#তোমাতে বিলীন🍁
#লেখিকা—আমায়া নাফশিয়াত ☘
#পর্ব—|| ১৪ ||
বাসায় পৌঁছে আশিয়ান গাড়ি নিয়ে গ্যারেজে রেখে গ্যারেজ তালা মেরে সোজা বাসার ভেতরে প্রবেশ করলো।ওর পিছনে মাহবুব সবগুলো শপিং ব্যাগ নিয়ে আসছে।আশিয়ান রুমে গিয়ে দরজা মেলে ধরতে মাহবুব সবগুলো শপিং ব্যাগ সোফার ওপর রেখে আশিয়ানকে সালাম দিয়ে চলে গেল।মাহবুব চলে যেতেই আশিয়ান শার্ট খুলে বিছানায় ছুড়ে মারলো।আশার ওপর তার মেজাজ এত খারাপ হয়েছে যে ওই মেয়েটাকে এখন কাছে পেলে নির্ঘাত সে মার্ডার করে ফেলবে।সাহস কত বড় মেয়েটার, এত শাসানোর পরেও বেহায়ার মতো এটা কী করলো!
রাগের চোটে আশিয়ান ওয়াশরুমে চলে গেল শাওয়ার নিতে।এই মুহুর্তে নিজেকে কন্ট্রোল করা প্রয়োজন নয়তো খারাপ কিছু ঘটিয়ে ফেলবে।গোসল করলে মাথা কিছুটা হলেও ঠান্ডা হবে।
এদিকে,
তারিন আর আশা ওরা দুজন মন খুলে হাসছে আশা যে রুমে থাকছে সেই রুমে বসে।তারিন হাসি থামিয়ে আশাকে বললো;
তারিন:-তোমার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়,,কী কাজটাই না করলে তুমি! একদম কেল্লাফতে করে দিয়ে এসেছো।
আশা:-ওই ক্ষ্যাত মেয়েকে তো আমি দেখে নেবো। সাহস কত আশিয়ানকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবে।এতই সোজা! হাহ্,,চেনে না তো আমাকে এখনো,, এই আশা কী চিজ!(হম্বিতম্বি দেখিয়ে)
তারিন:-যে বিষ ওর কানে ঢেলে দিয়ে এসেছো নির্ঘাত ওর বাপ ভাই কালকেই বিয়েটা ভেঙে দেবে দেখো।সো এত চিন্তা না করে লেটস চিল,,,সবশেষে তুমিই আশিয়ানের বউ হবে দেখে নিও।(স্বান্তনা দিয়ে)
আশা:-হুম মাই ডিয়ার সুইট ভাবী।মেনি মেনি থ্যাংকস আমাকে এত সাপোর্ট করার জন্য।তুমি না থাকলে জীবনেও এসব করতে পারতাম না আমি।
তারিন:-দুর বোকা মেয়ে,, তুমি তো আমার বোনের মতোন।তোমাকে আমি আশিয়ানের বউ হিসেবে মনে প্রাণে চাই এজন্যই তো এত সাপোর্ট করি।আচ্ছা এখন চলো নিচে যাই।বেশি সময় এখানে থাকলে যে কেউ সন্দেহ করে বসবে।
আশা:-হ্যা ভাবী চলো।
এই বলে দুজন রুম থেকে বেরিয়ে নিচে চলে এলো।বাকিরা সবাই ড্রয়িং রুমেই বসে আছে।বাকি যতো তথ্য সাজানোর বাকি ছিলো তা সব আজকেই সম্পন্ন করা হচ্ছে।কাল সকালে সেসব ও বাড়িতে পাঠানো হবে।আশা আর তারিনও এসে হেল্প করছে হাতে হাতে।
আশিয়ান নিচে এসেই আশার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো।হুট করে আশিয়ানকে এভাবে সামনে আসতে দেখে আয়শা ভয়ে শুকনো ঢোক গিললো।আশিয়ান তার হাতদ্বয় টাউজারের পকেটে ঢুকিয়ে গমগমে গলায় বলে উঠলো;
আশিয়ান:-আমার ব্যাপারে ঊদিতার কাছে কী লাগিয়েছো তুমি?
আশা ভরকে গেল আশিয়ানের কথা শুনে। সে বুঝতে পারছে না যে আশিয়ান এ কথা জানলো কী ভাবে!ও যখন ঊদিতাকে এসব কথা বলে তখন তো আশিয়ান ঊদিতার ধারে কাছেও ছিলো না! তবে?
আশা ভাবতে পারলো না তার আগেই আবারও আশিয়ান বলে উঠলো;
আশিয়ান:-কী হলো? মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছো কেন?কী বলেছো বলো?(রাগী কন্ঠে)
আশা আমতা আমতা করে বললো;
আশা:-ক,,কই আমি কিছু,,ব,,বলি নি তো!কীসের কথা ব,,বলছো তুমি? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না!
আশিয়ান:-তাই?আমি কীসের কথা বলছি তা তুমি বুঝতে পারছো না!রিয়েলি?(তাচ্ছিল্য করে)
আশা:-দে,,দেখাে,,আমি তোমার হবু বউকে কি,,কিছু বলি নি।ত,,তুমি শুধু শুধু সন্দেহ করছো আমায়!(তোতলানো স্বরে)
আশিয়ান:-আচ্ছা মানলাম আমি হুদাই সন্দেহ করছি!তাহলে তুমি কথা বলতে গিয়ে এত তোতলাচ্ছ কেন?আর এই এসির বাতাসের মধ্যেও ঘেমে যাচ্ছো কেন?আমি কী এমন জিজ্ঞেস করেছি যে তুমি এত ভরকে যাচ্ছো?(তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে)
আশার মুখ থেকে ঠিক মতো কথাও বের হচ্ছে না।খুব বেশিই ভরকে গেছে সে আশিয়ানের জেরা করায়।আশার নিরবতা দেখে আশিয়ান দাঁতে দাঁত চেপে রাগত স্বরে বলে উঠলো;
আশিয়ান:-তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি জাস্ট।গতকালকের থ্রেড তুমি সিরিয়াসলি নাও নি এজন্যই আজকে এরকম সাহস দেখালে।তাই না?
মি.মোরশেদ গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন;
মি.মোরশেদ:-তুমি ওর ওপর এত রেগে আছো কেন?কী করেছে ও আশিয়ান?
আশিয়ান:-কী করেছে এটা তোমার বন্ধুর অসভ্য মেয়েকেই জিজ্ঞেস করো পাপা।আজ পর্যন্ত কেউ আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে না।সেখানে এই মেয়ে আমার বিষয়ে খারাপ কথা বলে আমার বিয়ে ভাঙার চেষ্টা করেছে।যদিও যাকে এসব কথা বলেছে সে মোটেও ওর কথা বিশ্বাস করে নি।(তাচ্ছিল্য হেসে)
আশা এবার অবাক হয়ে আশিয়ানের দিকে তাকালো।কী বলছে আশিয়ান এসব?ঊদিতা তার কথা বিশ্বাস করে নি?কিন্তু ও যা বলে এসেছে তাতে তো সাথে সাথে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার কথা! তাহলে এটা কী থেকে কী হলো?আশার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।
আশিয়ান আবারও বললো;
আশিয়ান:-তোমার মতো বেহায়া মেয়ে আমি আজপর্যন্ত একটাও দেখি নি।কী করে এত নটাংকিপনা করো?আমাকে ভয় লাগে না তোমার?আমি চাইলে ঠিক কী কী করতে পারি তোমার সাথে তার কি কোনো ধারণা আছে?শুধু মাত্র পাপার বন্ধুর মেয়ে বলে তোমায় আমি বারবার ছাড় দিচ্ছি।নয়তো কবেই তোমাকে এমন টাইট দিতাম যে তুমি ভয়ে আমার ছায়াও মাড়াতে না।আজকে একদম লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি তোমায়,,আমার পেছনে জোঁকের মতো লেপ্টে থাকা বন্ধ করো।তা নাহলে তোমাকে আমার পাওয়ার ভালো করে দেখিয়ে দিবো।মেরে লাশ গুম করে দিলেও কেউ টের পাবে না,,, মাইন্ড ইট।
সরাসরি হুমকি দিয়ে আশিয়ান গটগট শব্দ তুলে সিড়ি বেয়ে নিজের রুমে চলে গেল। আশা ভয়ে একদম ঘেমে-নেয়ে গেছে।খুন করার কথা শুনতেই তার কলিজার পানি শুকিয়ে গেছে।বাকিরা ছি ছি করছে আশাকে।তারিন একদম চুপ করে আছে।সে যদি এখন আয়শার পক্ষ নিয়ে কথা বলে তাহলে সবাই তার দিকেই আঙ্গুল তুলবে।একটা প্রবাদ আছে না,,যে, চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। তারিনের ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই ঘটেছে।
সবার এতো এতো ছি ছি আর ধিক্কার সহ্য করতে না পেরে আশা নিজের রুমে চলে গেল।মনে মনে ঠিক করে ফেললো আর আশিয়ানের সাথে পাঙ্গা নিতে যাবে না। পরে দেখা গেল এসব করতে গিয়ে প্রাণটাই খুয়িয়ে বসে আছে! না থাক বাবা,, দরকার নেই এসবের,,বেঁচে থাকলে আশিয়ানের থেকে ভালো কাউকে পাওয়া যাবে।
🌷🌷🌷
আশিয়ান রুমে এসে সোজা বারান্দায় চলে গেল।ওখানে সুইমিংপুলের সামনে রাখা রকিং চেয়ারে বসে দোল খেতে লাগলো সে একমনে।কিচ্ছু ভালো লাগছে না তার।দুনিয়ার সবকিছুই বিষাক্ত মনে হচ্ছে তার কাছে এই মুহুর্তে।দুনিয়াটা কেন এত কঠিন?পৃথিবীর অনেক মানুষ তার ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাচ্ছে।অথচ তার কপাল এত খারাপ কেন হলো!সেও তো নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পেতে চেয়েছিলো।তাহলে কেন সে পেল না?কেন তার মন জুড়ে এত হাহাকার!
ক্লান্তিতে চোখ মুদে আলতো ভাবে দোল খেতে লাগলো আশিয়ান। একহাত দিয়ে মাথা টিপে ধরে রেখেছে সে।এ জীবনে সুখ কী আর ধরা দেবে তার কাছে?জানে না সে!
বেশ কিছুক্ষণ পর মিসেস ইয়াসমিন খাবার নিয়ে আশিয়ানের রুমে চলে এলেন।আশিয়ানকে সযত্নে মুখে তুলে খাবার খায়িয়ে দিয়ে তাকে ঘুমাতে বলে ফের চলে গেলেন তিনি।আশিয়ান মন ভালো করার জন্য রুমের বড় দেয়ালের সাথে লাগোয়া টিভিটা অন করলো।অতঃপর আধশোয়া হয়ে তামিল রোমান্টিক প্লাস একশান মুভি একটা দেখতে লাগলো সে।মুভি দেখতে দেখতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাে টেরই পেলো না।
🍂🍂🍂
পরদিন সকাল ১১ টার দিকে মিসেস ইয়াসমিন, কেয়া ও তামজিদ আলেয়াদের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন বিয়ে ও এনগেজমেন্টের সব তথ্য দিতে।ওখানে গিয়ে সব তথ্য দিয়ে ফিরতে ফিরতে প্রায় দুপুর সাড়ে বারোটা বেজে গেছে।বাসায় এসে দেখলেন ওনার ভাই-বোন তাদের পরিবারের সবাইকে নিয়ে হাজির।
মিসেস ইয়াসমিন ও মিসেস তারানার পরিবার থেকেও লোকজন সবাই হাজির।মি.মোরশেদের কাজিনরাও তাদের পরিবার নিয়ে বিকালে এসেছেন।কেয়া ও তারিনের পরিবারের সবাই ও এসে পড়েছেন।সন্ধ্যার দিকে আশার বাবা মা ও এসে পড়লেন।আশিয়ান ও তাসকিনের বন্ধু বান্ধব সবাই হাজির।সারা বাড়ি জুড়ে উৎসব উৎসব ভাব।বাচ্চা কাচ্চা জোয়ান বুড়ো সবার চেঁচামেচিতে আর হইহট্টগোলে মনে হচ্ছে যেন এটা কোনো মাছ বাজার।
আশিয়ান এত হৈ-হুল্লোড় সহ্য করতে না পেরে সে তার রুম লক করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো।সাথে তার প্রাণ প্রিয় বন্ধু তৌহিদ আর আসিফও ছিলো।তাদেরকে সাথে নিয়ে সে হাতিরঝিলে চলে এসেছে।সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হতে যাচ্ছে,,। চারিদিকে কৃত্রিম আলোয় সারা হাতিরঝিল ঝকমক করছে।ঝড়ো হাওয়ার মতোন বাতাস বইছে এখানে।ওদেরকে সাথে নিয়ে একটা নিরিবিলি জায়গায় বসে তাদের সাথে আড্ডা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে। তিন বন্ধু যেন আগের সেই প্রাণোচ্ছল ভার্সিটি লাইফে ফিরে গেছে।
🌿🌿🌿
ঊদিতা এখন বেশিরভাগ সময়ই তার রুমে কাটায়। তার কারণ আত্মীয় স্বজনের আসার কারণে বাসাটা পুরো ফার্মে পরিনত হয়েছে।এত ঝামেলা ঊদিতা পছন্দ করে না।এরমাঝে তাদের আত্মীয়দের মধ্যে ছেলে কাজিনই বেশি।এত এত ছেলে একসাথে দেখার পর ঊদিতা একপ্রকার ঘরবন্দী হয়ে পড়ে আছে।একমাত্র খুব ভোরেই যখন কেউ ঘুম থেকে ওঠে না তখন সে বাইরে বেরোয়।নয়তো অতি প্রয়োজন ছাড়া তো মোটেই নয়।
নিজের রুমে বসে আশিয়ানের কিনে দেয়া চকোলেট খায় আর মনে মনে আশিয়ানের কথা চিন্তা করে সে।এটাই যেন অভ্যাস হয়ে দাঁড়াচ্ছে ঊদিতার।হুট করে মনের মধ্যে আশিয়ানের জন্য একপ্রকার ভালোলাগা সৃষ্টি হয়েছে তার।সে বুঝতে পারে না আসলে এটা কেমন অনুভূতি!এরই মধ্যে তার ভাবীরা তাকে সাংসারিক জীবনের সমস্ত খুটিনাটি বিষয় তাকে শেখাতে ব্যস্ত হয়ে গেছেন।মাঝে মধ্যে কিছু আপত্তিকর কথাও তারা বলে ঊদিতাকে এসব শুনে ঊদিতা মনে মনে কিছুটা ভরকে যায়।তার জীবনে অশ্লীলতা নামটাও কখনো শুনার ভাগ্য হয়নি এখানে তার ভাবীরা তাকে এসব কী শেখাতে আসছেন!
তাও ঊদিতা নিজেকে সামলে নিয়ে তাদের কথা বুঝদারের মতো বুঝার চেষ্টা করে।উসামা আর তানিয়া ওরা জানে ঊদিতা এসমস্ত কথাবার্তা জীবনেও কখনো শুনে নি তারপরও তারা তাকে সুন্দর ভাবে বুঝাতে ব্যস্ত।ঊদিতা মনে মনে ভাবে তার স্বামী অর্থাৎ আশিয়ানও কী অন্যান্য স্বামীদের মতো তার ওপর সবসময় জোরজবরদস্তি করবে নাকি ভালোবেসে সবসময় আগলে রাখবে?ঊদিতার ছোট্ট মাথায় শুধু এসব চিন্তা ভাবনাই ঘুরপাক খায়।
মাঝেমধ্যে আলেয়ার বলা স্বামীদের ব্যাপারে নেগেটিভ কথা শুনে ঊদিতা মনে মনে ভীষণ ভয় পেয়ে যায়।আর একা রুমে বসে কান্না করে।আলেয়ার এসব কথা শুনে মনে মনে আফসোস করে “ইশশ,,,এখন বিয়েটা না করলে বোধহয় ভালোই হতো”!!
এসব আবোল তাবোল চিন্তা করতে করতেই ঊদিতার দিন যায় রাত আসে।অবশেষে কাঙ্ক্ষিত এনগেজমেন্টের দিন চলেই এলো।
সকাল থেকেই আলেয়াদের বাসায় জমজমাট পরিস্থিতি।বিকেলের শেষ ভাগে কনভেনশন হলে এনগেজমেন্ট অনুষ্ঠান শুরু হবে।আশিয়ান ঊদিতার জন্য অর্ডার দিয়ে বানিয়ে বড় নেকাব পাঠিয়ে দিয়েছে।ঊদিতা সকাল থেকেই গুম হয়ে বসে আছে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না তার। কেমন জানি তার বুকে দ্রিম দ্রিম আওয়াজে ঢোল পিটাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা।আশিয়ান চিরকুটের মাধ্যমে এও জানিয়েছে যে ঊদিতা যাতে খুব হালকা পার্টি মেকআপ করে।কারণ আশিয়ান চায় না তার হবু বউ অতিরিক্ত মেকআপ করে নিজের ন্যাচারাল লুক লুকিয়ে ফেলুক।
দুপুরের দিকে ঊদিতা গোসল শেষ করে বিছানার ওপর বসে রইলো।মিসেস আনিতা এসে মেয়েকে মুখে তুলে খাবার খায়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গেলেন।
ঊদিতার সামনে বিছানায় এখন এনগেজমেন্টের জন্য কেনা ভারী লেহেঙ্গা, গয়নাগাটি,দোপাট্টা, হিজাব, নেকাব,জুতা মেকআপের সব সরঞ্জাম পড়ে আছে। ঊদিতার বুকের ভেতর উথাল পাথাল হাওয়া বইছে। উসামা এসে ঊদিতাকে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিয়েছে লেহেঙ্গা পড়ে আসার জন্য।ঊদিতা মিনিট দশেক পর লেহেঙ্গা পড়ে বের হলো।ঊদিতাকে হাটু অবধি চুল ছাড়া নরমাল অবস্থায়ই অনেক বেশি কিউট লাগছে।উসামা মনে মনে মাশাআল্লাহ বলে উঠে।কারণ তার সামনে এখন ছোট্ট একটা কিউট পরি দাঁড়িয়ে আছে।
ঊদিতাকে হিজাব পড়া অবস্থায় দেখলে মনে হয় তরুণী আর যখন সে চুল ছেড়ে রাখে তবেই তখন তাকে বাচ্চা বাচ্চা লাগে।তার বয়সটা তখনই একমাত্র বোঝা যায়।
ঊদিতা লেহেঙ্গা পড়ে আসার পর পার্লারের একজন মহিলা এসে ঊদিতাকে সাজাতে শুরু করলেন।উসামা মহিলাটিকে বলে দিয়েছে কীভাবে সাজাতে হবে। মহিলাটি সেই অনুযায়ী তাকে সাজাচ্ছে।এই মহিলাটিকে আশিয়ানই পাঠিয়ে দিয়েছে একান্ত ঊদিতাকে সাজানোর জন্য।
আলেয়াকে তার নিজের রুমে অন্য এক মহিলা সাজাচ্ছেন। আলেয়া তো সবচাইতে গর্জিয়াস লুকে সাজানোর কথা মহিলাকে বলে দিয়েছে। মহিলা এখন সেই অনুযায়ী তাকে সাজাচ্ছে।
ঊদিতাকে সাজাতে আধাঘন্টার বেশি লাগে নি। সাজানো শেষে ঊদিতাকে ভারী ভারী গহনাগুলো পড়িয়ে দিয়ে হিজাব বেঁধে দিলো মহিলাটি।উসামা, ঊষা,তানিয়া ওরা শুধু অবাক চোখে ঊদিতাকে দেখে যাচ্ছে।যে মেয়েকে সাজগোজ ছাড়াই পরীর মতো লাগে সেই মেয়ে যখন এত সুন্দর মেকআপ করে তখন তাকে দেখতে তো সত্যিই আশ্চর্যের ব্যাপার মনে হয়!এখন এই অবস্থায় ঊদিতাকে যদি কোনো ছেলে দেখতে পেত তাহলে নির্ঘাত সেই ছেলেটা ঊদিতার জন্য পাগল হয়ে যেত।
একদম পুরোপুরি সাজ কমপ্লিট করে ঊদিতা নিজের রুমে বসে রইলো।আর মহিলাটি তার কাজ শেষ করে চলে গেল।বাসার সবাই সাজগোজ করতে ব্যস্ত।আলেয়ার তো এখনো মেকআপ করা অর্ধেকও শেষ হয়নি।
এদিকে,
আশিয়ান নিজের রুমে স্যুটকোট পড়ে একদম ফুলবাবুটি সেজে বসে আছে।এই মুহূর্তে সে ফোন স্ক্রল করতে বিজি।তার রুমে তার ফ্রেন্ড তৌহিদ আর আসিফ যার যার বাচ্চাদের কোলে নিয়ে বসে বসে কোক খাচ্ছে।তাদের বউরা সাজুগুজু করায় ব্যস্ত।আর বাচ্চাদের ওরা সামলাচ্ছে।তাদের কাছে এখন বিয়ে করা মানেই প্যারা ছাড়া আর কিছু মনে হয় না।আশিয়ান বর্তমানে এসব ভেজালে নেই তবে খুব শীঘ্রই পড়তে যাচ্ছে।
সবার রেডি হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল।আশিয়ান তার নিজের গাড়ি একাই ড্রাইভ করে কনভেনশন হলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। বাকিরা অন্যান্য গাড়ি করে আসছে।সবার আগে আশিয়ানের গাড়ি গিয়ে কনভেনশন হলের মেইন ফটক দিয়ে ঢুকলো।আত্মীয় স্বজন ও সকল অতিথিরা আগেই এসে পড়েছে।
আশিয়ানের গাড়িটি দেখা মাত্রই মিডিয়ার লোকজন ঘিরে ধরলো। আশিয়ানের বডিগার্ডরা এসে মিডিয়ার লোকজনকে দূরে ঠেলে দিয়ে আশিয়ানকে গাড়ি থেকে বের হতে সাহায্য করলো।বডিগার্ডরা আশিয়ানকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।আশিয়ানের গাড়ির পিছু পিছু তাসকিনের গাড়িটাও এসে ঢুকলো।একে একে আশিয়ানের পরিবারের সবাই এসে হাজির।তাসকিন আর আশিয়ানের বেশ কিছুক্ষণ ফটোসেশন চললো।তারপর আশিয়ান মারাত্মক এটিটিউট নিয়ে কনভেনশন হলের সদরদরজা লক্ষ্য করে হেঁটে যাচ্ছে।তাসকিনও তার পাশে আছে।
কনভেনশন হলের ভেতর ঢুকতেই তাদের ওপর গোলাপ ফুলের পাপড়ি ও পার্টি স্প্রের তুমুল বর্ষন শুরু হলো।তাদের দুজনের পিছু পিছু বাকিরাও ঢুকছে।জানা গেল ঊদিতা ও আলেয়া প্রায় মিনিট পনেরো আগেই চলে এসেছে।তারা এখন একটা গেস্ট রুমে বসে আছে।চারিদিকে রোমান্টিক সফট মিউজিক বাজছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর আলেয়া ও ঊদিতাকে মেইন হলে নিয়ে আসার তোরজোর শুরু হলো।আশিয়ান তখন তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন ও নামীদামী ব্যক্তিবর্গের সাথে আলাপে ব্যস্ত।
হঠাৎ মিউজিক পরিবর্তন হলো,,চারিদিকে তখন আরাশ আর হেলেনার গান শুরু হয়েছে।ঠিক তখনই আশিয়ানের নজর পড়লো এক অদ্ভুত মুগ্ধময়ী রমণীর ওপর।যে কিনা আশিয়ানের কিনে দেয়া সেই লেহেঙ্গা, হিজাব ও নেকাব পড়ে নিজেকে পরিবেষ্টিত করে রেখেছে।
“ফ্লাই উইথ মি,,
লাইক এ রেইনবো, বাটারফ্লাই!
কিস মি এন্ড আই উইল সিঙ,,
দি এঞ্জেলস লালাবাই….
ঊদিতার পদচারণে যেন চারপাশ মুখরিত হয়ে ওঠলো।ঊদিতার পাশে আলেয়াও ছিলো।তবে বেশিরভাগ মানুষের নজরই ঊদিতার দিকে।ঊদিতার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আশিয়ান।বুকের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে তার।এ কেমন অনুভূতি?
” ওয়ান্ট টু বি এলাইভ উইথ মি
লাইক এ রেইনবো, বাটারফ্লাই
বিলিভ এন্ড ইউ উইল সি
অল দ্যা কালারস ইন দ্যা স্কাই!! ”
ঊদিতার পরনে রয়্যাল ব্লু কালারের মধ্যে চেরি কালার স্টোনের গর্জিয়াস কারুকাজ করা লেহেঙ্গা ফোর কোয়ার্টার হাতা দেয়া টপস।সাথে রয়্যাল ব্লু কালারের হিজাব ও নেকাব।সাথে আছে স্বর্নের গহনাগাঁটি ও লেহেঙ্গার সাথে ম্যাচিং করা হিল জুতা।অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে এই রূপে দেখতে যদিও তার মুখটা নেকাবের আড়ালে লুকায়িত।ওদের ফটো ক্যাপচার করতে ব্যস্ত ফটোগ্রাফাররা।
এমনসময় আশিয়ানের নজর পড়লো ইলিয়ানা ও আসাদের ওপর।তাদের দেখে কুটিল হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে।ইলিয়ানা মুখ ভার করে তাকিয়ে আছে আশিয়ানের দিকে।সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে আশিয়ান অন্য কাউকে বিয়ে করতে যাচ্ছে।
ইলিয়ানাকে আরও বেশি করে জ্বালাতে আশিয়ান ঊদিতার দিকে এগিয়ে গিয়ে মুচকি হেসে একহাত বাড়িয়ে দিলো।ঊদিতা একবার আশিয়ানের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো লজ্জায়।আশেপাশে সবার কথা শুনে ঊদিতাও হাত বাড়িয়ে আশিয়ানের হাতের ওপর হাত রাখলো।আশিয়ানের দেখাদেখি তাসকিনও গিয়ে আলেয়ার হাত ধরে এগিয়ে স্টেজে আসতে লাগে।আশিয়ান ঊদিতাকে নিয়ে স্টেজে আসার পর এনা তাদের এনগেজমেন্ট রিং গুলো একটা বড় রাজকীয় থালায় করে নিয়ে এলো।স্টেজে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে তাশজিদ ও তাজিম তাদের এনগেজমেন্টের ব্যাপারে অনেককিছু বলছে সবাইকে লক্ষ্য করে।
এনা নীল রঙা মখমলের কাপড় সরিয়ে রিং গুলো বের করলো।প্রথমে ঊদিতা ও আলেয়াকে ইশারা করা হলো আশিয়ান ও তাসকিনকে রিং পরিয়ে দেয়ার জন্য।ঊদিতা কাঁপা কাঁপা হাতে রিংটা তুলে নিয়ে আশিয়ানের বাম হাতের অনামিকা আঙ্গুলে পরিয়ে দিলো।আলেয়াও তাসকিনকে পরিয়ে দিলো।এবার আশিয়ান আর তাসকিনের পালা।
আশিয়ান ডায়মন্ড রিংটা হাতে নিয়ে একবার ঊদিতার দিকে তাকালো তারপর ঊদিতার হাত টেনে নিয়ে যত্নসহকারে চিকন অনামিকা আঙ্গুলটিতে পরিয়ে দিলো।ঊদিতার খুবই নার্ভাস লাগছে আশিয়ানের স্পর্শতে।তাসকিনও আলেয়াকে মুচকি হেসে রিংটা পরিয়ে দিয়ে হাতের পিঠে চুমু খেলো।আলেয়া লজ্জা পেয়ে গেল।
আশিয়ান তাদের বিষয়টি লক্ষ্য করে মুচকি হাসি দিয়ে সবার সম্মুখে এবার ঊদিতার দুগালে হাত রেখে কপালে গভীর একটা চুমু দিলো।কেন জানি মন থেকেই চুমু খেলো আশিয়ান তাকে।ঊদিতার লজ্জায় মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে মাটি ফাঁক করে ঢুকে পড়বে।তাসকিন আর আলেয়া অবাক হয়ে তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে।আশা আর ইলিয়ানা তো জ্বলেপুড়ে শেষ।বাকিরা তুমুল করতালিতে ফেটে পড়লো।তাশজিদ, তাজিম ও তার অন্যান্য কাজিন তো আঙ্গুল মুখে পুরে সিটি বাজাতে লাগলো।
রিং পরানো শেষে ওরা দুই কাপল তাদের জন্য নির্দিষ্ট রাজকীয় চেয়ারে গিয়ে বসলো।আশিয়ানের হাতের ভাঁজে ঊদিতার হাত রাখা।আশিয়ানই ধরে রেখেছে।ঊদিতার সাথে আশিয়ানের সব কাজিন এসে কথা বলছে ফটো তুলছে।তাদেরকে আশিয়ান মানা করে দিলো যে ঊদিতার ছবি যাতে ওরা এফবিতে কোনো গ্রুপে না ছাড়ে।মিডিয়ার লোকেরা যদিও এসব কথা শুনে নি।তবে ঊদিতাকে দেখার কোনো চান্স নেই কারও।
আশিয়ান ইলিয়ানাকে এককথায় ইগনোর করে যাচ্ছে সমানতালে।আসাদ ইলিয়ানাকে সাথে নিয়ে তাদের কাছে এলো।আশিয়ানের সাথে আসাদ করমর্দন করলো।আসাদ হেসে হেসে জিজ্ঞেস করলো;
আসাদ:-কী আশিয়ান?কি খবর তোমার?অবশেষে বিয়ের পিড়িতে বসছো তুমি?
আশিয়ান ও হাসিমুখে জবাব দিলো;
আশিয়ান:-জ্বী আঙ্কেল,,বিয়ে তো একদিন না একদিন করতেই হবে তাই আর দেরী করলাম না।আর আমার ফিয়ন্সের মতো ভালো মেয়ে তো এখন পাওয়াই যায় না।420 মেয়ের অভাব নেই দুনিয়ায়।তাই এত ভালো কাউকে পেয়ে আর হাতছাড়া করি নি।
ইলিয়ানাকে কটাক্ষ করে বললো আশিয়ান।ইলিয়ানার মুখ চুন হয়ে গেল এ কথা শুনে।আসাদ ভুঁড়ি নাচিয়ে হেসে টাকলু মাথায় হাত বুলিয়ে বললো;
আসাদ:-তা অবশ্য ঠিক বলেছো ভাতিজা।এখনকার দুনিয়ায় ভালো মেয়ে খুব কমই পাওয়া যায়।এই দেখাে না আমি ইলুকে কত ভাগ্যগুনে পেয়েছি।এত অল্পবয়সী মেয়ে কী আমার মতো লোক পায়।হুম?
আশিয়ান:-আরে কী যে বলেন আপনি আঙ্কেল!আপনি এখনো যথেষ্ট ইয়াং রয়েছেন।আপনাকে দেখলে এখনো মেয়েরা ফিদা হয়ে যাবে।উদাহরণ তো আপনার সামনেই রয়েছে।আপনার ওয়াইফ ইলিয়ানা মানজার!তাই না আন্টি?ঠিক বলি নি আমি?(শয়তানি হেসে)
ইলিয়ানার চেহারা দেখার মতো হয়েছে আশিয়ানের মুখ থেকে আন্টি ডাক শুনে।ইলিয়ানা জবাবে কিছু বললো না।শুধু করুন দৃষ্টিতে আশিয়ানের দিকে তাকালো।ইলিয়ানার এমন তাকানোতে আশিয়ানের কোনো ভাবান্তর ঘটেনা।বরং সে ঊদিতার হাতের উল্টোপিঠে আলতো ভাবে চুমু খেয়ে বললো;
আশিয়ান:-আমার ভাগ্য অনেক ভালো যে ঊদিতার মতো কাউকে লাইফ পার্টনার হিসেবে পাচ্ছি আমি।আমি অনেক হ্যাপি।
আসাদ:-হুম দোয়া করি তোমরা অনেক সুখী হও।তোমাদের বিবাহ পরবর্তী জীবন হাসিখুশিতে ভরপুর থাকুক।
আশিয়ান:-আমিন।
আসাদ আশিয়ানের হাতে একটা গিফট বক্স দিয়ে ইলিয়ানার হাত ধরে আগের জায়গায় ফিরে এলো। ঊদিতা আশিয়ানের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।মনে মনে ভাবছে সে, লোকটা অনেক ভালো!
ভালোয় ভালোয় এনগেজমেন্ট অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলো।খাওয়া দাওয়া সেড়ে অনুষ্ঠান শেষ হতেই সবাই সবার বাসার দিকে রওনা হলো।এনগেজমেন্ট অনুষ্ঠানে যারা যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের সবাইকে বিয়ের কার্ড দেয়া হলো।হাসিমুখেই সবাই বিদায় নিলেন।আশিয়ান ঊদিতাকে বড় দুই বক্স চকোলেট গিফট করলো।ঊদিতা গিফট পেয়ে ভীষণ খুশি।
(ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।এবং গঠনমূলক কমেন্ট করবেন সবাই আশা করছি।আজকের পার্ট পড়ে কার কেমন লাগলো জানাতে ভুলবেন না কিন্তু। হ্যাপি রিডিং গাইজ ❤️।)
চলবে…🍃