#মায়াবন_বিহারিণী🌻
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#চতুর্থ_পর্ব
১০.
মাঝ থেকে কেটে গিয়েছে একদিন। গত পরশুদিনের মতো গতদিনও বেশ অস্বস্তিতে কেটেছে উপমার। আমেনা বেগম আর ইফতেখার সাহেবকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলেছে সে। ইফতেখার সাহেব ও কেমন যেন চুপচাপ নির্বাক ভঙ্গিমায় বাড়িতে আসা যাওয়া করছেন। আমেনা বেগম মুখ বাঁকিয়ে কথা শোনালেও কানে নেয়না সে। আজ বেশ সকালেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে বেশ কিছুটা দূরে অবস্থিত জমিলা খাতুনের বাড়ির দিকে পা বাড়ায় উপমা। দূর সম্পর্কের চাচি হলেও নিজ সন্তানের মতো বেশ স্নেহ করে তাকে। জমিলা খাতুনের বাড়ির সামনে গেলেও কেন যেন ভেতরে আর প্রবেশ করতে মন চাইলো না উপমার। চাচি যদি ঘটে যাওয়া কোনো প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাহলে কি জবাব দিবে সে?
তাই একরাশ মন খারাপ নিয়ে তার পাশে থাকা পুকুর ঘাটের কাছে পা বাড়ায় উপমা। এই পুকুরপাড়ের আশেপাশে সচরাচর কারো আনাগোনা হয়না তেমন। পুকুর ধারে থাকা থাকা বিশালাকার বকুল গাছটার নিচে বকুল ফুলের স্তুপ জমা হয়েছে। হয়তো কোন এক দমকা হাওয়ায় গাছের বেশিরভাগ ফুল মাটিতে ঝড়ে পড়েছে। অন্যান্য দিন হলে খুশিমনে গিয়ে বকুল ফুল গুলো কুড়িয়ে শাড়ির আঁচলে পুড়ে নিত উপমা কিন্তু আজকে তার ঠিক উল্টো ঘটল। নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে পুকুরপাড়ের ঘাটলার সিঁড়ি ডিঙিয়ে খানিকটা নিচের দিকে চলে যায় সে। অতঃপর পায়ের একাংশ পানির মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে সিঁড়িতে বসে পড়ে উপমা। পুকুরের হালকা ঘোলাটে পানিতে স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে তার। আশপাশে জমা শ্যাওলার মাঝে বেশ কয়েকটা লাল পদ্ম ও ফুটেছে। হুট হাট কোনো কারণে মন খারাপ হলেই এখানে ছুটে আসে উপমা।
পানিতে থাকা প্রতিচ্ছবির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে উপমা। চোখে মুখে মলিনতার রেখা, উদাসী ভাব। আনমোনা হয়ে চারপাশে পড়ে থাকা ছোট ছোট নুড়ি পাথর গুলো হাতে নিয়ে সামনে থাকা পানিতে ছুড়ে দিতেই পানির তরঙ্গে প্রতিবিম্ব সামান্য এঁকেবেঁকে যায়।
– “উপমা? এই উপমা? কই তুই?”
হঠাৎ কারো পরিচিত কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই সামান্য পরিমাণ হকচকিয়ে যায় উপমা। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই হৈমন্তীর হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী চোখে পড়ে তার। একপ্রকার দৌড়ে হাঁপিয়ে এসে পুকুরঘাটে থামে হৈমন্তী। অনেকদূর দৌড়ে আসায় শ্বাস প্রশ্বাসের গতি দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে তার। হৈমন্তীকে এভাবে হাঁপিয়ে উঠতে দেখে ভ্রু কুঁচকে নেয় উপমা। নির্বিকার ভঙ্গিমায় ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
– “কি হইছে? এভাবে হাঁক ছেড়ে চিল্লাচিল্লি করতেছিস ক্যান? কিছু হইছে?”
উপমার প্রশ্ন শুনে হৈমন্তী হাতের ইশারায় পেছনের দিকে তাক করে।
– “কি হইছে? পেছনে কি? কেউ আসতেছে?”
– “ক্যাম্প! ক্যাম্পে কাইল শহর থাইকা ডাক্তার আইছে। বেশ বড়সড় ডাক্তার।”
হৈমন্তীর কথায় মুহূর্তেই নড়েচড়ে বসে উপমা। কিন্তু এখান থেকে উঠে ক্যাম্প পর্যন্ত যাওয়ার ইচ্ছা তার মোটেও জাগ্রত হলো না। উল্টো সেখানে ঠায় বসে থেকেই বলে ওঠে,
– “হুম তো? তারা আইছে গ্রামে সেবা করার জন্য। মাসের নির্দিষ্ট দিন শেষ হইলে আবার শহরে চইলা যাবে।”
উপমার এমন ভাবলেশহীন জবাবে অবাক হয় হৈমন্তী। কেননা বরাবরের মতোই এই ডাক্তারি বিষয়টার প্রতি উপমার সবচেয়ে বেশি আগ্রহ। ক্যাম্পে প্রতিবার ডাক্তার আসার খোঁজ পেলে উপমাই সবার আগে ছুটে যায় সেখানে। তবে আজ কি হলো? আজ তার জবাব এমন রূঢ় আর অদ্ভুত কেন?
– “তুই কি ঠিক আছিস উপমা? তোর চেহারা সুরত এমন শুকাইয়া আছে ক্যান? বাড়িত কি চাচি চাচায় কিছু কইছে?”
হৈমন্তীর কথায় মৃদু হাসে উপমা। সে হাসি বড়ই রহস্যময়ী। তবে কাউকে এখনিই কিছু মুখ ফুটে বলতে চায় না সে। শুধু শুধু নিজের সাথে অন্যের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে কি লাভ? হৈমন্তী হচ্ছে উপমার সমবয়সী। একই সাথে পড়াশোনা করলেও হৈমন্তী হচ্ছে সবচেয়ে ভালো বন্ধু যাকে অনায়াসেই মনের সব কথা বলে উপমা। কিন্তু আজ মনে জমা সব কথা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যায় সে। প্রসঙ্গ বদলানোর উদ্দেশ্য বলে উঠে,
– “আজকাল তোর চোখ একটু বেশিই গোয়েন্দাগিরি শুরু করছে হৈমন্তী। আমার আবার কি হইব? আমার চোখ মুখ সবই ঠিক আছে। এখন কথা না বাড়াইয়া চল ক্যাম্পে যামু। অনেকদিন ধরে যাওয়া হয় না।”
উপমাকে কিয়ৎক্ষণের মধ্যে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে দেখে আবারও অবাক হয় হৈমন্তী। তবে মুখ ফুটে কিছু জিজ্ঞেস করে না। কেননা সে ভালো করেই জানে উপমা ঠিক সময় এলে নিজ থেকেই সবটা বলবে। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই সিঁড়ি থেকে উঠে দাঁড়ায় উপমা। তারপর হাঁটা শুরু করে ক্যাম্পের পথে।
১১.
সকাল থেকে শুরু করে একটানা ডিউটি করে বেশ হাঁপিয়ে উঠেছিল আবেগ। ডাক্তারি লাইফে এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। একটু আগেই দুজন রোগীকে দেখে ঔষধপত্র দিয়ে বিদেয় দিয়েছে সে। ডক্টর সায়ান ও অন্যপাশে রোগী দেখছে হয়তো। পুরো রুমে ভীড়ভাট্টা বেশ কমে যাওয়ায় চেয়ার টেনে একপাশে বসে পড়ে আবেগ। বাইরে একপলক তাকাতেই সূর্যের তেজস্ক্রিয় রশ্মি চোখে এসে পড়ে তার।
হাতে থাকা ঘড়িটার দিকে খেয়াল করতেই দেখে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে অনেক আগেই। শরীর বেশ ক্লান্ত হওয়ায় চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিতেই চোখ প্রায় লেগে আসে আবেগের। টেবিলের উপর এককোণে পড়ে থাকা ফোনের ভাইব্রেশনে চোখ মুখ কুঁচকে নেয় আবেগ। ফোনটা তার নিজস্ব শব্দে পুনরায় বেজে উঠতেই একপ্রকার বিরক্ত হয়ে ফোন হাতে তুলে নেয় আবেগ। ফোন রিসিভ করতেই অপর পাশ দিয়ে কারো থমথমে, গম্ভীর কন্ঠ ভেসে আসে,
– “কেমন আছো আবেগ?”
পরিচিত সেই কন্ঠস্বর! দীর্ঘ তিন মাস পর ফের সেই কন্ঠ শুনতে পেয়ে কিঞ্চিৎ পরিমাণ চমকে ওঠে আবেগ। সে তো মানুষটার সাথে স্পষ্ট ভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল তবে আজকে আবার কি প্রয়োজনে ফোন দিয়েছে সে?
– “আবেগ?”
পুনরায় অপর পাশ দিয়ে কথা ভেসে আসতেই গলা খাঁকারি দেয় আবেগ। অতঃপর বেশ শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে ওঠে,
– “মিস্টার আহিল শাহরিয়ার, আপনি? আপনার আমাকে ফোন করার বিশেষ কোনো কারণ?”
– “আবেগ! নিজের বাবার সাথে এভাবে কথা বলার মানে কি? ভুলে যেও না সম্পর্কে আমি তোমার বাবা হই।”
– “ভুলিনি মিস্টার শাহরিয়ার, কিছুই ভুলিনি আমি। শুধু আপনিই ভুলে গিয়েছিলেন আপনার দায়িত্ব, আপনার সম্পর্ক। সেসব প্রসঙ্গ না টেনে সরাসরি বলুন কি প্রয়োজনে ফোন দিয়েছেন আপনি?”
আবেগের এমন কথায় কিঞ্চিৎ পরিমাণ রাগ উঠলেও নিজেকে দমিয়ে নেন শাহরিয়ার সাহেব। পরবর্তীতে অপর পাশ থেকে শাহরিয়ার সাহেবের কথা কর্ণপাত হতেই রাগে কান গরম হয়ে আসে আবেগের।
ক্যাম্প থেকে সারি সারি মানুষ বের হচ্ছে। আর সেটা দেখে উপমা আর হৈমন্তীও পা টিপে টিপে অতি সন্তর্পণে প্রবেশ করে ক্যাম্পের দিকে। দু পাশে দুটো ক্যাম্প রয়েছে; হয়তো রোগীর সংখ্যা খুব বেশি তাই। অন্যান্য গ্রামে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত থাকলেও ত্রিমোহিনী তা থেকে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। একটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও তা গ্রামের শেষ মাথায় এবং জনমানবশূন্য। তাই প্রতিবছর মাসের নির্দিষ্ট কিছু সময় শহর থেকে বেশ বড় বড় ডাক্তার রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করা হয়। আর এবারও তাই করা হয়েছে।
প্রথমে পা টিপে টিপে বাম পাশের ক্যাম্পে যায় উপমা। দুজন মধ্যবয়স্ক ডাক্তার ঘুরঘুর করে প্রতি রোগীদের চেকআপ করছে। একজন বসে রোগীর ব্লাড প্রেসার মাপছে হয়ত।
– “এই হৈমন্তী! এইখানে তো যাওয়া সম্ভব না এখন। ভেতরে গেলে নিশ্চিত রোগী ভাইবা প্রশ্ন করা শুরু কইরা দিব। রোগী মানুষ দিয়া গমগম করতেছে।”
ভেতরের দিকে সামান্য উঁকি মেরে হৈমন্তীকে উদ্দেশ্য করে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে উপমা। হৈমন্তীও কথায় সায় দেয় তার।
– “এক কাজ কর, ওপাশের কামরায় গিয়ে দেখে আসি কেউ আছে কিনা?”
যেমন ভাবা তেমন কাজ। এপাশ থেকে ওপাশে গিয়ে ক্যাম্পের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় উপমা। দরজাটা হাল্কা চাপানো। ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে ভেতরের দিকে উঁকি দিতেই খেয়াল করে পুরো রুমে কোথাও কেউ নেই।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সাবধানতার সহিত ভেতরে প্রবেশ করে উপমা। মাঝারি কামরাটায় দু চারটে বেড, চেয়ার আর টেবিল রয়েছে। টেবিলের উপর চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সব সামগ্রী রাখা হয়েছে। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে টেবিলের উপর পড়ে থাকা নেমপ্লেট হাতে তুলে নেয়। সেটাতে ইংরেজিতে গুটি গুটি অক্ষরে লিখা রয়েছে “Dr. Shahriyar Abeg”। তার মানে এখানে আসা নতুন ডাক্তারের নাম কি আবেগ? নামটা পড়তেই মৃদু হাসে উপমা। আবেগ! নামটা বেশ মোহনীয় তো!
– “কে ওখানে? কে আপনি? কোনো কিছু প্রয়োজন ছিল?”
পেছন থেকে কারো গম্ভীর শীতল পুরুষালি কন্ঠ কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায় উপমা। থাকে থাকা নেমপ্লেট টাও মৃদু শব্দে টেবিলের উপর পড়ে যায়।…………..
#চলবে 🍂