#মায়াবন_বিহারিণী🌻
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#পঞ্চম_পর্ব
১২.
রুক্ষসুক্ষ গম্ভীর মুখশ্রী। চোখ দুটোও বেশ গভীর। সাদা অ্যাপ্রন পরিহিত, গলায়ও একটা স্টেথোস্কোপ ঝোলানো। আবেগের শীতল কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে উপমা। একরাশ ভয় নিয়ে পেছনে ঘুরে তাকাতেই আবেগের মুখ দর্শন হয় তার। ২৫-২৬ বছর বয়সী উজ্জ্বল বর্ণের মানব; যার মুখশ্রী জুড়ে গম্ভীরতার ছাপ।
এদিকে সামনে থাকা সদ্য কিশোরীর দিকে চোখ যেতেই চিন্তায় বিলীন হয়ে যায় আবেগ। এই মেয়ে কে? কোনো প্রয়োজনে এসেছে নাকি?
– “এই মেয়ে? কে তুমি? ওখানে কি করছো টেবিলের কাছে? দেখ নি ওপাশের ক্যাম্পে রোগী দেখা হচ্ছে?”
শীতল পুরুষালি কন্ঠে প্রশ্ন শুনে বেশ থতমত খেয়ে যায় উপমা। কি বলবে সে? সে কোনো রোগী নয় কিংবা এখানে চিকিৎসা করাতেও আসে নি? সামনে থাকা কিশোরীর এমন নীরবতা পালন করা দেখে ভ্রু কুঁচকে নেয় আবেগ। মেয়েটা কি তার কথা শুনতে পায়নি; নাকি ঠিক বুঝে উঠতে পারে নি?
– “কি হলো? তুমি কি শুনতে পাওনি? এখানে কি করছো?”
পুনরায় আবেগের প্রশ্ন শুনে কিছুটা ঘাবড়ে যায় উপমা। তার পেছন পেছন তো হৈমন্তী ও এসেছিল; তার মানে তো হৈমন্তীরও এখানে থাকার কথা। কিন্তু হৈমন্তী কোথায়? নিশ্চয়ই বাইরে কোথাও ঘুরপাক খাচ্ছে।
– “আব,আস,আসলে আমি এইখানে ইচ্ছা কইরা আসি নাই। আমারে এইখানে নিয়ে আসা হইছে।”
কোনো মতে ভয়ে ভয়ে বলে উঠে উপমা। উপমার প্রশ্নোত্তর শুনে আবেগ স্বাভাবিক ভাবেই সামনের দিকে এগিয়ে যায়। অতঃপর স্টেথোস্কোপ টা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলে উঠে,
– “তা রোগী কে? তুমি? নাকি তোমার পরিবারের অন্য কেউ?”
পেছন থেকে কোনো সাড়াশব্দ পায় না আবেগ। নিশ্চয়ই এই মেয়ের শ্রবণ সমস্যা রয়েছে নাহলে অন্যমনস্ক হয়ে থাকার সমস্যা রয়েছে। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে পেছনে তাকাতেই আশ্চর্য হয় আবেগ। সে কি ব্যাপার! মেয়েটা কোথায় গেল? এখনই তো এখানে ছিল। এটুকু সময়ের মধ্যে কিভাবে গায়েব হয়ে গেল? মেয়েটার কি কোনোভাবে অদৃশ্য হওয়ার ক্ষমতা রয়েছে? নিজের অজান্তেই উদ্ভট সব ভাবনায় মত্ত হয়ে পড়ে আবেগ।
এদিকে ক্যাম্প থেকে বাইরে বেরিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে উপমা। একটুর জন্য বেঁচে গিয়েছে সে। কোথায় ভেবেছিল ক্যাম্পে এসে শহর থেকে আসা ডাক্তারদের চিকিৎসা সম্পর্কে লুকিয়ে লুকিয়ে টুকটাক কিছু শিখে নিবে কিন্তু এখানে তো তার উল্টোটাই হলো। প্রতিবার এই উদ্দেশ্যেই দু একদিন পর পর ক্যাম্পে এসে উঁকি দেয় উপমা। আশপাশে একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে নেয় সে। কাজল কালো চোখ জোড়া হৈমন্তীকে খুঁজতে খুঁজতে একসময় পেয়েও যায়।
হুট করে মাথায় কেউ চাট্টি মারতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় হৈমন্তী। ভ্রু জোড়া কুঁচকে পেছনে তাকাতেই উপমার রাগান্বিত মুখশ্রী চোখে পড়ে তার। কিয়ৎক্ষণ পূর্বের কথা মনে পড়তেই শুষ্ক অধর দুটি জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে সে। উপমার রাগান্বিত হয়ে যাওয়ার কারণ তার বোঝা হয়ে গিয়েছে ইতোমধ্যে।
– “উ,উপ,উপমা তুই? আমি জানি তুই রাইগা আছিস। রাগ করিস না; আমি তো ভুল করে,,,,”
হৈমন্তী তার মুখ নিঃসৃত বাক্য পূর্ণ করতে পারে না। তার পূর্বেই উপমা চাপা রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠে,
– “চুপ কর ফাজিল মাইয়া। ভুল করে এখানে চলে আসছিস নাকি ইচ্ছা কইরা চলে আসছিস? আরেকটু হইলেই আইজ ধরা খাইতে হইত ঐ শহুরে ডাক্তারের কাছে। আর ঐ শহুরে ডাক্তারের ঐ ঠান্ডা গলার স্বর শুইনাই তো সব হযবরল হইতে চলছিল। কেমন গম্ভীর গম্ভীর ভাবখানা তার! আইচ্ছা ডাক্তার মানুষ ও এমন গম্ভীর হয় নাকি? তাগো তো হইতে হয় হাসিখুশি; উদার মনের। ডাক্তার ই যদি এমন হয় তাইলে রোগীদের ই বা কি হইব?”
দূর আকাশের পানে তাকিয়ে বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে উপমা।
১৩.
আবেগ। পুরো নাম হচ্ছে আরশান শাহরিয়ার আবেগ। আহিল শাহরিয়ার এবং ইশিতা শাহরিয়ারের একমাত্র ছোট ছেলে। মোটামুটি ২৫-২৬ বছর বয়সী একজন সুদর্শন পুরুষ। পেশায় একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ সদ্য ডাক্তার।
উপমা চলে যাওয়ার পর থেকেই কোনো এক গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে পড়ে আবেগ। মিনিট বিশেক পর আবারো রোগীদের হালকা ভীড় পড়ে যাওয়ায় ওপাশের ক্যাম্প থেকে ছুটে আসে সায়ান। সায়ান হচ্ছে ইপিআই হসপিটালের সিনিয়র ডক্টর যাকে আবেগের সাথে পাঠানো হয়েছে। কলেজ লাইফ শেষে যদি কোনো ভালো বন্ধু হিসেবে কাউকে আবেগ পেয়েছে তা হলো সায়ান। দুজনের মাঝেই বন্ধুত্ব বেশ গভীর। রোগীদের চাপে একটা সময় দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়ে আসে। ঘড়ির কাঁটায় ৫:০০ টা বাজলেই ক্যাম্প বন্ধ করে দেয়া হবে। তাই নিজেদের জিনিসপত্র গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ক্যাম্পে থাকা ডাক্তাররা। সায়ান আর আবেগ দুজন একসাথেই বেরিয়ে পড়বে। এখান থেকে কিছু দূরেই থাকার জন্য হসপিটাল কর্তৃক ব্যবস্থা করা হয়েছে। হঠাৎ করে সায়ানের ফোনে কল আসতেই খেয়াল করে শ্রেয়ার নাম স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে। মুচকি হেসে কল রিসিভ করে একপ্রান্তে গিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে মগ্ন হয়ে পড়ে সায়ান।
এদিকে আবেগ তার প্রয়োজনীয় সব সামগ্রী গোছানোর শেষে খেয়াল করে ফোনটা তার টেবিলের উপরেই পড়ে আছে। এগিয়ে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে ফোনটা হাতে তুলে নিতেই চোখ পড়ে কর্ণারে থাকা একটা ঝুমকার উপর। এটা এখানে কি করছে? ভ্রু কুঁচকে ঝুমকা অন্য হাতে তুলে নেয় আবেগ। এটা কার হতে পারে? কোনো রোগীর? চোখ বন্ধ করে কল্পনা করতেই চঞ্চল কিশোরীর মুখশ্রী ভেসে ওঠে। কাজল কালো চোখ, মুখশ্রী তার চঞ্চলতা আর কৌতূহল দিয়ে ঘেরা। হ্যাঁ, হতেই পারে! দুপুরের দিকে ঐ অল্প বয়সী মেয়েটাই তো ঘুরঘুর করছিল টেবিলের কাছে; তখনই হয়তো ভুল করে ছুটে গিয়েছিল। আর কিছু ভাবতে পারে না আবেগ; তার পূর্বেই পেছন থেকে ডাক পড়ে সায়ানের। ডাক শুনে দ্রুত ঝুমকাটা শার্টের পকেটে ভরে ব্যাগ নিয়ে হাঁটা শুরু করে বাইরের দিকে।
সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে গ্রামের মেঠো পথে গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে হেঁটে চলেছে উপমা। বিকেল পেরিয়ে যাচ্ছে। লাল সূর্য অস্তমিত হয়ে আরেকটু বাদেই চারপাশে অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে। রাস্তার পাশে দু সারি জুড়ে ধান গাছের শীষ। বাড়ির অনেকটা কাছে আসতেই পা দুটো থমকে দাঁড়ায় উপমার। সামনে থেকে এগিয়ে আসা মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিটির লোলুপ দৃষ্টি চোখ এড়ায় না তার। লোকটির চোখে লোলুপ দৃষ্টি আর মুখে বিশ্রী হাসির রেখা। এমন বিকৃত ভঙ্গিমা দেখে রাগে ক্ষোভে গা জ্বলে উঠে উপমার; তবে মুখ ফুটে কিছু বলে না। এই লোকটা বরাবরের মতই অপছন্দের তালিকায়। পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই পথ রুখে দাঁড়ায় সেই লোকটি। অগত্যা থেমে যেতে হয় উপমাকে।
১৪.
– “সমস্যা কি সজল ভাই? এইভাবে আমার পথ রুখে দাঁড়াইছেন কেন? আমারে যাইতে দেন!”
উপমার রাগান্বিত কন্ঠস্বর শুনে হাসে সজল।
– “উফফ, উপমা তোরে কতবার কইছি যে আমারে ভাই ডাকবি না! আমি তোর মায়ের পেটের ভাই লাগি?
আর এইভাবে দিনদুপুরে শাড়ি পইড়া গ্রামগঞ্জে ঘুইরা বেরানোর কি প্রয়োজন? শুনলাম আইজ নাকি ক্যাম্পেও গেছিলি; তা কয়জনরে নিজের রূপ দিয়া ঘায়েল করলি? তোরে তো বেশ কয়বার ই কইলাম যদি তুই চাস তাইলে তোরে আর তোর এই রূপ আমার কাছেই রাইখা দিমু। আর নাইলে এক রাইতের জন্য হলেও,,, চিন্তা করিস না কেউ জানব না। শুধু তুই আর আমি বাদে।”
আর কিছু শুনতে পারে না উপমা। সজলের এই নোংরা প্রস্তাবের কথা শুনতেই শরীর ঘিন ঘিন করে ওঠে তার। এতক্ষণ কিছু না বললেও শেষোক্ত কথায় রাগ মাথা পর্যন্ত পৌঁছে যায় উপমার।
– “খবরদার সজল ভাই! আপনার মন মানসিকতা নিচু ছিল জানতাম কিন্তু চিন্তা ভাবনা ও এত যে নোংরা হইয়া যাইব তা কল্পনাও করতে পারি নাই। আপনারে কতবার বলছি আমার সামনে আসবেন না তারপরও কেন আসেন। আজকে শেষ বারের মত কইতেছি এরপর আপনারে আমার আশপাশে দেখলেও ছাইড়া দেব না। আর আপনি নিশ্চয়ই ভালো কইরাই জানেন এই উপমা এক কথায় ই বিশ্বাসী।”
কর্কশ কন্ঠস্বরে সজলকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলে এক সেকেন্ড ও দাঁড়ায় না উপমা। সজলকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে পাশ দিয়ে হনহনিয়ে হেঁটে চলে যায়। এখানে দাঁড়িয়ে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেশক্তি নেই তার মাঝে। অপরদিকে সজলের মাঝে কোনো প্রকার হেলদোল নেই। সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে বিশ্রী ভাবে হাসে। মুখে তার অতৃপ্তি আর লোলুপ হাসি। কিছু একটা ভেবে হাঁটা শুরু করে তার নিজ গন্তব্যে।
গুটি গুটি পায়ে সন্তর্পণে বাড়ির উঠোনে প্রবেশ করতেই গোয়ালঘর থেকে আমেনা বেগমের কর্কশ কন্ঠস্বর কর্ণপাত হয় উপমার।
– “কি রে নবাবের বেটি; সারাদিন বাড়ির বাইরে থাইকতেই যহন হইব তহন আর বাড়িত আসার দরকার কি? পুকুরপাড়ে কিংবা গোয়ালঘরে ঘুমালেই তো পারিস। সকাল হইতে রাইত পর্যন্ত বাইরে ঘুইরা বের হবে আর এদিকে খেটে মরব আমি! অপয়া, অলক্ষ্মী কোথাকার।”
হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে উপমা। এটা নতুন কিছু নয়; প্রতিদিন ই এমন কটুক্তি শুনতে হয় তার। আমেনা বেগম ও একগাদা খড় গোয়ালঘরে রেখে বেরিয়ে পড়লেন দ্রুত। সন্ধ্যা নামার একটু আগেই মশার উপদ্রব শুরু হয় এখানে। উপমাও কোনো কথা না বলে চুপচাপ ঘরে চলে গেল। ঘরে গিয়ে পৌঁছাতেই চোখ পড়ে টেবিলের উপর বসে থাকা পূর্ণার উপর। মেয়েটা খুব মনোযোগ দিয়ে পাঠ্যবই অধ্যয়ন করছে। এবার ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী সে। বয়সে কাঁচা হলেও চিন্তাশক্তি তার বিশাল।
খুব সন্তর্পণে পেছনে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল থেকে কয়েকটা কাঁচা তেঁতুল, বরই বের করে নেয় উপমা। সকালে হৈমন্তীর সাথে ক্যাম্পে যাওয়ার পথে থাকা তেঁতুল গাছ থেকে নিয়েছিল সে। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে সেগুলো পূর্ণার সামনে তুলে ধরতেই প্রথমে সামান্য পরিমাণ হকচকিয়ে যায় পূর্ণা; কিন্তু পরমুহূর্তেই সেগুলো দেখে খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উপমাকে জড়িয়ে ধরে। উপমাও সযত্নে আগলে নেয় পূর্ণাকে।……………….
#চলবে 🍂