#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ৩৩. (অংশ ১)
.
নভেম্বরের শুরুর দিক। সকালের হালকা উষ্ণ তাপমাত্রায় থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। পায়ের নিচে সবুজ ঘাসের উপর জলরাশির মতো বিন্দু বিন্দু জমা হওয়া শিশির কণার স্পর্শে শিরশির করে উঠছে পুরো শরীর, জানান দিচ্ছে শীতের আগমনীর বার্তা। অতি অল্প মাত্রার কুয়াশায় ঢেকে গেছে চারদিকে। একাকী এই মুহুর্তটা খুব করে নিজের মাঝে ডুবে থাকার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত, কিন্তু কিছুতেই সফল হতে পারছি না। পারছি না নিজের নিঃসঙ্গতা দূর করতে। খুব করে পাশে একজনকে কামনা করছি, তার কাঁধে মাথা রেখে সময়গুলো অতিবাহিত করার । তাকে একটুখানি ছুঁয়ে দেবার মনোবাসনা জাগছে বারংবার। কিন্তু এই মুহূর্তে এটা তো আদোও সম্ভব নয়। সে তো এখন আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে, এখনো দেড় দিনের অবসান ঘটিয়ে তবেই সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে সামনে থেকে দেখতে পাবো, একটুখানি ছুঁয়ে দিতে পারবো।
আরও কয়েকদিন পর গ্রামের বাড়ি আসবার কথা থাকলেও গত চার দিন আগে গ্রামের বাড়িতে এসেছি সবাই মিলে। আমর আর রিফাপু এত তাড়াতাড়ি আসতে না চাইলেও বড়মা, ফুপি এবং আম্মুর জোরে আসতে হয়েছে। শুধু আমাদের পরিবার না, পুরো গোষ্ঠীসহ-ই হাজির হচ্ছে গ্রামের বাড়ি। বাকিরা আজকে বিকাল বা সন্ধ্যার মাঝেই এসে হাজির হবে। গোষ্ঠী সহ গ্রামে আসার মূল কারণটা হলো ফুপাতো ভাই সজিব ভাইয়ার হঠাৎ বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হওয়ায়। আব্বুর চাচাতো বোনের ছোট ছেলে সজিব ভাইয়া। পড়াশোনা শেষ করে চাকরির কয়েক পেরিয়ে বত্রিশ বয়স এর কোঠায় এসে বিয়ের পিরিতে বসলো। তার কারণ ফুপা হঠাৎ অকালে মারা যাওয়া। বড় বোনকে পড়াশোনা করিয়ে নিজেদের সংসার গুছিয়ে দিয়েছে, ছোট ভাইয়ের পড়াশোনার শেষ করে তবেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর আমাদের এত তাড়াতাড়ি আসবার কারণ হলো ফুপি। তাহেরা ফুপি বড় দাদুর একমাত্র মেয়ে হওয়ার ভাইয়ের দায়িত্ব বড় চাচা এবং আব্বু মিলেই পালন করেছে। ফুপিও বড় চাচা ও আব্বুকে আলাদা নজরে-ই দেখে এসেছে সবসময়। দ্বায়িত্ব এবং ভালোবাসা থেকে বড় চাচা ও আব্বু আমাদের সবাইকে নিয়ে কয়েকদিন আগেই চলে এসেছে গ্রামে। ফুপি এত তাড়াতাড়ি আসতে না চাইলেও ফুপা একপ্রকার জোর করেই পাঠিয়ে দিয়েছেন আমাদের সাথে। ফুপাও হয়তো চলে আসবেন আজকে। কিন্তু যার অপেক্ষায় প্রহর গুনে চলেছি, সে কি আদোও কালকের মাঝে আসতে পারবেন কি না সন্দেহ।
গ্রামে আসার প্রায় এক সপ্তাহ আগেই তাসফি কে ঢাকায় যেতে হয়েছে। সেদিন রাতটুকু থেকে পরেরদিন রাতেই চলে যেতে হয়েছে ভার্সিটি থেকে ফোন আসায়। ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার জন্য যেতে হয়েছে ওনাকে। এই কয়েকদিন ভার্সিটি টাইম ছাড়া ফোন কল এবং ভিডিও কলে প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা আমাদের কথোপকথন চলছে নতুন প্রেমিক যুগলের মতো।
প্রতিদিনের মতো কালকেও গভীর রাত পর্যন্ত কথা হয়েছে তাসফির সাথে। প্রতিদিন অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকলেও আজকে কোন কারণ ছাড়াই খুব ভোরে ঘুমটা ভেঙে যায়। তাই শীতের আগমনের ভোর হওয়া দেখার ইচ্ছে কে দমিয়ে রাখতে পারলাম না। বাড়ির পাশে নিজেদের পুকুর পাড়ে বসে মগ্ন ছিলাম নিজের মাঝে। কিন্তু কিছু সময় অতিক্রম হবার পর সেই মানুষটার শুন্যতা এভাবে অনুভব করবো সেটা আন্দাজ করেছিলাম। কারণ আমার সমস্ত কিছু শুধু একজন মানুষের কাছে এসেই আঁটকে গেছে বারবার।
সূর্যের তীক্ষ্ণ আলো ছড়িয়ে গেছে চারদিকে। গ্রামের মানুষগুলোও নিজের কাজের তাগিদে ছুটে চলেছে। দাদুদের আমলের বিশাল বাড়ির পাশে ফাঁকা জায়গাটায় বিয়ের আয়োজনে মেতে উঠেছে সবাই। তাহেরা ফুপি একমাত্র মেয়ে হওয়ায় গ্রামেই বিয়ে দিয়েছিলেন দাদু, দুটো বাড়ি পর। সেখানে বিয়ের মতো আয়োজন করার জায়গা না থাকায় এখানেই সকল আয়োজন করা হচ্ছে।
আকাশ-কুসুম ভাবনা থেকে বেড়িয়ে পুকুর পাড় ছেড়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম। বিশাল এই দোতলা বাড়ি একটা হলেও ভেতরে দু ‘ খন্ডে বিভক্ত। তার মূল কারণ হলো আমার ছোট দাদী আয়শা বেগম। যৌথ পরিবারের রেষারেষিতে থাকতে চাইতেন না তিনি, তাই প্রতিনিয়ত ঝামেলার অবসান ঘটিয়ে তিন ছেলে মেয়ে সহ তাকে আলাদা ব্যাবস্থা করে দেয় দাদু।
বাড়িতে ঢুকেই ফুপির মুখোমুখি পরে গেলাম। আমাকে দেখেই ফুপি বলে উঠলো,
“আজকে এত সকালে উঠেছিস যে, শরীর ঠিক আছে তো? কই গিয়েছিলি?”
“একদম ঠিক আছি ফুপি। আজকে সকালেই ঘুমটা ভেঙে গেল, তাই একটু পুকুর পাড়ে গিয়ে বসে ছিলাম।”
“ওও, আচ্ছা এখন চল আমার সাথে, বেলা তো অনেক হলো খেয়ে নে কিছু।”
আমি না না বললেও ফুপি কোন বারণ শুনলো না আমার। হাত ধরে জোর করে টেনে নিয়ে গিয়ে টেবিলে বসিয়ে দিলো। আমাকে বসিয়ে দিতেই রিফাপু হি হি করে হেঁসে উঠলো। বললো,
“এতক্ষণে মনে শান্তি শান্তি পাচ্ছি। আমি তো ভাবলাম শুধু আমাকেই ঘুম থেকে টেনে তুলে নিয়ে আসলো ফুপি। এখন তোকে দেখে ব্যাপক শান্তি পাচ্ছি বনু।”
“আর তোমার দাঁত কেলিয়ে হাসাটা আমাকে ব্যাপক অশান্তি দিচ্ছে। চুপ করো বলছি।”
আমার কথা রিফাপু কিছু বলতেই রিমাকে মুখ গোমড়া করে চেয়ারে এসে বসতে দেখে চুপ হয়ে গেল। এরপর আমার দিকে তাকাতেই হো হো করে হেঁসে উঠলাম দুজনে। তাকেও যে সদ্য ঘুম থেকে টেনে তুলে এখানে আসতে বাধ্য করা হয়েছে, সেটা বুঝতে বাকি রইলো না। একটু পর সাহিল ভাইয়াও এসে যুক্ত হলো আমাদের সাথে। বাকিরা এখনো আসেনি, দুপুরের মাঝেই সবাই চলে আসবে এটা নিশ্চিত। রিমা আমাদের হাসতে দেখে দাঁতে দাঁত চেপে আমার দিকে তাকিয়ে বললে,
“যত হাসার হেঁসে নে, তাসফি ভাই আসলে কিভাবে এত হাসি বেরোয় সেটাও দেখবো।”
“আমি কি ওনাকে ভয় পাই নাকি? হু!”
“আরে গাধা, এই ভয় পবে কেন? ভয়ডর তো সব বেচারা তাসফি ভাইয়ের কাছে ট্রান্সফার নিছে, এমন দজ্জাল বউ ঘরে তুলেছে কিনা।”
রিমার মাথায় টোকা দিয়ে বলে উঠলো সাহিল ভাইয়া। ভাইয়ার কথায় রাগী গলায় বলে উঠলাম,
“কি বললা তুমি, কি বললা? আমি দজ্জাল, ওনাকে ভয়ে রাখি? সবসময় আমার পিছনে লাগা ছাড়া তোমাদের শাস্তি হয় না?”
“আরে, আমি তোকে কি বললাম? আমি তে তাসফি ভাইয়ের বউয়ের কথা বললাম।”
“তাহলে কি কথা গুলো আমাকে বলা হলো না?”
“সম্মান দিয়ে কথা বলো সাহিল ভাইয়া। মেয়ে কিন্তু এখন আর আমাদের বোন নেই , বড় ভাইয়ের বউ ওরফে ভাবী হয়ে গেছে আমাদের। তাই না ভাবী?”
রিফাপুর কথায় রিমা ও সাহিল ভাইয়া হো হো করে হেঁসে উঠললো। আমি এবার রাগী চোখে রিফাপুর দিকে তাকালাম।
“এবার কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে। আমাকে রাগীও না বলছি।”
“কি হয়েছে, রাগাচ্ছিস কেন ওকে?”
আমার কথা শেষ হতেই ফুপি টেবিলে এসে খাবার রাখতে রাখতে বলে উঠলো। সাহিল ভাইয়া বলে উঠলো,
“তোমার ছেলের বউকে রাগাতে হয় নাকি? তার নাকের মাথায় রাগ তো অলওয়েজ লেগেই থাকে।”
“ফুপি… দেখছো? সেই কখন থেকে আমাকে খোঁচা দিয়েই যাচ্ছে এরা, কিছু বলো তুমি।”
আবারও এক দফা হাসির রোল পরে গেল। ফুপি এবার সবাইকে ধমক দিয়ে চুপচাপ খেতে বললো। এর মাঝে বড় চাচা এবং আব্বুও বসে পরলো। বড়মাও খাবার এগিয়ে দিতে লাগলো।
কয়েকবার খাবার মুখে দিতেই হঠাৎ পেট সহ গুলিয়ে আসলো। কিছুর আভাস পেতেই হুড়মুড় করে টেবিল ছেড়ে উঠে বেসিনে গিয়ে গড়গড় করে বমি করে দিলাম। আমার অবস্থা দেখে ইতিমধ্যে বড়মা এসে ধরেছেন আমায়, তারপর ফুপিও এসে ধরলেন। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে চেয়ারে এসে বসিয়ে দিলেন। সবাই খাওয়া ছেড়ে কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, আম্মু রান্নাঘর ছেড়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে সমানে প্রশ্ন করতে লাগলো, কি হয়েছে? কেন এমন হলো? আমি কিছু না বলে কাটিয়ে দিলাম। পরবর্তীতে খাওয়ার আর কোন ইচ্ছে হলো না, কেমন জানি অরুচিকর লাগতে লাগলো সবকিছু। তাই একটু বিশ্রামের নাম করে রুমে এসে শুয়ে পরলাম।
.
.
(চলবে…..)
আজকের পর্ব নিজের কাছেই কেমন জানি লাগছে🙁 তাই আর বেশি এগোলাম না। কিছুটা লিখেও কেটে দিয়েছি। বাকি অংশ আগামীকাল সুন্দর ভাবে গুছিয়ে দিলো ইনশাআল্লাহ।