অদ্ভুত বর – পর্ব 01

0
1282

#অদ্ভুদ_বর
#দিয়া_মনি
#পর্ব_০১
বাসর রাতে ১২হাত কাপড়ে ১৩হাত ঘোমটা দিয়ে ফুলে সজ্জিত বিছানায় বসে আছে দিয়া। মনের মধ্যে হাজারো ভয় বাসা বাঁধছে,,, কারন ও শ্যামবর্নের। আর ওর বর..?? সে দিয়ার একে বারে বিপরীত। যেমন সূদর্শন ঠিক তেমনই বিচক্ষন। যদিও এগুলো অন্যদের কাছ থেকে শোনা। কারন দিয়া এখনো ওর বরকে দেখেনি ওর বাবা ছবি এনেছিলেন কিন্তু দিয়া চায়নি বিয়েটা করতে। দিয়া ভাবছে কাল পর্যন্ত সে তার বাবার আদরের মেয়ে ছিলো আর আজ সে অন্য একটা অচেনা অজানা পরিবারের সদস্য।
দিয়ার মা খুব ছোট থাকতেই মারা যায়। বাবাই ওর কাছে সবকিছু। এবার সে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে,, পড়াশোনায় মোটামুটি ভালোই। ওর ইচ্ছা ছিলো পড়াশুনা করে অনেক বড় হবে।তবে বাবার অবস্থা তেমন স্বচ্ছল না। হয়তো এই কারনে তার জীবন সংসার এবং চার দেয়ালের মাঝে আটকে গেলো। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দরজার খট করে শব্দ হয়। তিনি এসেছেন। দিয়াকে দিয়ার নানু শিখিয়ে দিয়েছেন, স্বামী আসলে যেন প্রথমেই তাকে সালাম করে আর স্বামীর প্রতিটা কথা মেনে চলে। দিয়া উঠে তার স্বামীকে সালাম করতে গেলো। পায়ে হাত দিতে গেলেই লোকটা কিছুটা দূরে সরে দাড়ালো। তারপর গম্ভীর
—- তোমার মতো শ্যামলা একটা মেয়েকে রওশান ইয়ারাভ কখনোই নিজের বউ হিসাবে মেনে নিতে পারবে না। বিয়েটা আমি আমার মায়ের কথাতে করেছি। তাই আমার কাছ থেকে কিছু আশা করো না।
দিয়া চুপ করে ফ্লোরে বসে কাঁদতে লাগলো,,, ও জানতো লোকটা এমন কিছুই বলবে। আজ দিয়ার নিজেকে খুব অসহায় লাগছে,,, কি হবে ওর..? বিয়েটা করে একটা মানুষের গোছানো জীবন কি এলোমেলো করে দিলো দিয়া..?? লোকটা আবার বলে উঠলো,,
—- তুমি এখানে থাকো আমি বাইরে যাচ্ছি ঘুমাতে।
এবার দিয়ার বুক ফেটে কান্না আসছে,,, কেন সবসময় ওর সাথেই এমন হয়। কেন কেউ ভালোবাসতে পারে না ওকে..?? ওর গায়ের রংটাই কি সবার কাছে সবকিছু.?
এদিকে রওশন ওর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে সবে মাত্র ঘরের দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো,,, তারপর দরজা আটকে দিলো,, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ আসছে খাট থেকে। রওশন খানিকটা অবাক হয়ে খাটের দিকে চেয়ে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে খাটের দিকে এগিয়ে যায়। তারপর শীতল কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে,,
—- কাঁদছো কেন দিয়া..?? মন খারাপ..?
দিয়া এবার জোরে কেঁদে দেয়। তারপর তোতলাতে তোতলাতে বলে।
—- যখন নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করেন নি তাহলে সিমপ্যাথি দেখাতেও হবে না। আমি এমনি কাঁদছি। আপনার কথা শুনে আমার একটুও কষ্ট হয়নি। ঠিকই তো বলেছেন আপনি।
রওশন অসহায় দৃষ্টিতে দিয়ার দিকে তাকালো। তারপর পরও ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসা করলো
—- কি বলেছি আমি। আর তুমি জানো না বাসর রাতে বরকে সালাম করতে হয়..??
দিয়া নাক ডলতে ডলতে উত্তর দিলো।
—- সালাম করতেই তো গিয়েছিলাম আপনিই তো বললেন বউ হিসাবে আমাকে মানেন না।
রওশন এবার বুঝতে পারলো যে দিয়া কেন কাঁদছে,, ভয়ে এবং অতিরিক্ত চিন্তার কারনে দিয়া আগে থেকেই অনেককিছু কল্পনা করে ফেলেছে যার মধ্যে এটা একটা। রওশনের খুব জোর হাসি পাচ্ছে পিচ্চি মেয়ে কল্পনা করে সেটা এতো দূর টেনে ফেললো। তারপর মজা করার জন্য গম্ভির স্বরে বললো,,
—- এখন এসে সালাম করো। তখন কি বলেছি সেটা ভুলে যাও। আমাকে সালাম করে গিয়ে চেন্জ করে ওজু করবে তারপর আবার ঘোমটা দিয়েই আমার সামনে আসবে। নাহলে কিন্তু বাড়ি থেকে বের করে দিবো।
দিয়া ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলো,,,
—- চেন্জ করে কি পড়বো..??
রওশন হুংকার দিয়ে বলে উঠলো…
—- রওশন ইয়ারাভের বউ য়ের মুখে এমন কথা শোভা পায় না। কাবার্ডে গিয়ে দেখো কি আছে। ওখান থেকেই একটাকিছু পড়ে আসো।
দিয়া চুপচাপ কাবার্ড খুললো তারপর একটা লিনেন এর নীল থ্রিপিচ বের করে রওশনের সামনে এনে ধরলো,,
—- এটা পড়বো..??
—- যা খুশি পড়ো। আর তাড়াতাড়ি ওজু করে আসো নামায কালাম নাই নাকি..?? বাবার বাড়ির মতো এখানেও সারাদিন ঘুরঘুর করে বেড়ালে হবে..?
রওশন ঠোট চেপে হাসছে আর দিয়াকে কথা শোনাচ্ছে ,, বেচারা দিয়া ঘোমটা দিয়ে আছে বলে কিছু বুঝতেই পারছে না। দিয়া আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে তারপর কাঁপাকাঁপা গলায় বলে,,
—- সরি। মাফ করে দিবেন। পরবর্তীতে আর কোনো ভুল হবে না।
বলেই রওশনকে সালাম করে ওয়াসরুমে ঢুকে শাওয়ার নিতে লাগলো। এদিকে রওশন পাঞ্জাবি পায়জামা খুলে ট্রাউজার আর টি-শার্ট পড়ে নিলো। তারপর ল্যাপ্টপ অন করে কিছু ডিল তার পি এ কে বুঝিয়ে দিলো। ১ঘন্টা হয়ে গেছে দিয়া এখনো বের হচ্ছে না। আর কেন বের হচ্ছেনা সেটা রওশন খুব ভালো করেই জানে। তাই দরজার লক খুলে ও নিজেই ভেতরে ঢুকে যায়। গিয়ে দেখে দিয়ার গায়ে শাড়ি পেচিয়ে আছে গয়না সহ গোসল করতে গিয়ে ওর এই হাল। দিয়া এতোক্ষন নিচে তাকিয়ে কোমরের বিছা খুলছিলো,, হঠাৎ সামনে রওশনকে দেখে ওর অবস্থা বেহাল।
—- আপনি এখানে..?? কি করছেন..?
—- গোসল করতে বলেছি আমি..?? শুধু শাড়ি চেন্জ করতে বলেছিলাম। এখন যদি তোমার ঠান্ডা লাগে..?? আর অসুস্থ হয়ে যাও তখন..?
—- ভুল করে ঝর্না ছেড়ে দিয়েছি। বুঝতে পারিনি এটা হবে। আমরা তো পুকুরে বা কলে গোসল করি। কখনো জানতাম নাকি এতো বড় বাড়িতে আসবো..? তাহলে হয়তো শিখে নিতাম।
রওশন দেখলো দিয়া শীতে কাঁপছে তাই দিয়াকে কোলে নিয়ে বেসিনের ওপর বসিয়ে দেয়। দিয়া পুরো হতবাক। রওশন ওকে কোলে নিয়েছে এটা যেন ওর বিশ্বাসই হচ্ছে না। চোখ বুজে আছে ভয়ে এই বুঝি রওশন ওকে আবার ধমক দেয়। রওশন এক এক করে দিয়ার গায়ের গয়না খুলছে,,, বিছা খুলতে গিয়ে রওশনের হাত দিয়ার পেটে লাগে। শিউরে ওঠে দিয়া। এটা দেখে রওশন ঠোট চেঁপে হাসে। রওশন এবার ইচ্ছা করেই দিয়ার ঘাড়ে গলায়,,কানে পেটে বারবার নিজের হাতের ছোঁয়া দিতে থাকে। দিয়া ভয়ে আর অদ্ভুদ অনুভুতিতে বারবার কেঁপে উঠছে। রওশন এবার দিয়ার আঁচলে হাত দেয়। দিয়া এবার আস্তে করে বলে।
—- বাকিটা আমি পারবো আপনি যান প্লিজজ।
রওশন মুচকি হেসে ওখান থেকে বেরিয়ে যায়। দিয়া চেন্জ করে ওজু করে ভেতরে আসে। দিয়া ভেতরে আসতেই রওশন ওয়াসরুমে ঢুকে যায়।
—- আমি থাকলে উনি বারবার চলে যাচ্ছেন। সেটা তো ঠিক না এটা ওনার ঘর। উনিই বরং নিরিবিলি থাকুক। আমি বারান্দায় যাই। ওটাকে করিডোর বলে মনে হয়।
রওশন ওজু করে ঘরে এসে দেখে দিয়া করিডোরে দাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিরবির করছে। রওশন কিছুটা এগিয়ে গিয়ে কান পেতে শুনতে লাগলো দিয়া কি বলছে,,
—- আম্মু আমাকেও তুমি তোমার কাছে নিয়ে যাওনা। এখানে আমি সবাইকে শুধু বিরক্তই করছি। জানো কেউ আমাকে চায়না। আমার গায়ের রংটার জন্য। আচ্ছা আমি শ্যামলা হয়ে যখন জন্মেছিলাম তখন ফুপুদের বলোনি কেন আমাকে মেরে ফেলতে। কেউ তো খুশি ছিলো না আমাকে নিয়ে
এসব শুনে রওশনের মাথায় রক্ত উঠে যায়। দিয়াকে হ্যাচকা টান দিয়ে রুমে নিয়ে বিছানায় ছুরে ফেলে,, দিয়া অনেকটা ভয় পেয়ে যায় রওশনের এই আচরনে। ভয়ে ওর চোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। রওশন দিয়ার চোখে পানি দেখে আরো রেগে যায়। রেগে খুব জোরে দেওয়ালে কয়েকটা ঘুসি দিয়ে বাইরে চলে যায়। এদিকে দিয়া ভাবতে লাগলো রওশন এমন করলো কেন..? কিছুক্ষন পর রওশন ফিরে আসে হাতে একটা বক্স।
—- নফল নামায পড়তে হবে আমাদের আসো।
দিয়া উঠে গিয়ে রওশনের সাথে নামায পড়ে নেয়। তারপর বালিশ নিয়ে করিডোরে চলে যায়। রওশন আবার রেগে গিয়া দিয়াকে কোলে তুলে নেয়,,,
—- আরে নামান আমাকে আমি ঘুমাবো।
—- সেজন্যই নিয়ে যাচ্ছি।
—- আমি গেলে তো আপনি বাইরে চলে যাবেন। তার চেয়ে আপনি খাটে ঘুমান আমি নাহয় ওখানেই ঘুমাচ্ছি।
—- তুমি আমার সাথে আমার পাশে ঘুমাবে। বলেছি না আগে যা বলছি ভুলে যাও।
—- আমার বালিশ,,,, আমার বালিশ তো ওখানে।
—- বালিশ লাগবে না।
রওশন দিয়াকে খাটে বসিয়ে ওর হাতে বক্সটা দেয়। দিয়া একটু নাড়াচাড়া করে বক্সটা আবার রওশনের দিকে এগিয়ে দেয়।
—- এটা কার জন্য..??
—- আমার গার্লফ্রেন্ডের জন্য। দেখো তো কেমন হয়েছে। ( বাসর রাতে বর কিছু দিলে বুঝে নিতে হয় যে জিনিসটা বউ এর জন্য। আর এই মেয়ে..? সবসময় মরার চিন্তা করে)
—- আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে..?? নিশ্চই খুব সুন্দ দেখতে ( মুখটা মলিন করে বললো)
রওশন বিরক্ত হয়ে নিজেই বক্সটা খুলে ফেললো একটা পায়েল, সোনা রূপার কম্বিনেশনে,, ছোট ছোট ফুলের ডিজাইন করা। রওশন দিয়ার পা টেনে নিজের হাটুর ওপর রাখলো,,,
—- আরে আরে কি করছেন..?? পা ছাড়ুন। বড়দের গায়ে পা দিতে হয় না।
—- গাইয়্যা মেয়ে। চুপ করে বসে থাকো।
গাইয়্যা মেয়ে কথাটা গিয়ে দিয়ার বুকে বিধে গেলো। ও চুপ করে রওশনের মুখের দিকে তাকালো,, ধবধবে ফর্সা চেহারায় বাদামি চোখটা অদ্ভুদ লাগছে,,, কেমন জানি নেশা নেশা লাগছে দিয়ার,, নাকের নিচে একটা ছোট্ট তিল যা রওশনের সৌন্দর্যে এক নতুনত্ব প্রকাশ করছে,,, তার ওপর চাপ দাড়ি। দিয়া শুধু নিজের শেষ হয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করছে,,, হুট করে রওশন বলে উঠলো।
—- আমার দিকে এভাবে চেয়ে চেয়ে কি দেখছো..??
—- না কিছু না। ( থতমত খেয়ে উত্তর দিলো ) এটা আমার জন্য..??
—- হুম তোমার জন্য। কেমন হয়েছে..??
—- আপনি তো বললেন আপনার গার্লফ্রেন্ডের জন্য।
—- তোমার পায়ে বেশি ভালো মানায় তুমিই রাখো। আচ্ছা তুমি আমার সম্পর্কে কিছু জানতে চাওনা..??
—- একটা কথাই জানতে চাই।
—- কি..??
—- আমি চলে গেলে খুশি হবেন..?? ( রওশন কিছু বললো না ) কোনো ব্যাপার না। ঘুমান আপনি আমি আপনার পা টিপে দিচ্ছি।
রওশন বালিশে মাথা রেখে দিয়াকে টেনে নিজের বুকের ওপর শুইয়ে দিলো,,,
—- চুপ করে ঘুমাও। ভোরে উঠতে হবে। আর শোনো প্রতিদিন সকালে তুমি নিজে আমাকে কফি বানিয়ে দিবে। ঠিক আছে..??
রওশনের কোনো কথাই দিয়ার কানে যাচ্ছে না,,, দিয়া রওশনের বুকে শুয়ে রওশনের হার্টবিট শুনছে,, ধুকধুক ধুকধুক ধুকধুক। রওশনের শরীর থেকে একটা আলাদা মাতাল করা ঘ্রান পাচ্ছে দিয়া। নিজের অজান্তেই দিয়ার ঠোটের কোণে হাসি ফুঁটে ওঠে। রওশনের বেড আয়না বরাবর হওয়ায় রওশন আয়নায় দিয়াকে দেখতে পাচ্ছে,,, দিয়া মুচকি মুচকি হাসছে দেখে রওশনের বুকের ভেতর মোচর দিয়ে উঠছে,,, ওরও ইচ্ছে করছে এই মিষ্টি মেয়েটাকে নিজের করে পেতে। তবে এখনো সে সময় হয়নি। দিয়াকে ওর সব স্বপ্ন পূরন করতে হবে। একজন বড় হার্ট সার্জন হতে হবে। তাই নিজেকে দিয়ার থেকে দূরে রেখে দিয়ার স্বপ্নকে ওর কাছে তুলে দিতে হবে।
—- দিয়া এবার ঘুমাও। কাল অনেক কাজ আছে।
—- হুম।
—- আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
—- হুম।
দিয়া হুম হুম করছে দেখে রওশন দিয়ার দিকে তাকায়। ঘুমিয়ে গেছে। রওশনও দিয়াকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে পাড়ি জমায় ঘুমের রাজ্যে।
চলবে,,,,
[ সাড়া পেলেই পরের পর্ব পোস্ট করবো নাহলে এখানেই গল্পের ইতি।
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here