#মায়াবন_বিহারিণী 🌻
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#চতুর্বিংশ_পর্ব (অন্তিম খন্ডাংশ-৪)
৬১.
হঠাৎ পেছন থেকে প্রত্যাশিত কারো কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে থমকে দাঁড়ায় অবন্তী। ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই খেয়াল করে আবেগ তার দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। সেকেন্ড কয়েক বাদেই আবেগ এসে অবন্তীর পাশে দাঁড়ায়। আসবে আবেগ এসেছে বলে অবন্তীও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
– “যাক বাঁচা গেল। আমি তো ভেবেছিলাম আপনি আসবেনই না। আপনাকে আসার জন্য অনেক ধন্যবাদ স্যার।”
অবন্তীর কথার বিনিময়ে সৌজন্যমূলক হাসি দেয় আবেগ।
– “চলুন তাহলে এখানে বসে বাকি গল্পটুকু শোনা যাক।”
বলেই অবন্তী পাশে থাকা বেঞ্চে বসতে নিলেই আবেগ স্বাভাবিক গলায় বলে উঠে,
– “উহু, এখানে না।”
– “তাহলে কোথায়?”
ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে অবন্তী।
– “চলো তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি।”
বলেই সোজা পথ ধরে হাঁটা শুরু করে দেয় আবেগ। অবন্তী ও দেরি করে না; আবেগের পথ অনুসরণ করে দ্রুত চলা শুরু করে। মিনিট বিশেকের রাস্তা পার হতেই অবন্তী খেয়াল করে চারপাশের পরিবেশ নিস্তব্ধ অনেকটাই আগের তুলনায়। মনে একরাশ ভয় জন্ম নেয় তার। আবেগ তাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে? কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে আবেগ গিয়ে একটা নদীর সামনে দাঁড়ায়। ঠিক সেই গাছ, সেই দুটো নৌকা বাঁধা তবে পার্থক্য শুধু এইটুকু যে সময়ের বিবর্তনে তা মৃত। গাছের পাতা ঝরে গিয়ে শুধু শিকড় আগলে একটি কাঠ দন্ডায়মান; আশেপাশে তার শুকনো ডাল পালা আছে অবশ্য। আর প্রখর রোদ তাপে নৌকা দুটোর গায়ের পাটাতনের কাঠে ফাটল ধরেছে; সাথে করে জন্মেছে শৈবাল ও। আশেপাশে একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিল আবেগ। সবকিছু পাল্টে গেলেও এই জায়গায় তেমন কোন পরিবর্তন ঘটেনি। অন্যদিকে চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখছে অবন্তী। আসলে সে বোঝার চেষ্টা করছে যে আবেগ আসলে তাকে কোথায় নিয়ে এসেছে। কিন্তু পরক্ষণেই আবেগের বর্ণণাতীত সব বৈশিষ্ট্য মিলে যাওয়ায় তার বুঝতে বাকি থাকে না যে আবেগ তাকে নিয়ে ব্যাখ্যায়িত সেই নদীর পাশেই নিয়ে এসেছে। বেশ কিছুক্ষণ সময় ব্যায়িত হবার পর ও আবেগকে চুপ থাকতে দেখে অবন্তী গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠে,
– “আচ্ছা তারপর কি হয়েছিল? ইফতেখার সাহেব, পূর্ণা, উপমা কোথায়?”
অবন্তীর প্রশ্নে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আবেগ। অতঃপর ধরা গলায় বলা শুরু করে,
– “মাঝখান থেকে কেটে গিয়েছে দশদিন। এই দশদিনে হসপিটালের ব্যস্ততায় সময় হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে ক্রমশ। তাতে অবশ্য ভালোই হয়েছে একদিক থেকে। সময় গুলো দ্রুত চলে যাচ্ছে। হসপিটালের কেবিনে বসে একদৃষ্টে বাইরের দিকে তাকিয়ে উপমার কথাগুলো ভাবছিল আবেগ। মেয়েটা কি অদ্ভুতভাবে নিজের মায়ায় ফেলে দিয়েছে; যে সময়ে অসময়ে তার কথাই শুধু মনে পড়ে। হঠাৎ করে কেবিনের দরজায় টোকা পড়তেই টনক নড়ে ওঠে আবেগের। দ্রুত গলা ঝেড়ে অপর পাশের থাকা মানুষটিকে ভেতরে আসতে বললেই ডক্টর সায়ান হেলেদুলে ভেতরে প্রবেশ করেন। হাতে তার একগাদা ফাইল।
– “ডক্টর সায়ান, আপনি?”
– “হ্যাঁ, এখন তো লাঞ্চ টাইম। তাই ভাবলাম আপনার কেবিনে চলে আসি। লাঞ্চ করাও হয়ে যাবে আর সাথে করে আপনাকে ইনভাইটেশন ও দেয়া হয়ে যাবে।”
– “ইনভাইটেশন? কিন্তু কিসের?”
ডক্টর সায়ানের দিকে খানিকটা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে উঠলো আবেগ।
– “সিঙ্গেল থেকে চিরদিনের জন্য মিঙ্গেল হয়ে যাওয়ার ইনভাইটেশন। আপনিও তাড়াতাড়ি বিয়েটা করে ফেলুন, বুঝলেন ডক্টর আবেগ?”
সায়ানের কথা শুনে মৃদু হাসলো আবেগ। তবে এ বিষয়টা নিয়ে বিগত কয়েকদিন ধরেই চিন্তা করছিল সে। মাকে আর বড় ভাইকে অন্তত একবার সবটা জানানো উচিত। উপমাকে একবার বিয়ে করে এখানে আনতে পারলেই তার যাবতীয় পড়াশোনা সহ সকল কিছুর দায়িত্ব সে শান্ত মনে পূর্ণ করতে পারবে। না হলে উপমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় কোথাও না কোথাও থেকেই যায়। তাই খুব শীঘ্রই ইশিতা বেগমকে উপমার ব্যাপারে জানানোর সিদ্ধান্ত নেয় আবেগ।
যথারীতি দিনক্ষণ পার হয়। দেখতে দেখতে সায়ান আর উশানীর বিয়ের দিন চলে আসে। আজ তেমন একটা ক্রিটিক্যাল কেস না থাকায় সন্ধ্যার পর পরই সায়ানের বাড়ির দিকে রওনা দেয় আবেগ। এমনিতেই গতকাল হলুদ রাতে পেশেন্টের জন্য অনুষ্ঠানে জয়েন করতে পারে নি। যার ফলস্বরূপ আজকে আগেই যেতে হচ্ছে তাকে। হসপিটাল থেকে বেরিয়ে মিনিট চল্লিশেক পার হতেই সায়ানের বাড়িতে পৌঁছে যায় আবেগ। পুরো বাড়ি সুন্দর করে লাইটিং দিয়ে ডেকোরেশন করা। ভেতরে মানুষের ভীড়ভাট্টা ঠেলে সায়ানের রুমে প্রবেশ করে আবেগ এবং সেখানেই সায়ানের সাথে দেখা করে নিজেও রেডি হয়ে নেয়। ঘন্টাখানেক বাদেই সায়ান এবং উশানীর বিয়ে পড়ানো শুরু হয়ে যায়। হসপিটালের অনেকেই এসেছে উশানী আর সায়ানের বিয়েতে। সব আয়োজন শেষ হতে হতে প্রায় রাত দুটো বেজে যায়। ঢাকা শহরের খোলা রাস্তা তখনও আলোকিত। সায়ানের বাসা থেকে বেরিয়ে গাড়ির কাছে আসতেই ফোন তার নিজস্ব রিংটোনে বেজে ওঠে। পকেট থেকে ফোন বের করতেই আবেগ খেয়াল করে ইশিতা বেগমের নম্বর থেকে মোট ৫ টা মিসড কল এসেছে; হয়তো ভেতরে থাকা আওয়াজের কারণে শুনতে পায়নি। কিন্তু কল ব্যাক করতে গিয়েই ঘটে আরেক বিপত্তি। ফোনে চার্জ ডেড লাইন ক্রস করে ফেলেছে। রিং হতে হতে মাঝপথেই ফোন বন্ধ হয়ে যায় আবেগের। ফলস্বরূপ ফের ইশিতা বেগমকে কল ও করা হয় না তার। পার্কিং এরিয়া থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিজ বাসার দিকে রওনা দেয় সে।
৬২.
– “দাড়াও আবেগ।”
ঘরে ঢুকে নিজের রুমের দিকে ক্লান্ত শরীরে সবেমাত্র পা বাড়িয়েছিল আবেগ। মিস্টার আহিলের কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে না চাইতেও থমকে দাঁড়ায় সে।
– “তোমার ফোন কোথায়? তোমার ফোনে আমি কতবার কল করেছি জানো? জরুরী কোনো কথা কিংবা কাজেই তোমাকে পাওয়া যায় না।”
– “ব্যাটারি ডেড হয়ে গিয়েছিল। বলুন কি বলবেন মিস্টার আহিল শাহরিয়ার!”
স্বাভাবিক কন্ঠেই প্রত্ত্যুতরে বলে উঠে আবেগ।
– “ঠিক আছে, আমরা আগামী সপ্তাহেই তোমার জন্য মেয়ে দেখতে যাচ্ছি আর সেখানেই বিয়ের ডেট ফিক্সড করে আসব। আমার বন্ধুর মেয়ে আনিশা, ইউকে থেকে এবার বিডিতে ফিরছে। ও আসলেই আমি তোমাদের দুজনের বিয়েটা সেরে ফেলতে চাই। সো মেন্টালি প্রিপেয়ার্ড হও।”
আহিল সাহেবের কথা কর্ণপাত হতেই চোয়াল শক্ত হয়ে আসে আবেগের। কোনো সাজেশন নেই, জিজ্ঞাসাবাদ নেই; ডিরেক্ট বিয়ে! এর কোনো মানেই হয় না। চাপা রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠে,
– “আপনি এসব কি বলছেন মিস্টার আহিল? কিসের বিয়ে? বলা নেই কওয়া নেই বললেই কোনো সম্পর্ক হয়ে যায় না। আর সবচেয়ে বড় কথা আমি কখনোই আনিশাকে বিয়ে করতে পারব না; কেননা আমি একজনকে ভালবাসি আর তাকেই বিয়ে করব।”
আবেগের এমন কথায় ভ্রু কুঁচকে নেন মিস্টার আহিল। অতঃপর মুখশ্রীতে গম্ভীর ভাব এনে বলে উঠেন,
– “আবেগ, তুমি তোমার লিমিট ক্রস করে যাচ্ছো! তোমার সাহস হয় কি করে এ কথা উচ্চারণ করার? নিশ্চয়ই তোমার এই চিপ প্রফেশনের মত তোমার ভালোবাসা ও চিপ হবে। আর আমি একবার যা বলেছি তাই হবে। শুনে রেখে এ বাড়িতে আমার কথাই চলবে। অনেক বাড় বেড়েছ তুমি; যা বলেছি তাই করো। তুমিও যাবে আমাদের সাথে আগামী সপ্তাহে এন্ড দ্যাটস ফাইনাল।”
– “তাহলে আপনিও শুনে রাখুন মিস্টার আহিল, আমি উপমাকে ভালোবাসি আর ওকেই বিয়ে করব। কোনোকিছুর বিনিময়ে আমি তাকে হারাতে পারব না।”
– “তাহলে বেরিয়ে যাও এ বাড়ি থেকে। এ বাড়িতে কোনো জায়গা নেই তোমার।”
শেষোক্ত কথাটির সময়েই ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হন ইশিতা বেগম। আহিল সাহেবের কথা শুনে বেশ বড়সড় ধাক্কা খান তিনি। কি বলছে এসব তার স্বামী! আর আবেগকেই বা কেন বেরিয়ে যেতে বলছে?
– “কি যা তা বলছেন আপনি, আবেগ বেরিয়ে যাবে কেন? কি করেছে ও? এত রাতে ছেলেটা কোথায় যাবে?”
– “কি করেছে সেটা তোমার ছেলেকেই জিজ্ঞেস করো, সে কিনা আনিশাকে বিয়ে করবে না! কোন এক রাস্তার চিপ মেয়েকে ভালবেসে ফেলেছে!”
আহিল সাহেবের কথা শুনে চুপ হয়ে যান ইশিতা বেগম। অবিশ্বাস্য চোখে একবার আবেগের দিকে তাকান তিনি। তার আবেগ কাউকে ভালোবাসে?
– “ঠিক আছে, আমি বেরিয়ে যাচ্ছি এ বাড়ি থেকে।”
বলেই ইশিতা বেগমের দিকে এগিয়ে যায় আবেগ। অতঃপর ইশিতা বেগমের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিচু গলায় বলে উঠে,
– “আ’ম সরি মা, আমি তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি এটা ভেবো না। আমি আমার শীঘ্রই ফিরে আসব আমার ভালোবাসাকে নিয়ে। আর ততদিন পর্যন্ত আমি তোমার থেকে দূরেই থাকব কারণ মিস্টার আহিল এবার আমার ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আর আমি সব সহ্য করলেও এটা সহ্য করতে পারব না।”
ইশিতা বেগমের চোখের কোনে জল জমে তা উপচে পড়তেও শুরু করেছে ইতোমধ্যে। তবে তিনি মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলেন না স্বামী আহিল শাহরিয়ার এর সামনে। আবেগের চোখের কোণেও জল জমেছে তবে সেটা কারোও দৃষ্টিগোচর হলো না। সে ধীর পায়ে রুম থেকে প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়লো রুম থেকে। আবেগের মায়ের এবং বড ভাবীর আহত দৃষ্টি ও আটকাতে পারলো না আবেগকে। সে চুপচাপ বেরিয়ে পড়ে বাসা থেকে। আবেগ বেরিয়ে যেতেই আহিল সাহেবের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকান ইশিতা বেগম।
– “এইযে দেখতে পারছেন যে এই বাড়ি থেকে একটা প্রাণ চলে গেল; শূধুমাত্র আপনার এই দাম্ভিকতার কারণে। আর আপনার এই দাম্ভিকতার পতন হিসেবে একদিন এই প্রাণহীন বাড়িতে শুধু আপনার একাই থাকতে হবে। সেদিন আপনি আপনার আপনজনদের পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে উঠবেন কিন্তু কাছে পাবেন না!”
বলেই নিজের রুমের দিকে কান্না করতে করতে চলে যান ইশিতা বেগম।…..…..
#চলবে