অদ্ভুত বর – পর্ব 16

0
471

#অদ্ভুদ_বর
#দিয়া_মনি [ DîYã MôÑî ]
#পর্ব_১৬
সকালে ঘুম ভাঙতেই দিয়া খেয়াল করলো ওর পেট নড়ছে।
— আমার পেট,,, আমার পেট নড়ছে কেন?
দিয়া উঠে আয়নার সামনে দাড়ালো। জামা উচু করে পেটের দিকে তাকাতেই দেখলো পুরো পেটটা নীল হয়ে আছে সাথে হাজারো আঁচড়ের দাগ। ভয় পেয়ে গেলো দিয়া তবুও মুখে প্রকাশ করলো না কারন জ্বীনের সামনে গেলে এমন অদ্ভুদ জিনিসের সামনে পড়তে হবে এটা তো স্বাভাবিক। দিয়া ওয়াসরুমে ঢুকে গেলো ফ্রেস হতে। ওদিকে রওশন ঘুমের মধ্যেই দিয়ার সাইডে হাত রাখে কিন্তু দিয়াকে পাচ্ছে না। দুই মিনিট দিয়ার সাইডটায় হাত বুলিয়ে যখন দিয়াকে না পায় তখন ভয়ে ধড়ফড়িয়ে ওঠে। সারা রুমে চোখ বুলিয়ে নিলো দিয়া কোথাও নেই।
— দিয়া কোথায়? এতো সকালে কোথায় গেলো ও.? আর দিয়ার গায়ে ব্যাথা? সেটা কি কমেছে?
ঠিক তখনই ওয়াসরুমের দরজা ঠেলে বাইরে আসলো দিয়া পরনে কুচিবিহিন একটা গোলাপী শাড়ি। চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। পায়ের নুপুর ঝুনঝুন করে তালে তাল মেলাচ্ছে।
— এখন কেমন আছো.?
— ঠিক আছি কিন্তু সারা শরীরে কিসের দাগ..??
— ওগুলো জ্বীনদের আঁচড়ের।
— পেটের নিচটা নীল কেন.?
— জানার কি খুব প্রয়োজন.?
— অবশ্যই না জানলে বুঝবো কিভাবে..? জানেন আজ সকালে মনে হলো আমার পেট নড়ছে। ভেতর থেকে কেমন কেমন জানি লাগলো।
— তুমি প্রেগনেন্ট দিয়া। আর আমারদের টুইন বেবি হবে একটা ছেলে একটা মেয়ে। দুজনই অর্ধেক জ্বীন অর্ধেক মানুষ।
কথাটা শোনা মাত্র দিয়ার মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠলো। হাতপা কাঁপছে। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। দিয়ার হাত অটোমেটিক ওর পেটে চলে যায়।
— তুমি যদি না চাও তাহলে বেবিদের রাখবো না দিয়াপাখি। আমার দাদাজান বলেছিলেন আমাদের বংশের সব ছেলেদের প্রথম সন্তান যমজ হবে আর জ্বীনের বৈশিষ্ট্য থাকবে ওদের মাঝে। আমি আর রোশান তেমনই হয়েছি এবার আমার বেবিরা হবে।
— আমাদের বেবি.?
— হুম। প্রথমবার সন্তান এমন হয় পরেরবার ঠিক হয়ে যায়। তবে এরা অনেক ভোগায়। তাই বলছি যদি বলো তো এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখি কাল তোমাকে নিয়ে এবর্শন করিয়ে আনবো।
কথাটা শুনে দিয়ার পৃথিবি যেন থমকে গেলো,, ওর প্রথম সন্তান এরা, রওশন কিভাবে ভাবলো একথা?
— আমার বেবি আমার কাছে থাকবে।
— দিয়াপাখি তুমি সামলাতে পারবে না ওদের। ওদের ওপর ইফরীত্বের ছাঁয়া আছে। ওরা অনেক খারাপ হবে।
— অদ্ভুদ মানুষ আপনি। নিজের সন্তানদের মেরে ফেলতে চান।
— ওরা তোমাকে মেরে ফেলতে এসেছে। তোমাকে কষ্ট দিতে এসেছে।
— আপনি কি চান.? ওদের মেরে আমি নিজেকে মারি.? বাই দ্যা ওয়ে এতো তাড়াতাড়ি বেবি হলো কেমনে.? বিয়ের ৬মাসও হলো না এখনো অথচ বেবিরা চলে এসেছে,, ধুরর এখন বেবি সামলাবো নাকি নিজেকে কিছুই বুঝতেছিনা।
— এজন্যই বলছি এবর্শন করিয়ে ফেলতে।
— আপনার সমস্যা কি.? ওরা ভালো না তাইতো.? তো কি হইছে পৃথিবিতে যে শুধু ভালো বেবি আসবে তার তো কোনো এগ্রিমেন্ট করা নেই। অনেক বেবিই তো ভালো হয়ে জন্মায় সঙ্গদোষে তো ওরা ঠিকই বিগড়ে যায়। আমার বেবিরা খারাপ হয়ে এসেছে আমরা নাহয় ওদের ভালো করে নিবো।
— উপরে চলো
— উপরে যাবো মানে.? আমি এখনো বাচ্চা মরার শখ নেই আমার।
— ধুরর উপরে মানে ছাদে চলো দাদাজানের রুমে গিয়ে উপায় খুজতে হবে। বাবা তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছিলো।
— এই অবস্থায়..? আব্বু দেখলে কি ভাববে.?
— রশনি থ্রি কোয়াটার প্যান্ট আর গেঞ্জি পড়ে বাড়ি থাকে, আব্বু কিছু ভাবেনি কারন এসব এখন কমন। মর্ডান মমেয়েরা এগুলোতে অভ্যস্থ।তাই তোমাকে এই কুচিছাড়া শাড়িতেও কিছু ভাববে না।
— আরে রশনি আপু তো মেয়ে আর আমি বাড়ির বউ,, এভাবে দেখলে অভদ্র ভাববে।
— বাড়ির বউ কি কখনো মেয়ে হয়না.? আমার আব্বু আম্মু কি কখনো তোমাকে বউ ভেবেছে.? সবসময় নিজের মেয়ের মতো দেখেছে। ইনফ্যাক্ট রশনির চেয়ে ভালো তোমাকে বেশি বেসেছে।
— তাহলে আব্বুদের বইলেন মেয়ে হিসাবে আমাকে একটা বিয়ে দিতে। তাদেরও তো জামাই এর শখ আছে। বেশ হবে
— উফফ আল্লাগ তুমি এ কার পাল্লায় ফেলালে আমায়..? মেয়েটা দুইদিন পর দুইটা বাচ্চার মা হবে তবুও সেন্সিটিভ হয়না।
— মানে.?
— কিছুনা চলো।
রওশন দরজার দিকে হাটতে গেলেই রায়হান দরজায়া নক করে । দিয়া রায়হানকে দেখে চট করে পেছনে ঘুরে যায়। রায়হান খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খায় দিয়ার কাজে।
— রওশন, মামনি ওদিক ঘুরে আছে কেন.?
— তোমার মামনি আজ কুচি ছাড়া শাড়ি পড়েছে। এভাবে তোমার সামনে আসলে নাকি তুমি অভদ্র ভাববে তাই ওদিক তাকিয়ে আছে।
— মানে.?
— তুমি তোমার মামনির কাছ থেকে শোনো আমি ফ্রেস হতে গেলাম। ভুলেই গেছিলাম আমি এখনো ব্রাশ করিনি।
— আচ্ছা যা।
রওশন চলে যেতেই রায়হান পকেট থেকে দুইটা আংটি বের করলো,,
— মামনি এদিকে ঘোরো।
— আব্বু আমাকে ফকিন্নি ফকিন্নি লাগছে। পরে কথা বলবো ঘুরা যাবে না।
— আমার আম্মাও কুচি ছাড়া শাড়ি পড়তো মামনি। আর কে বলেছে কুচি ছাড়া শাড়ি পড়লে ফকিন্নি লাগে.? আমার তো মনে হয় খুব সুন্দর লাগে।
— তাহলে তো ফেরাই যায়।
দিয়া পেছনে ঘুরতেই রায়হান দিয়ার হাতে আংটিগুলো পড়িয়ে দেয়। তারপর সাইডে রাখা টেবিলের ওপর থেকে পানির গ্লাস উঠিয়ে একটা লকেট ভিজিয়ে দিয়াকে সে পানি খেতে দেয়।
— কিসের পানি এটা.? আর দুইটা আংটি কেন.?
— আংটি দুটো আমার ছেলের, ছেলেমেয়েদের জন্য। আর পানিটা তোমার সুস্থতা কাম্যের জন্য। পেটে ব্যাথা করলে এই লকেটটা ভিজিয়ে পানি খাবে।
দিয়ার হাতে একটা লকেট দিলো রায়হান। দিয়া লকেটটা উচু করে দেখলো লকেটের ওপর আরবি হরফে ছোটছোট করে কিছু একটা লেখা।
🍁🍁🍁
টিয়াদের বাড়ির ছাদে দাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে টিয়া। পরশু ওর বিয়ে,, ছেলেটা কে? কি করে? কোথায় থাকে কিছুই জানে না ও। বলতে গেলে জানতে চায়নি ও। ছেলেসহ ছেলেদের বাড়ি থেকে কিছু মানুষ এসেছে আজ টিয়াকে নিতে। কিছু শপিং করিয়ে দিবে টিয়াকে সেই সাথে কিছু গহনা কিনতে হবে যার জন্য টিয়াকে প্রয়োজন।
— সবুজ!! তুই আর আমি কি সত্যিই আলাদা.? আমরা কি কখনো এক হতে পারবো না? তুই সত্যি সত্যি বিয়ে করে নিচ্ছিস.? করবি নাই বা কেন তুই তো আমাকে তোর লাইফের প্যারা মনে করিস। তোর ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা তো আমার নেই,, তবুও কেন? কেন এতো কষ্ট হচ্ছে আমার। সবটা মেনেও মানতে পারছিনা কেন..?
— কিরে চুন্নি কি করিস ছাদে?
কন্ঠটা শুনে টিয়ার বুকের ভেতর ছ্যাত করে উঠলো,, সেই চিরচেনা কন্ঠ কিন্তু সে এখানে আসবে কেন.? তারও তো বিয়ে। নিজের বিয়ে ছেড়ে কেউ
— ডাইনি পেছনে তো তাকা।
টিয়া এবার পেছনে তাকালো, সবুজ আর তিথি দাড়িয়ে আছে। তিথির হাতে একটা ছোট্ট ব্যাগ। হয়তো বিয়ের কোনো কিছু নতুবা ওর নিজের কোনো জিনিস। টিয়া পেছন ঘুরে আবার আকাশের দিকে চেয়ে রইলো।
— পাত্তা দিলো না আমাদের। দেখলি তো সবুজ বিয়ের সময় হলে মানুষের কতো পরিবর্তন হয়.? নে প্যাকেটটা তুই দে আমি নিচে গিয়ে অন্য কাজগুলো দেখি।
তিথি চলে যেতেই সবুজ প্যাকেট নিয়ে টিয়ার কাছে গেলো। টিয়ার সামনে প্যাকেটটা উচু করে ধরে নাচাতে লাগলো।
— সবুজ বিরক্ত করিস না নিচে যা।।
— দুইদিন পর তো বিয়ে হয়ে যাবে আপাতত এই দুদিন বিরক্ত করতে দে। এরপর থেকে আর করবো না।
— তুই প্লিজ নিচে যা। ভালো লাগছে না আমার। একা থাকতে চাই আমি।
— কেন? ভালো লাগছে না কেন..?
টিয়ার এবার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। এমনিতেই ওর মনমেজাজ খারাপ তার ওপর সবুজ এসে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছে।
— তোর বউকে তো দেখালি না।
— তোর নজর লেগে যাবে। একেবারে বিয়ের দিন দেখিস্। তোর বর দেখতে কেমন.? দেখেছিস.?
— ভালো
— হুম দেখতে হবে তো কার বর। চল এবার শপিং এ যেতে হবে আমাদের।
— তুই যাচ্ছিস..?
— বা রে আমার বেস্টির বিয়ে ওর জন্য সবকিছু তো আমাকেই পছন্দ করতে হবে।
এমন সময় টিয়ার ফোনে তিথির ম্যাসেজ আসে।
— দুইদিন পর তো সারাজীবনের জন্য সবুজরে পাবি। এখন পিরিত কম করে নিচে আয়,, নাহলে বিয়েটাই বন্ধ হয়ে যাবে। আর শোন সবুজ তোর জন্য একটা আংটি কিনেছিলো হয়তো দিয়েও দিসে ওটা হাতে রাখিস আন্টি খুশি হবে। টাটা বেবি।
ম্যাসেজটা পড়ে টিয়া সবুজের দিকে তাকালো। সবুজ মুখ গোমরা করে প্যাকেটটা নেড়ে চেড়ে দেখছে। টিয়া সবুজের কাধে হাত রাখে। সবুজ চোখ উঠিয়ে টিয়ার দিকে তাকায়। মেয়েটার চোখমুখ এখনো ফুলে আছে।
— কি রে পেতনি কিছু বলবি?
— I Love You,,,
টিয়ার মুখে হঠাৎ ভালোবাসার কথা শুনে অপ্রস্তুত হয়ে যায় সবুজ। টিয়া সবুজকে চুপ থাকতে দেখে বলে উঠলো,,
— এটাই ভাবছিস তাইনা আমি নির্লজ্জের মতো কেন ভালোবাসার কথা বললাম.? কি করবো বল.? তোকে ছাড়া যে আমি কিছু ভাবতে পারিনা।আর তুই? তুই সবসময় আমাকে ইগনোর করিস, রাগিয়ে দিস্। কাল সারারাত কেঁদেছি এটা ভেবে যে তুই আমাকে কেন পছন্দ করিস না। ইভেন আমি জানতেও চাইনি আমার বর কে? আর তুই এতোটাই নির্দয় যে হাসিমুখে নাটক করে গেলি। বাহ তোর নাটকের প্রশংসা না করে পারছি না। তোকে এক মিনিট আগে অবধি ভালোবাসতাম তবে না আর না।
— তোর ফালতু ড্রামা বন্ধ কর। আর না মানে কি? মনে রাখিস আমি ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসতে পারবি না তুই। কারন সুযোগটাই পাবি না। নাটকের কথা বলছিস.? হ্যা নাটক করেছি কারন আমি জানতাম তুই নিজেই আমাকে তোর মনের কথা বলবি। আসলে কি জানিস তোর ইগো বেশি ভাঙবি তবু মচকাবি না। ভালোবাসিস তবুও দেখাতে চাস্ পছন্দ করিস্ না। তোদের মেয়েদের এতো ড্রামা মনে আসে কিভাবে.? দিয়া একজন ফ্যাচ ফ্যাচ করতে করতে সেই রওশন জিজুকেই বিয়ে করলো,, আর একটা তুই.?গুন্ডামি দেখাস্.?
— দিয়ার নামে একদম কিছু বলবি না,,, ওর জন্যই আমাদের লাইফে তুই এসেছিলি,,
— এটা ঠিকই বললি কিন্তু এটা বলতে পারলি না যে ওর জন্যই তুই আমাকে আর আমি তোকে পেয়েছি।
— আমি বিয়ে করবো না।
— ওকে ফাইন কোনো ব্যাপার না আমার কাজিন অনেক সুন্দরি।
— কিহ.? কোন কাজিন?
— আরে ওই যে আছেনা ফর্সা করে লম্বা, বিদেশি টাইপের
— তুই ওকে পছন্দ করিস্? ওহ এজন্যই আমি মাত্র যখন নিজের মনের কথা বললাম তখন তুই কিছু বললি না। তো যা না তোর ওনাকে বিয়ে কর।আর আমাকে আল্লাহর ওয়াস্তে ছেড়ে দে।
— ছাড়ার জন্য এতো কষ্ট করে বিয়ে অবধি আসিনি। যেটা শুনতে চেয়েছিলাম সেটা পেয়ে গেছি এবার সবুজের ভালোবাসা দেখবি। সবুজের রংয়ে রাঙাবো তোকে।
বলেই কোলে তুলে নিলো টিয়াকে। সিড়ি দিয়ে টিয়াকে কোলে নিয়ে নামছে সবুজ, সবুজের বন্ধুরা সিটি দিয়ে সবুজকে উৎসাহ দিচ্ছে।
🍁🍁🍁
দাদাজানের ঘরের সামনে দাড়িয়ে আছে রওশন, দিয়া, রিমিকা, রশনি আর রায়হান। রায়হান দরজার সামনে এসে দাড়িয়ে দিয়ার কাছ থেকে লকেটটা নিয়ে দেওয়ালে ছোঁয়ালো। তারপর দিয়াদের ইশারা করলো যেন রওশন & দিয়া একসাথে দরজায় হাত রাখে। ধ্রাম শব্দ করে দরজা দুদিকে খুলে যায়। দিয়া ভেতরটা একবার উকি দেয়,,
— এটা কতদিন পরপর পরিস্কার করা হয়.? (দিয়া)
— টানা ২৯ বছর পর দরজা খুলতে পেরেছি আমরা।
রওশনের কথা শুনে দিয়া ড্যাবড্যাব করে ঘরটার দিকে চেয়ে রইলো,, ঘরের ভেতরটা কোনো লাইব্রেরির চেয়ে কম না,, বিশাল বড় একটা বইএর তাক সম্ভবত হাদিস আছে ওখানে। দক্ষিনদিকে জানালা আর সেখানে একজনের শোয়ার মতো একটা চৌকি রয়েছে। উত্তরদিকে আল্লাহর নামে দেয়ালে ফলক কাটা। পূর্ব দিকে সাদা জুব্বা আর কিছু জায়নামায পশ্চিম দিকে একটা জায়নামায বিছিয়ে রাখা হয়েছে আর তার ওপর একটা কুরআন শরীফ। কতটা সুশ্রী একটা ঘর। একবিন্দু ধুলাও কোথাও নেই। দেখে মনেই হচ্ছে না যে এইরুমটা টানা ২৯বছর বন্ধ ছিলো।
চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here