তোমাতে বিলীন – পর্ব 15

0
1213

#তোমাতে বিলীন🍁
#লেখিকা—আমায়া নাফশিয়াত ☘
#পর্ব—|| ১৫ ||
এভাবেই ধীরে ধীরে সময় বয়ে যেতে লাগলো।এনগেজমেন্টের পর ঊদিতার সাথে আশিয়ানের আর কোনো যোগাযোগ হয় নি।তবে তাসকিন আর আলেয়ার দৈনিক ফোনকলেই প্রেমালাপ চলতো।ঊদিতার সময় নিজের রুমেই কাটে।আর আশিয়ানের বাসায় নিজের রুমে বসে ল্যাপটপের মাধ্যমে অফিসের কাজ করে আর বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে গিয়েই সময় কাটে তার।কিছুদিন রিল্যাক্সে থাকতে চায় সে।
তারিন আর আশা বিয়ে ভাঙার জন্য নতুন কিছুই করতে পারে নি।ওরা বুঝে গেছে আশিয়ানের বিয়ে আর কোনোমতেই ভাঙতে পারবে না তারা।আশিয়ানকে ওরা এই কয়দিনে আরও ভালো করে চিনে গেছে।এই ছেলেটা বহুত ডেঞ্জারাস।কোনো কিছুই তার চোখ এড়ায় না।
অবশেষে মেহেন্দির দিন চলে এলো।যার যার বাসায় অনুষ্ঠান করা হবে।আশিয়ানদের বাসার সামনের খোলা জায়গায়ই মেহেন্দি ও গায়ে হলুদের স্টেজ করা হয়েছে।আর আলেয়াদের বাসার ছাদের উপর স্টেজ তৈরী করা হয়েছে।এসব অনুষ্ঠানে ঊদিতা থাকবে না। সে মানা করে দিয়েছে।শুধু আলেয়ার জন্য অনুষ্ঠান করা হবে।ঊদিতা নিজের রুমেই হলুদ মেখে গোসল করবে এবং মেহেদী লাগাবে।
ঊদিতা নিজের রুমে মেহেদী রঙা একটা শাড়ি পড়ে আছে।তাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে।আশিয়ান পার্লার থেকে দুজন মহিলাকে পাঠিয়ে দিয়েছে ঊদিতাকে মেহেদী পরিয়ে দেয়ার জন্য।এনা,কেয়া আর তারিন এসেছিলো একবার।সবার সাথে দেখা করে আবার চলে গেছে।এনা ও কেয়া ঊদিতার সাথে অনেক ছবি তুলেছে।
ওরা চলে যাওয়ার পর ঊদিতা নিজের রুমে বসে বসে মেহেদী পড়তে লাগে।মহিলা দুজন ভীষণ সুন্দর ভাবে ঊদিতার হাতদ্বয়ে মেহেদী পরিয়ে দিচ্ছেন।বাকিরা সবাই ছাদের ওপরে অনুষ্ঠানে আনন্দ করতে ব্যস্ত।মিসেস আনিতা,উসামা আর ঊষা অবশ্য ঊদিতার পাশে বসে আছেন।ঊদিতার দুহাত পায়ে মেহেদী পরানো শেষ হলো।ঊদিতার হাতে ছোট করে আশিয়ানের নাম লেখা হয়েছে।ঊদিতা তো লজ্জায় লাল হয়ে গেছে আশিয়ানের নাম দেখে।
অপরদিকে আশিয়ান আর তাসকিনের ও মেহেদী অনুষ্ঠান চলছে।ভীষণ জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান হচ্ছে।বাংলাদেশের নামকরা সিঙ্গার কয়েকজন এসেছেন গান গাওয়ার জন্য।এনা ও কেয়া এবং আশিয়ানের খালাতো ও ফুফুতো বোন দুজন আশিয়ান ও তাসকিনকে মেহেদী পরিয়ে দিচ্ছে।বাকিরা নাচগান ও হৈ-হুল্লোড়ে ব্যস্ত।সেখান থেকে লাইভ সবকিছু দেখতে পাচ্ছে ঊদিতা তার ভাইয়ের ফোনে।আশিয়ান,তাসকিন দুজনেই বেশ হাসিখুশি।
অবশেষে মেহেন্দি সন্ধ্যা শেষ হলো।আশিয়ান মেহেদী ভরা হাত নিয়ে নিজের রুমে চলে এলো।মেহেদী শুকিয়ে যাওয়ার পর হাত ধুয়ে এসে মাথা ব্যথার ঔষধ খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়লো সে।এত চিৎকার চেঁচামেচি সহ্য করতে পারে না আশিয়ান।তার মাথা ধরে যায়।
এদিকে ঊদিতারও হাত পায়ের মেহেদী শুকিয়ে যাওয়ার পর হাত পা ধুয়ে ওযু করে এসে নামাজ পড়ে খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাে।
♥️♥️♥️
পরদিন সকাল থেকেই সবার ব্যস্ততা শুরু। আজ গায়ে হলুদ তাই।ঊদিতার কোনো চাপ নেই। সে দিব্যি নিজের রুমে বসে বসে আশিয়ানের দেয়া চকোলেট খাচ্ছে।ঊদিতা যেন আরও বেশি সুন্দরী হয়ে গেছে।একদম চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের অধিকারী যাকে বলে।আসলে লোকে সত্যিই বলে যে বিয়ের ফুল ফুটলে মেয়েরা আগের থেকে অনেক সুন্দরী হয়ে যায়।
বিকালে আশিয়ান ও তাসকিনকে হলুদ মাখিয়ে গোসল করানো হয়েছে গার্ডেনে।তাজিম আর তাশজিদ তো ওদেরকে হলুদ মাখিয়ে ভুত বানিয়ে ফেলেছে।দৌড়াদৌড়ি ও হলুদ মাখানো শেষে তাদের বিকালের ছোটখাটো অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলো।
সন্ধ্যার পর শুরু হলো হলুদের অনুষ্ঠান।আজ আশিয়ান ও তাসকিন মেহেদী অনুষ্ঠানের মতো হলুদ রঙা সেইম পাঞ্জাবি পাজামা পড়লো।তাদের মতো তাদের বাকি ভাইয়েরাও সেইম ডিজাইনের পাঞ্জাবি পাজামা পড়েছে।তাদেরকে দেখতে অনেক ড্যাশিং লাগছে।ড্রেস কোড হলো, পাঞ্জাবি হলুদ ও পাজামা সাদা।শুরু হলো নাচগান।আশিয়ান ও তাসকিনের কাজিনরা সবাই হয় গান গাচ্ছে নয়তো নাচছে।অবশেষে আশিয়ান ও তার ভাইদের নাচ করার সময় এলো।
আশিয়ান,তাসকিন,তাজিম,তাশজিদ,তাহমিদ, তামজিদ তারা ছয় ভাই মিলে ইংলিশ গান “কল দ্যা পুলিস হুয়েন শি ওয়াইন” গানটির সাথে ফাটাফাটি ড্যান্স করলো।নাচ শেষে তুমুল করতালিতে ফেটে পড়লো জনগণ।অস্থির নাচ নেচেছে ওরা।আশিয়ানের নাচের স্টেপগুলো দেখে তো মেয়েরা ফিদা হয়ে গেছে।সত্যি অসাধারণ ডান্স করতে পারে আশিয়ান।
এনা ডান্সটা ভিডিও করে ঊষার ফোনের হোয়াটসঅ্যাপে সেন্ড করে দিলো।ঊষার ফোনে আশিয়ানের ডান্স দেখে ঊদিতা অবাক।লোকটা অনেক সুন্দর করে নাচতে পারে।ঊদিতা মনে মনে আশিয়ানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।ঊদিতা আজ হলুদ শাড়ি পড়েছিলো।আশিয়ানের ছোঁয়ানো হলুদ মাখিয়ে তাকে গোসল করানো হয়েছে।ঊদিতার মনে অন্যরকম এক অনুভূতির সঞ্চার হয়েছিলো।যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
ঊদিতার শাড়ি পরিহিতা ও চুল ছাড়া অবস্থায় বেশ কয়েকটা ছবি তোলা হয়েছে।মুখে রয়েছে হালকা মেকআপের ছোঁয়া।অসাধারণ লাগছে তাকে দেখতে।ঊষা ফটো তুলে আশিয়ানের ফোনে সেন্ড করে দিলো।
রাত প্রায় ২ টা বাজে আশিয়ান তখন ছাদে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে ব্যস্ত।ফোন দেখে নি তখনও।তাই ঊষার পাঠানো ছবিগুলোও তার চোখে পড়ে নি।এখন ফোন চেক করতে গিয়ে হোয়াটসঅ্যাপের নোটিফিকেশন চোখে পড়ে তার।হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে একটা ফটোতে ক্লিক করতেই তার চক্ষু স্থির হয়ে গেল।
ঊদিতাকে দেখতে এত আকর্ষণীয় লাগছে আশিয়ানের কাছে তা বলে বুঝানো যাবে না।লম্বা চুল এমনিতেই আশিয়ানের দুর্বলতা।আগে ইলিয়ানার কোমড় অবধি চুল দেখেই আশিয়ান মুগ্ধ হয়ে যেত।আর এখন ঊদিতার হাটু অবধি চুল দেখে আশিয়ান পুরো থ।মেয়েটাকে দেখলে বুঝাই যায় না যে সে এত অপরুপা।যে হারে নিজেকে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে রাখে।আশিয়ান তাকিয়ে আছে ঊদিতার ফটোর দিকে।এই প্রথম কাউকে দেখে এত আকর্ষণ অনুভব করছে আশিয়ান।
আশিয়ানের বন্ধু ও কাজিনরা হুইস্কি, ওয়াইন এসব খেয়ে খেয়ে আড্ডা দিচ্ছে।তাই তার দিকে তেমন একটা নজর দিলো না ওরা।আশিয়ান ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে ঊদিতার ফটোর দিকে নেশালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।চোখ জোড়া আটকে আছে তার ঊদিতার কমলার কোয়ার মতো তুলতুলে রক্তলাল টসটসা ঠোঁটের দিকে।মনে উল্টো পাল্টা চিন্তাভাবনার তুফান বইছে তার।নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে।
এক নিঃশ্বাসে গ্লাসের সবটুকু ওয়াইন খেয়ে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের রুমে চলে এলো আশিয়ান।ফোনটা বিছানায় রেখে শুয়ে পড়লো।ঊদিতার কথা চিন্তা করতে করতে একসময় ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো সে।এই মুহূর্তে ইলিয়ানার কথা তার মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে।এই মুহূর্তে সে ভুলে গেছে তার অতীত জীবনের কালো অধ্যায়টাকে।ঊদিতাকে নিয়ে কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করেছে সে।
🍁🍁🍁
আজ শুক্রবার,,, আশিয়ান-ঊদিতা ও তাসকিন-আলেয়ার বিয়ে।সকাল থেকেই চৌধুরী হাউজে ভীষণ ব্যস্ততা।আশিয়ান প্রতিদিনকার মতো ব্যায়াম করে শাওয়ার নিয়ে ব্রেকফাস্ট সেড়ে ১২ টার দিকে জুম্মার নামাজ আদায় করতে গেল।আশিয়ানের দেখাদেখি বাকি ছেলেরাও বাসার কাছের মসজিদটাতে নামাজ পড়তে চলে গেল।
অন্যদিকে ঊদিতা সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে গোসল করে বিছানার ওপর মনমরা হয়ে বসে আছে।মিসেস আনিতা এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন।আজ তার কলিজার টুকরো তাকে ছেড়ে শ্বশুর বাড়িতে চলে যাবে।মায়ের কান্না দেখে ঊদিতাও নিজেকে সামলাতে পারলো না।ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো।
কাঁদতে কাঁদতে হিচকি তুলে ফেললো সে।চোখমুখ টকটকে লাল হয়ে ফুলে গেছে তার কান্না করতে করতে।উসামা ও শাহরিয়ার এসে মিসেস আনিতাকে ঊদিতার থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল।ঊদিতা মুখ ঢেকে একনাগাড়ে কান্না করে যাচ্ছে।শাহরিয়ার এসে ঊদিতাকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করতে লাগলো।ঊদিতার মাথায় চুমু দিয়ে কান্না থামাতে বললো।
নানাভাবে চেষ্টা করে ঊদিতাকে বহুত কষ্টে শান্ত করলো শাহরিয়ার।ঊদিতার কান্না দেখে উসামা,ঊষা,মিসেস লিমা,তানিয়া সবাই কান্না করছে লুকিয়ে।শাহরিয়ারেরও চোখজোড়া ছলছল করছে।বোনের জন্য তার নিজেরও গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।ঊদিতাকে নানানভাবে খুশি করার চেষ্টা চালাচ্ছে শাহরিয়ার।অবশেষে সফল হলো সে।পার্লার থেকে লোক আসায় শাহরিয়ার চলে গেল বাইরে।
মি.আনিসুল মেয়ের সামনে আসার সাহস পাচ্ছেন না।ঊদিতাকে দূর থেকে একপলক দেখে চোখ মুছে জুম্মার নামাজ পড়তে চলে গেলেন তিনি।মেয়ের কান্না দেখে তিনি নিজেও একদফা কান্না করেছেন রুমে ঢুকে।ওনার বড্ড আদরের মেয়ে ঊদিতা।কান্না করাটাই স্বাভাবিক।
পার্লার থেকে বিউটি শিয়ান আসায় ঊদিতা ওয়াশরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে ভালো করে ফ্রেশ হয়ে বিয়ের লেহেঙ্গা পড়ে এলো।অতঃপর শুরু হলো ব্রাইডাল মেকআপ করা।আলেয়ার রুমে আলেয়াকে সাজানো হচ্ছে।
সাজগোজ শেষে পুরোপুরি তৈরি হয়ে সবাই বিয়ের জন্য ঠিক করা কনভেনশন হলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো।সেন্টারে বরপক্ষের আগেই কনে পক্ষরা সবাই পৌঁছে গেলো।বেশ কিছুক্ষণ ফটোসেশান শেষে ঊদিতা আর আলেয়াকে আলাদা এক গেস্টরুমে বসানো হলো।
আশিয়ানরা জুম্মার নামাজ শেষে বাসায় এসে রেডি হয়ে গেল।আশিয়ান আজ টকটকে লাল রঙের গর্জিয়াস শেরওয়ানি পড়েছে।মাথায় পাগড়ি পড়ে নি সে মাথা গরম হয়ে ব্যথা করবে তার জন্য।শেরওয়ানির সাথে সাদা পাজামা ও লাল নাগড়াই জুতা পড়েছে সে।সারা শরীরে ব্রান্ডেড পারফিউমের সুঘ্রাণ আর হাতে এপল ব্রান্ডের ওয়াচ্।চুলগুলো হার্ড জেল দ্বারা একপাশে সেট করা।হাতে লেটেস্ট মডেলের আইফোন ও ভিভো ফোন।দুইটাই একসাথে ইউজ করে সে।
তাসকিনও সেইম গেটআপ কিন্তু কালার চেঞ্জ। যেমন আজ সে খয়েরী রঙের শেরওয়ানি পড়েছে।
সবাই রেডি হয়ে সেন্টারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো।আজ মিসেস ইয়াসমিন ভীষণ খুশি।তিনি আজ তাঁর কলিজার টুকরো ছেলের জন্য বৌ আনতে যাচ্ছেন।এরচাইতে খুশির আর কী হতে পারে!
প্রায় আধাঘন্টা পর ওরা সবাই সেন্টারে গিয়ে পৌঁছালো।আশিয়ানের গাড়ি আজ তার ড্রাইভার ড্রাইভ করেছে।সেন্টারে ঢুকার পর আশিয়ান ও তাসকিন গাড়ি থেকে নেমে এলো।ফটোগ্রাফাররা ব্যস্ত হয়ে পড়লো তাদের ফটো তুলতে।
বেশ অনেকক্ষণ ফটোসেশান শেষে ওরা কোনো রকম বাঁধা ছাড়াই সেন্টারের সদরদরজা দিয়ে প্রবেশ করলো।ভেতরে ঢুকতেই সেদিনের মতো আজও তাদের ওপর পার্টি স্প্রে ও ফুলের পাপড়ির বর্ষণ শুরু হলো।ওদের বাকি ছেলে কাজিন ও ভাইরা তাদের পিছে পিছে ভাব নিয়ে আসছে।সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদের দেখে পটানোর ধান্দায় একটু ভাব নিচ্ছে আরকি।আশিয়ান ও তাসকিন গিয়ে রাজকীয় দুই সোফায় বসলো।তাদের বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে ফটো তুলছে ফটোগ্রাফাররা।ওদের আত্মীয় স্বজনরাও এসে তাদের দুজনের সাথে ফটো তুলছে।কাজিনরা সবাই তাদের দুজনকে ঘিরে গ্রুপ ফটো তুলছে।
কনে পক্ষের মেয়েরা বারবার গিয়ে অকারণে ছেলেদের সামনে হাসাহাসি করছে।ছেলেদেরকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা মাত্র।ছেলেরাও সেই লেভেলের ফাজিল।তারাও মেয়েদের সাথে সমানতালে ফ্লার্ট করছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর ঊদিতা ও আলেয়াকে স্টেজে নিয়ে আসা হলো।ঊদিতাকে দেখতে পেয়ে আশিয়ান দাঁড়িয়ে পড়ে।আশিয়ানের দেখাদেখি তাসকিনও বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো।ঊদিতার পরনে সেই টকটকে লাল কালারের লেহেঙ্গা।সাথে লাল হিজাব ও লাল বড় নেকাব পড়েছে সে।মাথায় বড় ও অনেক সুন্দর স্বর্নের চ্যাপ্টা টায়রা,হাতে মোটা মোটা স্বর্নের বালা ও আঙ্গুলে আংটি।গলায় ডায়মন্ডের নেকলেস ও স্বর্নের হার।সাথে কিছুটা গর্জিয়াস মেকআপ সবকিছু মিলিয়ে তাকে অপরুপ লাগছে দেখতে।
আলেয়া তাসকিনের সাথে ম্যাচ করে খয়েরী রঙের সাদা স্টোনের কারুকাজ করা লেহেঙ্গা পড়েছে।চুলগুলো কার্ল করে একপাশে ছেড়ে রাখা।গহনাগাঁটিতে ভরপুর সারা শরীর তার।আর অতিরিক্ত মেকআপ করার ফলে অনেক সুন্দর লাগছে তাকে যদিও তার আসল ফেসটা বোঝার কুদরতই নেই।সাথে আছে পায়ে হাই পেন্সিল শুজ।এত স্টাইলিশভাবে সেজেছে সে, যে তা বলার মতো নয়।
ঊদিতা কাছে আসায় আশিয়ান তার হাত বাড়িয়ে দিলো ঊদিতার দিকে।ঊদিতা আশিয়ানের হাত ধরে স্টেজে ওঠে এলো।আলেয়াও তাসকিনের হাত ধরে স্টেজে ওঠলো।আশিয়ান ফটোগ্রাফারের কথা অনুযায়ী ঊদিতার কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে নিয়ে এলো।সুন্দর ভাবে পোজ নিয়ে দাঁড়াতেই ফটো তুলতে শুরু করলো ক্যামেরাম্যান।ভিন্ন ভিন্ন স্টাইলে ভিন্ন ভিন্ন এঙ্গেল থেকে ফটো তোলা হলো।ওদের সাথে একে একে সবাই এসে ফটো তুলতে লাগলো।
এত এত আলোর ঝলকানিতে ঊদিতা চোখে আঁধার দেখছে।আশিয়ান এখনো ঊদিতার কোমড় জড়িয়ে ধরে বসে আছে।ঊদিতা তো লজ্জায় কিছু বলতেও পারছে না।ঊদিতাকে সাথে নিয়ে আশিয়ান বিশাল বড় ওয়েডিং কেক কাটলো।তারপর আশিয়ান ঊদিতাকে হালকা ভাবে নেকাবটা একটু ওপরে তুলে একটুকরো কেক খায়িয়ে সাথে সাথে নেকাব নামিয়ে দিলো।ঊদিতাও আশিয়ানকে লজ্জায় নত হয়ে কেক খায়িয়ে দিলো।আত্মীয় স্বজন সবাইকে একপিস করে কেক খায়িয়ে দেয়া হলো।
বেশ কিছুক্ষণ পর কাজি সাহেবকে সাথে নিয়ে মি.মোরশেদ, মি.এনামুল,মি.আনিসুল,মি.গোলজার সহ আরও অনেক মুরব্বিরা এগিয়ে এলো তাদের দিকে।এবার বিয়ে পড়ানো হবে।ঊদিতা একটু নড়েচড়ে বসলো।ওনারা এগিয়ে এসে প্রথমে আলেয়া আর তাসকিনের বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন।কাজী সাহেব আলেয়াকে জিজ্ঞেস করলেন যে দেনমোহর হিসেবে সে কী চায়!একটু চুপ থেকে আলেয়া চিন্তা ভাবনা করে লজ্জায় নিচমুখ হয়ে জবাব দিলো তাকে দেনমোহর হিসেবে নগদ ৫০ লক্ষ টাকা দিতে হবে।তাসকিন রাজি হয়ে গেল।অতঃপর তিনকবুল বলে রেজিস্ট্রার পেপারে সাইন করে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হলো।
এবার আশিয়ান ও ঊদিতার বিয়ে পড়ানোর পালা।কাজী সাহেব ঊদিতাকে জিজ্ঞেস করলেন সে মোহরানা হিসেবে আশিয়ানের কাছ থেকে কী চায়!ঊদিতা একবার তার বাবা ও ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আস্তে কন্ঠে জবাব দিলো যে আশিয়ানের সামর্থ্য অনুযায়ী আশিয়ান যা-ই মোহরানা হিসেবে দিবে সে তাতেই খুশি।মেয়ের জবাব শুনে মি.আনিসুলের মনটা ভরে গেল।অবশেষে তাঁর দেয়া শিক্ষা সার্থক হয়েছে।ওনার ছেলেমেয়েরা ওনার মান রেখেছে।
আশিয়ান ঊদিতার কথা শুনে যারপরনাই বিস্মিত হলো।সে ভাবেও নি ঊদিতার উত্তর এমন হবে।আশিয়ান মনে করেছিলো আলেয়ার মতো ঊদিতাও সেইম কথাই বলবে।কিন্তু এটা সে মোটেও আশা করে নি।আশিয়ান গলা খাঁকারি দিয়ে ঊদিতাকে বাজিয়ে দেখার জন্য বললো;
আশিয়ান:-আমি যদি এখন তোমাকে ১০ হাজার টাকা দেনমোহর হিসেবে দেই তাহলে কী তুমি রাজী হবে?(জানতে চেয়ে)
ঊদিতা নেকাবের আড়ালে স্মিত হেসে শান্তকন্ঠে বলে উঠলো;
ঊদিতা:-মনে রাখবেন,আমি আপনাকে টাকার জন্য বিয়ে করছি না।আপনি আমাকে যদি দেনমোহর না দেন তাতেও আমার কিছু যায় আসে না।আর দেনমোহর হিসেবে ১০ হাজার টাকা কিন্তু মন্দ নয়।আপনি আমাকে খুশি হয়ে যা দিবেন তাতেই আমি খুশি।দেনমোহর হিসেবে বেশি টাকা তারাই চায় যারা সন্দেহ করে যে তাদের স্বামী তাদের যে কোনো মুহূর্তেই ছেড়ে দিতে পারে।নিজের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য তারা এমনটা করে।কিন্তু আমি মনে করি আমার আল্লাহ আমার জন্য ভালো কিছুই নির্ধারণ করে রেখেছেন।আর বিয়েতে বেশি টাকা দেনমোহর নির্ধারণ করা একটা ট্রেডিশন হয়ে গেছে যা মোটেও ঠিক নয়।আমাদের উচিত আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা।তাই আপনি আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী যা দিবেন এতেই আমি সন্তুষ্ট।আশা করি বুঝতে পেরেছেন।
আশিয়ান একদৃষ্টিতে ঊদিতার দিকে তাকিয়ে কাজীকে বললো দেনমোহর হিসেবে ১ কোটি টাকা ও একটা ডুপ্লেক্স বাসা লিখতে।ঊদিতা অবাক হয়ে গেছে আশিয়ানের কথা শুনে।ঊদিতা কিছু বলতে গেলে আশিয়ান তাকে থামিয়ে দিলো।কিছু বলার সুযোগ দিলো না সে ঊদিতাকে।আশেপাশের সবাই হতবাক আশিয়ানের কথা শুনে।
কাজী সেই অনুযায়ী তাদের দুজনের বিয়ে পড়াতে লাগলেন।প্রথমে ঊদিতাকে কবুল বলার কথা বলা হলো।ঊদিতা একটু নিরব থেকে শাহরিয়ারের দিকে একবার তাকালো।শাহরিয়ার ঊদিতাকে আশ্বস্ত করে ইশারায় কবুল বলতে বললো।ঊদিতা একবার তার বাবা,মা ও বোনের দিকে তাকিয়ে আস্তে ধীরে তিন কবুল বলে সাইন করে ফেললো।আশিয়ানকে কবুল বলতে বললে আশিয়ান একবার মিসেস ইয়াসমিন ও একবার ইলিয়ানার দিকে তাকিয়ে এক নিঃশ্বাসে তিন কবুল বলে রেজিস্ট্রার পেপারে সাইন করে দিলো।ব্যস ঊদিতা ও আশিয়ানের বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেল।সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলেন খুশিতে।সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো হলো এবং খেজুর খেতে দেয়া হলো।
বিয়ে পড়ানো শেষে সবাই খেতে বসলো।আশিয়ান ও ঊদিতার খাওয়ার জন্য আলাদা রুমে নিয়ে যাওয়া হলো।আশিয়ানের খেতে ইচ্ছা করছে না তারপরও মায়ের জোরাজুরিতে খেতে হচ্ছে। আশিয়ান আর ঊদিতার জন্য আলাদা করে খাবার দিয়ে আসা হলো।আশিয়ান নিজহাতে খাচ্ছে আর ঊদিতাকে মিসেস আনিতা মুখে তুলে খাবার খায়িয়ে দিচ্ছেন।
সবার খাওয়া দাওয়া শেষে লাস্ট টাইমে আরো কিছুক্ষণ ফটোসেশান করে সন্ধ্যার দিকে বাসায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো সবাই।মিসেস আনিতা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে একাধারে কান্না করছেন।কোনোমতেই তাকে থামানো যাচ্ছে না।কনেপক্ষের প্রায় সবার চোখে পানি।এরকম হৃদয়বিদারক মুহূর্তে যে কারও চোখে পানি আসতে বাধ্য।আপনজন ও বাবা মাকে ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি অর্থাৎ অচেনা একটা জায়গায় যেতে কী যে কষ্ট তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই বুঝতে পারবেন।প্রত্যেকটা মেয়ের জন্য এই সময়টা খুবই কষ্টের।
ঊদিতা তার ভাইকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কান্না করছে।শাহরিয়ার তাকে একটুও শান্ত করতে পারছে না।শাহরিয়ারের চোখ থেকেও ক্রমাগত পানি পড়ছে।আদরের বোনটা আজ চোখের সামনে থেকে দূরে চলে যাবে।চাইলেও আর যখন তখন দেখতে পারবে না। এরথেকে কষ্টের আর কী হতে পারে!
শাহরিয়ারকে ছেড়ে একে একে সবাইকে জড়িয়ে ধরে অবশেষে নিজের বাবার কাছে এসে ঝাপটে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে ওঠলো ঊদিতা।ঊদিতার কান্না দেখে মি.আনিসুল ও কেঁদে ফেললেন।ওনার কলিজা মনে হচ্ছে কেউ ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে। এত কষ্ট কেন হচ্ছে আজ?
আশিয়ান এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলো সব।সে এগিয়ে এসে মি.আনিসুলকে শান্তনা দিতে লাগলো।মি.আনিসুল একদিকে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আরেকদিকে আশিয়ানকে জড়িয়ে ধরলেন।ক্রন্দনরত কন্ঠে বললেন;
মি.আনিসুল:-আমার মেয়েটা অনেক ক্ষেত্রে বোকাসোকা বাবা।ওকে আমি বাইরের জগৎ সম্পর্কে বেশি কিছু জানতে দিই নি কখনো।সবধরনের কলুষতা থেকে ওকে আমি বাঁচিয়ে রেখেছি।অনেক আদরের মেয়ে আমার।তুমি ওকে দেখে রেখো বাবা, আমি একমাত্র তোমার ওপর ভরসা করে আমার মেয়েটাকে তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি।আমার মেয়েটাকে কখনো কষ্ট পেতে দিয়ো না।আগলে রেখো তাকে।ভুল করলে বুঝিয়ে দিয়ো।তোমার কাছে আমার অনুরোধ।
আশিয়ান বিনীত কন্ঠে বললো;
আশিয়ান:-এমন করে বলবেন না বাবা।আমি ঊদিতাকে সবসময় দেখে শুনে রাখবো।ওকে কখনো কষ্ট পেতে দিবো না।আপনি চিন্তা করবেন না প্লিজ।আমি আছি ওর সাথে।
মি.আনিসুল আশিয়ানের হাতের ওপর ঊদিতার হাত রাখলেন।আশিয়ান শক্ত করে ঊদিতার হাত ধরলো।ঊদিতার পরিবারের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঊদিতাকে জোর করে গাড়িতে তুললো সে।ঊদিতা তার বাবা ও ভাইয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে ক্রন্দনরত কন্ঠে বললো সে তাদেরকে ছেড়ে যাবে না।সে তাদেরকে ছেড়ে থাকতে পারবে না।এসব বলে কান্না করতে লাগলো সমানতালে।
আলেয়া দু ফোঁটা চোখের পানি ফেলেই শেষ। আর বেশি কান্নাকাটি করে নি সে।তার মেকআপ যদি এখন নষ্ট হয়ে যায় তাহলে প্ল্যান অনুযায়ী বাসর ঘরে ফটোগ্রাফি করতে পারবে না সে।তাই সে আর কান্না করে নি।এদিকে তারই পরিবারের লোকজন মরাকান্না জুড়ে দিয়েছে তার জন্য।আলেয়ার ভীষণ বিরক্ত লাগছে এসব।কখন যে ও বাড়িতে যাবে সেই চিন্তায় ব্যস্ত সে।
অবশেষে সবাই গাড়িতে উঠলো চৌধুরী হাউজে যাওয়ার জন্য।অতিথিরা সবাই বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।আশিয়ানের গাড়ির পিছনের সিটে আশিয়ান ঊদিতাকে নিয়ে বসেছে।ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চালাতে শুরু করলো।ঊদিতা কান্না করতে করতে একসময় সেন্সলেস হয়ে হয়ে আশিয়ানের বুকে লুটিয়ে পড়লো।আশিয়ান ঊদিতাকে নিজের আরও কাছে টেনে এনে ঊদিতার নেকাব তুলে ফেলে।ঘেমে-নেয়ে লাল হয়ে গেছে ফর্সা মুখটা।আশিয়ান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঊদিতার দিকে।এ দেখার যেন শেষ নেই।
(ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।এবং আজকের পার্ট পড়ে কার কেমন লাগলো সবাই কমেন্ট ও রিয়েক্টের মাধ্যমে জানাতে ভুলবেন না কিন্তু।আমি আপনাদের সবার মন্তব্য পড়ে এখন শর্টকাটে সব বুঝিয়ে দিয়েছি।এতে যদি কারও বুঝতে অসুবিধা হয় তাহলে আমার কিছু করার নেই।ডিটেইলসে লিখতে আমারও মহা বিরক্ত লাগে।তবুও আপনাদের যদি বুঝতে সমস্যা হয় সেই ভেবে এতদিন ডিটেইলসে দিয়ে আসছি।যাইহোক, অনেকে বলছেন আশিয়ানের সাথে ঊদিতার যায় না,, তাদেরকে বলছি দুনিয়ায় সবাই সবার জন্য পারফেক্ট হয়ে আসে না।আশিয়ানের অনেক ক্ষেত্রে বদ স্বভাব আছে,,ঊদিতা তো এখন বিয়ে করে আশিয়ানের বউ হয়ে এসে গেছে এবার দেখবেন আশিয়ানকে কীভাবে সে পরিবর্তন করে!সবে তো শুরু,,,এনিওয়ে,, হ্যাপি রিডিং গাইজ ❤️ )
চলবে…🍃

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here