#মন_পাথরে_হঠাৎ_ঝড়
#পর্ব_৭
Tahrim Muntahana
দুপুর ১২ টা! চারদিকে রোদে খা খা করছে। মনে হচ্ছে সূর্যটা আজ খুব রেগে আছে! তোখর রোদে বাইরে বের হওয়া মুশকিল। তবুও জীবিকার তাড়নায় মানুষ এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। বাঁচতে তো হবে! এই গরমে এসির মধ্যেও আদর ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ঠিক গরম বললে ভুল হবে সে তো ভয়ে ঘেমে যাচ্ছে। হৃদপিন্ডটা দ্রুত গতিতে লাফাচ্ছে। আদরের মনে হচ্ছে শব্দটা বুঝি হৃদান শুনতে পাচ্ছে! তাই তো দরজার কাছে একদম ঠেসে বসে আছে। আর হৃদান গম্ভীর মুখে ভ্রু কুচকে আদরের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মাথায় আসছে না আদর কেন এমন করছে? মেয়েটি এখন ভয় পাচ্ছে কি? হৃদানের এমন চাহনী আদরের ভয় আরো দ্বিগুন বাড়িয়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে আজ আর সে বাঁচতে পারবে না। ঠাস ঠাস গুলি করে তার অতি বুদ্ধিসম্পন্ন খুলিটা উড়িয়ে দিবে! তারপর মেরে কোথাও ফেলে দিবে। নোংরা মাছি, পোকা’রা আদরের শরীরে বসে থাকবে। ভেবেই আদরের শরীর শিরশির করে উঠলো। এবার আর নিজের কান্না টা লুকিয়ে রাখতে পারলো না। ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিলো। হৃদান ভড়কে গেলো একদম। আদরের কান্না যেন থামছেই না। হেঁচকি উঠে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। জীবনের মায়া কার না আছে। সেখানে সাক্ষাত জম পাশে থাকলে তো এমন মনে হওয়ার ই কথা। হৃদান আদরের একদম কাছে চলে আসলো। তার হৃদপিন্ডটায় টা মনে হচ্ছে সংকোচন বেশী হচ্ছে নাহলে এত ব্যাথা করবে কেন? একটা মেয়ের কান্নায় এত কষ্ট হয়! হৃদান চৌধুরী আর কি কি নতুনত্বের সাথে পরিচিত হবে! হৃদান একহাত আদরের গালে রেখে নিজের দিকে ঘুরালো। চোখ ফুলে লাল হয়ে গেছে এর মধ্যেই।
‘এই আন্ডাবাচ্চা কাঁদছো কেন? কি হয়েছে? কোথাও ব্যাথা পেয়েছো? বলো কি হয়েছে? আমি বুঝবো কি করে বলো আমাকে!’
আদরের সেদিকে খেয়াল নেই সে কেঁদে যাচ্ছে তো কেঁদেই যাচ্ছে। হঠাৎ করেই আদরের চোখে চোখ পড়তেই হৃদানের কেন জানি মনে হলো আদর তাকে ভয় পাচ্ছে? আবার চমকে উঠলো! সে এই মেয়ের চোখের ভাষা পড়তে পেরেছে! রিয়েলি! দেট মিনস হৃদান চৌধুরী ফল ইন লাভ! তাও এই আন্ডাবাচ্চার! হুট করে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। আদরের কান্না থেমে গেলো। সে আড়চোখে হৃদানের দিকে তাকিয়েই কাঁদছিলো। হঠাৎ হাসি দেখে আদর ভড়কে গেছে। হৃদান চৌধুরীর মুখে হাসি? হাউ পসিবল? কান্না করার জন্য কি ভুল দেখছে নাকি? চোখে পানি মুছে, চোখ কচলে আবার তাকালো ; নাহ হৃদান চৌধুরী হাসছে, ঠোঁটের কোণে সুক্ষ হাসিটা অপূর্ব! ভয়াবহ রকমের সুন্দর লাগছে হৃদানকে। কারো হাসি এতটা সুন্দর! নাকি তার চোখেই সুন্দর লাগছে। আদরের এমন অবস্থা দেখে হৃদান হালকা শব্দ করে হেসে উঠলো। চমকে উঠলো আদর। নাহ সে আর নিতে পারছে না। হৃদান চৌধুরীর এতটা পরিবর্তন তার মাথায় ঢুকছে না। এবার সে অজ্ঞান হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। হৃদান আদরের একদম কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘অবাক হচ্ছো আন্ডাবাচ্চা? এতো পরিবর্তন কি করে সম্ভব? একটা মেয়ে হঠাৎ করে এসেই হৃদান চৌধুরীকে পাল্টে দিয়েছে। একদম পাল্টে দিয়েছে। মেয়েটি কে শুনবে? তুমি! তুমি নামক মেয়েটি আমার পাথর, নিষ্ঠুর মনে ভালোবাসার ঝড় হয়ে এসেছো। একদম উলটপালট করে দিয়েছো। তার শাস্তি তো তোমাকে পেতে হবে আন্ডাবাচ্চাজান!’
আদর আর নিতে পারলো না। কি সব বলছে হৃদান! সে কি করলো? দেখায় হয়েছে দু’দিন! দুদিনে কি এমন হয়েছে! মাথায় খেলছে না তার। হুশ হারিয়ে ঠাসস করে পড়ে গেলো হৃদানের বাহুতে। প্রথমে হৃদান চমকালেও পরে যখন বুঝতে পারলো হো হো করে হেসে দিলো সে। তার হাসি যেন মুখ থেকে যাচ্ছেই না। এতটা বাচ্চা কি হয় এই মেয়ে। এই টুকু শুনেই এমন অবস্থা! বাসর ঘরে তো যাওয়ার আগেই এই মেয়ে চার-পাঁচ বার অজ্ঞান হবে। তখন কি হবে? এসব ভাবনায় হৃদানের আরো হাসি পেলো। প্রেম নিবেদন ই হলো না সেখানে সে বিয়ে বাসরে চলে গেছে। হৃদান চৌধুরী টোটালি ম্যাড!
___________________
আতইয়াব পাগলের মতো খুঁজে চলছে আদর কে। ফোন ধরছে না আদর। আতইয়াব জানে তার বোন কতটা অভিমানী। কে জানে কোথায় চলে গেছে। পরশ, ফালাহ ওদের বাড়িতে খুঁজ নিয়েছে সেখানেও যায়নি। এখন সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারিমের হোস্টেলে যাবে। সেখানে যেতে পারে। ছুটে চলল গাড়ি করে। আজ সন্ধ্যায় একটা অপারেশন আছে। তাও যেই সেই আপারেশন না। হৃদান চৌধুরীর পেশেন্টের অপারেশন। উপর ওয়ালাই জানে কি হয়! অনেক বড় ঝড় বয়ে যাবে পেশেন্টের কিছু হলে! ভাবতে ভাবতেই হোস্টেল এসে পৌঁছালো আতইয়াব। দারোয়ান কে বলে হোস্টেল হেড কে ডেকে পাঠালো। ভেতরে যাওয়ার অনুমতি নেই। হোস্টেল হেড যখন জানালো তারিম কে তার ভাই নিয়ে গেছে আতইয়াব চমকে গেলো। তারিমের ভাই কে? কে নিয়ে গেলো ভাই পরিচয় দিয়ে? বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
ওর ভাই নিয়ে গেছে মানে? নাম কি ওর ভাইয়ের?
হৃদান চৌধুরী!
এবার আতইয়াব আতকে উঠলো। হৃদান চৌধুরী তারিম কে নিয়ে গেছে? নিশ্চয় কোনো বিপদে পড়েছে। আতইয়াবের ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। তারিমকে হারানোর ভয় হচ্ছে। কিন্তু কেন হচ্ছে? তারিম কে তো সে ভালোবাসে না ; তাহলে? তারিম তাকে ভালোবাসে বলে এমন হচ্ছে? নাকি পবিত্র এক বন্ধনে আবদ্ধ আছে বলে এমন হচ্ছে?
পাগলের মতো ছুটতে লাগলো গাড়ি নিয়ে। আজ হৃদান চৌধুরীকে সে ছাড়বে না!
কিছুক্ষণ হলো জ্ঞান ফিরেছে আদরের। সেই থেকে থম মেরে বসে আছে। পাশে বসে আছে তারিম। আদরের অবস্থা দেখে তারিম মিটমিটিয়ে হাসছে। তারও এমন হয়েছিলো হৃদান কে দেখে। এমন সময় আদরের ফোনটা বেজে উঠতেই তারিম ফোনটা হাতে নিলো। আদরের এদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে তার ভাবনায় ব্যস্ত। ভাইয়া নামটা ভেসে উঠতেই তারিমের ফোনটা রিসিব করে একটু কথা বলতে ইচ্ছে হলো। মানুষটা আর তার থাকবে না! ক্ষনিকের জন্য জীবনে এসেছিলো। আর মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই। আদরকে ফোন ধরিয়ে দিয়ে সে বাইরে যেতে নিবে আদর হাত ধরে ফেললো। তারিম করুণ চোখে তাকালো আদরের দিকে। আদর পাত্তা না দিয়ে টেনে বসিয়ে দিলো। ফোনের স্পিকার অন করে বিছানার উপর রাখলো ফোনটা। অপর পাশ থেকে আতইয়াব বলে উঠলো,
বনু তুমি ঠিক আছো? কোথায় চলে গেছো? ভাইয়ার টেনশন হয় তো?
আদর চুপ করে আছে। আতইয়াব আবার বলে উঠলো,
আ’ম সরি আদরপাখি। ভাইয়ার ভুল হয়ে গেছে। আমি তোমাকে সন্দেহ করি নি কখনো। না করেছি তারিম কে! আমার মনে শুধু প্রশ্ন জেগেছিলো। প্লিজ বিলিভ মি!
এবার আদর ফ্যাচ ফ্যাচ করে কেঁদে দিয়ে বলল,
ভাইয়া! এএএএএএএএএএএএএএএএএএএএএএএএএএএ!
আদরপাখি আ’ম সরি। প্লিজ ফরগিভ মি। আর কোনো ভুল করবো না। প্লিজ স্টপ ক্রাই। তোমার কান্না আমার সহ্য হয়না জানো তুমি! যা শাস্তি দিবার দিবে তবুও কেঁদোনা!
আতইয়াবের চোখ থেকেই মনে হচ্ছে পানি পড়বে। পানিতে টইটম্বুর হয়ে আছে দুটো চোখ। আদর কান্না না থামিয়ে বলে উঠলো,
ভাইয়া তোমার ওই পঁচা প্রেমিকা আমাকে মারতে এসেছিলো! আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। দিস ওমেন ইস ভেরি ব্যাড। আই হেট হার।
আতইয়াবের কান্না ভেজা চোখটা রাগে লাল হয়ে এলো। সাহস কি করে হয় তার বোনের দিকে হাত বাড়ায়। এর একটা বিহীত করেই ছাড়বে সে। ওই মেয়েকে উচিত শিক্ষা তো দিতেই হবে। এসব ভাবনার মাঝেই তারিনের কথা মনে হতেই আতইয়াব বলল,
আই অলসো হেট হার পাখি। ভাইয়া ওই ব্যাড গার্লকে শাস্তি দিবে। এখন কান্না থামাও। তারিন কোথায়? কথা হয়েছে ওর সাথে?
এতক্ষণ তারিন নিরব দর্শক হয়ে দেখছিলো সব। মাথা উপর দিয়ে যাচ্ছে এসব তার। আদর কি সব বলছে কে জানে। হঠাৎ আতইয়াবের মুখে তার নাম শুনে চমকে উঠলো তারিন। আতইয়াব তার কথা বলছে! বিশ্বাস ই হচ্ছে না যেন। আদরের কথা না শুনে আতইয়াব আবার বিচলিত হয়ে বলে উঠলো,
আদর আমি কিছু বলছি? হোস্টেল থেকে শুনলাম তারিন কে হৃদান চৌধুরী নিয়ে গেছে। ভালো না উনি। দয়া মায়াহীন একটা মানুষ। তারিন ঠিক আছে? ওর কোনো ক্ষতি হলে হৃদান চৌধুরীকে ছাড়বো না আমি। আমাকেও চেনে না সে। আমার বউ এর দিকে হাত বাড়ালে হাত কেটে নিবো একদম।
আতইয়াবের চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। তার ভেতর খুব করে তারিন কে হারানোর ভয় হচ্ছে। তারিন তো হতবাক হয়ে আতইয়াবের কথা শুনছে। আমার বউ কথাটা যেন তার সর্বাঙ্গ কাঁপিয়ে তুলেছে। আদর আতইয়াবের কথায় বাঁকা হাসলো। পরক্ষণে হৃদানের ব্যাপারে কথাটা তার ভালো লাগেনি একদম। হৃদান চৌধুরী চেন্জ! সে হাসে! কথা বলে মিষ্টি করে! তারিন ভ্রু কুচকে বলল,
‘তারিম ইস ওকে ভাইয়া। আমার সাথেই আছে। আর আমিও সেইভ আছি। আমি বাড়ি আসছি একটু পর।’
আতইয়াব শান্ত হলো। স্বস্তির নিশ্বাস নিলো সে। এখন মনে হচ্ছে প্রাণ ফিরে পেলো সে। শান্ত সুরে বলল,
‘তারিম কে নিয়ে ফিরবে! তাকে বলে দিও বেশী পাকনামি না করতে। আতইয়াব তাযিন ইততেয়াজ কে এখনো চিনে নি সে!’
ফট করে কল কেটে দিলো। ভালো লাগছে তার এখন। কিন্তু তারিম! তার তো মনে হচ্ছে সে সব স্বপ্ন দেখছে। হাউ পসিবল! আদর খুশিতে তারিম কে নিয়ে নাচতে শুরু করলো। তার প্ল্যান সাকসেসফুল! দরজায় ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে হৃদান সব কিছুই লক্ষ্য করছিলো। এতক্ষণের কান্না সব যে অভিনয় হৃদানের বুঝতে বাকি নেই। শেষমেষ সে একটা ড্রামাকুইনের প্রেমে পড়লো? না জানি সামনে তার জন্য কি অপেক্ষা করছে। বড় শালা টা তো মাশাআল্লাহ! বোন দিবে নাকি আল্লাহ মালুম! তাকেও চিনে না। একদম তুলে নিয়ে আসবে!
আদরের চোখ দরজার দিকে পড়তেই থেমে গেলো সে। এভাবে হাসতে দেখে খানিকটা লজ্জাও পেলো। এতক্ষণ উল্টাপাল্টা নাচছিলো দুজন। হঠাৎ করেই আদর কে লজ্জা পেতে দেখে হৃদান অবাক হলো। আদরের সাথে যেন লজ্জাটা মানাচ্ছে না। এসব বাদ দিয়ে সে এখানে আসার কারণ টা বলল,
‘আমি বের হবো সেটাই বলতে এসেছিলাম তোমাদের। তো এখন তো তোমরাও চলে যাবে বলছো। চলো নামিয়ে দিই তোমাদের।’
আদর এবার আরো অবাক হলো। হৃদান চৌধুরী তাদের নামিয়ে দিবে। এটা সত্য! আদরের অবাক হওয়া দেখে হৃদান মুচকি হেসে বলল,
‘মানুষ যেমন মরণশীল তেমনি পরিবর্তনশীল। মুড যেমন একসময় একেকরকম থাকে তেমন একজন মানুষ ও হঠাৎ পরিবর্তন হতে পারে। তার জন্য একটি ওয়ে প্রয়োজন। আমার জীবনের ওয়েটা আমি পেয়ে গেছি। তাই আগের হৃদান চৌধুরীর সাথে এখনের হৃদান চৌধুরীর মিল খুঁজো না। তাহলে সারাজীবন অবাক হয়েই যাবে। এক্সেপ্ট করতে শিখো আন্ডাবাচ্চা ভবিষ্যতে তোমার জন্যই সুবিধাজনক হবে। আমার হৃদয়ে যে ঝড় বয়ছে একই ঝড় যে তোমার হৃদয়েও দেখতে চাই। রেডি হয়ে এসো!’
হৃদান আর দাড়ালো না। মুচকি হেসে বের হয়ে গেলো ঘর থেকে। আদর আর মাথা ঘামালো না। রেডি হতে লাগলো। আবার এসে যদি ডিসুম ডিসুম দেয়। ঠিকঠাক হয়ে তারিম কে নিয়ে বের হয়ে এলো। পথিমধ্যে পান্চু কে দেখেই আদর লাফিয়ে উঠলো। তার তো পান্চু কে দারুণ লাগে। এগিয়ে গেলো আদর। পেছন থেকে ডেকে উঠলো,
‘আধা টাকু পান্চু কাকু! কাম কাম!’
পান্চু ভয়ে লাফিয়ে উঠলো। মেয়েটিকে তার জম মনে হয় এখন। মেয়েটি ওদের জীবনে আসার পর থেকেই তার সাথে খারাপ হচ্ছে। এতদিনের চেনা বসকে সে চিনতে পারছে না। ভুতের উদ্ভব হয়েছে। তার টাক মাথায় সত্যি সত্যি ভুতের নজর পড়েছে। এই মেয়ে থেকে দূরে থাকতে হবে ভেবে যেই না দৌড় দিবে ওমনি আদর সামনে এসে দাড়ালো। পান্চুর মুখ চুপসে গেলো একদম। আদর দুষ্টু হেসে ভ্রু নাচালো। পান্চু কাচুমাচু করে দাড়িয়ে রইলো। এখন সে রোস্ট হবে ভেবেই নিলো। হঠাৎ আদরের চোখ পান্চুর টাক মাথায় পড়তেই চমকালো সে। ব্যান্ডেজ কেন? বিচলিত হয়ে বলল,
‘আধা টাকু পান্চু কাকু তোমার টাক মাথায় ব্যান্ডেজ কেন?’
পান্চুর মনে হচ্ছে আদর কে একটা ঘুসি দিতে পারলে। সব তো তার জন্যই হয়েছে। মাথা বললেই তো হতো টাক মাথা বার বার করে বলে মনে করিয়ে দেওয়ার কি আছে? তার টাক মাথায় যখন শিরশির করে বাতাস ঢুকে তখনি তার মনে পড়ে সে টাকু! আদরের বড্ড মায়া হলো ব্যান্ডেজ দেখে। পান্চুকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে হাত বুলিয়ে দিলো মাথায়। পান্চু অবাক হয়ে গেলো আদরের কান্ডে। আদরের চোখ ছলছল করছে। মেয়েটা বড্ড ইমোশনাল! আদর মলিন কন্ঠে বলল,
‘কি করে ব্যাথা পেলে আধা টাকু পান্চু কাকু?’
আদরের মলিন কন্ঠে পান্চুও এবার নরম হলো। কেন জানি তার ভালো লাগছে আদর কে। কেমন মায়া মায়া লাগে মেয়েটিকে। মেয়েটা যে ভালোবাসতে পারে সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত। পান্চু বলল,
‘ঘন্টা তিনেক আগে বসের রুমে যাচ্ছিলাম। হটাৎ জোরে জোরে হাসির শব্দে ভুত ভেবে ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যাই। যার ফলে এমন। বস তো হাসে না তাই ভাবছিলাম ভুত। কিন্তু ভাবিনাই বসের জীবনে পেত্মীর আগমন হয়েছে।’
শেষের কথাটুকু আস্তে বলায় আদর শুনতে পায়নি। প্রথমটুকু শুনেই হেসে দিলো সে। ভুতকে কেউ এত ভয় পায়। সে তো ভয় পায়না! দুঃখী দুঃখী কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ব্যাথা পেলে তুমি হাতে পায়ে পেতে কিন্তু আমার পছন্দের টাক মাথাটাই কেন পেলে? ফাওল লোক! বেশ হয়েছে তোমার টাকু মাথায় হাগু পড়ুক।’
বলেই খিলখিল করে হেসে দৌড় দিলো। পান্চু যদি আবার মেরে দেয় তাকে। পান্চু তো রেগে ফায়ায়। কি বলে গেলো এই মেয়ে? তার মাথায় হাগু পড়বে। ছ্যাহ! পান্চু যেন কল্পনা করছে তার মাথায় হাগু পড়েছে। খপ করে টাকু মাথায় হাত দিলো; নাহ নেই। যাক বাবা ভালো! পান্চুর কান্ডে তারিম এবার হো হো করে হেসে দিলো। আদরের কথায় পান্চু যে সম্মোহনী হয়ে এমন করছে সে বুঝতে পারছে। নিজের কাজেই পান্চু লজ্জা পেলো। তাড়াতাড়ি হাটা ধরলো সেখান থেকে। মেয়েটা তার ইজ্জত প্লাস্টিক করে দিয়েছে। ওরা সবাই যেতেই তারিমের সামনে উপস্থিত হলো হৃদান। সে পুরো ঘটনায় দেখেছে। বেশ মজাও পেয়েছে সে। তারিম কে বলল,
নিজের খেয়াল রেখো। ভাইয়াকে ভুলে যেও না। মাঝে মাঝে স্মরণ করো!
কেন জানি তারিমের কান্না পেলো। দৌড়ে গিয়ে হৃদান কে জড়িয়ে ধরলো। এইটুকু সময়ের মধ্যে মানুষটা তার বড্ড আপন হয়ে গেছে। হৃদান ও আগলে নিলো তাকে। মনে হচ্ছে তারিম কে রেখে দিতে পারলে তার কাছে। কিন্তু সম্ভব না! তারিম কে ছাড়িয়ে মাথা হাত বুলিয়ে দিলো হৃদান। কিছু না বলেই হাটা ধরলো। কিছু শূণ্যতা তাকে আবার মনে করিয়ে দিচ্ছে বহুদিনের পুরোনো ক্ষতটা। তা আদও ভুলার কি?
_____________________
হসপিটার অপারেশন রুমে পাইচারি করছে হৃদান। ভেতরে অপারেশন করছে আতইয়াব। কিছুক্ষণ পর পর নার্স দৌড়াদৌড়ি করে এটা ওটা নিয়ে আসছে। মেজর অপারেশন চলছে। এই একটা অপারেশন হৃদান চৌধুরীর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। পিয়াস চেয়ারে বসে হৃদান কে পর্যবেক্ষন করছে। হৃদানের ব্যাপারে এমন কিছুই নেই যে সে না জানে। কত বছরের বন্ধুত্ব তাদের! চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে হৃদানের হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। হৃদান করুণ চোখে পিয়াসের দিকে তাকালো। পিয়াসের বুক টা ধক করে উঠলো। এই মানুষটার চোখে করুণতা মানায়? উহু! হৃদান চৌধুরী কখনো নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করেনি আজও করবে না। বুঝালো হৃদান কে। হৃদান চুপ করে বসে রইলো।
ঠিক তিনঘন্টা পর অপারেশন রুমের লাইট অফ হয়ে গেলো। হৃদান ধপ করে দাড়িয়ে গেলো। আতইয়াব বের হতেই হৃদান এগিয়ে গিয়ে কিছু বলবে তার আগেই অন্য একজন ডক্টর বলে উঠলো,
‘মি. চৌধুরী আমরা আমাদের বেষ্ট টা দিয়েছি। অপারেশন সাকসেসফুল কিনা বলতে পারছি না। পেশেন্টের জ্ঞান না ফিরলে বলা সম্ভব না। সম্ভবত কোমায় চলে যেতে পারে।’
চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো হৃদানের। কোমায় যাবে মানে কি? এতদিনের অপেক্ষা এইভাবে শেষ হয়ে যাবে। রেগে ডক্টরের কলার চেপে ধরলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
‘বলতে পারিস না মানে কি? ডক্টর হইছিস কেন? একজন রোগিকেই যদি বাঁচাতে না পারিস তোদের ডক্টর হয়েই লাভ কি তাহলে। এই পেশেন্টের যদি কিছু হয় তোদের কাউকে ছাড়বো না আমি। এই হসপিটালের অস্তিত্ব একদম মাটির সাথে মিশিয়ে দিবো। কত বছর অপেক্ষা করেছি। কতটা বছর! এর জন্য? কোমায় চলে যাবে এটা শোনার জন্য অপেক্ষা করেছি? খুন করে ফেলবো একদম!’
সবাই ভয়ে কাঁপছে শুধু একজন ছাড়া। হৃদানের এরকম ব্যবহার আতইয়াব কে রাগিয়ে দিলো। ডক্টরের কলার থেকে হৃদানের হাত ছাড়িয়ে বলল,
‘জন্ম মৃত্য উপর ওয়ালার হাতে। আমরা চাইলেই বাঁচাতে পারবো না। তাই অযহত আমাদের উপর আপনার ক্ষমতা খাটিয়ে লাভ নেই। অপেক্ষা করুন।’
হাটা ধরলো নিজের কেবিনের দিকে। এই হৃদান চৌধুরী কে দেখলেই তার রাগ হয়। এই ঝামেলা শেষ হলে আর হৃদান চৌধুরীর নজরে পড়তে চায় না সে। দূরে থাকবে একদম। হৃদান রাগ নিয়ে হসপিটাল থেকে বের হয়ে গেলো। রাগ কিছুতেই কমছে না তার। সবকিছু ভেঙে দিতে ইচ্ছে করছে। হটাৎ আদরের কথা মনে হতেই গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো। তার এখন আদর নামক মেডিসিন লাগবে!
চলবে..