#সুখ_সন্ধানী
অন্তীম পর্ব
লেখিকা #Fabiha_Busra_Borno
খুব সাবধানে উঠে উনার পিছনে ঠিক গলা বরাবর কুচ করে একটা টান দিই। অমনি ফসফস শব্দ বেরুতে থাকে গলা দিয়ে। মনে হচ্ছে শ্বাসনালী কেটে গেছে। মোবাইল ফোন মাটিতে পড়ে যায়। উনিও উনার শেষ শক্তি দিয়ে আমাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আমার সমস্ত শরীরে ব্যাথা তাই আগের মতো সম্ভব হচ্ছে না উনার সাথে পেরে ওঠার। কোন রকম পাশের চেয়ার দিয়ে উনার চোখে মুখে আঘাত করি। উনি ছিটকে কিছুটা দূরে চলে গেছে।
ঘরের দরজা খোলা আছে তাই ভাবলাম, এই দুর্বল শরীর নিয়ে এদের সাথে পারবো না। যে করেই হোক আমাকে বাইরে যেতে হবে। শত কষ্টেও কেউ কখনো চাই না সে মারা যাক। আমি বেড়িয়ে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে এলোমেলো পায়ে রাস্তার উদ্দেশ্যে হাটতে থাকি। তখনই দুটো মোটরসাইকেল ভিতরে আসতে দেখলাম। আড়ালে লুকাতে গিয়ে ছোট একটা গর্তে পড়ে যায়। এখান থেকে উঠার জন্য সামান্য শক্তি আমার শরীরে নাই। বেশ কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বিধাতার সাথে কথা বললাম। জীবনে কোন কাজে আমি সফল হয় নি। শেষ কাজ হিসেবে যেটা করতে লাগলাম সেটাও অসম্পূর্ণ থেকে গেলো। আর সামান্য কিছু সময় যদি তিনি আমাকে দেয় তাহলে অসম্পূর্ণ কাজ সম্পুর্ন করতে পারবো।
ঠিক তখনই দুজন লোক হন্তদন্ত হয়ে এদিকে সেদিকে কিছু খুঁজে চলেছে। জানি আমাকে খুঁজছে এখন। এই মুহূর্তে আমাকে দেখতে পেলে সেকেন্ডের মধ্যে শেষ করে দিবে।শরীরে লেগে থাকা রক্ত গুলো শুকিয়ে টান টান হয়ে গেছে। এদিক সেদিক তাকিয়ে ওরা সোজা গেইটের বাইরে চলে গেছে। আমিও হামাগুড়ি দিয়ে বাড়ির পিছনে ভাঙা প্রাচীরের দিকে অগ্রসর হতে থাকি।একেতো শরীরে আঘাতের পরে আঘাত এর তীব্র যন্ত্রণা তারউপর হামাগুড়ি দেওয়ার সময় এটা সেটার হাতে ফুটে যাচ্ছে।
এভাবে প্রাচীরে সামনে এসে পৌছালাম। কিন্তু এই প্রাচীর টপকে অপারে যাওয়া সম্ভব না। কোন রকম রাস্তার পথচারীদের একটু সংকেত দিতে পারলে দুশো টা তাজা প্রাণ বেচে যাবে। আমি আমার রক্তাক্ত হাত প্রাচীরের ফাঁক দিয়ে অপারে বের করে দিলাম,যদি কারো নজরে পরে ভেবে। আনন্দের বিষয় হলো,, খুব সামান্য সময়ের মধ্যে আমার হাত মানুষের চোখে পড়ে। সাথে সাথে দুই এক জন মানুষ প্রাচীর টপকে ভিতরে চলে আসে। আমি শুধু কোন রকম বললাম,, দুশো শিশু আছে এ বাড়িতে, বাঁচান ওদের।
ঝড়ের বেগে মানুষের ঢল নামে এখানে। আমাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তারাহুরো শুরু করে দেয় অনেকে। আমি তাদের বুঝাতে চাইছি আগে বাচ্চাদের বাঁচান পরে আমাকে। তখন অনেকে ভিতরে গিয়ে কোন বাচ্চার হদিস খুঁজে পায়নি। তবে দুটো মোটরসাইকেল আর একটা লাশ খুঁজে পায়। আমার থেকে অনেক তথ্য পাওয়া যাবে বলে সাথে সাথে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। আমি ডাক্তার সহ পুলিশ সাধারণ জনগণ সবাই কে বলে চলেছি,, আগে ওই বাচ্চাদের বাঁচান। কোন একটা ট্রলারে করে পাচার করে দিবে।হাতে সময় নেই।
পুরো শহরে মুহুর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এই ঘটনার কথা। এতোকিছুর পরেও নিজেকে আর জাগিয়ে রাখা সম্ভব ছিলো না আমার পক্ষে।পৃথিবীর মিছে মায়া ত্যাগ করে আমি মনে হয় মৃত সন্তান বাবা ভাইদের সঙ্গে চলেছি,,,,,,,,,,,,,৷৷
ঘরের চারিদিকে কত রকম যন্ত্রপাতি, স্যালাইন নাকের উপর কি যে একটা দেওয়া। সাদা জানালার পর্দা, বন্দ দরজা বিশিষ্ট কোন একটা ঘরে নিজেকে আবিষ্কার করি। আমি কোথায় এখন? আল্লাহ কি আবারও আমার জীবন ভিক্ষা দিয়েছে এই সব ভাবতে ভাবতে উঠে বসার সামান্য চেষ্টা করলাম কিন্তু বিফল হলো। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে বুঝলাম আমি কোন মেডিক্যালে আছি আর আমি এখনো জীবিত।
সাদা এপ্রোনে কোন একটা নার্স ভেতরে এসে আমাকে তাকানো দেখেই বাইরের কাউকে বলছে,রোগীর জ্ঞান ফিরেছে। সাথে সাথে দুজন পুলিশ একজন ডাক্তার ভিতরে এসে এখন কেমন আছি তা জিজ্ঞেস করেন।
আমি বিনয়ী সুরে বললাম , আলহামদুলিল্লাহ। উনারা ডাক্তারের সাথে কিছু কথা বলে সবাই বাইরে চলে গেছেন। কেটে গেছে দুইদিন। শরীরে তেমন আর ব্যাথা নাই। আজ দুজন পুলিশ এসে আমাকে নিয়ে গেলেন।কেমন একটা জানালা বিহীন ছোট্ট ঘরে দুটো চেয়ার আর একটা টেবিল আছে শুধু। আমাকে সামনের চেয়ারে বসিয়ে পুলিশের লোক টা বলতে থাকে,,
তোমার দেওয়া তথ্যের সুত্র ধরে আমার বাংলাদেশের নারী এবং শিশু পাচারকারীর এক বিশাল গ্যাং কে আটক করতে সক্ষম হয়েছি। তোমার নাম এখন পুরো বাংলাদেশের জনগণের মুখে মুখে। গত দুইদিন তোমার জ্ঞান ছিলো না তাই তুমি আমার কথার মানে হয়তো বুঝতে পারছো না।
একটু থেমে তিনি আবারও বলতে শুরু করেন,,ট্রলারে দুশো শিশু পাচার হবে শুনে আমরা পুরো চট্রগ্রামের চলাচলের জন্য যে সকল ট্রলার ব্যবহৃত হয় সব গুলো বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ জারি করে সরকার। আর ওই ভাঙা বাড়িতে পাওয়া মোটরসাইকেলের কাগজপত্র থেকে দুজনের নাম বের করা হয়েছে। যাদেরকে তুমি খুন করেছো সবাই শিশু পাচারকারী দলের বলিষ্ঠ কর্মকর্তা। বাংলাদেশ সরকার তোমার দেওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে আকাশপথে টহল দেওয়ার নির্দেশ দেন।
আর শেষ নির্দেশের ফলস্বরূপ দুশো কচি নিষ্পাপ বাচ্চাদের জীবন বেঁচে যায়। শুধু সরকার নয় পুরো দেশবাসী এখন তোমার প্রসংশায় পঞ্চমুখ। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে তুমি আইনের সহোযোগিতা ছাড়াই এমন কাজ করতে গিয়ে নিজের হাতে আইনের নিয়ম ভেঙে ফেলেছো,,নিজ হাতে চারজন কে খুন করেছো। তাই সামান্য হলেও তোমার শাস্তি ভোগ করতে হবে। তবে আমার সবাই চাই, এমন একটা ভালো কাজের জন্য খুব কম শাস্তি ভোগ করো তুমি।
সাধারণ খুনের শাস্তি মৃত্যুদ্বন্দ্ব হয়। যেহেতু আমার খুনের পিছনে ভালো উদ্দেশ্য ছিল তাই আমার শাস্তি কম হবে বলেন। কত কম হবে? ফাঁসির আদেশ না দিয়ে হয়তো যাবত জীবন দিবেন। আর মৃত্যুদ্বন্দ দিলেও আমার সমস্যা নেই। যার দুনিয়ায় আপন বলে কেউ নাই, যে মারা যাওয়ার পরে তার জন্য কান্না করার কেউ নাই, তার জীবন মরণ দুটো সমান। আগামী দুইদিন পরে নাকি আমাকে আদালতে নেওয়া হবে। আমি এখন সব সময় নিরবে বসে আল্লাহ কে ডাকি। কোন কাজ নেই খাওয়ার চিন্তা নেই। খুব নিশ্চিত ভাবে দিন কাটছে।
খুব সকালে একজন মহিলা পুলিশ আমাকে রেডি থাকতে বলেন। সকাল ১০ টাই আমাকে নিয়ে আদালতে যাওয়ার জন্য নিতে আসবেন। আমার আবার রেডি!! যায়হোক যখন আমি রাস্তায় বের হলাম তখন পুরো রাস্তার যে দিকে চোখ যায় সেদিকে শুধু আমার ছবি দেখতে পাচ্ছি। ছবির নিচে লেখা আছে,,
“” আসমানীর নিঃশর্তে মুক্তি চাই “””
আদালত পর্যন্ত সমস্ত রাস্তায় একই অবস্থা দেখলাম। হাজার পার মানুষ আমার পক্ষে মিছিল বের করবে তা কখনোই ভাবিনি। এতো দিন জানতাম খারাপ কথা গুলো মানুষের কাছে বেশি প্রচার হয় কিন্তু ভালো কাজের কথাও মানুষের কাছে প্রচার হয় তা বুঝলাম।
পুলিশের গাড়ি থেকে যখন আমি নামছি মনে হচ্ছে জনগণ আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবেন পুলিশের কাছে থেকে।
এতো মানুষের ভীড়ের মধ্যে দিয়ে আমাকে নিয়ে যেতে যেতে প্রায় দুপুর হয়ে গেলো। আমি কাঠগড়ায় দাড়িয়ে আছি। মহামান্য প্রধান বিচারক আমাকে জিজ্ঞেস করেন কেন এবং কিভাবে আমি চার চারটি খুন সংঘটিত করলাম।
আমি আমার মনের মতো করে বিগত দিনের ঘটে যাওয়া কথা গুলো উনাকে বর্ননা দিলাম। তারপর মহামান্য আদালত আমাকে দশ বছরের কারাদণ্ড দিলেন। মাত্র ১০ বছর শাস্তি হওয়ায় আমি খুশি না। এমন আরামের জায়গা তে আজিবন থাকতে চাই, না আছে থাকার চিন্তা, না আছে পড়ার চিন্তা আর না আছে খাওয়া চিন্তা। আমি চাই এমন অবস্থায় থেকে আমার মরণ হোক। সুখ সন্ধানী জীবনে এর চেয়ে বেশি সুখ হয়তো আর কখনো পাবো না।
সমাপ্ত
আগামী কাল থেকে নতুন গল্প পাবেন। আশা করি নতুন গল্পটাতে আপনাদের সবাইকে পাশে পাবো।