মায়াবন বিহারিনী – পর্ব 14

0
300

#মায়াবন_বিহারিণী 🌻
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#ত্রয়োদশ_পর্ব
৩২.
ক্লান্ত দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। প্রাণহীন আকাশে আবার একটু একটু পাখিদের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। হৈমন্তী‌দের বাড়ির পাশে থাকা বড় কাঁঠালগাছের শক্ত ডালে বাঁধা দোলনায় বসে পা দুলিয়ে চলেছে উপমা। পাশেই হৈমন্তীও কাঁঠাল গাছের ডালে বসে রয়েছে। হাতে থাকা শিউলি ফুলগুলোর দিকে একদৃষ্টে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে সেগুলো মুক্ত বাতাসে উড়িয়ে দেয় উপমা। কয়েকটা উপর থেকে পুনরায় এসে খোলা চুলের ভাঁজে আটকে গেলেও বাকিগুলো মাটিতে পতিত হয় অগোছালো ভাবে। দুজনের মাঝেই পিনপতন নীরবতা।
– “তয় সত্যিই কি শহুরে ডাক্তার আর আসবে না? তুই কি একবারও খোঁজ নিছিলি তার?”
হৈমন্তীর হঠাৎ প্রশ্নে মাথা তুলে তাকায়‌ উপমা। ভ্রু যুগল সামান্য কুঁচকে নিয়ে প্রত্যুত্তরে বলে উঠে,
– “কি জানি? আর আমিই বা খোঁজ নিব ক্যান তার? সে তো আমার হাতে সেইদিন পায়েল টা ধরাই‌য়া দিয়া কি যেন বিড়বিড় কইরা বলতে বলতে চইলা গেছিল। বলছিল যে তার চইলা যাওয়ার দিন সে আমারে ঐটা দিয়া যাবে। কিন্তু এমনও তো হইতে পারে যে সে তার কাজের ব্যস্ততায় আর আসতে পারব না”
উপমার কথায় ফুস করে নিঃশ্বাস ফেলে হৈমন্তী। অতঃপর হতাশা জড়ানো গলায় বলে উঠে,
– “তোর মতো বলদ মাইয়া আমার কপা‌লেই জুটতে হইল? একটা সামান্য বিষয়টারে জগাখিচুড়ী পাকা‌ইয়া ফেল‌ছিস।”
হৈমন্তীর কথার অর্থ বুঝতে না পেরে হৈমন্তীর দিকে গোল গোল চোখে তাকায় উপমা। কি সব বলছে হৈমন্তী? কি এমন ভুল করেছে সে।
– “প্রেমিক মানুষ তার প্রেয়সীর লগে একটু অভিমান করতেই পারে। তার উপর সবচেয়ে বড় কথা হইলো সে একজন পুরুষ মানুষ। তারা সচরাচর তাদের প্রেয়সীর লগে অভিমান কইরা থাকতে একটু বেশিই ভালোবাসে।
আর তুই কি না শহুরে ডাক্তারের অভিমান না ভাঙাইয়া এইখানে বইসা বাতাস খাইতেছিস। বলি কি মাথায় কি শুধু অন্য বুদ্ধি থাকলেই হইব, প্রেমিক মাইনষের মন বোঝার লাইগাও একটু বুদ্ধি থাকতে হইব।”
বিরক্তির দৃষ্টে তাকিয়ে একনাগাড়ে বলে ওঠে হৈমন্তী। অপরদিকে হৈমন্তীর কথার আগা গোড়া বুঝতে না পেরে ঠোঁট উল্টে ফেলে উপমা। একের পর এক হৈমন্তী এসব কি বলে যাচ্ছে তাকে। শেষ পর্যন্ত আর না পেরে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় সে।
– “আহা কি শুরু করছিস হৈমন্তী! সেই কখন থেইকা একই কথা ঘুরাইয়া পেচাইয়া বইলা যাইতেছিস। একটু পরিষ্কার কইরা বলবি যে কি বলতে চাইতে‌ছিস তুই? আর কিসের অভিমান? কিসের প্রেমিক পুরুষ? ডাক্তার মশাই যদি আমার প্রেমিক পুরুষই হইতো তাইলে সে তো আমারে বইলাই দিত যে সে আমারে ভালোবাসে। সে তো আমারে কিছুই বলে নাই।”
ঠোঁট যুগল কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে অসহায় কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উপমা।
– “এইটাই তো বুইঝা নিতে হবে তোরে। তোর গা ছাড়া ভাবের কারণেই হয়তো ডাক্তার মশাইয়ের মনে অভিমান জমছে। তা বলি কি এইভাবে অবহেলা না কইরা আগলায় নিলেই তো পারিস।
আমি নিশ্চিত শহুরে ডাক্তারের রাগ ভাঙালেই সব জলের মতন পরিষ্কার হইয়া যাইব। সে নিজেই তোরে তার ভালোবাসার কথা বইলা দিব। আর এইটাও শতভাগ নিশ্চিত যে তুই নিজেও কোনো না কোনোভাবে শহুরে ডাক্তারের প্রেমে পইড়া গেছিস।”
হৈমন্তীর কথা শুনে চক্ষু দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম উপমার। কি বলছে এসব হৈমন্তী! তবে কি আসলেই?
৩৩.
প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে। ক্যাম্পে তেমন কোনো রোগীর আনাগোনা নেই বললেই চলে। সবাই তাদের প্রতিদিনের নিয়মমাফিক অনুযায়ী ব্যাগপত্র গুছিয়ে যার যার বাসায় ফেরত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আবেগ ও তার ব্যাতিক্রম নয়। আজকের দিনটা একটু বেশিই ব্যস্ততায় কেটেছে তার। টেবিল থেকে ফোনটা নিয়ে উঠতেই সায়ান তাকে ইশারায় বাইরে যেতে বললে সেও চুপচাপ বাইরের দিকে পা বাড়ায়। আজ সেই পুরনো জায়গায় ছুটে যেতে ইচ্ছে করলেও কোনো উপায়ান্তর নেই। নিজের মনকে যে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সে।
বাইরে দাঁড়িয়ে এককোণে চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকে আবেগ। এখনো সায়ানের‌ ফেরত আসার কোনো নাম গন্ধ ও নেই। হয়তো ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে পুনরায়।
– “এই যে ডাক্তার মশাই?”
চঞ্চল কন্ঠস্বর! পেছন থেকে পরিচিত সেই ক্ষীণ কন্ঠ কর্ণগোচর‌ হতেই হকচকিয়ে উঠে আবেগ। হৃৎস্পন্দন আগের চেয়ে অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। তার এই অস্থিরতার মাঝেই পেছন থেকে পুনরায় কারো ডাক পড়ে। এবার বেশ খানিকটা আশা নিয়ে পেছনে ঘুরে তাকাতেই মুখটা চুপসে যায় তার। পেছনে কেউ তো দূরের কথা কারো অবয়বটুকু ও নেই। বিষাদ মাখা মুখশ্রী নিয়ে ঘুরে পুনরায় পেছন ফিরে তাকাতেই পিলে চমকে উঠে আবেগ। অস্ফুট স্বরে বলে উঠে,
– “উ,উপমা?”
– “এই যে ভ্যাবলা কান্ত মশাই; কোথায় হারাইয়া গেলেন শুনি?”
উপমার উপস্থিতি টের পেতেই মুখের রং পরিবর্তন হতে শুরু করে আবেগের। মনে মনে বেশ খুশি হলেও চেহারা দেখে তা বোঝা মুশকিল। মুখে বেশ গম্ভীর ভাব এনে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
– “তুমি এখানে? এখানে কি করছো তুমি?”
– “কেন আমার কি এইখানে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হইছে নাকি? আমি তো আসছিলাম এইখানে আপনার জন্য; না মানে আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।”
উপমার নির্লিপ্ত উত্তর। আরেক দফা অবাক হয় আবেগ। কি কথা বলতে এসেছে উপমা? তবে কি সে কোনোভাবে আবেগের মনের কথা জানতে পেরেছে, আর সেটারই কি উত্তর দিতে এসেছে? না, না এ সম্ভব না। কেননা এখনও তো আবেগ নিজের মনের কথা উপমাকে মুখ ফুটে বলতেই পারে নি। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে কাঠ কাঠ গলায় জবাব দেয়,
– “তোমার কথা শোনার মতো পর্যাপ্ত সময় আমার কাছে নেই। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
ততক্ষণে সায়ানের ডাক ও পড়ে গিয়েছে। উপমাকে একপ্রকার উপেক্ষা করেই পাশ কাটিয়ে চলে যায় আবেগ। আবেগের এমন ব্যবহার দেখে কিছুক্ষণের জন্য থতমত খেয়ে যায় উপমা। দেখেই বেশ বোঝা যাচ্ছে যে আবেগ রেগে রয়েছে। আর এর জন্যেই তাকে উপেক্ষা করে চলেছে। ভাবা যায়? কিন্তু কেন? তবে কি কোনোভাবে হৈমন্তীর বলা বাণীই সত্যি হতে চলেছে? ভাবতেই চম‌কায় সে।
– “মেয়েটাকে এভাবে এভোয়েড‌ না করলেও পারতেন ডক্টর আবেগ।”
সায়ানের মৃদু কন্ঠ শুনতে পেয়ে মাথা তুলে তাকায়‌ আবেগ। সায়ানের‌ দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে সে। অতঃপর প্রত্যুত্তরে এক ভয়ানক কথা বলে উঠে,
– “না পারলেও করতে হবে আমাকে ডক্টর সায়ান। উপমা একটা বাড়ন্ত চঞ্চল কিশোরী। তার সামনে যদি আমি আমার প্রেম প্রস্তাব নিয়ে যাই মেয়েটা হয় আমাকে ভুল বুঝবে, আর না হয় আমার প্রেমকে তুচ্ছ করে ছুঁড়ে মারবে সেই অদূরে।
তাছাড়া তাই প্রেম বিরহ থেকে তাকে প্রেম আবেদন না করাটাই শ্রেয় বলে মনে হয় আমার। আর তাই যে কদিন এই ত্রিমোহিনীতে‌ আছি সে কদিন উপমার থেকে যথাসম্ভব দূরেই থাকতে হবে আমাকে।”
আবেগের কথায় চুপ হয়ে যায় সায়ান। বলার মতো আর তেমন কিছু খুঁজে পায় না। শুধু মনে মনে সবটা ঠিক হয়ে যাওয়ার প্রার্থনা করে। মেঠো পথের রাস্তা ধরে ধরে হেঁটে চলে যায় দুটো অবয়ব।
বাড়ি এসে সেই কখন থেকেই চুপচাপ বসে রয়েছে উপমা। পূ‌র্ণা কয়েকবার এসে খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলেও তার মাঝে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না। তার মস্তিষ্ক জুড়ে অন্যসব কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। এ কেমন গোলযোগে ফেঁসে গিয়েছে যে তা থেকে কোনোভাবেই বেরোতে পারছে না সে? শুনেছে ইফতেখার সাহেব ও নাকি আজ রাতেই সদর থেকে ফেরত আসবেন।
– “প্রেমিক মাইনষেরে নিজের আঁচলে বাইন্ধা রাখতে হয় সবসময়। নাইলে একবার গিঁট ছুই‌টা গেলে সেই গিঁট আর চাইলেও বান্ধন যায় না।
তাই বলি বেশি দেরি না কইরা শহুরে ডাক্তারের অভিমান ভাই‌ঙে ফেল। নাইলে নিজের মনের কথা জানাইয়া দে। অন্তত মানুষটারে তো আর চিরদিনের জন্য হারাইয়া ফেলবি না!”
বাড়ি ফেরত আসার সময় বলা হৈমন্তীর কথাগুলো মনে পড়তেই ভয়ে আঁতকে উঠে উপমা। সত্যিই কি সে আবেগকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলবে? না। এ সম্ভব না। আবেগকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেললে সে বাঁচবে কি করে?
গুটি গুটি পায়ে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় উপমা। আবেগকে মনে পড়তেই ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটে ওঠে তার। তবে কি শেষ মেষ আবেগের প্রেমে সত্যিই পড়ে গেল উপমা?………………….
#চলবে 🍂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here