রোদেলা
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব:৭২
প্রিসিলা রেজওয়ান ওরা রোদেলা সুফিয়ানের বিপরিত রূপ। আসলে ওদের জানাশোনা আগে থাকলেও তা ছিলো একেবারে ভিন্ন একটা ধরনের। রোদেলার মা নাসিমা ভীষণ কড়া মানুষ। তিনি সুফিয়ানদের বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও কখনোই ওদের দুই ভাইয়ের সাথে প্রিসিলার কথা বলা পছন্দ করতো না। তিনি জানেন আগুন আর কাঠ একসাথে থাকা অনিরাপদ। সুফিয়ানের মধ্যে এমন কিছু কখনোই ছিলো না। রেজওয়ানকে তেমন করে চিনে না নাসিমা। ছেলেটা কেমন যেন আত্মভোলা, অহংকারী। কখনোই ওদের ফ্ল্যাটে আসতো না। প্রথম প্রথম নিজেকে অনেক ছোট মনে হতো নাসিমার। ওদের বাড়িতে এসে থাকছে বলেই হয়তো ছেলেটা এমন এড়িয়ে চলে ওদেরকে। কিন্তু সুফিয়ানের আন্তরিকতায় সেসব ভাবনা ভেসে যেতো। তবুও নাসিমাও ওদের ফ্লাটে কখনোই পাঠাতো না প্রিসিলাকে।
প্রিসিলার সাথে রেজওয়ানের বিয়ে হচ্ছে শুনে সবাই ধরেই নিয়েছে যে ওদের প্রেমের বিয়ে। অথচ নাসিমা এ ব্যাপারে অনেক সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। তাই দুজন দুজনের পরিচিত এর চেয়ে বেশী কিছু ছিলো না ওদের দুজনের মধ্যে । জানাশোনা তো অনেক দূরের কথা। তাই হয়তো কেমন বেখাপ্পা লাগছে দুজনকে। একজন পাশের জনের পছন্দ অপছন্দ না জানলে যা হয় আর কি।
সুফিয়ান বলেছে-
: আরেহ্ বাদ দাও, একটু সময় যাক সব ঠিক হয়ে যাবে।
ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রোদেলা বললো-
: আমরা চলে যাবে খুব শীঘ্রই, ওর তো কাগজপত্র তৈরী না হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকা লাগবে।
: তুমি এত কেন ভাবো বলো তো…?
: আমি প্রিসিলাকে চিনি… ও খুব নরম মনের,
: এত ভেবো না, আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী।
: এ কথাটাই আমার একমাত্র ভরসা।
বেশ খানিকক্ষণ চুপ থেকে রোদেলা বলে-
: জানেন সুফি কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করে-
“তুমি কি তোমার ছোটবেলায় ফিরে যেতে চাও…?” কিংবা “তোমার কোন অতীত বদলাতে চাও…?”
দুটো প্রশ্নের উত্তরই হবে “না” ….
একটা সময় অনেক কষ্ট পেতাম, দুঃখ হতো এমন কেন আমাদের জীবণ…? এক পা এগুলে জীবণ আমাদেরকে দশ পা পিছনে ছুড়ে ফেলে দিতো…
এখন আমি বুঝি এসবের দরকার ছিলো আজকের আমি তৈরি হতে। আল্লাহ কাওকে যখন কিছু দিবেন ভাবে, সে ঐ জিনিসটার উপযুক্ত কি না তা দেওয়ার আগে নানান কষ্ট, ঘাত প্রতিঘাত দিয়ে পরীক্ষা করে নেন। আমরা অধম তা বুঝি না, শুধু শুধু দোষ দিই খোদাকে। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন। কত কত দিন যে রাগ হতো তার প্রতি তার হিসেব নেই। কত কত দিন নিজের মৃ*ত্যু*কে সহজ মনে হতো তারও হিসেব নেই। আল্লাহ যা করেন তা মঙ্গলের জন্য কথাটা কত সত্যি তা আমি রিয়েলাইজ করতে পারি।
রোদেলাকে থামতে দেখে সুফিয়ান বলে-
: কবি শেলীর একটা কথা আছে শুনেছো নিশ্চয়ই –
“Our sweetest songs are those that tell us saddest thought” কষ্ট আছে বলেই হয়তো জীবণ এত সুন্দর। তুমি এত ভেবো না, আমরা গিয়েই ওকে দ্রুত নিয়ে যাবার চেষ্টা করবো।
: হুম, অনেক কষ্ট সহ্য করেছে আমার এই বোনটা…
আমি চাইনা আর কোন কষ্ট ওকে ছুঁক….
: ছাঁদে যাবে?
: এত রাতে…! কেন বলুন তো…?
: মস্ত এক চাঁদ উঠেছে আজ আকাশে…
ঐ দেখো…
বলেই হাত দিয়ে জানালার দিকে দৃষ্টি করে ও।
খুশিতে মুখ চকচক করে ওর, কারন পূর্ণিমা রাত ওর ভীষণ পছন্দ…
এ রিসোর্টের ছাদে নতুন করে একটা স্টলের মতো হয়েছে। তাই ছাদ সবসময়ই খোলা থাকে। ওরা দুজনে ছাদে উঠে একসাথে চাঁদ দেখবে আর কিছু মুহূর্ত কাটাবে বলে। সিঁড়ির শেষ ধাপে উঠতেই সুফিয়ান হাত চেপে থামায় রোদেলাকে৷ বিরক্ত রোদেলা রাগ হয় ওর এমন আচরণে। রাগী কন্ঠে বলে-
: একটু হলেই পরে যেতাম গড়িয়ে….
: আমি থাকতে তা অসম্ভব,
: ডেকে এনে আবার এমন দরজা ধরে দাঁড়িয়ে কেন আছেন..?
মুখের সামনে আঙুল ধরে চুপ করতে বলার ভঙ্গিতে ইশারায় দেখায় সামনে। এদিকটাতে পিঠ দিয়ে বসে আছে প্রিসিলা রেজওয়ান। একজনের হাত আরেকজন ধরে কথা বলছে দুজনে। পেছন থেকে রেজওয়ানের শরীরের দুলুনি দেখে বোঝা যাচ্ছে কোন কারনে হাসছে রেজওয়ান। প্রিসিলা হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো অন্য দিকে।
রোদেলা মুখে হাত চেপে হেসে ফেলে এ দৃশ্য দেখে। চোখ দুটো শান্তি হলো যেন। সুফিয়ানকে রেখেই সিঁড়ি ভেঙে নেমে যায় নিচে। সুফিয়ানও নামে পিছু পিছু। রিসোর্টের একেবারে নিচে নেমে হাঁটতে থাকে পাশাপাশি দুজনে। সুফিয়ান হঠাৎ ঘড়ি চেক করলো। স্মার্ট ঘড়িটায় স্পর্শ করতেই সময় দেখালো, সময় তখন সাড়ে বারোটা। রোদেলাকে বললো-
: বীচে যাবে…?
: হুম…
হুম বলার ভঙ্গিটা খুব পছন্দ সুফিয়ানের, কেমন একটা আদুরে ভাব আছে এই ভঙ্গিটায়। দুজনে হাত ধরে বীচের কাছটায় বসে, সুফিয়ান বলে-
একটা গান শোনাবে…..
: ধূর..
: প্লিজ….!
হাঁটুতে থুতনি রেখে গান ধরে রোদেলা-
চলনা দুজন আজ নীলিমা ছুঁয়ে ভালোবাসি…
বৃষ্টি ধারার মতে জোছনা নিয়ে নিরবে কাছে আসি…
ও.. বলো না তুমি সেই না বলা কথা গানে গানে
ওই নীল আকাশ ওই দখিনা বাতাস,
আমাকে কাছে টানে,
অভিমানী ভালোবাসা চায় যে হারাতে,
ঐ দূর অজানাতে।
তুমি আমি ভেসে যাবো মেঘলা বাতাসে,
এই হাত রেখে হাতে।
চাঁদ কি জানে তুমি চাঁদেরই মতো,
মন জানে না মন ছুঁয়েছে কত।
বললে তুমি আর কবিতা কোন,
যাই হারিয়ে তুমি যে পথে চলো….
এসো না হৃদয়ে তুমি, অচেনা শ্রাবণে নামি
অভিমানী ভালোবাসা চায় যে হারাতে,
ঐ দূর অজানাতে।
তুমি আমি ভেসে যাবো মেঘলা বাতাসে,
এই হাত রেখে হাতে………….
রাত দেড়টারও অনেক পরে ওরা রুমে ফিরে। আগামীকাল ছেঁড়া দ্বিপে যাচ্ছে ওরা। পরশু রাতে রওনা দিবে ঢাকার উদ্দেশ্যে। এরপর দুটো দাওয়াতে এটেন্ড করতে হবে। ওর বন্ধু সিমি আর শাহনাজ আন্টিদের বাসায়। খালা, মামা, নাতাশারা ও দাওয়াত করেছে যদিও। কিন্তু এই দুটো দাওয়াতেই ও এটেন্ড করবে শুধু। বাকী গুলোতে প্রিসিলা রেজওয়ান গেলেও ও আর সুফিয়ান যাবে না।
রাতে ঘুম ভালো হলো দু’জনের। ওরা কখন রুমে ফিরেছে জানে না রোদেলা। নশতা খেতে খেতে একবার ভেবেছিলো জিজ্ঞেস করে প্রিসিলাকে। কিন্তু কথাটা বলতে গিয়েও গিলে ফেলে। কারন জিজ্ঞেস করলে ওরা লজ্জা পেতে পারে।
নাশতা শেষ করে নিজেরা ট্রলার ভাড়া করে দুপুর হওয়ার আগেই রওনা দিলো ছেঁড়া দ্বীপের উদ্দ্যেশ্যে। বাকী তিনজন এর আগে এলেও, এবারই প্রথম এলো রোদেলা। ট্রলারে বসেই ভেবেছিলো সেদিনের কথা গুলো। শোভনের পাগলামী মনে পরলো ওর এসব ভেবে। কি কি বলেছিলো তাও ভাবতে থাকলো আনমনে। শোভন…!
কি পাগল ছিলো ও রোদেলাকে পেতে। এট এনি কষ্ট…! কতটা বদলে গেছে সময়, কতটা বদলে
যায় মানুষ সময়ের কাছে অসহায় হয়ে। এ বদলে যাওটা দোষের না, সম্মানের। নিজের পরিবারের প্রতি ভালোবাসা আর সম্মান থাকলেই এভাবে বদলাতে পারে মানুষ। শোভন আর সারার প্রতি সম্মান বেড়ে গেলো রোদেলার। দুজন দুজনকে কি সুন্দর আগলে রেখেছে। ও সত্যি বলতে ভয়ই পাচ্ছিলো শোভনের মুখেমুখি হতে। কিন্তু এসব সহজ করে দিয়েছে সারা আর সুফিয়ান যে প্রথম দেখায় পরিচিত ভঙ্গিতে ইশারায় কথা বলতে একটুও দ্বীধা হয় নি ওর। ও ভালো আছে এটাই স্বস্তির খবর। হয়তো ওরা ভালো না থাকলেই কষ্ট পেতো রোদেলা।
ছবি তুলতে তুলতে আনমনে সুফিয়ান দেখে ভাবুক রোদেলাকে৷ কয়েকটা ছবি তোলে এই ভঙ্গিতে বসা অবস্থায়। হালকা নীল রঙের শাড়ি পরে হাঁটুতে থুতনি রেখে কি যেন ভাবছে ও। মেহেদী পরা পায়ের পাতা, শাড়ির কুঁচি, মুষ্ঠিবদ্ধ হাত এটা হয়তো ওর প্রিয় বসার ভঙ্গি। ক্যামেরার শব্দটা এদিকে ঘুরতেই সংবিৎ ফিরে রোদেলার। এসব মনে পরবে ভেবেই এখানে আসতে চায় নি ও। কেমন যেন লজ্জিত ভাব ফুটে ওঠে ওর। সুফিয়ান কাছে এসে বলে –
: সোজা হয়ে বসো তো কয়েকটা ছবি তুলি,
জড়তা ভেঙে সহজ হয়ে ছবি তুলে রোদেলা। এরপর
জোড়ায় জোড়ায়, সবশেষে সবাই মিলে দলীয় ছবি। সবার চোখেমুখে খুশি। সে খুশিতে যোগ দেয় রোদেলাও।
জীবণ সুন্দর…!
জীবণ সত্যি সুন্দর…….!
—————
পরদিন সন্ধ্যা নাগাদ ওরা পৌছে গেলো টেকনাফে। সেখান থেকে রাতের খাবার খেয়ে ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দিলো সাড়ে দশটায়। পরদিন সকাল ছয়টায় পৌঁছে গেলো ঢাকাতে। বাড়ি পৌঁছে ঘুম দিলো সবাই যে যার ঘরে।
চলবে…..