অদ্ভুত বর – পর্ব 17

0
503

#অদ্ভুদ_বর
#দিয়া_মনি [ DîYã MôÑî ]
#পর্ব_১৭
সবাই ঘরের ভেতরে ঢুকলো। দিয়া এক ধ্যানে বই এর তাকটার দিকে তাকিয়ে আছে। একটা বই সোনালী আভায় জ্বলজ্বল করছে।
— দেখুন ওই বইটা কেমন জ্বলজ্বল করছে।
দিয়ার কথা শুনে সবাই তাকটার দিকে তাকালো কিন্তু কোনো উজ্জ্বলা কারোর চোখে পড়লো না। রওশন এসে দিয়ার হাত টেনে চৌকিটায় বসালো। দিয়া প্রথমে বসতে না চাইলেও গায়ে ব্যাথার জন্য বসে গেলো। বাড়ির সবাই প্রতিটা বই খুলে চেক করছে কোথাও দাদাজানের লেখা কিছু আছে নাকি। ঠিক তখন দিয়ার চোখ বিছানো জায়মানাযের দিকে যায়। কুরআন শরীফের এক এক পাতা উল্টে যাচ্ছে আপনাআপনি। দিয়া আর ওদিকে তাকালো না ভয় লাগছে ওর। ওদিকে পেটের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। দিয়া উঠে রওশনের পাশে এসে দাড়ায়।
— কি হলো উঠে এলে কেন? যাও গিয়ে বসে থাকো।
— পেটের মধ্যে বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে দিসে বেবিরা। বসে থাকতে পারছি না।
— বেবিগুলো সময়ের তুলনায় বেশি বেড়ে উঠবে আর ওদের শক্তির প্রকাশ করবে,, বলেছিলাম তো তোমাকে।
— উপরের তাকে একটা বই জ্বলজ্বল করছে ওটা নামান না কেন.? ওটা দেখতে চাই আমি।
— কোনটা.? ভালো করে বলো।
দিয়া হাতের ইশারায় একটা বই দেখালো। রওশন টুল নিয়ে বইটা পাড়লো,, এটা কোনো বই না ডায়েরির মতো নিউজপ্রিন্টের খাতা। সাইড দিয়ে সেলাই করে কালো মলাট লাগানো। উপরে বড় বড় করে লেখা জ্বীন রহস্য।
— এটার কথা বলছিলে.?
— হ্যা। হ্যা এটাই এখানেই সবকিছু আছে।
রওশন বুঝলো দিয়া নিজে না ওর বেবিরা দিয়াকে কন্ট্রোল করছে,, ওর বেবিরা দিয়াকে দিয়ে ওকে কিছু বলতে চায়। রওশন ডায়েরিসহ সবাইকে নিয়ে চৌকিটার কাছে বসলো। দিয়া রওশনকে পড়তে বললো,, রওশন খাতাটা খুললো দেখলো উপরে ১৯৮৪সাল লেখা। মানে ৩৫বছর আগের ঘটনা।
♣♣ সেদিন ছিলো বৈশাখের প্রথম দিন। আমি রাদিন এবং আমার ছোট ছেলে রমজান আমরা গিয়েছিলাম এক ছেলের ওপর থেকে জ্বীনের আছড় সরাতে। গ্রামের রাস্তা ধরে হেটে চলেছি আমরা দুজন,, ইটের বাঁধানো রাস্তা হওয়ার রমজান হাটতে পারছিলো না তাই ও বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে হাটছিলো। হঠাৎ দেখি পাশের খালের পথ ধরে হারিকেন হাতে একজন লোক হেটে আসছে। সম্ভবত যাদের বাড়ি যাবো তাদের বাড়ি থেকেই পাঠিয়েছে। সে এসেই আমাকে লম্বা সালাম দিয়ে কুশলবিনিময় করলো তারপর বললো,,
— হুজুর আমাগো বাড়ি যাইতে হইলে কিন্তু অহনো আরো এক ঘন্টা হাটোন লাগবো। যাইতে পারবেন তো?
আমি হেসে তাকে উত্তর দিলাম যে হ্যা যেতে পারবো।তারপর শুরু হলো আমাদের তিনজনের পথ চলা। লোকটা নানা কথায় আমার ভয় দেখানোর চেষ্টা করতে থাকে। আবার একা একাই হেসে ওঠে। যখন আমরা গ্রামের একদম মাঝামাঝি চলে আসি তখন লোকটা হঠাৎ উদাও হয়ে যায়। আমরা দাড়িয়ে ছিলাম দুপাশে ঘেরা বাঁশবাগানের মাঝখানে,,, সামনে ছোট একটা খাল আর তার উপরে বাঁশের তৈরি সাঁকো। রমজান আমার হাত ধরে ঝাকিয়ে সামনে তাকাতে বললো,,
— রমজান কোনো সমস্যা.?
— আব্বা সামনে দেখেন আমাদের সাথে যে এসেছিলো সে সাঁকোর উপরে উড়ছে মনে হচ্ছে।
সামনে তাকালাম আমি। হ্যা সেই লোকটাই তবে আকারে দ্বিগুণ বেড়ে গেছে মুখটা ঝাপসা, বিদঘুটে আওয়াজ করে হাসছে। যদিও ভয় করছিলো তবুও রমজান আছে সাথে। ভয় পেলে চলবে না,, আর আমরা নিজেরাই যদি ভয় পাই তাহলে মানুষদের সাহায্য করবো কিভাবে.? বুকে বল সঞ্চয় করে রমজানকে বললাম আযান দিতে। আর নিজে আয়তাল কুরছি পড়া শুরু করলাম।
— আব্বা গলা দিয়ে স্বর বের করারও শক্তি পাচ্ছি না।
— তুমি আয়তাল কুরছি পড়ো আমি আযান দিচ্ছি।
আযান দিতে শুরু করলাম। অনেক জোরেই আযান দিচ্ছি পাশে দাড়িয়ে রমজানও জোরে জোরে আয়তাল কুরছি পড়ছে। তবে আমাদের দুজনের গলার পাশাপাশি এটাও শুনতে পাচ্ছি যে কিছু কাকের কা কা এর কাতর ধ্বনি,, মাঝে মাঝে কুকুরের কান্না,, কখনো বা শেয়ালের ডাক। আযান থামালাম একটা আওয়াজ পেয়ে,,
— ঠিক করলি না তোরা। তোদের কখনো ভালো হতে দেবো না আমি। আজ বেঁচে গেলি কিন্তু বেশিদিন বাঁচবি না।
বসে পড়লাম দুজনে,,, যেন কতদিনের ঝড়ের কবল থেকে আজ রক্ষা পেলাম। নিজেদের শরীর বন্দক করে নিলাম যেন সামনের পথে আর কোনো সমস্যা না হয়। চাঁদের আবছা আলোয় হেটেহেটে পৌছে গেলাম গন্তব্য স্থলে। বিপদ ঘটলো বাড়ির উঠানে,,, বাড়ির আয়তন মেপে দেখলাম ৪কাঠা জমির ২কাঠায় বাড়ি এক কাঠায় গাছপালা আরেককাঠা সামনের উঠোন। আর সে উঠোনে আমাদের দিকে চেয়ে বসে আছে একটা কাক আর একটা কুকুর। বুঝতে বাকি রইলো না যে এরাই সে। ওদের ডিঙিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম। বাইরে থেকে সালাম দিলাম
— আসসালামুয়ালাইকুম।
তিনচারজন লোক হারিকেন নিয়ে বাইরে চলে আসলো,, সবার চোখের কোণে পানি শুকিয়ে আছে। ছেলেটার বাবা আমাদের দেখেই কেঁদে উঠলো
— হুজুর আহেন। দেহেন আমার পোলাডার কি অবস্থা। ওরে বাঁজান হুজুর
— সব ঠিক হয়ে যাবে।
ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম একটা ৫-৭ বছরের বাচ্চা ছেলে কাঁচা মাছ চিবিয়ে খাচ্ছে,, গন্ধে গা গুলিয়ে উঠলো ছেলেটাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। হাতপায়ের নখগুলো কয়লার মতো কালো। দাঁতগুলো অত্যাধিক লম্বা। ছেলেটার কাছে যেতেই ও বলে উঠলো,,
— এখানেও চলে এসেছিস..? লাভ নাই কিচ্ছু করতে পারবি না তুই।
আমার আমার নিয়ম মতো ওর চিকিৎসা করতে লাগলাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না শেষে নিজের গলা থেকে আল্লাহর নামের লকেটটা খুলে চেঁপে ধরলাম ছেলেটার কপালে।জোরে জোরে সূরা জ্বীন তিলাওয়াত করছি। রমজান কুরআন শরীফ মেলে সূরা বাকারা থেকে শুরু করে সূরা নাস অবধি পড়তে লাগলো। ছেলেটার শক্তি যেন দ্বিগুন হয়ে গেলো। ৭জন ধরে চেপে রাখলেও বেগ পাচ্ছি না ওর। ভোর ৪টার কাছাকাছি। দূর থেকে আযানের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ছেলেটা চোখগুলো রক্তের মতো লাল হয়ে গেলো
— ভেবেছিলাম শুধু তোদের ক্ষতি করবো কিন্তু না তোদের পুরো পরিবার কে শেষ করে দেবো।
তারপর থেকে আমার ভেতরে অদ্ভুদ পরিবর্তন হতে শুরু করে। খেতে পারি না,, ঘুমাতে পারিনা। ঘটনার ১৪তম দিন হঠাৎ রমজান নিখোজ হয়ে যায়। ওর খোজ আর পাওয়া যায়নি। ♣♣
♠♠ দেখতে দেখতে কেটে গেলো আরো একমাস। সেদিন আমি চৌকিতে বসে জিকির করছিলাম এমন সময় চারিদিকে আঁধার ঘনিয়ে আসে। ভয় পেলেও জিকির করা বন্ধ করিনি আমি। হৃদয় কেঁপে কেঁপে উঠছে এমন সময় পশ্চিমপাশের জায়নামাযের চারিপাশ আলোকিত হতে শুরু করে। শুধু জায়মানাযটা জ্বলছে। আরেকটু স্থীর হয়ে তাকাতেই দেখলাম একজন সাদা জুব্বা পড়া ব্যাক্তি দাড়িয়ে আছে। ভয়ে ঘাম ছুটে গেছে আমার। ঠিক তখনই উনি আমাকে সালাম দিলেন “আসসালামুয়ালাইকুম” ওনার কন্ঠ শুনে কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেলো,, এতো সুন্দর কন্ঠ মনে হয় আমি আমার জীবনে এই প্রথমই শুনলাম। কোনো রকমে সালামের উত্তর দিলাম “ওয়ালাইকুম আসসালাম”। তারপর কিছুক্ষন ঘরে নিরবতা বিরাজ করলো। এদিকে আমার কৌতুহল বেড়েই চলেছে। আমি ওনাকে প্রশ্ন করলাম,,
— কে আপনি ? এখানে কি চান?
— আপনাকে কিছু সংবাদ দিতে চাই। আমাকে আপনার হুজুর নিজামউদ্দিন পাঠিয়েছেন।
নিজের শিক্ষকের নাম শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। তারপর মনকে শক্ত করে জিজ্ঞাসা করি।
— কি খবর.?
— আপনার ছেলে রমজান আর বেঁচে নেই। গতকাল রাতে ইফরীত্বরা তাকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিয়েছিলো হুজুর ওনার জানাযা করিয়েছেন।
মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। সেদিন বুঝলাম ছেলে হারানোর কষ্ট কি? পা দুটো অবশ হয়ে আসতে লাগলো তখন উনি আবার বলে উঠলেন
— আপনার বংশপরম্পরায়, প্রতি প্রথম সন্তানের যমজ সন্তান হবে তবে তারা পুরোপুরি মানুষ হবে না। আর মানুষ হলেও তাদের কাছে থাকবে আপনার এবং হুজুর নিজামউদ্দিনের অর্জিত শক্তি। কারন ইফরিত্বরা ওয়াদা করেছে ওরা আপনার পুরো পরিবারকে শেষ করবে।
— আমার ছেলে? রমজান?
— হুজুর এটাও বলেছেন যে আপনার বড় ছেলে রায়হানের প্রথম সন্তান হবে মানুষ।দ্বিতীয় সন্তানের যখন ৫বছর বয়স হবে তখন ইফরীত্বরা ওকে নিয়ে যাবে।
— এদের থেকে রক্ষা পাবো কিভাবে.?
— আপনাদের বংশে এমন যমজ সন্তান আসবে যার একজন হবে ছেলে আরেকজন মেয়ে। ওরাই আপনাদেরকে রক্ষা করবে। আর ওরা তখনই শক্তি পাবে যখন ওদের মা মারা যাবে। ♠♠
আর পড়লো না রওশন। রিমিকা দিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। দিয়া চুপচাপ বসে আছে। রওশন দিয়াকে কোলে নিয়ে ঘরে চলে গেলো।
— রওশন এসব মানবে না। ও কখনো দিয়াকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে দেবে না।
— তাহলে কি উপায় আব্বু.? আমরা সত্যিই চাইনা পিচ্চি ভাবির কিছু করে নিজেদের বাঁচাতে।
— জানি না কি হবে।
রওশন রুমে এসে দিয়ার ওরনা নিলো তারপর দিয়ার হাতে ওরনার একপাশ বেঁধে নিজের হাতে একপাশ বাঁধলো।
— আমার চোখের সামনে থেকে একদম নড়বে না। যা লাগবে সব রহিমা খালাকে বলবে।
— যেটা ৩৫বছর আগে ঠিক হয়ে আছে সেটা তো বর্তমানে ঘটবেই। সো যাস্ট চিল। চলুন আজ লং ড্রাইভে যাই।
— চুপচাপ ঘুমাও নাহলে মারবো।
— মারবেন..? নারী নির্যাতন কেস করবো.. পরে জেলের ভাত খেতে হবে কিন্তু।
— প্লিজ দিয়াপাখি। প্লিজজ। আর পারছি না এসব শুনতে। পারছি না সহ্য করতে। আমিও তো মানুষ প্রথমে রোশান,, তারপর তোমার অপারেশন,, তারপর সেদিন তোমার আর রোশানের ঝামেলা। আর এখন তুমি আর বেবিরা।
— আপনিই পাঠাইছিলেন আপনার ভাই এর কাছে।
— কি করবো.? আর যে কোনো উপায় ছিলো না। তবে আমি জানতাম তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। কারন কোনো জ্বীনই বিবাহিত মেয়েদের ওপর জোর খাটাতে পারে না।
— ইন্টেলিজেন্ট ব্যাটা।
— কিহ.?
— কুচ নেহি। যাই হোক যা হওয়ার তাই হবে,, ফিউচার নিয়ে ভেবে প্রেজেন্ট নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। আচ্ছা আমাদের বেবির নাম তাহলে ঝুনঝুনিই ফাইনাল? না না একটা করে ভালো নামও রাখতে হবে।
— রেডি থাকবে কাল তোমাকে নিয়ে হসপিটালে যাবো।
দিয়ার উচ্ছ্বাসিত মুখ এক নিমিষে মলিন হয়ে গেলো। রওশন কি চাচ্ছে.? তবে কি রওশন এবর্শন করিয়ে ফেলতে বলবে দিয়াকে ?
চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here