মায়াবন বিহারিনী – পর্ব 17

0
384

#মায়াবন_বিহারিণী 🌻
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#সপ্তদশ_পর্ব
৪৩.
পথিমধ্যে হেঁটে চলেছে উপমা। যেই পরিকল্পনা মোতাবেক বাড়ি থেকে সে বেরিয়ে ছিল তাতে কিছুটা হলেও হৈমন্তীর প্রয়োজন ছিল। গ্রামের শেষ মাথায় অফিসার আমানের দারোগা অফিস। এতদূর পথ একা একা চললে ফিরতে বেশ বেলা হয়ে যাওয়ার আশংকায় হৈমন্তীর বাড়িতে গিয়ে জানতে পারে হৈমন্তী আজ তার ভাইয়ের সঙ্গে সদরে গিয়েছে বেশ আগেই। পরিবারের একজন অন্যতম সদস্য অসুস্থ হওয়ার ফলস্বরূপ পুরো বাড়ি জনশূন্য বললেই চলে। তাই একরাশ মন খারাপ করেই সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে সে। ইশ্ এমন যদি হতো এখন হুট করেই অফিসার আমানের সাথে দেখা হতো তাহলে?
সেই ভাবনায় পুনরায় উত্তরের সুদূর পথ ধরে পা বাড়ায় উপমা।
আজকে বেশ সকালে উঠেই আবেগ বের হয়েছিল হাঁটতে। আজকেই তো এখানে তার শেষ দিন। কাল ভোরের পূর্বেই চলে যেতে হবে এই প্রিয় জায়গাটির মায়া কাটিয়ে আবারো সেই যান্ত্রিকতার শহরে। তবুও এই কয়েকদিনের সফর চির স্মরণীয় করে রাখার মত। এই অল্প কয়েকদিনেই ত্রিমো‌হিনীর আবহাওয়ার সাথে সে মিশে গিয়েছে। সাথে করে প্রাপ্তির খাতায় ও যোগ হয়েছে সবচেয়ে মূল্যবান উপহার। তার প্রেয়‌সী। হ্যাঁ, উপমাকে তো সে পেয়েছে এই ত্রিমোহিনী‌র মাধ্যমেই। আচ্ছা এখান থেকে যখন চলে যাবে তখন তার প্রেয়সীর দেখা পাবে কি করে? সেই চঞ্চলতা, মায়াবী চোখজোড়া, মৃদু হাসির রেখা এসব তো আর রোজ রোজ দেখতে পারবে না সে। এসব কল্পনা করতেই হৃদয় ধীরে ধীরে বিষন্নতার রূপ নেয় আবেগের। ততক্ষণে সে সায়ানের সাথে ক্যাম্পে পৌঁছে গিয়েছে। আজ উপমা আসবেনা? চোখ জোড়া আশপাশে একবার ভালো করে বুলিয়ে নেয় আবেগ। না উপমার কোনো হদি‌সই নেই। হয়ত এখন আর দেখা পাওয়া যাবে না চঞ্চল রমণীর।
– “উপমা তো বাড়িত নাই। যদি আসলেই কিছু কইরা বসে? চালচলন তো অয়ন্তিকার মতোনই। সবখানে নাক গলা‌নির স্বভাব আর উড়ু উড়ু ভাব।”
ইফতেখার সাহেবের দিকে সরু দৃষ্টিতে চেয়ে সন্দিহান গলায় বলে উঠেন আমেনা বেগম। ঘরে বসে সবে মাত্র মুখে একটা পান পুরে ছিলেন ইফতেখার সাহেব। আমেনা বেগমের কথায় তিনি তুখোড় দৃষ্টে আমেনা বেগমের দিকে তাকান। অতঃপর বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলে উঠেন,
– “তোমরা মাইয়া মাইনষের জাতটাই খারাপ। সব বিষয়েই বা হাত ঢুকাইয়া নিজের নির্বুদ্ধিতার কারনামা‌ দেখাও। যা যেমন চলতেছে তারে তেমনই চলতে দাও।”
এটুকু বলেই থামেন তিনি। পুনরায় কিছু একটা ভাবতেই তার ঠোঁটের কোণে পৈশাচিক হাসির রেখা ফুটে ওঠে।
– “বাদবাকি রইলো উপমা? অয়ন্তিকার উড়ু উড়ু ভাব যেমন তার ডানা ছাটতে‌ই চইলা গিয়াছি‌ল প্রয়োজনে উপমার পরিণতি ও একই হইব।”
আমেনা বেগম ও ইফতেখার সাহেবের কথায় ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসেন। ততক্ষণে রুমের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পড়ে গিয়েছে। সামনে চোখ তুলে তাকাতেই খেয়াল করে সজল হাতে একটা ব্যাগ এবং প্রয়োজনীয় কিছু সামগ্রী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইফতেখার সাহেব চোখের ইশারা দিতেই দাঁত কেলিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে সজল। বাঁকা চোখে একবার আমেনা বেগমের দিকে তাকাতেই তিনি পানের বাক্স নিয়ে রুম থেকে হুড়হু‌ড় করে বেরিয়ে যান। আর পরক্ষণেই শুরু দুজনার মধ্যবর্তী আলাপ আলোচনা।
৪৪.
– “আপনাগো বড় সাহেব, লম্বা, ফর্সা কইরা থাকা বড় স্যা‌রটা কি এহন আছে?”
চঞ্চল চোখ দুটো আশপাশে ভালো করে বুলিয়ে নিয়ে সামনে থাকা দারোগা‌কে উদ্দেশ্য করে বলে জিজ্ঞাসা করে উঠে উপমা। থানায় নতুন ট্রান্সফার কৃত দারোগা কুদ্দুস একবার ভালো করে পরখ করে নিলেন উপমা কে।
মেয়েটার উৎসুক কন্ঠ মোটেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। আর এখানে এত পুলিশ থাকতে অফিসার আমানকেই প্রয়োজন কেন তার। তাই স্বাভাবিক ভাবেই তিনি বলে উঠলেন,
– “বড় সাহেব এখন নাই। আলী মিয়ার লগে পাশের গঞ্জের এক জায়গায় গেছে তদন্ত তল্লাশি করবার জন্যে। তয় আপনে এহেনে? কোনো মামলা, মোকাদ্দমা করতে হইলে এহেনে আরো বড় স্যার রা আছে।”
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার কথা শুনে মুহুর্তেই মনের মধ্যে থাকা আশাগু‌লোকে দূর দূর করে পালিয়ে যেতে দেখলো উপমা। হাতে তো একদমই সময় নেই। এতদূর সাহস করে চলে আসাটা কি তবে বিফলে গেল? অফিসার আমানের সাথে এত জরুরি কথা এখন বলবে কি করে তাহলে সে!
তবুও নিরাশ ভঙ্গিমায় সেই কুদ্দুস দারোগা কে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
– “না থাক, দরকার নাই। তয় বড় স্যার আসতে কতক্ষণ সময় লাগব।”
উপমা ভেবেছিল এবার আশানুরূপ কোনো উত্তর পাবে সে। কিন্তু তার ধ্যানধারণায় পানি দিয়ে কুদ্দুস দারোগা বলে উঠেন,
– “সঠিক জানি না। কিন্তু মনে হয় না বড় সাহেব বিকেলের আগে ফেরত আসব। শুনছি কোন বাড়িতে জানি খুন খারাবি‌ নিয়া মামলা হইছে। সেইখা‌নেই গেছে সে।”
এবার উপমা পুরোপুরি হতাশ হলো। এখন প্রায় মধ্যদুপুর। বিকেলে যদি অফিসার আমান আসে তবে বাড়ি ফিরতে ফিরতে নিশ্চিত রাত হয়ে যাবে। আর ইফতেখার সাহেবের মতো তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ যদি একবার সন্দেহ করে বসে তার উপর তাহলে আর রেহাই নেই। অবশ্য এসবকে বুদ্ধির আওতায় আনা যায় না। এসবকে বড়জোর কুবুদ্ধির খাতায় হস্তান্তর করা যাবে।
তাই কুদ্দুস দারোগার‌ কথা শুনে একপ্রকার মন খারাপ নিয়েই থানা হতে বের হয়ে পড়ে উপমা। আজকের তৈরি করা এত সুন্দর একটা পরিকল্পনা যে এভাবেই নষ্ট হয়ে যাবে তা কে জানতো? তবে যাই হোক না কেন অফিসার আমানকে এসব সম্পর্কে খুব শীঘ্রই অবগত করা প্রয়োজন।
গ্রামবাসীর সবাইকে ঘুরে ঘুরে প্রার্থী পদের ভোটের পেপার বিলা‌চ্ছেন ইফতেখার সাহেব। গ্রামবা‌সীও তেমন একটা আগ্রহ না দেখালেও একপ্রকার বাধ্য হয়েই তা গ্রহণ করছে। তারা খুব ভালো করেই জানে ইফতেখার সাহেবের ক্ষমতা সম্পর্কে। এবারও বিভিন্ন অসৎ উপায় অবলম্বন করে তিনিই চেয়ারম্যান পদে জয়ী হবেন এটা সম্পর্কে অবগত গ্রামবাসী।
অন্যদিকে সূর্য মাথার একপাশে হেলে পড়েছে অনেকটা। রৌদ্রের প্রখরতা কমে গিয়ে মৃদু শীতল বাতাস বইতে শুরু করেছে আশপাশ জুড়ে। উত্তরের রাস্তা ধরে পুনরায় একই পথে হেঁটে আসে উপমা। কিন্তু তার মাঝেই একটা বাড়ির সামনে থাকা বাঁশঝাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে দেখতে পেয়েই থমকে দাঁড়ায় উপমা। চোখ দুটো যেন বিশ্বাস করতে চাইছে না। তবুও এ অবিশ্বাসের মাঝে মৃদু হাসির রেখা ফুটে তার হতাশায় নিমজ্জিত মুখশ্রীতে।
৪৫.
ক্যাম্পের অনেকটা কাছাকাছি চলে আসায় উপমার টনক নড়ে ওঠে। মনে পড়ে যায় আবেগের কথা। আজ তো তার সাথে একটিবার দেখা করা ভীষণ প্রয়োজন। আর একটা রাত পরেই তো মানুষটা তাকে ছেড়ে আবার শহরে পাড়ি জমাবে। কতদিন, কতকাল পর দেখা হবে নাকি আর কোনোদিনই দেখা হবে না এই শঙ্কায় পড়ে যায় উপমা। তবুও কেন যেন সেদিকে আর পা বাড়াতে মন চাইলো না তার। একে তো শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই তার উপর মাথা ভর্তি ভারী ভারী চিন্তা। এই নিয়ে আর আবেগের সামনে মুখোমুখি হওয়া সম্ভব নয়। তাই সেদিকে না গিয়ে সোজা বাড়ির রাস্তায় পা বাড়ায় উপমা।
অন্যদিকে চলতি ঘড়ির কাঁটার দিকে বাঁকা চোখে তাকায় আবেগ। সময় তো প্রায়ই শেষ। হাতে গোনা দু একটা রোগী আছে ক্যাম্পে। আজই তার শেষ ডিউটি এখানে। শুধু তার না আরোও বেশ কয়েকজনেরই‌। তাই‌ আজ শেষ দিনে রোগীদের চাপ একটু বেশিই ছিল। কিন্তু এতসব মানুষের মাঝেও তার চোখ জোড়া অন্য কাউকেই খুঁজছিল। কিন্তু বারবার হতাশা তাকে জানান দিয়ে দেয় যে, ‘না তোর প্রেয়সী আসেনি আজ’। আচ্ছা উপমা কি কোনোভাবে ভুলে গিয়েছে যে আজকেই তাদের শেষবারের মতো দেখা হলেও পারত। কিন্তু উপমা তো এমন মেয়ে নয়। ভাবতে ভাবতেই উপমার প্রতি কিঞ্চিৎ পরিমাণ অভিমান জমা শুরু করে আবেগের হৃদয়ে। তার ধ্যানধারণায় ছেদ পড়ে ডক্টর সায়ানের‌ ডাকে।
– “ডক্টর আবেগ, আর ইউ ওকে? চলুন এবার, সময় শেষ আমাদের। বাড়িতে গিয়ে রেস্ট নিয়ে প্যা‌কিং শুরু করতে হবে ফের। কাল ভোরেই ঢাকার ট্রেনে ব্যাক করতে হবে।”
সায়ানের‌ কথা শুনে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় আবেগ। অতঃপর টেবিল ছেড়ে উঠে উপস্থিত সবার সাথে শেষ একবার কুশল বিনিময় করে সায়ানের সঙ্গে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে পড়ে।
বাড়ি ফেরার পর চারপাশের পরিবেশ বেশ শান্ত শীতল দেখে বেশ খানিকটা চমকা‌য় উপমা। গুটি গুটি পায়ে রুমের ভেতরে প্রবেশ করতেই খেয়াল করে আমেনা বেগম সযত্নে বসে পূর্ণাকে‌ খাইয়ে দিচ্ছেন। এমন দৃশ্য পরিলক্ষিত হতেই চোখ কোট‌র থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম উপমার। সাথে করে সন্দেহ আরো এক ধাপ গাঢ় হয় তার। আমেনা বেগম তার ঘরে? তার উপর তিনি নিজ হাতে পূর্ণাকে খাইয়েও‌ দিচ্ছেন! এও কি আদৌ সম্ভব। কেননা পূর্ণার জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায়শই দায়িত্ব উপমা নিজ হাতেই পালন করেছে। অপরদিকে উপমাকে সদর দরজায় মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমেনা বেগম আদুরে গলায় বলে উঠেন,
– “আহা বাইরে দাঁড়ায় আছিস ক্যান? সন্ধ্যা হইয়া গেছে। যা কলপা‌ড় থেইকা হাত মুখ ধুইয়া আয়। আমি খাওন বাইড়া দিতাছি।”
এবার উপমা নিশ্চিত যে এসব কোনো মমতাময়ী মায়ের স্নেহ না বরং কোনো গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ মাত্র। কোনো কথা না বলে রুমে প্রবেশ করে চেয়ারের উপর থাকা একটা শাড়ি আর গামছা নিয়ে দ্রুত চলে যায় বাহিরে।…………….
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here