রোদেলা,পর্ব : ৬৬

0
811

#রোদেলা,পর্ব : ৬৬
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু

কল্লোল গত একঘন্টা ধরে তাগাদা দিচ্ছে নাতাশাকে দ্রুত রেডি হতে। ভাদ্র মাসের এই গরমের মধ্যে শেরওয়ানি পরে বসে থাকতে অস্বস্তি লাগছে ওর। দাওয়াত-টাওয়াত এলে বিরক্তিতে পরে যায় কল্লোল, কারন এ সময় নাতাশা কাওকে চিনে না। তার উপর ফুফাতো বোনের বিয়ে বলে কথা। প্রায় প্রতিবারই নাতাশার সাথে ওর ঝগড়া হয় এই দেরি হওয়ার জন্য। একটা মাত্র ছেলে তাকেও রেডি করে কল্লোল নিজেই।

বেঁধে দেয়া সময়ের পনেরো মিনিট পর অবশেষে তৈরী হয়ে নিচে নামে নাতাশা, এত রাগ লাগছিলো এতক্ষণ, কিন্তু নাতাশাকে দেখে সব রাগ ক্ষোভ হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। এত সুন্দর লাগছে নাতাশাকে যেন…..

উপমা খুঁজে পাওয়ার আগেই নাতাশা ছেলেকে সাথে নিয়ে কল্লোলকে কড়া গলায় বললো-
: এতক্ষণ তো মাথা খাচ্ছিলে, এখন উঠো…

কল্লোল সবাইকে নিয়ে নিচে নামলো। গাড়ি নিজে ড্রাইভ করে রওনা দিলো দাওয়াতের উদ্দেশ্যে। ঘড়ির কাটার নয়টা বাজলো দুটো গাড়ি কৃষ্ণচূড়া বাড়িটায় পৌঁছাতে। এত সুন্দর করে সাজানো হয়েছে এই বিশাল বাড়িটা যে বলার মতো না। অনেক দিন পর এ বাড়িতে এলো কল্লোল। বাড়ির মূল ফটকে রোদেলার বাবা-মা দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাতে। নাসিমা রোদেলার বাবাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন সবার সাথে।
: এই হচ্ছে নাতাশার বর কল্লোল, আর ও শোভন আর এই যে মা, সামনে এসো, এ হচ্ছে আমার আরেক মেয়ে সারা শোভনের বৌ। তা মা নাতনীকে আনো নি কেন…?
: আরে আন্টি ওকে নিয়ে দাওয়াতে আসা মুশকিল, মায়ের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি বিকেলে।
: আর এই যে এ্যামী বর কোথায় তোমার….?
: ওর কথা আর বলিয়েন না আন্টি, ও তো লেটলতিফ। এখনো এসে পৌঁছায় নি। ভাগ্যিস আমি আগেভাগে এসেছিলাম, ওর কথার ভঙ্গি শুনেই হাসিতে ফেটে পরলো সবাই…
রোদেলার বাবা বললো –

: নিজেদের মানুষ তোমরা এত দেরি করে আসলে।
যাও মা তোমরা ভিতরে যাও, খাওয়ার পর্ব শেষ করে ফেলো।

এই প্রথম বারের মতো তাকে দেখলো নাতাশাদের শ্বশুর বাড়ির সবাই । বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই চমক। এত সুন্দর করে সাজিয়েছে পুরো বাড়িটাকে যেন বিয়েটা গৌণ এ বাড়িটার সৌন্দর্য দেখাতেই এই আয়োজন। বিয়ে উপলক্ষে বাড়িটাে নতুন করে রঙ করা হয়েছে। গাছ আগেও ছিলো এখন আরো অনেক গাছ লাগানো হয়েছে নতুন করে।

বৌ পার্লারে গিয়েছে সেই বিকেলে । বর আসলো বলে, কিন্তু বৌয়ের খবর নেই। এ নিয়ে ফেনে রাগারাগি করছে নাসিমা।

ওরা একে একে ঢুকলো বাড়িতে। সামনের অংশে মেহমানদের বসার জন্য বিশাল সামিয়ানা, তার সামনে বর বৌয়ের বসার জন্য বিশাল স্টেজ। অতিথিরা এখন সেটা দখল করে আছে। ছবি তুলছে এদিকে সেদিকে। খাবারের আয়োজন ভিতর বাড়িতে। বুফে সিস্টেমে খাবার ব্যাবস্থা।

রোদেলার কাজিনেরা খুব ব্যাস্ত মেহমানদারিতে। নোভেলকেও দেখা যাচ্ছে ব্যাস্ত ভঙ্গিতে কি যেন নিয়ে যাচ্ছে ভিতর বাড়িতে। এতদিন পর সবাইকে দেখে ভীষণ ভালো লাগছে সবার। নাতাশার শ্বশুরবাড়ির লোক সবাই এক টেবিলে খেতে বসেছে। খাওয়া দাওয়ার আইটেম দেখে চক্ষু চড়কগাছ। চাইনিজ আইটেম টু বাংলা, সুইট এন্ড সওর প্রণ টু মুগ ডালের ঘন্ট…. কোনটা রেখে কোনটা খাবে তা ভেবে নাজেহাল অতিথিরা। কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ করলো কল্লোল মেহমানরা এমন ব্যুফে সিস্টেমে প্রচুর খাবার নষ্ট করে। একেকজনের সামনে উচ্ছিষ্ট খাবারের স্তুপ জমেছে। এ জিনিসটা খুবই অপছন্দ কল্লোলের। শোভন বললো আরে এদের চোখেই কেবল ক্ষুধা। তাই তো দিশেহারা হয়ে সব খাওয়ার ব্যার্থ চেষ্টা করে।

ওদের খাওয়া শেষ হতেই কল্লোল আর শোভন মেহমানদের খাবার সার্ভ করতে শুরু করে। নিজেদের লোক বলে কাজে হাত লাগানো আরকি। মেয়েরা ব্যাস্ত ছবি তোলা নিয়ে। বাড়ি গিয়ে ফেসবুকে আপলোড করতে হবে না….

প্রায় হাজার লোকের আয়োজন। তবুও বিশাল এই বাড়িটায় এ সংখ্যাটা যেন নগন্য। দূরের মেহমানরা অনেকেই খেয়ে চলে গেলো, রাত বাড়ছে তাই।

এত মানুষ দেখছে কিন্তু মনে মনে একজনকে খুঁজছে শোভন। এদিকেই কোথাও আছে হয়তো। কিন্তু কিছুতেই দেখা মিললো না তার। বর আসলো রাত দশটায়।

নাতাশা আর ওর বাকী কাজিনরা গেইট ধরতে গেলো। অনেক দফারফা করে ভিতরে ঢুকতে সময় লাগলো বিশ মিনিটের মতো। কনের ভাইবোন যেমন বুনো ওল…বরের ভাইবোন আর বন্ধুরাও বাঘা তেতুল। কেও কম যায় না কারো থেকে।

শোভন কল্লোল পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। ছেলেমেয়েদের এমন মিষ্টি ঝগড়া দেখতে ভালোই লাগছে ওদের। বর ভিতরে ঢুকতেই ওদেরকে দেখে সুফিয়ান এগিয়ে এলো কল্লোল আর শোভনের দিকে। আন্তরিক ভঙ্গিতে আলিঙ্গন করলো দুজনকে।
কল্লোল বললো-
: বাহ্ ভাই, দারুণ ব্যাপার হলো, দুই ভাই এখন ভায়রাভাই হলেন। দুই বোন হলো জা…

স্মিত হাসলেন সুফিয়ান। তাদের খাওয়াদাওয়ার খোঁজ নিলেন, তারপর নোভেল ডেকে ভিতরে যেতে বললেন। তাদেরকে বলে ভিতর বাড়িতে গেলো সুফিয়ান। সুফিয়ান লোকটা আগাগোড়া বিনয়ে মোড়া। প্রথমে এটাকে মেকি লাগতো। পরে অবশ্য বুঝেছে শোভন লোকটা প্রকৃতপক্ষেই ভালো মানুষ।

রোদেলা সুফিয়ানের পিছনেই ছিলো। কেও একজন বললেন –
: তোমার বোনের বিয়ে, আর তুমি এত দেরি করে এলে…
: আর কি বলবো ফুফু, আমার শ্বাশুড়ি মা নেই।
সবকিছুর গোছগাছ আমাকেই করতে হয়েছে। আমি এ বাড়ির শুধু মেয়ে আর ঐ বাড়ির বৌ আর ওদের দুজনে মা। জানেনই তো….

কথাগুলো বলেই বরের দলের সাথেই ভিতরে চলে গেলো। ব্যাস্ততায় এদিকটায় লক্ষ্য করলো না হয়তো। রোদেলাকে একপলক দেখলো শোভন। সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিলো ও।

একপলকের দেখায় ভিতরটা কেমন থমকে গেলো, যেন সময় আটকে গেছে কোন টাইম লুপে। অনেক অনেক কথা, ভাঙা স্মৃতি জুড়ছে মনের ভিতরে। শোভনের অতীত এখন যেন পাজল স্লেট। কোন কোনটা মিলে যাচ্ছে, কোন অংশ নিখোঁজ। দ্রুত একটা সিগারেট ধরালো শোভন। মাথাটা কেমন ভারী হয়ে যাচ্ছে।

এদিকটায় ছেলেরা বসে আড্ডা দিচ্ছে। সারা এসে শোভনকে নিয়ে গেলো। বললো একা একা তো ছবি তুললাম খুব, এসো তোমার সাথে তো কোন ছবিই তোলা হলো না। অগত্যা শোভন গেলো সারার সাথে ছবি তুলতে।

ছবি তোলার এক ফাঁকে রোদেলার চোখে চোখ পরলো শোভনের। একেবারে অনিচ্ছায়, অপরিকল্পিত ভাবে। সারা দু-হাতে জড়িয়ে ধরেছে ওকে, ক্যামেরা ম্যানের ইন্সট্রাকশনে এই পোজ।

আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসলো রোদেলা। পরিচিত কারো সাথে হঠাৎ দেখা হলে যেই ভঙ্গিতে হাসির বিনিময় হয় সেরকম। যে হাসির অর্থ – আরেহ্ কতদিন পর দেখা, তারপর কেমন আছেন….?
শোভন একটু সময় নিলো এই সামাজিকতায় অংশ নিতে। হাসির বিনিময়ে ও নিজেও হাসলো একটু।

কত কথা জমা ছিলো ওর, কত কত জিজ্ঞাসা ও…
কিন্তু সব কথা মিটিয়ে দিতে হলো একটা স্মিত হাসিতে…
কারন সময়টা বড্ড অসময় এখন…
শোভন সারাকে বিয়ে করে সংসারী হয়েছে ওর নিখোঁজের বছরেই। ঘর আলো করে মেয়ে হয়েছে ওদের দুবছর হলে।

অপরদিকে রোদেলা….
টেলিফোনে বিয়ে করে বরকে নিয়ে গেলো ইংল্যান্ড।
সেখানে ব্যাবসা শুরু করেছে সুফিয়ান আর রোদেলা একটা কলেজের প্রফেসর হয়েছে দুই বছর। ভাগ্যিস প্রিসিলার বিয়ে বাকী ছিলো, তা না হলে বোধহয় আর দেখাই হতো না।

সারার সাথে রোদেলার খুব ভাব। ওর খোঁজ হওয়ার পর নাতাশার কাছ থেকে নম্বর জোগাড় করে কথা বলেছে অনেক আগেই। এখন ওরা খুব ভালো বন্ধু। কিন্তু শোভন সবসময় ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়েছে। এতেই দুজনেরই মঙ্গল হয়তো…

রোদেলা…
তেমনি কাঁধ পর্যন্ত চুল, সাদামাটা সাজ, ডান হাতে ঘড়ি, সু জুতা পায়ে। ঝলমলে শাড়ি অবশ্য পরেছে একটা, কিন্তু ওর সাজ যেন সেই একই রকম। সেই নো-মেকাপ মেকাপ লুক। একটুও বদলায়নি ও। বয়সটাকে যেন ফিক্সড করে রেখেছে কোন মন্ত্র বলে। সাড়ে সাত বছর পর দেখছে ওকে। তবুও শোভনের মনে হচ্ছে এখনো যেন সেই অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ুয়া সে। দশ বছর পরও হয়তো ওকে এমনি দেখাবে।

তবে কিছু একটা পরিবর্তন ঠেকছে ওর, ঠিক ধরতে পারছে না। মনে মনে খুঁজতে লাগলো পরিবর্তনটা কি…?
অনেক পরে হঠাৎ মনে পরলো চশমা….!
আগে রোদেলা চশমা পরতো না, এখন কালো ফ্রেমের ক্যাটস আই শেপের চশমা পরেছে চোখে। সাত বছরে এই কেবল পরিবর্তন রোদেলার।

ছবি তোলা শেষে সারা ওকে সেখানে ফেলেই চললো বৌ দেখতে। শোভন গরম গরম জিলাপি নিতে এগিয়ে গেলো জিলেপির স্টলে । অস্বস্তি কাটাতে এরচেয়ে ভালো উপায় আপাততঃ ওর জানা নেই।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here