সুখ সন্ধানী – পর্ব ১০

0
241

#সুখ_সন্ধানী
পর্ব ১০
লেখিকা #Fabiha_Busra_Borno

উনি আমাকে বললেন,, কে তুমি? প্রতিদিন তোমাকে দেখি এদিকে আসতে যেতে! বাসা কোথায় তোমার?
উনার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমি তারাতাড়ি সেখান থেকে চলে আসতে চাই কিন্তু উনি আমার হাত ধরে ফেলেন এবং বলেন,, কি ব্যাপার কি হয়েছে বলবে তো আমাকে? আর কে তুমি? কথা বলছো না কেন??

উনার জোরে জোরে প্রশ্ন করা দেখে বেশ কয়েকজন লোক জমে গেলো,, তারপর নানান জন নানান রকম প্রশ্ন করতে শুরু করে। এদের এতো প্রশ্নে আমি ভয় পেয়ে যায়। সবাই আমাকে ছেলেধরা চক্রের সদস্য মনে করে পুলিশের কাছে দিতে চাই। তখন আমি সবাইকে বলি আমি তেমন কেউ না। গ্রামের কিছু কাহিনী এবং শহরে আসার সময় বাসে ঘটে যাওয়া কাহিনী গুলো বলি সবাই কে। এখানে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য আসি এটাও বললাম। মহিলা টি আমাকে উনার সাথে যাওয়ার জন্য বলেন এবং উপস্থিত জনতাও আমাকে উনার সাথে যেতে বললেন। ইচ্ছে না থাকলেও উনার সাথে গেলাম।

বিশাল একটা বাড়ির সামনে এসে উনি বললেন এটাই আমার বাড়ি। তুমি আজ থেকে আমার বাড়িতে থাকবে।আমি কোন কথা বললাম না। শুধু উনার পিছনে পেছনে গেলাম। এতো বিশাল বাড়িতে এর আগে কখনো আসিনি। বাড়ির ভিতর তেমন কাউকে দেখলাম না। বার কি তের বছর বয়সী একটা মেয়ে দরজা খুলে দিলো। দেখে মনে হচ্ছে এই বাড়িতে কাজ করে। উনি মেয়েটাকে বলে,, ফাতেমা এই মেয়েকে ওয়াশরুমে নিয়ে যা-তো,আমি আমার কিছু কাপড় বের করে দিচ্ছি।

গোসল শেষ করে বাইরে আসতেই দেখি খাবার টেবিল ভরা কত কি খাবার। বাড়িতে তো কাউকে দেখছি না। এতো খাবার কিভাবে এই দুজনে খায়। উনি আমাকে টেবিলের সামনে এনে একটা চেয়ার টেনে বসতে দিলেন। তারপর ফাতেমা খাবার বেড়ে খেতে দিলেন। কৌতূহল, ভয় এবং সংকোচের জন্য খাবার মুখে নিলেও পেটে যাচ্ছে না। উনি খেতে খেতে বললেন,, তুমি আমাকে খালা বলে ডাকতে পারো, ফাতেমাও আমাকে খালা বলে।

খাওয়ার পরে উনি আমাকে বললেন,, তুমি লেখাপড়া করেছো কতখানি?

বাবার সংসারে দু’বেলা পেট পুরে খেতে না পাওয়া মেয়ের লেখাপড়া হয় বলেন? কোন রকম ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছি।

কোন কাজ করতে তোমার ভালো লাগে! না মানে তুমি কি কি কাজ পারো?

গ্রামে থাকতে এখানে সেখানে প্রচুর রান্না করতাম। রান্না করতেও আমার ভালো লাগে।

তুমি ভালো রান্না পারো?তাহলে তো তোমার হাতের রান্না খেয়ে দেখতে হবে!!

এভাবে উনার সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পরে জিজ্ঞেস করি উনার ছেলে মেয়ে আছে নাকি আর উনার স্বামী কোথায়,,

জবাবে উনি বলেন, এক ছেলে আর এক মেয়ে আছেন। দুজনেরই বিয়ে হয়েছে, ছেলের ঘরে একটা নাতিও আছে। কিন্তু তারা এখানে থাকে না। চট্রগ্রামের কোন একটা কোম্পানিতে চাকরি করেন আর মাঝে মাঝে এখানে আসেন। আর গত ছয়মাস আগে উনার স্বামী মারা গেছেন। এখন এ-ই বাড়িতে উনি আর ফাতেমা থাকে।

আমি নিয়তির খেলায় সব কিছু হারিয়ে একা আর উনি সব কিছু থেকেও একা একা জীবন পার করছেন। রাতে উনার জন্য মাছের ঝোল এবং দেশি মুরগী ভুনা করে দিলাম। আমার জীবনে এতো প্রসংশা কখনো শুনিনি যতটা আজ উনি করেছেন । খুব ভালো লাগছে উনার প্রশংসা গুলো। প্রতিদিনের রান্না গুলো আমিই করি এখন। এখানে এসে অনেক নতুন নতুন রান্নাও শিখেছি।আসলে মন থেকে কোন কিছু করতে চাইলে তা খুব সহজেই হয়।

এ বাড়িতে আসার পরে হিমেল রাতুল মুকুল আর মায়ের কথা খুব মনে পড়তো। মাঝে মাঝে খালার সাথে কান্না করে ব্যাথা গুলো হালকা করতাম। এভাবেই কখন মাস শেষ হয়ে গেছে বুঝিনি। আজ দুপুরের খাবারের পরে খালা ফাতেমা কে কিছু টাকা দিলেন। বুঝতে পারলাম কাজে টাকা দিচ্ছেন।খালা আমার কাছে এসে আমাকেও তিন হাজার টাকা দিলেন। আমাকে টাকা দেওয়া দেখে সম্পুর্ন অবাক হয়ে গেলাম। এতো বড় বাড়িতে নিরাপদে থাকছি, খাচ্ছি এটাই তো অনেক। আবারও টাকা কেন। খালা হয়তো আমার মনের কথা গুলো শুনতে পেয়েছেন। তাই উনি বলেন,, অবাক হয়ে কাজ নেই, টাকা গুলো জমিয়ে রাখ কোন একদিন কাজে আসবে।

এ বাড়িতে আমার কোন খরচ নেই। থাকা খাওয়া জামাকাপড় সব কিছু খালাই দেয়। মাসে মাসে খালার দেওয়া টাকা গুলো জমা করি। কখনো খালার সাথে বাইরে গেলে মনে মনে আমার হারানো আপনজনদের খুঁজি।

আজ খুব সকালে খালা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলেন,, পুরো বাড়িটা পরিষ্কার করতে এবং আমার ইচ্ছে মতো রান্না করতে। আজ উনার ছেলে ছেলের বউ নাতি আসবেন। তিনজনেই যা যার মতো কাজে লেগে গেলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরেই খালা আমাকে রান্নার জন্য পাঠালেন। বাকি কাজ গুলো উনি আর ফাতেমা করতে পারবেন। রান্না ঘরে এসে আমি দেশি কিছু রান্না করলাম,, ডিম ভুনা, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, মাছের মাথার মুড়িঘন্ট, গরুর মাংসের কালা ভুনা ইত্যাদি।

রান্না প্রায় শেষ হবে এমন সময় কলিং বেল বাজলো। খালা মহা খুশিতে দরজা খুলে ফুটফুটে একটা বাচ্চা কে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে ভিতরে আসেন। রান্না ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে দেখছি যে,কি সুন্দরী একটা মেয়ে আর লম্বা ফর্সা ছেলে বেশ কিছু ব্যাগ হাতে ভিতরে আসছেন। ছেলে আর ছেলের বউয়ের দিকে খালার কোন খেয়াল নেই। ফাতেমা উনাদের ব্যাগ ভিতরে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ মায়ের সাথে কথা বলার পরে উনারাও রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসেন। ততক্ষণে টেবিলে খাবার সাজানোর পর্ব শেষ আমার। আমি আবারও সেই রান্না ঘরে এসে বসে আছি।

খাওয়া শুরু হতে না হতেই রান্নার প্রশংসা শুরু হয়েছে। খালা তো আমার রান্নার গুনগান গায়তে গায়তে গাছের মাথায় তুলে দিয়েছে আমাকে। এখন উনার ছেলে ও আমাকে দেখার জন্য ডাকতে বলেন। খালা আমাকে,, “”আসমানী এদিকে আয় একটু”” বলে ডাক দিলেন। আমি লজ্জা আর ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেলাম। বারবার ডাকছে তাই গাঁয়ে মাথায় ভালো করে কাপড় দিয়ে উনাদের সামনে গিয়ে সালাম দিলাম।

রাশেদ ভাইজান আমাকে বললেন,, তোমার হাতের রান্না খেয়ে এখন চাকরি ছেড়ে রেস্টুরেন্ট খুলতে ইচ্ছে করছে। খুব সুন্দর রান্না করো। আমি নিশ্চিত তোমার হাতের রান্না যে একবার খাবে সে বারবার চাইবে খেতে।

উনাদের এতো এতো প্রশংসা শুনে রাতে চিন্তা করলাম,, সত্যিই যদি আমার একটা হোটেল থাকতো!!কিন্তু হোটেল খুলতে অনেক টাকা লাগে এতো টাকা কই পাবো। হঠাৎ করে এমন স্বপ্ন দেখার সাথে সাথে আমার জমানো টাকার কথা মনে পড়ে। টাকা গুলো বের করে গুনতে শুরু করি,,বাইশ হাজার হয়েছে। এই টাকা নিয়ে এইসব ফালতু নিয়ে ভাবনা করে শুধু রাতের ঘুম নষ্ট ছাড়া অন্য কিছু হবে না।

এ বাড়িতে ভাইজান আর ভাবি বেশ কয়েকদিন ছিলেন। উনাদের আচার ব্যবহার দেখলে মনেই হয় না বিন্দু পরিমাণ অহংকার আছে।কি সুন্দর করে ভাবি আমাদের সাথে মিশেন কথা বলেন। ভাইজান যখনই কিছু খান তখনই ফাজলামো করে বলেন, রেস্টুরেন্ট খুলবেন। হঠাৎ করে আজ আমিও মুখ ফসকে বললাম, রেস্টুরেন্ট খুলতে কত টাকা লাগে ভাইজান?

কথা টা শোনা মাত্র সবাই আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। কেন এমন ভাবে তাকিয়ে আছে তা আমার বোধগম্য না। একটু পরে ভাবি বললেন,, তুমি কি সত্যিই চাও যে, অন্যের উপর নির্ভর না করে, তোমার নিজের একটা পরিচয় হোক, সমাজের আরো আট দশজনের মতো তোমার জীবন হোক?
আমি শুধু নিরবে মাথা নিচু নিরব সম্মতি জানালাম।

আজ ভাইজান ভাবি চলে যাবেন। যাওয়ার আগে আমাকে বকশিস স্বরূপ পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে গেলেন এবং বললেন খুব শিগগিরই তোমার স্বপ্ন পুরোণ হবে। উনারা যাওয়ার পরে পুরো বাড়িটা আবারও আগের মতো শুনশান নীরবতাতে ছেয়ে গেছে। খালা সারাদিন কিছু খায় নি। মনমরা হয়ে ঘরে বসে ছিলো সারাদিন। রাতে কোন রকম বুঝিয়ে সুজিয়ে একটু খাইয়ে দিলাম।

এভাবে আবারও বেশ কয়েক মাস কেটে গেলো। আমার জমানো টাকা প্রায় চল্লিশ হাজার পার হয়েছে। মাঝে মাঝে খালা বাজার করতে যে টাকা দিতো তা থেকে বেচে যাওয়া টাকা কখনোই খালা ফেরত নিতো না। একদিন বিকালে ভাইজান ফোন করে আমার সাথে কথা বলতে চাইলেন। খালা ফোন আমাকে দিলে ভাইজান বলেন,, উনার পরিচিত বন্ধু আছেন, যিনি একটা রেস্টুরেন্টের মালিক। আমার রান্নার হাত সম্পর্কে উনার সাথে কথা বলেছিলেন। উনি নাকি আমার রান্নার স্বাদ দেখার জন্য আমার রান্না খেতে চেয়েছেন। আগামী সপ্তাহে উনি উনার বন্ধুকে সাথে নিয়ে এখানে আসবেন। রান্না ভালো লাগলে উনার রেস্টুরেন্টে সেফ হিসেবে কাজ দিবেন। মাসে মাসে ভালো বেতন পাবো আমি।

কথা গুলো শোনার পরে খালা আর ফাতেমা ভিষণ খুশি, আমিও মনে মনে খুশি হলাম। খালা আমাকে আরো কিছু রান্নার নিয়ম শিখিয়ে দিলেন যেগুলো শহরের মানুষের প্রিয় খাবার। সেই রান্না গুলো ও আমি আমার নিজের মতো করে রান্না করতে থাকি,, স্বাদ গুলো মাশাল্লাহ।

আজ আমার সুখ সন্ধানী জীবনের পরিক্ষা হবে,, ভিষণ উৎকন্ঠা মনে সময় পার করছি। অবশেষে উনার,,,

চলবে,,,,,

আমার গল্পটা যদি আপনাদের মনে সামান্য যায়গা নিয়ে থেকে থাকে তাহলে আপনাদের বন্ধুদের মেনশন করে গল্পটা পড়ার সুযোগ করে দিবেন প্লিজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here