলটা হাতে নিয়ে একদমে লাগিয়ে নিলো পুরো শরীরে। বিছানা থেকে মোবাইলটা পকেটে পুরে রূপার কাছে এগিয়ে এলো। দু’ গালে এবং কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বললো, ‘বেশি লোকজনের মাঝে যেন না যাওয়া হয়, ছেলেদের ওদিকে তো একদমই নয়, কোন কিছুর প্রয়োজন পড়লে আমাকে ফোন দিবো, ব্যস্ত থাকলেও আসবো। মেয়েটাকে নিজের সাথেই রাখবে, সবসময় রিফার সাথেই থাকার চেষ্টা করবে।’
রূপা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যা বলে দিলো। তাসফি কে রাগ দেখালেও সবসময় তাসফির কথাগুলো বাধ্য মেয়ের মতোই মেনে চলে সে। এই মানুষটার কথাগুলো কখনোই ফেলতে পারে না।
রূপা হঠাৎ করে তাসফির পায়ের পাতায় ভর দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরলো। তাসফি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হালকা হাসলো। রূপা টুপ করে চুমু দিলো তাসফির ঠোঁটে। তাসফির মতো করেই বলে উঠলো, ‘এই হ্যান্ডসাম লুকে মেয়েদের সামনে একদম যাবা না, লুচু মেয়েগুলো তাকিয়ে থাকলেও সেদিকে তাকাবা না। কথা বলতে আসলে সোজা বলে দিবা, আমার বউ বাচ্চা দুটোই আছে। আমার দিকে নজর দিবেন না আন্টি। মনে থাকে যেন।’
হাসলো তাসফি, বাধ্য ছেলের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে সেও সায় দিলো। রূপার এই কথাগুলো তার প্রতিদিন ভার্সিটিতে যাবার আগে শুনতে হয়। এক প্রকার অভ্যাসেই পরিণত হয়ে গেছে যেন। আর দাঁড়ালো না।
রুম থেকে বেরিয়ে আসলো দুজনেই। মেয়েকে এবং তাকে আবারও সাবধানে থাকতে বলে সোজা নিচে চলে গেল তাসফি। রূপাও মেয়েকে খুঁজতে খুঁজতে রিফার রুমে এলো। সেখানেই পেয়ে গেল তামায়াকে। আতিফার সাথে খেলছে সে। তামায়া ও আতিফা কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল মুহূর্তেই। মা মেয়েকে একই রঙের শাড়ি তে দেখে সবাই অবাকের সাথে সাথে প্রশংসাও করলো। তাসফি কেও একই রঙের পাঞ্জাবি তে দেখে টিটকারি করা ছাড়লো না কাজিন দলের সবাই। এক প্রকার হৈ হৈ করেই রিফার বিয়েটা সম্পন্ন হলো। রূপার ছোট দাদী আয়শা বেগমের পরিবার থেকে কেউই আসে নি। দাওয়াত করা হয়েছিলো তাদের, যদিও সেদিনের ঘটনার পর থেকে আর কোন প্রকার সম্পর্ক রাখে নি তাদের সাথে। রূপার বড় চাচা ও বাবা ছাড়া আর কেউই এতদিন গ্রামে যায় নি। তবে শুনেছে আয়শা বেগমের ডান হাতে বেশ বড় একটা টিউমার হয়েছে, খাবারও খেতে পারে না। ওনার ছেলেও টাকার ভয়ে চিকিৎসা করায় না। গাঁজা ও মাদক খাওয়ার ফলে রাজিবকেও পুলিশ কাস্টারি তে রাখা হয়েছে। টাকার লোভে রিয়ার বাবা তাকে এক বয়ষ্ক লোকের সাথে বিয়ে দিয়েছে। বড় চাচা ও বাবার থেকে এতটুকুই জেনেছে রূপা। সে চায় না আগের কথাগুলো ভেবে ভবিষ্যৎ টা নষ্ট করতে। তাসফি তামায়া এবং পরিবারের কথাই ভাবতে চায় শুধু।
.
.
সুখের মুহুর্ত গুলো খুব তারাতাড়িই যেন চলে যায়। শুধু রেখে যায় কিছু সুন্দর মিষ্টি স্মৃতিগুলো কে। আজ নয় দিন হয়ে গেল আমাদের ঢাকায় আসার। রিফাপুর বিয়ের দু’সপ্তাহ পর ঢাকায় চলে আসি আমরা। তারপরই প্রচন্ড ব্যস্ত হয়ে পড়ি দুজনেই। তাসফি সারাদিন ভার্সিটি নিয়ে ব্যস্ত থাকে, আর আমি ভার্সিটি শেষে মেয়েকে দিয়ে। বিকেলের পরেই শুরু হয় বাবা মেয়ের খুনসুটি ভালোবাসা। সাথে আমাকেও যুক্ত হতে হয়।
রিফাপুর বিয়ের রাতে সুযোগ পেয়ে সারপ্রাইজটা দিয়েই দিয়েছিলাম তাসফি কে। নিজেকে যতটা পেরেছিলাম বউ সাথে তৈরি করেছিলাম তাসফির জন্য। তামায়া জেদ ধরেছিলো আতিফার সাথে থাকবে সে, সেই সুযোটাই কাজে লাগিয়ে ছিলাম সেদিন। তাসফি রুমে ঢুকেই থমকে গেছিলো আমাকে দেখে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো কয়েক মিনিট। যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলো না আমাকে বউ সাথে দেখে। ওর চাহনিতে আমি নতুন বউয়ের মতোই লজ্জায় মিশে যাচ্ছিলাম যেন। আর তাসফি সেই সুযোগেই কাছে টেনে নিয়েছিলো আমাকে। নতুন ভাবে ভালোবাসায় মুড়িয়ে রেখেছিলো আমাকে।
সন্ধ্যা থেকে নানান বাহানা ধরে বাবার বুকে ঘুমিয়ে পড়েছে তামায়া। আমার মতোই তারও যেন এই বুকটা শান্তির স্থান। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে তাসফিও গভীরে ঘুম আচ্ছন্ন হয়ে আছে। চুলগুলো এলোমেলো ভাবে কপালে পড়ে আছে। ফ্যানের বাতাসে মৃদু উড়ছে। তাসফি ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে বাজে বাজে চিন্তা গুলো মাথায় উঁকি দেয়, এবারও তার ব্যাতিক্রম হলো না। এই দু’টো মানুষ আমার একটা অস্তিত্ব। এদের ছাড়া আমি কখনোই কোন সময় ভালো থাকতে পারবো না। আমার জীবনটা যেন এই দু’টো মানুষের কাছে এসেই সমাপ্ত। নিজের সবকিছু উজার করে আগলে লাগলে রাখার চেষ্টা করবো তাদের দু’জনকে। তাসফির মতো করে তাসফি কে আমি কখনোই হয়তো ভালোবাসতে পারবো না, কিন্তু আমি আমার মতো করে ওকে আর তামায়াকে ভালোবেসে যাবে। বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিবো তামায়ার মাম্মাম এবং তাসফির রুপুসোনা হয়ে।
.
ডায়েরিটা বন্ধ করলো রূপা। আড়াই বছর পর ডায়েরিটা তে কলমের ছোঁয়া দিলো সে, কলমের কালে রঙে প্রতিটা শব্দ নিজের ভালোবাসা ও আবেগ দিয়ে গত কয়েক বছরের কিছু ব্যাক্ত না করা কথাগুলো তুলে রাখলো ডায়রির প্রতিটা পাতায়। ডায়েরিটা বন্ধ করে ওয়াল র্যাকে রেখে দিলো। বিছানায় এসে উঠে পরলো। বাবা মেয়ে দুজনেই গভীর ঘুমে। সেও শুয়ে পড়লো তাদের পাশে। তাসফির গালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে, তামায়ার গালেও ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। তামায়ার গালে আলতো করে হাত রাখতেই কিছুটা নড়ে উঠলো সে। মায়ের স্পর্শ পেতেই ঘুমের মাঝেই বাবার বুক থেকে নেমে মায়ের বুকে গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে গেল। রূপাও মেয়েকে জড়িয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করলো। হঠাৎ অনুভব করলো তাসফি খাট থেকে নেমে গেল। ওয়াশরুমের লাইট জ্বলে উঠতেই বুঝতে পারলো ওয়াশরুমে গেছে তাসফি। ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে রূপার পাশে এসে শুয়ে পড়লো। তাকে সহ মেয়েকেও জড়িয়ে নিলো। রূপার গলায় মুখ গুঁজে দিতেই রূপা বলে উঠলো,
“কখন জেগে গেছেন?”
ঘুম জড়ানো গলায় তাসফি বলে উঠলো,
“যখন আমার ঘুমের সুযোগ নিয়ে চুমু দিলে, তখন।”
“এইজন্যই আপনাকে ঘুমের মাঝে চুমু খেয়ে শান্তি পাই না আমি। সবসময় জেগে যান।”
“জেগে না গেলে বউয়ের মিষ্টি মিষ্টি চুমু গুলোকে তো আর অনুভব করতে পারতাম না।”
“আপনি এমন কেন?”
হালকা হাসলো তাসফি। রূপার গলার স্লাইড করতে করতে বললো,
“রুপুসোনা!”
“হু….!”
“তুমি বললে আজ আমি জীবনের কথা নয়, জীবনটাকেই বলতে চাই। বাকিটা জীবন ভালোবাসতে নয়, ভালোবাসায় তোমাকে বেঁধে রাখতে চাই। আমি কাব্যের ভাষায় নয়, আমার ভাষায় তোমায় বলতে চাই। ভালোবাসি রুপুসোনা।”
“এতটা ভালোবাসেন কিভাবে আমাকে?”
আগের চেয়েও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাসফি। গলায় বেশ কয়েকটা গভীরভাবে চুমু দিয়ে আস্তে করে বললো,
“এভাবেই ভালোবাসি আমার রুপুকে।”
.
.
সমাপ্ত……
🖤🖤🖤
শেষ পর্বে নিজের কাছেই কিছুটা অগোছালো লেগেছে আমার। তাই সারপ্রাইজ হিসেবে এই পর্বটা দিলাম। তাসফি রূপা কে যারা এতএত ভালোবাসা দিয়েছেন, তাদের সবাইকে তাসফি ও রূপার পক্ষ থেকে এতএত ভালোবাসা। সাথে আমার পক্ষ থেকেও সবাইকে অনেক ভালোবাসা।🖤