#মায়াবন_বিহারিণী🌻
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#ষষ্ঠ_পর্ব
১৫.
বাইরের আকাশ আজ ঝকঝকে পরিষ্কার। জ্বলজ্বলে তারাগুলোর মাঝে পূর্ণ চন্দ্রিমা বিদ্যমান। হাতে কফির মগ নিয়ে বারান্দায় খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে আবেগ। ক্যাম্প থেকে ফিরতে ফিরতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছে তার। ত্রিমোহিণী গ্রামটা বেশ বড়। ক্যাম্প থেকে অনেকটা দূরেই সায়ান আর আবেগের থাকার জন্য বন্দোবস্ত করা হয়েছে। কফিটা শেষ করতেই বেশ কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। শুনেছে এখান থেকে ভোরের দিকে অনেক সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়। অন্যদিকে সায়ান অনেকক্ষণ ধরেই তার প্রিয় মানুষের সাথে ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত।
কিচেনে কফির মগ রেখে রুমে আসতেই পকেটে থাকা ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে আবেগের। ঘড়ির দিকে তাকাতেই খেয়াল করে রাত প্রায় বারোটা বেজে এসেছে। পকেট থেকে ফোন বের করতেই স্ক্রিনে মিস্টার আহিল নামটা চোখে পড়ে তার। চাপা রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে আবেগের। ফোন রিসিভ না করে সাইলেন্ট মোডে রেখে ইজি চেয়ারটাতে বসে পড়ে সে। অতঃপর তিন চার বার এভাবে বাজতে বাজতে একসময় আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়। নিস্তব্ধ পরিবেশে যখন ঘুমের রেশ চোখে এসে জড়ো হয় তখনই ফোন পুনরায় ভাইব্রেশন দিয়ে উঠে।
তবে এবার ভাইব্রেশন কলের না বরং মেসেজের। পরপর তিন চারটে মেসেজ।বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে নেয় আবেগ। ফোনে থাকা মেসেজ গুলো ক্লিক করতেই সেখানে দেখতে পায়,
“আবেগ, বাবা ফোন রিসিভ কর। আমি তোর মা বলছি। প্লিজ তাড়াতাড়ি ফোনটা রিসিভ কর; জরুরি কথা আছে।”
সন্দিহান চোখে মেসেজ গুলো বিড়বিড় করে পড়ে আবেগ। আসলেই কি মিসেস ইশিতা মেসেজ দিয়েছে নাকি এটাও কোনো ভ্রম। কিন্তু মা তো কখনো এভাবে ম্যাসেজ করে না। জরুরী প্রয়োজন পড়লে বাড়ির ল্যান্ড লাইন থেকেই কল করে। তার চিন্তার মাঝে পুনরায় মেসেজ টোন কর্ণপাত হতেই তড়িঘড়ি করে নাম্বারে ডায়াল করে আবেগ। সেকেন্ড কয়েক পর রিসিভ হওয়ার পর পরই অপর পাশ থেকে থমথমে কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
– “আবেগ!”
মিসেস ইশিতার জায়গায় অন্যকারো কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে বিরক্তিতে চ উচ্চারণ করতে গিয়েও থেমে যায় আবেগ। শীতল কন্ঠে প্রত্যুত্তরে বলে উঠে,
– “মানুষের সাথে ধোঁকাবাজি করার স্বভাবটা গেল না আপনার তাইনা, মিস্টার আহিল শাহরিয়ার?”
– “আবেগ! ভুলে যেও না তুমি তোমার বাবার সাথে কথা বলছো? একজন পিতার দায়িত্ব হলো তার বিগড়ে যাওয়া সন্তানকে সঠিক পথে নিয়ে আসা। আর আমিও সেই দায়িত্বই পালন করছি।”
অপর পাশ থেকে আহিল সাহেবের কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় আবেগ।
– “হাসালেন মিস্টার আবেগ শাহরিয়ার। আপনি পালন করছেন পিতা হওয়ার দায়িত্ব? নাইস জোকস্ অফ দ্যা ইয়ার।
একজনের দুর্বলতা জেনেও সে দুর্বলতায় আঘাত করাকে আপনি আপনার সো কল্ড দায়িত্ব বলছেন মিস্টার আহিল শাহরিয়ার?”
– “ভুল কি আছে আমার দায়িত্বে? আমি তো শুধু বলেছি তোমার এই ডাক্তারি পেশা ছেড়ে দিয়ে আমাদের বিজনেস জয়েন করো। আমি খুব ভালো করেই জানি যে এসব ডাক্তারি তোমাকে দিয়ে হবে না। এতবড় কোটিপতির ছেলে হয়েও তুমি বোকামি করে চলেছ। কি দরকার ছিল এসব করার? শুনেছি হসপিটাল থেকে নাকি তোমাকে ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে? নিশ্চয়ই সেখানে গিয়ে তুমি কম্ফোর্টেবল নও!”
– “ইনাফ মিস্টার আহিল শাহরিয়ার! ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট। আমাকে নিয়ে আপনার এতটাও চিন্তা বড়ই বেমানান। আ’ম ভেরি কম্ফোর্টেবল উইথ মাই প্যাশন। আর রইলো আপনার বিজনেসের কথা? আপনি খুব ভালো করেই জানেন আমি কেন আপনার বিজনেস জয়েন করি নি। আমি আমার ডাক্তারি লাইফে বেশ ভালোই আছি। এভাবে নেক্সট টাইম আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা ভুল করেও মাথায় আনবেন না, ইটস কোয়াইট লেট!”
আহিল সাহেবকে উত্তরে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন ডিসকানেক্ট করে দেয় আবেগ। বড় বড় দুটো নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সে। পৃথিবীতে যদি কারো উপর সবচেয়ে বেশি রাগ, ক্ষোভ আর ঘৃণা জন্মে থাকে তা হলো নিজ পিতা আহিল শাহরিয়ারের উপর। ফোন নিয়ে রুমে যেতেই খেয়াল করে সায়ান বিছানায় হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে ইতিমধ্যে। সেও আর বিলম্ব না করে লাইট অফ করে পাশেই শুয়ে পড়ে আর পরক্ষণেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায়।
১৬.
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে চারপাশ জুড়ে। পাখিদের আনাগোনা আর কিচিরমিচির ও শোনা যাচ্ছে এর মধ্যে। চোখের উপর আলোর রশ্মি ছুঁয়ে যেতেই চোখ পিটপিট করে তাকায় উপমা। শেষ রাতে কখন যে ঘুমে চোখ লেগে এসেছিল তা খেয়াল নেই তার। ঘড়ির দিকে তাকাতেই খেয়াল করে সকাল ৬:৩০ টা বাজে। নিশ্চয়ই আমেনা বেগম ও উঠে পড়বে একটু পর। অন্যদিকে বিছানায় গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে পূর্ণা। অতঃপর অলসতা বিসর্জন দিয়ে আড়মোড়া ভেঙে দ্রুত উঠে পড়ে উপমা। ঘরের কোণে থাকা লাল পাড়ের শাড়িটা নিয়ে দ্রুত পা বাড়ায় বাড়ির পাশের ঘাটলার দিকে।
কল পাড়ে বেশ কিছু কাজ সেরে আসতেই প্রায় ৭:৩০ টা বেজে যায় উপমার। ততক্ষণে বাড়ির সবাই জাগ্রত ও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাড়িতে গিয়ে এত সকালে উঠোনে ইফতেখার সাহেব সহ আরো দু চার লোককে দেখে ভ্রু কুঁচকে নেয় উপমা। কিন্তু পরক্ষণেই উপস্থিত মানুষের কথোপকথন কর্ণপাত হতেই বুঝতে পারে পুনরায় চেয়ারম্যান পদের নির্বাচন শুরু হবে তাই এত সকালে তাদের এ বাড়িতে আসা। উপমাও আর বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না সেখানে। আমেনা বেগম কথা শোনাতে কমতি না রাখলেও ইফতেখার সাহেবের একদম নিশ্চুপ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা তাকে বেশ ভাবিয়ে তোলে। কে জানে এই নিশ্চুপতা কিসের লক্ষণ?
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই পরিপাটি হয়ে নিয়েছে আবেগ। আজ একটু আগেই বের হয়ে চারপাশের এলাকা ঘুরে পর্যবেক্ষণ করে দেখবে সে। এতদিন ক্যাম্প টু বাসা, বাসা টু ক্যাম্প এ যেতে যেতে কোথাও বের হতে পারে নি সে। সায়ানকেও তার সাথে যেতে বললে কোনো এক কারণে তা নাকচ করে দেয় সায়ান। তাই একাই বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় আবেগ।
ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৮ টা বেজে ১৫ মিনিট। ক্যাম্পে মোটামুটি ১০ টার দিকেই কার্যক্রম শুরু হয়। টেবিলের উপর থেকে ঘড়িটা হাতে নিতে নিতেই রুম থেকে বের হয়ে যায় আবেগ। ঘোরাঘুরি করার পর সোজা ক্যাম্পে যাবে সে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু দূরে যেতেই মেঠো পথের একপাশে সারি সারি ধানের শীষ আর অন্যপাশে হলদে সরিষা ফুলের অসীমতা চোখে পড়ে তার। অনেকদিন পর একটু প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নিতে সফল হয় আবেগ। মৃদু হেসে মেঠো পথ ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। গ্রামাঞ্চলে সকাল সাড়ে আটটা মানে অনেকটাই সকাল। তাইতো রাস্তায় বেশ ক’জনকে চোখে পড়ে তার। বেশ খানিকটা হাঁটার পর মাঝারি আকারের নদী চোখে পড়ে আবেগের। নদীর একাংশ জুড়ে শুধু পদ্মপাতা; তার মাঝে গাঢ় গোলাপি রঙের পদ্ম ফুল ফুটে রয়েছে। অন্যপাশে দু একটা নৌকা বাধা রয়েছে। সাথেই একটা বিশালাকার গাছ। হয়তো এই নদী দিয়ে কারো চলাচল হয় না।
উঁচু মেঠো পথের একপাশ দিয়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে পড়ে আবেগ। অনেকখানি হাঁটার ফলস্বরূপ পা দুটোর একটু বিশ্রাম প্রয়োজন। তাছাড়াও এখানকার নীরব নির্জন স্থানে একটু সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছে বলেও মন ভালো হয়ে যায় তার। মায়ের সাথে খুব ছোট থাকতেই গ্রামে আসা যাওয়া হতো আবেগের; তবে যতই বড় হতে থাকে ততই নিজেকে চার দেয়ালের বন্দী অট্টালিকার শহরে মানিয়ে নিতে হয়েছে তার।
নৌকা দুটো বেশ পুরনো বলেই মনে হচ্ছে। নৌকার অগ্রভাগে থাকা অংশটাতে গিয়ে বসতে নিলেই ভ্রু কুঁচকে নেয় আবেগ। সাথে চমকায় ও। নৌকার মাঝামাঝিতে বেশ কয়েকটি পদ্মফুল রাখা। তবে কি তার মতো এখানে আরো কেউ উপস্থিত রয়েছে? থাকলেও কোথায়? আশেপাশে তো কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। কৌতুহল নিয়ে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল আবেগ। কিন্তু পরক্ষণেই তাকে পুনরায় চমকে দিয়ে কারো গানের গলার স্বর কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই মস্তিষ্ক অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হয়ে ওঠে আবেগের। কোনো অদৃশ্য মানবী নেই তো আবার তার দৃশ্যপটের আশপাশে; নাকি সবটাই মনের ভ্রান্তি?…………..
#চলবে