বীরাঙ্গনা হইতে বারাঙ্গনা (২য় পরিচ্ছেদ) – 03

0
289

#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (২য় পরিচ্ছেদ)
#মম_সাহা
পর্বঃ ৩
হাতের উপর হাত রেখে এই প্রথম পত্র সিনেমা দেখেছে। তাও কেমন মিষ্টি প্রেম প্রেম সিনেমা। সাথে সুদর্শন পুরুষের কিঞ্চিৎ যত্নও পেয়েছে সে। কিঞ্চিৎ বললে ভুল হবে, এতটা যত্ন সে কখনোই পায় নি কোনো পুরুষের কাছ থেকে। তবে অভ্রদাও প্রকাশ্যে না হোক আড়ালে করতো এমন যত্ন। সিনেমা শেষ হতে হতে বিকেল নেমেছে। ঝড়ো আবহাওয়া চারদিকে। বৃষ্টি আসবে আসবে করেও আসছে না তবে আকাশ অনবরত ডেকে যাচ্ছে নিজের মতন। সিনেমা হল থেকে বেরিয়েই আকাশের ভয়ঙ্কর রূপ দেখে ক্ষাণিক ভীত হলো পত্র। আৎকে উঠে বললো,
“বৃষ্টি আসবে তো মনে হচ্ছে। তাড়াতাড়ি চলুন। এমনেতেও কতো দেরি হয়ে গেলো!”
মেয়েটার চিন্তিন নয়ন যুগল দেখে হাসলো আতস। আরেকটু কাছে এসে মেয়েটার কানের পিঠে এক গুচ্ছ চুল গুঁজে দিয়ে শীতল কণ্ঠে বললো,
“ভয় পাচ্ছে কেন! আমি আছি তো। নিয়ে যাবো।”
পত্র মাথা দুলালো। আতস শক্ত হাতে মুঠ করে ধরলো পত্রের নরম তুলতুলে হাতটা। আদুরে ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে জিপের দিকে অগ্রসর হলো। পত্র ততক্ষণে মাথা নুইয়ে রেখেছে। আশেপাশে চা বাগানের অনেক পরিচিত মুখই আছে। কারো চেখে পড়ে গেলে যে সমস্যা পোহাতে হবে তাকে। গাড়ির কাছটাতে এসেই চমকে গেলো পত্র। গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে আতসের বন্ধু কঙ্কর এবং গৌরব। তারা দু’জন অবশ্য নিজেদের মাঝে বাক বিতণ্ডায় ব্যস্ত, এখনো খেয়াল করে নি আতস ও পত্র কে। পত্রই প্রথম দেখেছে তাদের, দেখার সাথে সাথে সে দাঁড়িয়ে পড়লো সেই জায়গাতে। পত্র আচমকা থেমে যাওয়াতে পা থেমে গেলো আতসেরও। সে অবাক চোখে পত্রের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
“কী সমস্যা পত্রলেখা? দাঁড়িয়ে পড়লে যে!”
পত্র চোখের ইশারায় সামনে তাকালো, সাধারণ মানুষের ফাঁকফোকরে নিজের বন্ধুদের দেখতে পেয়ে বেশ চমকে গেলো। বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“ওরা এখানে কেন? কখন এলো?”
পত্র ঠোঁট উল্টালো, ভ্রু যুগল কুঁচকে বললো, “আপনার বন্ধু, আমি কীভাবে জানবো কখন এসেছে!”
পত্রের বাচ্চামো মেশানো কন্ঠে হাসলো আতস, মিছি মিছি ভাবুক হয়ে বললো,
“তাও তো কথা, আমার বন্ধুর খবর তুমি কীভাবে দিবে! তা এখন কী করা যায় বলো তো?”
পত্রও বেশ চিন্তিত হলো। কতক্ষণ ভেবেচিন্তে অবশেষে সমাধান বের হতেই উৎফুল্ল হাসলো পত্র। বিশ্ব জয়ের হাসি খানা মুখে লেপ্টে বললো,
“আপনি এক কাজ করুন, আপনি একা ই যান উনাদের সামনে আর আমি পিছনের ঢালু রাস্তা দিয়ে সোজা হেঁটে বাজারে উঠে যাবো। তারপর বাড়ি চলে যাবো। কী বলেন?”
পত্রের বুদ্ধি ঠিক পছন্দ হলো না আতসের। সে চোখ-মুখ গুটিয়ে বললো,
“না, না, তা কী করে হয়! আধাঁর হয়ে গেছে এমনেতেই, এর মাঝে তুমি একা কীভাবে যাবে! তা হয় নাকি কখনো!”
“এটা আমাদের চা বাগান, আমি এর পুরো কোণা কোণা চিনি। অত চিন্তা করার কিছু নেই।”
পত্রের স্বান্তনার বাণীতেও কাজ হলো আতসের কথার৷ সে নাছোড়বান্দা, পত্রকে একা যেতেই দিবে না। অতঃপর অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করানো হলো আতসকে। সে অতঃপর রাজি হলো পত্রকে একা ছাড়ার জন্য। আতসকে রাজি করতে পেরে পত্র বিজয়ী হাসি দিয়ে মুখ চোখ ঢেকে ছুট লাগাৰো নিচের গন্তব্যে। সেখানে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আতসও গেলো বন্ধুদের দিকে।
গৌরব ও কঙ্কর তখনও কথায় ব্যস্ত। আতসের আগমনে অবশেষে তাদের কথার নদীতে ভাঁটা পড়লো। বন্ধুকে দেখতেই দু’জন নেমে দাঁড়ালো জিপ গাড়ি থেকে। দু এক চাপড় আতসের পিঠে ফেলতে ফেলতে ঠাট্টার স্বরে বললো,
“কী বন্ধু? ব্যাপার কী? সিনেমা হলে কী করছো শুনি?”
আতস মুচকি হেসে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো,
“তোরা নেই তাই ভালো লাগছিল না বলে সিনেমা দেখতে এসেছিলাম। মাইন্ড রিফ্রেশ আরকি।”
“মাইন্ড রিফ্রেশ? তা কার সাথে মন পরিষ্কার করতে এসেছিলেন আপনি? আমরাও শুনি একটু।”
ঠাট্টার স্বরে কথাটা বলেই গৌরব আর কঙ্কর সমস্বরে হেসে উঠে। এদের হাত থেকে এত সহজে নিস্তার পাবে না ভেবেই আতস দ্রুত উঠে গেলো নিজের গাড়িতে। তার পেছন পেছন কঙ্কর ও গৌরবও উঠে বসলো। প্রকৃতির আঁধার ঠেলে হেডলাইটের আলো দূর হতে দূরন্তরে পৌঁছে যাচ্ছে। জনমানবহীন রাস্তা। সম্ভবত ঝগ আসবে বলে মানুষ নিজ নিজ গন্তব্যে চলে গিয়েছে। এতক্ষণের উচ্ছ্বসিত আড্ডা প্রায় ক্ষাণিকটা ঝিমিয়ে এলো। সেখানে ভর করলো গুরু-গম্ভীর কথা। কঙ্কর বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“এই নভটা হুটহাট যে শহরে চলে যায় সেটাই বিরক্তিকর লাগে। আরও তিন চারমাস আগেও একবার ওরে আমি নিজের খরচে চা বাগানে এনে ছিলাম। ও বেশ গবেষণা করেই বলেছিল চা বাগানে একটা প্রজেক্ট করা যায়। এতে বেশ লাভ আছে। সে জন্য ই তো তোদেরও বললাম টাকা ইনভেস্ট করতে। এইটার সকল কার্যক্রম তো নভ’র বুদ্ধি অনুযায়ী চলবে। অথচ ওর কোনো খবর আছে? ঢাকা গিয়ে বসে আছে সে।”
কঙ্করের কথায় তাল মিলিয়ে গৌরবও বললো,
“হ্যাঁ, সে আশাতেই তো প্রায় এক দেড়মাস এখানে পড়ে আছি। এর মাঝে আবার কীসব অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। পড়ে না দেখ সব চিন্তাভাবনা জলে যায়।”
আতস গাড়ি চালাতে চালাতেই বললো,
“হয়তো ওর কোনো দরকার পড়েছে তাই গিয়েছে। তাছাড়া আমাদের টাকা সব চলে এলেও ওর টাকা তো এখনো আসো নভ। তাই জন্য হয়তো গিয়েছে।”
নভকে নিয়ে আরও আলোচনা চললো। প্রকৃতি তখন তার অবস্থা আরও করুণ করে তুলতে ব্যস্ত।
_
আঁধার হালকা করার জন্য পত্রদের বাড়ির উঠোনে জ্বলছে নিভু নিভু হারিকেন। ঘরের ভেতর জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে পুষ্প। উঠোনে পাড়া প্রতিবেশীদের ভীড়। এর মাঝেই গুটি গুটি পায়ে উঠোনে হাজির হয় পত্র। বেশ অগোছালো ভাবেই উঠোনে পা রেখেছে অথচ আচমকা এত গুলো মানুষ উঠোনে দেখে সে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকে উঠোন পানে।
ছায়া তখন নাকের জল, চোখের জল মুছছে শাড়ির আঁচল দিয়ে। হুট করেই একবারেই অপ্রত্যাশিত ভাবে নিজের মেয়েকে উঠোনে দেখে সে চমকে যায়। মুহূর্তেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। অবাক কণ্ঠে বলে,
“তোর এতক্ষণে আসার সময় হলো? স্কুল ছুটি দিয়েছে চারটা বাজে আর এখন ছ’টা বাজছে। কই ছিলিস?”
পত্র যে অথৈজলে পড়লো। তার দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছেন পরিচিত কাকী জেঠিমা রা। পত্র কিছুক্ষণ চুপ থেকে অনেক বুদ্ধি করে বললো,
“আমি বিন্নী দের বাড়ি ছিলাম মা। জেঠিমা’র শরীর টা তো অসুস্থ জানোই।”
ছায়া রেগে গেলেন। মুখ ঝামটি দিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ হ্যাঁ, মানুষের বাড়িতে পড়ে থাকিস। এদিকে যে তোর বোন মরার পথে তা খোঁজ রাখিস? রাখবিও বা কীভাবে? তোর ঐ পিসি আর তুই তো কখনো সহ্য করতে পারিসই নি আমার মেয়েটাকে৷”
পিসির কথা উঠতেই পত্রের গোলগাল মুখশ্রী টা রেগে গেলো। দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
“একদম আমার পিসিকে কিছু বলবে না, মা। ছাড়বো না কিন্তু।”
মেয়ের তেড়ে আসা দেখে ছায়া রুণমূর্তি ধারণ করলো। বসিয়ে দিলো সপাটে দুটো চ/ড়। মুহূর্তেই পরিবেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলো। সকলে পত্রকে পাঠিয়ে দিলো তার ঘরে। পত্র মনে এক রাশ রাগ, মন খারাপ নিয়ে পিসির রুমে গিয়ে দরজা দিয়ে দিলো সশব্দে। মা আজকাল অতিরিক্ত করেন যা পত্রের সহ্য হয় না।
_
ঘরের পাশের ডোবা থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে সাথে তুমুল বৃষ্টির শব্দ। গভীর রাতে ঘুমে মগ্ন পুরো চা বাগান। ঘুমিয়ে আছে পত্রলেখাদের বাড়ির প্রতিটি প্রাণ। কিন্তু সেই বিভোর ঘুম টা হঠাৎ করেই ভেঙে গেলো ছায়ার। চারপাশে বেশ অন্ধকার। ঘরের এক কোণায় হারিকেনটা জ্বলছে নিভু নিভু আলোয়। বৃষ্টির এই অনবরত শব্দ ছাপিয়েও তার কানে এলো একটু ভিন্ন ধরণের শব্দ। আপন মনেই ভ্রু কুঁচকালো ছায়া। বরাবরই সে বেশ সাহসী মানুষ। ভয় ডর তার কমই কাজ করে। সে জন্য ই আগ পিছ না ভেবে সে উঠে বসলো বিছানায়। চারপাশে বৃষ্টি পড়ছে তুমুল তা বুঝাই যাচ্ছে।
ছায়া ধীর পায়ে কাঠের দরজা টা খুলে বেরিয়ে এলো উঠোনে। হাতে তার নিভু নিভু লণ্ঠন। ছায়া উঠোনে আসতেই অস্বচ্ছ শব্দটা পরিষ্কার হলো। আশেপাশে কেউ নুপুর পড়ে ছুটছে যার রিনিঝিনি শব্দ কানে বাজছে। ছায়া ভয় পেলো না। হারিকেন টা আঁচল দিয়ে আড়াল করলো যেন বৃষ্টির পানি না লাগে সেখানে। নুপুরের শব্দটা আরও ঘন হলো। ছায়া তার বাড়ির সদর দরজার দিকে তাকাতেই দেখলো লাল রঙের বেনারসি পরিহিতা একজন রমণী পায়ে আলতা লেপে ছুটে যাচ্ছে বাড়ির বাহিরে। মুহূর্তেই ছায়ার শরীর কেঁপে উঠলো। চোখের পাতায় ঝলমল করে উঠলো অতীত। তার বাড়ির অবহেলিত সেই নারীর কথা মাথায় চলে এলো। এককালে যে নারী সাজতে ভালোবাসতো। স্বামীর আহ্লাদে টইটুম্বুর থাকতো। যাকে ছায়া কতো তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিল। অবশেষে যে বিদায় নিয়ে ছিলো গভীর অভিমানে। আবহাওয়ার শীতল স্রোত যেন ছায়ার অস্তিত্ব নাড়িয়ে দিল। ছায়া বিমূঢ় চিত্তে ডাক দিলো, “দিদি!”
ছুটন্ত সেই নারী অবয়ব থেমে গেলো তৎক্ষনাৎ। সাথে থেমে গেলো তার খিলখিল হাসি। এক হাত ঘোমটা টানা মুখটা নিয়ে চাইলো ছায়ার পানে। ছায়া তখন ভাষাহারা। কিন্তু তার সামনের দাঁড়ানো মহিলা অবয়বটার লতার মতন অঙ্গ খানি যেন হাসছে।
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here